بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمـَنِ الرَّحِيمِ وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِّمَّن دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু। যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, সৎকর্ম করে এবং বলে, আমি একজন আজ্ঞাবহ, তার কথা অপেক্ষা উত্তম কথা আর কার? সূরা হা-মীম সেজদাহ ( মক্কায় অবতীর্ণ ), আয়াতঃ৩৩
Monday, June 27, 2011
বিশ্ব ইজতেমার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
‘হে মুসলিম ভাইয়েরা, তোমরা সত্যিকারের মুসলমান হও।’
তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী দিলস্নীর দক্ষিণাঞ্চলের এলাকা হরিয়ানা মেওয়াত অধিবাসী ধর্মকর্মহীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলমানদের উদ্দেশে কথাগুলো বলেছিলেন বিশ্বব্যাপী সমাদৃত আজকের তাবলীগ জামায়াতের সার্থক রূপকার হযরত মাওলানা ইলিয়াছ কান্ধলভী (রহ.)। তিনি বলেছেন-দাওয়াত ও তাবলীগের হাকিকত বা উদ্দেশ্য হল ‘ঈমানের দাওয়াত। এ দাওয়াত নিজের সংশোধন তথা সমগ্র মানবজাতির মুক্তির দাওয়াত। ঈমানের এই দাওয়াতের উদ্দেশ্য হল আল্লাহর দেয়া জীবন, সম্পদ এবং সময় আল্লাহর রাস্তায় বের হয়ে এর সঠিক ব্যবহার শিক্ষা করা এবং বাস্তব জীবনে এর সঠিক প্রয়োগ করার পাশাপাশি আল্লাহ ভোলা মানুষকে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক করে দেয়ার মেহনত করা। মানবজীবনে আজ এই দাওয়াতের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
সে জন্য আজ থেকে প্রায় ৬ দশক আগে ১৯১০ সালে ভারতের এক জনবিরল অঞ্চল মেওয়াত থেকে হাতে গোনা ক’জন মানুষ নিয়ে তিনি তাবলীগের দাওয়াতে মেহনত শুরু করেন। তাবলীগের এ মেহনত এখন সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। হজরত ইলিয়াছ (র.) ১৩৫১ হিজরি সালে হজ্ব থেকে ফিরে আসার পর সাধারণ মুসলমানদের দুনিয়া ও সংসারের ঝামেলা থেকে মুক্ত করে ছোট ছোট দলবদ্ধ করে মসজিদের ধর্মীয় পরিবেশে অল্প সময়ের জন্য দ্বীনি শিক্ষা দিতে থাকেন। এরই মাঝে একদা তিনি হুজুর আকরামকে (স.) স্বপ্নে দেখেন এবং মহানবী (স.) তাকে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজের জন্য নির্দেশ দেন। মহানবীর (স.) নির্দেশ মোতাবেক তিনি দাওয়াত ও তাবলীগের কাজের সূচনা করেন। তারপর এ কাজকে আরও বেগবান ও গতিশীল করার জন্য এ উপমহাদেশের সর্বস্তরের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও বুজর্গদের কাছে দোয়া প্রার্থনা করা হয় এবং দিলস্নীর কাছে মেওয়াতে সর্বস্তরের মুসলমানদের জন্য ইজতেমা বা সম্মেলনের ব্যবস্থা করা হয়। এরপরই ক্রমেই তাবলীগের কার্যক্রম বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের গন্ডি ছাড়িয়ে পেঁৗছে যায় বিশ্বের সর্বত্র। হযরত মাওলানা আবদুল আজিজ (রহ.) এর মাধ্যমে ১৯৪৪ সালে বাংলাদেশে তাবলীগ শুরু হয়। তারপর ১৯৪৬ সলে বিশ্ব ইজতেমা সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের তাবলীগের মারকাজ কাকরাইল মসজিদে। পরে ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রাম হাজী ক্যাম্পে ইজতেমা শুরু হয়। এরপর ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে, তারপর ১৯৬৫ সালে টঙ্গির পাগারে এবং সর্বশেষ ১৯৬৬ সালে টঙ্গির ভবেরপাড়া তুরাগ তীরে অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ব ইজতেমা সেই থেকে এ পর্যন্ত সেখানেই ১৬০ একর জায়গায় তাবলীগের সর্ববৃহৎ ইজতেমা বা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
উল্লেখ্য, তাবলীগ জামায়াতের সদর দফতর দিল্লীতে থাকা সত্বেও এর বার্ষিক সমাবেশের জন্য বাংলাদেশকে বেছে নেয়া হয়। কথিত আছে, তাবলীগ জামায়াতের মুরুবি্বদের বৈঠকে ইজতেমার স্থান নির্ধারণের জন্য নাকি লটারি হয়েছিল। সেই লটারিতে বাংলাদেশের নাম ওঠে। আর সেই থেকেই বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ মহাসমাবেশ এ বিশ্ব ইজতেমা। ভারতের মুম্বাই ও ভূপালে এবং হালে পাকিস্তানের রায় বেন্ডে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হলেও জনসমাগমের বিচারে টঙ্গির বিশ্ব ইজতেমাই বড় এবং বিশ্ব দরবারে বিশ্ব ইজতেমা বলতে বাংলাদেশের টঙ্গিতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমাকেই বুঝায়। বিশ্ব ইজতেমা সফল হোক সেই কামনা করছি।
Sunday, June 26, 2011
একমাত্র ইসলামেই রয়েছে নারীদের প্রকৃত সম্মান
শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক
মাতৃজাতি সমাজের অর্ধাংশ এবং অর্ধাঙ্গিনী। তাদের প্রতি ঘৃণা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও উপক্ষো এবং অন্যায়-অত্যাচার সমাজকে পুঙ্গ করে রাখবে। অন্ধকার যুগে তো সমাজ নারীদের প্রতি এতই হিংস্র, নির্দয়-নিষ্ঠুর ও নির্মম ছিল যে, মেয়ে সন্তানকে ভালবাসত না কেউই, অনেকে তাকে জীবিত কবর দিয়ে দিত। বর্তমান যুগ যাকে নারীদের রাজত্বের যুগ বলা যেতে পারে, এই যুগেও মেয়ে সন্তান জন্মের প্রতি অনেক কম লোকেরই আনন্দ হয়। এ কি নারীদের প্রতি বৈরীভাবের লক্ষণ নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম মেয়েদের প্রতিপালন হতে সর্বস্তরে তাদের মান-মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অতুলনীয় শিক্ষা ও আদর্শ রেখেছেন। যার কিছু নিুরূপÑ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি দুইটি মাত্র মেয়েকে সুন্দররূপে ভরণ-পোষণ ও প্রতিপালন করবে সে বেহেশতে আমার এত নিকটবর্তী হবে যেরূপ হাতের আঙ্গুল সমূহ পরস্পর নিকটবর্তী। মুসলিম শরীফ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি তিনটি মেয়ে বা তিনজন ভগ্নির প্রতিপালন ও শিক্ষাদান সুচারুরূপে করবে, যে পর্যন্ত না তাদের নিজ নিজ ব্যবস্থা হয়; তার জন্য বেহশত অবধারিত হবে। দুইজন সম্পর্কে জিজ্ঞাসায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, দুইজনের প্রতিপালনেও তাই। একজনের প্রতিপালন সম্পর্কে জিজ্ঞেস কারা হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তদুত্তরে তাই বলেছেন। মিশকাত শরীফ ৪২৩
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, যার কাছে কোনো মেয়ে থাকে এবং সে মেয়েকে তুচ্ছ না করে, ছেলেকে অগ্রগণ্য না করে আল্লাহ তাকে বেহেশত দান করবেন। আবু দাউদ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, তোমার কোনো মেয়ে স্বামীর পতিত্যক্তা হয়ে নিরাশ্রয়রূপে তোমার আশ্রয়ে ফিরে আসলে তার জন্য তুমি যা ব্যয় করবে তা তোমার জন্য সর্বাধিক উত্তম দান এবং তা আল্লার সন্তুষ্টি উদ্দেশ্যের ব্যয় গণ্য হবে। ইবনে মাজাহ শরীফ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, নারী জাতি সৃষ্টিগতভাবেই একটু বক্র স্বভাবের; পূর্ণ সোজা করতে চাইলে ভেঙ্গে যাবে তথা বিচ্ছেদের পালায় এসে যাবে। সুতরাং তাকে বাঁকা থাকতে দিয়ে তার সাথে তোমাদের জীবন নির্বাহ করতে হবে। তোমাদের প্রতি আমার বিশেষ উপদেশ-তোমরা নারীদের প্রতি উত্তম ও ভালো হয়ে থাকবে। মুসলিম শরীফ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নারীগণ নামাজ-রোজা, সতীত্ব রক্ষা ও স্বামীর আনুগত্য এই সংক্ষিপ্ত আমল দ্বারা আল্লাহ তাআলার কাছে এত বড় মর্যাদা লাভ করবে যে, বেহেশতের যে কোনো শ্রেণীতে সে প্রবেশ করার অধিকার লাভ করবে। মিশকাত শরীফ ২৮১
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, পরিপূর্ণ ঈমানদার ঐ ব্যক্তি যে তার সহধর্মিণীর সাথে সদ্ব্যবহার করে এবং তার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়। তিরমিজী শরীফ
একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম কড়া নির্দেশ দিলেন, গৃহিনীদেরকে কেউ প্রহার করতে পারবে না। অতঃপর একদিন ওমর রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের নিকট প্রকাশ করলেন, নারীগণ অত্যন্ত বেপরোয়া হয়ে গেছে। সেমতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম (প্রয়োজন স্থলে সংযমের সহিত) প্রহারের অনুমতি দিলেন। এরপর বহুসংখ্যক মহিলা তাদের স্বামীর প্রতি অভিযোগ নিয়ে রাসূলুাল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি অসাল্লামের ঘরে ভিড় জমাল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম কঠোর ভাষায় বললেন অনেক মহিলা তাদের স্বামীদের সম্পর্কে অভিযোগ করছে, ঐরূপ স্বামীগণ মোটেই ভালো মানুষ নয়। আবু দাউদ শরীফ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, সহধর্মিনীর সাথে যে উত্তম জীবন-যাপনকারী হয় সেই উত্তম মানুষ। আমি আমার সহধর্মীণীদের সাথে উত্তম জীবনযাপন করি। তিরমিজি শরীফ
সত্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম সহধর্মীণীর প্রতি অতি উত্তম ছিলেন। একবার ছফর অবস্থায় বিবি ছফিয়্যা রাজিয়াল্লাহু তাআলা আনহার জন্য উটে আরোহণ কঠিন হল; (তার পক্ষে উট উচু ছিল)। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম নিজ উরু পেতে দিলেন। ছফিয়্যা রা. সিঁড়ির মতো নবীজির উরু মোবারকের ওপর পা রেখে উটে চড়লেন। বুখারী শরীফ
আর একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম এতেকাফে ছিলেন। ছফিয়্যা রা. রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহ আলাইহি অসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসলেন, তার প্রত্যাবর্তনের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তাকে মর্যাদার সাথে বিদায় দানে তার সঙ্গে মসজিদের দরজা পর্যন্ত আসলেন। বুখারী শরীফ
আয়েশা রা. কম বয়সী ছিলেন; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের ঘরে নয় বছর বয়সে এসেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তার বাল্য বয়সের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখতেন। আয়েশা রা. বর্ণনা করেছেন, কিছু বান্ধবী ছিল যাদের সঙ্গে আমি বাল্যসুলভ খেলাধুলা করতাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম ঘরে আসলে ওরা লুকিয়ে যেত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম ওদেরকে তালাশ করে আমার কাছে পাঠতেন। তারা আবারও আমার সাথে খেলাধূলা করত। বুখারী শরীফ
আয়েশা রা. বর্ণনা করেছেন, একবার ঈদের আনন্দে খঞ্জর চালনার জিহাদী খেলা মসজিদে হচ্ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম আমাকে ঘরের দরোজায় তার পিছনে দাঁড় করিয়ে তার কাঁধের ফাঁক দিয়ে ঐ খেলা দেখালেন। খেলা দেখায় আমার মন ভরে না যাওয়া পর্যন্ত তিনি দাঁড়িয়ে থাকলেন। আয়শা রা. বলেন- খেলা দেখায় লালায়িতা যুবতী কত দীর্ঘকাল দেখবে তা সহজেই অনুমেয়। বুখারী শরীফ
আয়শা রা. বর্ণনা করেছেন একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম আমার সাথে দৌড়-প্রতিযোগিতা করলেন। তাতে আমি জয়ী হলাম। অনেক দিন পর যখন আমার শরীর ভারী হয়ে গিয়েছিল তখন আর একদিন সেই প্রতিযোগিতা করলে আমি পরাজিত হলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তখন কৌতুক করে বললেন, আমার সেই পরাজয়ের বিনিময়ে তোমার এই পরাজয়। আবু দাউদ শরীফ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের কী মধুর সম্পর্ক ছিল সহধর্মিণীদের সঙ্গে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তাদের সাথে সময়ে খোশ-গল্প জুড়ে ছিলেন। হাদিসটি বুখারী শরীফেও উল্লেখ আছে- ‘হাদিসে উম্মে যারা’ নামে। এক সময় আরবের একাদশ সংখ্যক সুসাহিত্যিক মহিলা একত্র হয়ে প্রত্যেকে নিজ নিজ স্বামীর অবস্থা বর্ণনায় ভাষা জ্ঞানের বাহাদুরী দেখাল। তাদের মধ্যে ‘উম্মে যারা’ নামের মহিলা সুদীর্ঘ ও সুললিত ভাষায় নিজ স্বামীর সর্বাধিক বেশি প্রশংসা করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম আয়েশা রা. কে কাছে বসিয়ে সেই একাদশ মহিলার প্রসিদ্ধ গল্পটি শুনালেন এবং বললেন, আয়েশা! উম্মে যারার স্বামী তার জন্য যেরূপ ছিল আমি তোমার জন্য সেরূপ।
নারী সম্প্রদায়ের শিক্ষার প্রতিও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম অনুরাগী ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের আমলে দীন-শিক্ষার একমাত্র কেন্দ্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামই ছিলেন; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের ভাষণসমূহ বিশেষভাবে শরিয়তের বিশেষ বস্তু ছিল। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের ভাষণে নর-নারী নির্বিশেষে সকলের উপস্থিতির আদেশ ছিল। জুমা ও ঈদের নামাজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম খোৎবা বিশেষ ভাষণরূপে দিতেন; সেই ভাষণ শোনার জন্য সকলেই উপস্থিত হতেন, তবে নারীগণ সকলের পেছনে থাকতেন। একবার ঈদের খোৎবা সাধারণ নিয়মে প্রদানের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম লক্ষ্য করলেন, নারীদের পর্যন্ত তার কথা পূর্ণ রূপে পৌঁছেনি। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম খোৎবাস্থল হতে ফিরার পথে বেলাল রা. কে সঙ্গে করে নারীদের অবস্থান স্থলে পৌঁছে তথায় নারীদের লক্ষ্যে পুনঃভাষণ দিলেন। বুখারী শরীফ
আরও একবারের ঘটনা-নারীগগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের কাছে অভিযোগ করল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের মজলিসে তারা পুরুষদের ভিড়ের কারণে পূর্ণ উপকৃত হতে পারে না; সেমতে তাদের অভিলাষ অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তাদের অনুরোধ রক্ষায় ভিন্ন মজলিসের ব্যবস্থা করলেন।
নারীদের প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম কত অধিক সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং তাদের কত বেশি মর্যদা দিতেন! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ-বিদায় হজ্জের নীতি নির্ধারণী ঐতিহাসিক ভাষণে নারীদের মর্যাদা দানের কর্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। সেই ভাষণে তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন-
‘নারীদের ওপর স্বামীদের যেরূপ হক্ব ও দাবি আছে তদ্রুপ স্বামীদের ওপর স্ত্রীদেরও হক্ব এবং দাবি আছে।’ তিনি আরও বলেছেন-নারীদের সম্পর্ক আমার বিশেষ নির্দেশ যে, তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার ও সর্বপ্রকার কল্যাণকর ব্যবস্থা সর্বদা বজায় রাখা। তাদেরকে তোমরা লাভ করেছ আল্লাহর আমানতরূপে, তাদের সতীত্বকে ভোগ করছ আল্লাহর বিধানের অধীনে। সেই আল্লাহর রাসূল আমি, অতএব তাদের সম্পর্কে আমার নির্দেশ পালনে তোমরা বাধ্য।
একদা আবু বকর রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের ঘরে আসছিলেন; বের হতে বিবি আয়েশা রা. উচ্চস্বর শুনতে পেলেনÑ তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের সঙ্গে প্রতিউত্তর করছিলেন। আবু বকর রা. ক্রোধ ভরে ঘরে প্রবেশে আয়েশা রা.কে এই বলে শাসাতে লাগলেন, এত বড় স্পর্ধা! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের আওয়াজের উর্ধ্বে তোমার আওয়াজ! আবু বকর রা. এই বলে আয়েশা রা. কে চড় মারতে উদ্যত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তাকে থামালেন এবং আয়েশাকে প্রীতির ভাষায় বললেন, দেখলে তো মিঞা সাহেব থেকে কত কষ্টে তোমাকে বাঁচিয়াছি? -আবু দাউদ শরীফ
সংগ্রহ
জামেয়া রহমানীয়া মাদ্রাসা
মাতৃজাতি সমাজের অর্ধাংশ এবং অর্ধাঙ্গিনী। তাদের প্রতি ঘৃণা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও উপক্ষো এবং অন্যায়-অত্যাচার সমাজকে পুঙ্গ করে রাখবে। অন্ধকার যুগে তো সমাজ নারীদের প্রতি এতই হিংস্র, নির্দয়-নিষ্ঠুর ও নির্মম ছিল যে, মেয়ে সন্তানকে ভালবাসত না কেউই, অনেকে তাকে জীবিত কবর দিয়ে দিত। বর্তমান যুগ যাকে নারীদের রাজত্বের যুগ বলা যেতে পারে, এই যুগেও মেয়ে সন্তান জন্মের প্রতি অনেক কম লোকেরই আনন্দ হয়। এ কি নারীদের প্রতি বৈরীভাবের লক্ষণ নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম মেয়েদের প্রতিপালন হতে সর্বস্তরে তাদের মান-মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অতুলনীয় শিক্ষা ও আদর্শ রেখেছেন। যার কিছু নিুরূপÑ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি দুইটি মাত্র মেয়েকে সুন্দররূপে ভরণ-পোষণ ও প্রতিপালন করবে সে বেহেশতে আমার এত নিকটবর্তী হবে যেরূপ হাতের আঙ্গুল সমূহ পরস্পর নিকটবর্তী। মুসলিম শরীফ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি তিনটি মেয়ে বা তিনজন ভগ্নির প্রতিপালন ও শিক্ষাদান সুচারুরূপে করবে, যে পর্যন্ত না তাদের নিজ নিজ ব্যবস্থা হয়; তার জন্য বেহশত অবধারিত হবে। দুইজন সম্পর্কে জিজ্ঞাসায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, দুইজনের প্রতিপালনেও তাই। একজনের প্রতিপালন সম্পর্কে জিজ্ঞেস কারা হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তদুত্তরে তাই বলেছেন। মিশকাত শরীফ ৪২৩
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, যার কাছে কোনো মেয়ে থাকে এবং সে মেয়েকে তুচ্ছ না করে, ছেলেকে অগ্রগণ্য না করে আল্লাহ তাকে বেহেশত দান করবেন। আবু দাউদ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, তোমার কোনো মেয়ে স্বামীর পতিত্যক্তা হয়ে নিরাশ্রয়রূপে তোমার আশ্রয়ে ফিরে আসলে তার জন্য তুমি যা ব্যয় করবে তা তোমার জন্য সর্বাধিক উত্তম দান এবং তা আল্লার সন্তুষ্টি উদ্দেশ্যের ব্যয় গণ্য হবে। ইবনে মাজাহ শরীফ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, নারী জাতি সৃষ্টিগতভাবেই একটু বক্র স্বভাবের; পূর্ণ সোজা করতে চাইলে ভেঙ্গে যাবে তথা বিচ্ছেদের পালায় এসে যাবে। সুতরাং তাকে বাঁকা থাকতে দিয়ে তার সাথে তোমাদের জীবন নির্বাহ করতে হবে। তোমাদের প্রতি আমার বিশেষ উপদেশ-তোমরা নারীদের প্রতি উত্তম ও ভালো হয়ে থাকবে। মুসলিম শরীফ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নারীগণ নামাজ-রোজা, সতীত্ব রক্ষা ও স্বামীর আনুগত্য এই সংক্ষিপ্ত আমল দ্বারা আল্লাহ তাআলার কাছে এত বড় মর্যাদা লাভ করবে যে, বেহেশতের যে কোনো শ্রেণীতে সে প্রবেশ করার অধিকার লাভ করবে। মিশকাত শরীফ ২৮১
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, পরিপূর্ণ ঈমানদার ঐ ব্যক্তি যে তার সহধর্মিণীর সাথে সদ্ব্যবহার করে এবং তার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়। তিরমিজী শরীফ
একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম কড়া নির্দেশ দিলেন, গৃহিনীদেরকে কেউ প্রহার করতে পারবে না। অতঃপর একদিন ওমর রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের নিকট প্রকাশ করলেন, নারীগণ অত্যন্ত বেপরোয়া হয়ে গেছে। সেমতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম (প্রয়োজন স্থলে সংযমের সহিত) প্রহারের অনুমতি দিলেন। এরপর বহুসংখ্যক মহিলা তাদের স্বামীর প্রতি অভিযোগ নিয়ে রাসূলুাল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি অসাল্লামের ঘরে ভিড় জমাল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম কঠোর ভাষায় বললেন অনেক মহিলা তাদের স্বামীদের সম্পর্কে অভিযোগ করছে, ঐরূপ স্বামীগণ মোটেই ভালো মানুষ নয়। আবু দাউদ শরীফ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, সহধর্মিনীর সাথে যে উত্তম জীবন-যাপনকারী হয় সেই উত্তম মানুষ। আমি আমার সহধর্মীণীদের সাথে উত্তম জীবনযাপন করি। তিরমিজি শরীফ
সত্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম সহধর্মীণীর প্রতি অতি উত্তম ছিলেন। একবার ছফর অবস্থায় বিবি ছফিয়্যা রাজিয়াল্লাহু তাআলা আনহার জন্য উটে আরোহণ কঠিন হল; (তার পক্ষে উট উচু ছিল)। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম নিজ উরু পেতে দিলেন। ছফিয়্যা রা. সিঁড়ির মতো নবীজির উরু মোবারকের ওপর পা রেখে উটে চড়লেন। বুখারী শরীফ
আর একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম এতেকাফে ছিলেন। ছফিয়্যা রা. রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহ আলাইহি অসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসলেন, তার প্রত্যাবর্তনের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তাকে মর্যাদার সাথে বিদায় দানে তার সঙ্গে মসজিদের দরজা পর্যন্ত আসলেন। বুখারী শরীফ
আয়েশা রা. কম বয়সী ছিলেন; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের ঘরে নয় বছর বয়সে এসেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তার বাল্য বয়সের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখতেন। আয়েশা রা. বর্ণনা করেছেন, কিছু বান্ধবী ছিল যাদের সঙ্গে আমি বাল্যসুলভ খেলাধুলা করতাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম ঘরে আসলে ওরা লুকিয়ে যেত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম ওদেরকে তালাশ করে আমার কাছে পাঠতেন। তারা আবারও আমার সাথে খেলাধূলা করত। বুখারী শরীফ
আয়েশা রা. বর্ণনা করেছেন, একবার ঈদের আনন্দে খঞ্জর চালনার জিহাদী খেলা মসজিদে হচ্ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম আমাকে ঘরের দরোজায় তার পিছনে দাঁড় করিয়ে তার কাঁধের ফাঁক দিয়ে ঐ খেলা দেখালেন। খেলা দেখায় আমার মন ভরে না যাওয়া পর্যন্ত তিনি দাঁড়িয়ে থাকলেন। আয়শা রা. বলেন- খেলা দেখায় লালায়িতা যুবতী কত দীর্ঘকাল দেখবে তা সহজেই অনুমেয়। বুখারী শরীফ
আয়শা রা. বর্ণনা করেছেন একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম আমার সাথে দৌড়-প্রতিযোগিতা করলেন। তাতে আমি জয়ী হলাম। অনেক দিন পর যখন আমার শরীর ভারী হয়ে গিয়েছিল তখন আর একদিন সেই প্রতিযোগিতা করলে আমি পরাজিত হলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তখন কৌতুক করে বললেন, আমার সেই পরাজয়ের বিনিময়ে তোমার এই পরাজয়। আবু দাউদ শরীফ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের কী মধুর সম্পর্ক ছিল সহধর্মিণীদের সঙ্গে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তাদের সাথে সময়ে খোশ-গল্প জুড়ে ছিলেন। হাদিসটি বুখারী শরীফেও উল্লেখ আছে- ‘হাদিসে উম্মে যারা’ নামে। এক সময় আরবের একাদশ সংখ্যক সুসাহিত্যিক মহিলা একত্র হয়ে প্রত্যেকে নিজ নিজ স্বামীর অবস্থা বর্ণনায় ভাষা জ্ঞানের বাহাদুরী দেখাল। তাদের মধ্যে ‘উম্মে যারা’ নামের মহিলা সুদীর্ঘ ও সুললিত ভাষায় নিজ স্বামীর সর্বাধিক বেশি প্রশংসা করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম আয়েশা রা. কে কাছে বসিয়ে সেই একাদশ মহিলার প্রসিদ্ধ গল্পটি শুনালেন এবং বললেন, আয়েশা! উম্মে যারার স্বামী তার জন্য যেরূপ ছিল আমি তোমার জন্য সেরূপ।
নারী সম্প্রদায়ের শিক্ষার প্রতিও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম অনুরাগী ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের আমলে দীন-শিক্ষার একমাত্র কেন্দ্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামই ছিলেন; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের ভাষণসমূহ বিশেষভাবে শরিয়তের বিশেষ বস্তু ছিল। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের ভাষণে নর-নারী নির্বিশেষে সকলের উপস্থিতির আদেশ ছিল। জুমা ও ঈদের নামাজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম খোৎবা বিশেষ ভাষণরূপে দিতেন; সেই ভাষণ শোনার জন্য সকলেই উপস্থিত হতেন, তবে নারীগণ সকলের পেছনে থাকতেন। একবার ঈদের খোৎবা সাধারণ নিয়মে প্রদানের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম লক্ষ্য করলেন, নারীদের পর্যন্ত তার কথা পূর্ণ রূপে পৌঁছেনি। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম খোৎবাস্থল হতে ফিরার পথে বেলাল রা. কে সঙ্গে করে নারীদের অবস্থান স্থলে পৌঁছে তথায় নারীদের লক্ষ্যে পুনঃভাষণ দিলেন। বুখারী শরীফ
আরও একবারের ঘটনা-নারীগগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের কাছে অভিযোগ করল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের মজলিসে তারা পুরুষদের ভিড়ের কারণে পূর্ণ উপকৃত হতে পারে না; সেমতে তাদের অভিলাষ অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তাদের অনুরোধ রক্ষায় ভিন্ন মজলিসের ব্যবস্থা করলেন।
নারীদের প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম কত অধিক সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং তাদের কত বেশি মর্যদা দিতেন! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ-বিদায় হজ্জের নীতি নির্ধারণী ঐতিহাসিক ভাষণে নারীদের মর্যাদা দানের কর্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। সেই ভাষণে তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন-
‘নারীদের ওপর স্বামীদের যেরূপ হক্ব ও দাবি আছে তদ্রুপ স্বামীদের ওপর স্ত্রীদেরও হক্ব এবং দাবি আছে।’ তিনি আরও বলেছেন-নারীদের সম্পর্ক আমার বিশেষ নির্দেশ যে, তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার ও সর্বপ্রকার কল্যাণকর ব্যবস্থা সর্বদা বজায় রাখা। তাদেরকে তোমরা লাভ করেছ আল্লাহর আমানতরূপে, তাদের সতীত্বকে ভোগ করছ আল্লাহর বিধানের অধীনে। সেই আল্লাহর রাসূল আমি, অতএব তাদের সম্পর্কে আমার নির্দেশ পালনে তোমরা বাধ্য।
একদা আবু বকর রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের ঘরে আসছিলেন; বের হতে বিবি আয়েশা রা. উচ্চস্বর শুনতে পেলেনÑ তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের সঙ্গে প্রতিউত্তর করছিলেন। আবু বকর রা. ক্রোধ ভরে ঘরে প্রবেশে আয়েশা রা.কে এই বলে শাসাতে লাগলেন, এত বড় স্পর্ধা! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের আওয়াজের উর্ধ্বে তোমার আওয়াজ! আবু বকর রা. এই বলে আয়েশা রা. কে চড় মারতে উদ্যত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তাকে থামালেন এবং আয়েশাকে প্রীতির ভাষায় বললেন, দেখলে তো মিঞা সাহেব থেকে কত কষ্টে তোমাকে বাঁচিয়াছি? -আবু দাউদ শরীফ
সংগ্রহ
জামেয়া রহমানীয়া মাদ্রাসা
Tuesday, June 21, 2011
কার্গুজারী
চিল্লার জন্য আল্লাহ আমাকে কবুল করেন
‘আমার জীবনের পরিবর্তনের পিছনে বিশ্ব ইজতেমা বিশেষ ভূমিকা রেখেছে বলে আমি মনে করি। লাখ লাখ মানুষের সমাগম ঘটে এই ইজমেতমায়। প্রত্যেক সাধারণ মুসলমানের মন পরিবর্তনে প্রভাব ফেলে এই আয়োজন। কেননা সারা বিশ্ব থেকে অল্লাহর প্রিয় বান্দাদের আগমন ঘটে । ধনী গরিব ভেদাভেদ ভুলে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির সঙ্গে সকলই ত্যাগ স্বীকার করে এক মজমায় জমা হয়। আল্লাহর কাছে অসংখ্য শুকরিয় জানাই যিনি আমাকে এ দাওয়াতি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন। ’
এভাবেই নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন ভাই মুহাম্মাদ আনেয়ার হুসাইন। বর্তমানে তিনি একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। ডিগ্রি পাশ করে বেকার সময় কাটাচ্ছিলেন। পাশাপাশি চাকরি খুঁজছিলেন। কিন্তু কোন কুল কিনারা হচ্ছিল না। এমতাবস্থায় গত ২০০৮ সালে বিশ্ব ইজতেমার সময় চলে আসে। ভাই আনোয়ার জানান,তার এলাকার বন্ধু ভাই শামীম তাকে ইজতেমায় যাওয়ার জন্য আহবান করে। তখন আমি কোন চিন্তা করে এক কথাতেই রাজি হয়ে যাই। কোন কাজ নেই তে!। এলাকা থেকে জামায়াত বন্দী হয়ে টঙ্গীর ময়দানে তিন দিনের জন্য চলে যাই। আমার জীবনের এক স্বরণীয় স্মৃতি হয়ে থাকবে টঙ্গীর ময়দানের সেই তিন দিন। মানুষ যে একমাত্র আল্লাহর জন্যই এমন নিবেদিত প্রাণ হতে পারে তা আমি সরাসরি দেখেছি ইজতেমার ময়দানে। ইজতেমায় থাকাকালীন এবং তার পরে বেশ কিছু দিন আমার মনে এমন এক প্রশান্তি অনুভব করেছি যা আমি বলে বুঝাতে পারবো না। এমনটি আগে কখনও হয়নি।
যাই হোক, আমি নামাজে নিয়মিত হওয়ার চেষ্ট করে যাচ্ছিলাম এবং দ্বীন শেখার ব্যাপারে চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। কিছুদিন পর আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসি। নামাজ কালাম সব বন্ধ হয়ে যায়। চাকরির পিছনে পিছনে ছুটছি কিন্তু চাকরি হবার কোন নাম নেই। আমার আবার অস্থির সময় ফিরে আসে। মন অবসন্ন থাকে । ভালো লাগে না কিছুই। একদিন ভাই শামীমের সঙ্গে অনেক দিন পরে দেখা হয়, তখন তিনি আমার অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নিলেন। সব খুঁজ নিয়ে তিনি আমাকে বললেন, আনোয়ার তুমি না আমার সঙ্গে ইজতেমায় গিয়েছিলে, সেখানে মুরব্বীরা কী বলেছিল তুমি কি তা সব ভুলে গিয়েছ ? দীন শেখা এবং দীনের দাওয়াতের কাজ একনিষ্ঠভাবে ও ধারাবাহিকভাবে না করলে এ কাজে তুমি কোন ভাল ফলাফল পাবে না। এক্ষেত্রে তোমার একান্ত ইচ্ছাই যথেষ্ট। সব কাজের ক্ষেত্রে অল্লাহর হুকুম ও রাসূল সা. তরিকা মতো করো এবং ধৈর্য ধারণ করো। ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তোমার সকল অবস্থা পরিবর্তন করে দিবেন । আল্লাহর জন্য হয়ে যাও, আল্লাহ চায় তো সব মুশকিল আসান করে দিবেন। ভাই শামীমের এ সব কথা শোনার পর আমার নিজেকে অনেক বেশি অপরাধী মনে হতে লাগলো। আমি কালবিলম্ব না করে পরের সপ্তাহেই তিন দিনের জামাতের জন্য বের হয়ে যাই। এরপর এক চিল্লার জন্য আল্লাহ আমাকে কবুল করেন। উত্তরাঞ্চলের বিভাগীয় শহর রংপুরে জীবনের প্রথম চিল্লা অতিবাহিত করি। এরপর থেকে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি দাওয়াতে তাবলিগির এ মেহনতের সঙ্গে সদা জড়িত থাকার জন্য। গত বছর আল্লাহর রহমতে তিন চিল্লা যাওয়ার সুযোগ হয়। আল্লাহর অনুগ্রহে ছোটখাট একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছি। তা দিয়ে আল্লাহ আমাকে ভালোই রাখছেন। জীবনের এ তরু ণ বয়সে আল্লাহ যে আমাকে তার দীন মোতাবেক জীবন পরিচালনার জন্য সহিহ বুঝ দান করেছেন এ জন্য তার শুকরিয়া জানিয়ে শেষ করতে পারবো না। বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে ইজতেমার ময়দানে লাখ লাখ মানুষের সমাগম ঘটবে,তাই সকলের কাছে এ গুনাহগারের দোয়া দরখাস্ত। আল্লাহ আমাদের এ কাজের আঞ্জাম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার তৌফিক দান করুন, আমিন।
বিবেক মানবদেহের সঞ্চালক
বিবেক মানবদেহের সঞ্চালক
আল্লামা আজিজুল হক
হযরত নোমান ইবনে বশির রা. বলেছেন- আমি রাসূলুল্লাহ সা.-কে বলতে শুনেছি যে ইসলামে ‘হালাল-হারাম’ স্পষ্ট। এ দুটির মাঝে কতোগুলো ‘সন্দেহভাজন’ বিষয়বস্তুও আছে। সেগুলো কোন পর্যায়ে তা অধিকাংশ লোকই নিশ্চিতভাবে নির্ধারণ করতে পারে না। যে ব্যক্তি সে সন্দেহজনক বিষয়গুলো থেকে সংযমি হবে তারই দীন-ঈমান ইজ্জত-আবরু সুরক্ষিত থাকবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি সন্দেহজনক বিষয়বস্তুসমূহে লিপ্ত হবে, তার অবস্থা হবে কোনো রাখাল তার পশুপালকে (সরকারী বা কারো) সংরক্ষিত স্থানের নিকটবর্তী চরিয়ে থাকে; এমতাবস্থায় অ- সময়ের মধ্যেই তার পশুগুলো সে সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকে পড়বে (এবং তার দ্বারা রাখাল বিপদগ্রস্ত হবে। তেমনি মধ্যস্থলিয় সন্দেহযুক্ত বিষয়বস্তুগুলো থেকে যে ব্যক্তি সংযমি না হবে এবং তা থেকে দূরে না থাকবে, অচিরেই অনিবার্যভাবে তার নফস বা প্রবৃত্তি স্পষ্ট হারামে লিপ্ত হয়ে যাবে, ফলে সে দুনিয়া ও আখেরাতে অপদস্থ হবে) তোমরা শুনে রাখ, প্রত্যেক বাদশাহর সংরক্ষিত এলাকা থাকে তেমনি আল্লাহ তায়ালার নিষিদ্ধ বিষয়বস্তুসমূহই দুনিয়ার বুকে তার সংরিক্ষত এলাকা। (সেখানে কারো প্রবেশ করতে নেই, অধিকন্তু তার নিকটবর্তী হওয়া তথা সন্দেহজনক বিষয়ে লিপ্ত হওয়াও উচিত নয়।
আরো শুনে রাখ মানবদেহে এমন একটি অংশ রয়েছে যে, সেই অংশটি যখন যথার্থভাবে ঠিক হয়ে যায়, তখন মানুষের পূর্ণ অস্তিত্ব ঠিক হয়ে যায়। অর্থাৎ সম্পূর্ণ মানবদেহটিই তখন সঠিকভাবে পরিচালিত হতে থাকে। পক্ষান্তরে সেই অংশটি যখন খারাপ হয়ে পড়ে, তখন সমস্ত অস্তিত্বটিই খারাপ হয়ে যায়। অর্থাৎ মানব দেহের কোনো অংশ বা কোনো অঙ্গই তখন সঠিকভাবে পরিচালিত হয় না। খুব ভালো করে জেনে নাও সে অংশটি হুে ছ মানুষের বিবেক।
বিশ্লেষণ : শরিয়তের যাবতীয় হুকুম-আহকাম চার প্রকার দলিল ভিত্তিতে প্রমাণিত হয় । কুরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াস। এর যে কোনো একটি দ্বারা যে কোনো বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে ‘হালাল’ বৈধ ও গ্রহণীয় বলে প্রমাণিত হবে যে এটিই হালাল এবং যে কোনো বিষয় সুষ্পষ্টভাবে ‘হারাম’ নিষিদ্ধ ও বর্জনীয় বলে প্রমাণিত হবে তা হারাম।
এ দৃষ্টিকোণ থেকে হালাল এবং হারাম অতি স্পষ্ট এবং এই সকল দলিল, প্রমাণ ও মাপকাঠি দ্বারা উভয়টিকে বেছে নেয়া অত্যন্ত সহজ। অধিকন্তু এটিও স্পষ্ট যে, হালালকে গ্রহণ করা যাবে এবং হারামকে বর্জন করতে হবে। এতে বিন্দুমাত্রও নড়চড় করার অবকাশ নেই। কিন্তু হালাল ও হারাম পর্যায়দ্বয়ের মধ্যবর্তী আরো কিছু পর্যায় রয়েছে। যথা মাকরূহ, খেলাফেআওলা বা অবাঞ্ছনীয়, ইমাম ও খাঁটি ওলামাদের মতোবিরোধমূলক বিষয়াদি।
এতদ্ব্যতীত এমন আরো বহু বিষয়াদি আছে যা শরিয়তে লিপিবদ্ধ আছে এবং তা ছাড়াও দৈনন্দিন কার্যকলাপের ভেতর দিয়ে প্রায়শই এমন বিষয়াদি আমাদের সম্মুখবর্তী হতে থাকে যা নির্দিষ্টভাবে হালাল বলেও নিশ্চিত হওয়া যায় না, কিংবা হারাম বলেও স্থির করা যায় না এ সকল অনিশ্চিত ও সন্দেহভাজন বিষয়গুলোকে সযত্মে পরিহার করে চলাই একান্ত বাঞ্ছনীয়। কেননা এ সমস্ত সন্দেহজনক বিষয়বস্তুসমূহ থেকে বিরত থাকলে এক দিকে জাগতিক ব্যাপারে যেমন লাভবান হওয়া যায়, কারণ সন্দেহের স্থানে পা রাখলেই স্বীয় মান-মর্যাদা কলুষিত হওয়ার এবং নানা প্রকার কুৎসা রটানোর সুযোগ উপস্থিত হয়।
অন্যদিকে তেমনি দীনের ব্যাপারেও লাভের সীমা থাকে না। কারণ যে ব্যক্তি স্বীয় নফ্স ও প্রবৃত্তিকে সন্দেহের স্থান থেকে বিরত রাখতে অভ্যস্ত হবে, সে নিশ্চয় যাবতীয় কুপ্রলোভনের বস্তু থেকে এবং যাবতীয় হারাম কাজ থেকে স্বীয় নফ্সকে ফিরিয়ে রাখতে সক্ষম হবে।
হারাম ও সন্দেহভাজন কাজ থেকে বাঁচতে হলে সর্বপ্রথম নিজের বিবেককে যথার্থভাবে সুষ্ঠু ও ঠিক করতে হবে। কারণ মানুষের বিবেকই মানবদেহরূপী কারখানার জন্য বৈদ্যুতিক মটর স্বরূপ। মটর ঠিকভাবে চালু থাকলে কারখানার প্রতিটি শাখা তার প্রতিটি অংশ ও সমস্ত কল-কবজার চাকাগুলো রীতিমত চলতে থাকবে। আর মটরে গোলযোগ থাকলে তার সংযোগ রক্ষাকারী সমস্ত মেশিন ও তার অংশগুলোর মধ্যেও গোলযোগ দেখা দিবে। অবশ্য মটরের সঙ্গের চাকাগুলো সক্রিয়সংযোগ রক্ষার প্রতিও তীক্ষè দৃষ্টি রাখতে হবে। তা না হলে মেশিনের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে সংযোগবিহীন শুধু মটর চালালে উদ্দেশ্য সফল হবে না এবং এ ধরনের নিরর্থক ও অনিয়মিত পরিচালনার ফলে কারখানা ফেল হয়ে যাবে। অতএব মেশিনের সমস্ত কল-কবজা ও তার বিভিন্ন অংশগুলোকেও রীতিমত চালু রেখে মোটরের প্রতি সবিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ, তার ভাল-মন্দের প্রভাব সমস্ত কারখানার ওপর পড়ে থাকে। তেমনিভাবে মানুষের কর্তব্য তার বিবেক-বুদ্ধিকে সুষ্ঠু করে তার পর সেই সুষ্ঠু জ্ঞান-বিবেক দ্বারা স্বীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে পরিচালিত করা।
দেহ আলোচনা
উপরোক্ত হাদিসের শেষ বাক্য ‘আলা ইন্নাফিল জাছাদে মুজগাতান’ মানবদেহের মধ্যে একটি বিশেষ অংশ আছে যার উন্নতি-অবনতির উপর সম্পূর্ণ দেহের উন্নতি ও অবনতি নির্ভর করে। এ তথ্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এতে মানুষের সৃষ্টি তত্ত্ব ও দেহ-তত্ত্বের ইঙ্গিত দানে মানবের প্রকৃত উন্নতির উপায় উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং সতর্ক করা হয়েছে যে, স্থূল দেহের উন্নতি অপেক্ষা সূক্ষè আত্মার উন্নতির ওপরই মানুষের প্রকৃত ও মুখ্য উন্নতি নির্ভর করে। আত্মার উন্নতি সাধিত না হলে মানব জীবন বিফল ও অত্যন্ত বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।
মানুষের অজুদ বা অস্তিত্ব দুই ভাগে বিভক্ত স্থুলদেহ’ যা বাহ্য দষ্টিতে বা যান্ত্রিক সাহায্যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়ে থাকে এবং ‘সূক্ষèআত্মা’ যা ঐরূপে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হতে পারে না। মানুষের স্থুলদেহ সৃষ্টির মূলে যেমন বিভিন্ন উপাদান রয়েছে যথা পানি, মাটি, বায়ু ও অগ্নি তেমনি তার এ ভৌতিক দেহাভ্যন্তরে পাঁচ প্রকারের আত্মাও রয়েছে। যথা
১। পশুর আত্মা, যা দ্বারা খাওয়া শোয়া, কামরিপু চরিতার্থ করা ইত্যাদি প্রবৃত্তির উদ্রেক হয়।
২। হিংস্র জীবের আত্মা : যা দ্বারা দ্বেষ, হিংসা, ক্রোধ ও রাগের বশীভূত হয়ে মারামারি কাটাকাটি করত: প্রতিশোধ গ্রহণের প্রবৃত্তি জন্মে থাকে।
৩। শয়তানের আত্মা : যার প্ররোচনায় পাপাচার, অহঙ্কার, মিথ্যা ও সূক্ষ্ম কূট-কৌশলের দ্বারা মানুষকে ধোকা দেয়া ইত্যাদির প্রবৃত্তি উদিত হয়।
৪। ফেরেশতা আত্মা : যা দ্বারা সদাচার, ন্যায়পরায়ণতা, সততা, সত্যতা, পরোপকারিতা ও আল্লাহর বশ্যতা স্বীকার করা ইত্যাদির আগ্রহ ও আকর্ষণ জন্মে থাকে।
৫। মানুষের আত্মা : যার কর্তব্য হুে ছ প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় আত্মাকে বশ করত: তাদেরকে কুপ্রবৃত্তির দিক থেকে ফিরিয়ে দিয়ে ফেরেশতা আত্মার সদগুণাবলীতে গুণান্বিত ও পরিচালিত করা এবং আল্লাহর মারেফত ও মহব্বত হাসিল করত: দুনিয়াতে আল্লাহর খেলাফত তথা আল্লাহর হুকুম আহকাম জারির পরিবেশ কায়েম করার আগ্রহ ও আকর্ষণ সৃষ্টি করা।
প্রথম তিনটি আত্মাকেই তাসাওফের পরিভাষায় ‘নফসে আম্মারা’ বলা হয় এবং চতুর্থ ও পঞ্চম এ দুটিকে রূহ, আ’ক্বল বা লতিফা বলা হয় এবং এটিই হুে ছ বিবেক, বুদ্ধি ও মানবাত্মা।
দেখা গেল যে, এই পাঁচ প্রকারের আত্মাই তাসাওফের পরিভাষায় দুই নামে পরিচিত হয়েছে। একটি হল নফসে আম্মারা; এর তিনটি বিভাগ যথা পশুরআত্মা, হিংস্রজন্তুরআত্মা ও শয়তানেরআত্মা। দ্বিতীয়টি হলো রু হ অর্থাৎ মানবাত্মা বা বিবেক -আকল। এর দুটি বিভাগ যথা ফেরেশতার আত্মা ও মনুষত্বেরআত্মা।
রাসূল সা. ‘আলা ইন্না ফিল জাছাদে মোজগাতান’ বলে মানব দেহের যে বিশিষ্ট অংশটির প্রতি নির্দেশ করেছেন, সে অংশটিই হুে ছ রু হ বা আকল-বিবেক। এর উন্নতিতে পূর্ণ মানবদেহের উন্নতি এবং এর অবনতিতে সম্পূর্ণ মানবদেহের অবনতি ঘটে থাকে; এটাই রাসূল সা. বলেছেন রু হ বা জ্ঞান-বিবেক রত্মটির উন্নতি হলে সমগ্র মানবদেহের উন্নতি হবে এবং এর অবনতিতে সমগ্র মানবদেহের অবনতি ঘটবে।
এখন দেখতে হবে যে, এই অংশটির উন্নতির অর্থ কী? বস্তুত প্রতিটি জিনিসের উন্নতি বা অবনতির বিচার করা হয় তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের দ্বারা। তাই এখন দেখতে হবে যে রু হ বা বিবেকের উপর কী কী দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্পিত হয়েছে। এ প্রশ্নের উত্তর অতি সহজ। কারণ, রু হ মানবাত্মা বা বিবেক বলে যে দুটি আত্মার নামকরণ হয়েছিল অর্থাৎ ফেরেশতাআত্মা ও মনুষ্যত্বের আত্মা তাদের কর্তব্য ছিল সদাচার, সততা, সভ্যতা ও আল্লাহর বশবর্তীতা ইত্যাদির প্রতি আকৃষ্ট করা এবং সঙ্গে সঙ্গে নফস নামে যে অপর তিনটি শক্তি বা আত্মা আছে তাদেরকে বশে এনে ফেরেশতা আত্মার সদগুণাবলীতে পরিচালিত করা। অতএব রু হ বা বিবেকের দায়িত্ব ও কর্তব্যও তাই হবে। এ মহান কর্তব্য পালনে রু হ মানবাত্মা বা বিবেক যতোটুকু উন্নতি করতে পারবে, পূর্ণমানবদেহটি ততটুকুই উন্নতি লাভ করবে। এমনকি অবশেষে এই রু হ মানবাত্মা যে উর্দ্ধজগত থেকে এসেছিল পুনরায় সে মানবদেহকে নিয়ে সেই উর্দ্ধজগতে অর্থাৎ বেহেশতে গিয়ে পৌঁছবে। পক্ষান্তরে রূহ মানবাত্মা নিজের ঐ কর্তব্যে ত্রু টি করত: নিজেই যদি নফস তথা ঐ তিন প্রকার আত্মার বশ্যতা স্বীকার করার অবনতিতে পতিত হয়, তা হলে পূর্ণ মানবদেহই অবনতির তিমির গর্তে পতিত হবে। অবশেষে ঐ রু হ মানবাত্মা মানবদেহকে নিয়ে সর্ব নিু জগতে তথা জাহান্নামে পৌঁছাবে।
আধ্যাত্মিক জ্ঞানবিশারদগণ রু হ বা বিবেকের উন্নতির পাঁচটি স্তর বর্ণনা করেছেন এবং প্রত্যেকটির ভিন্ন ভিন্ন নামকরণ করেছেন। পূর্বেই ইঙ্গিত করা হয়ে ছিল যে, রু হ মানবাত্মা বা আকল ও বিবেককে তাসাওফের পরিভাষায় লতিফা নামেও নামকরণ হয়ে থাকে। সেই অনুসারেই রু হের উন্নতির পাঁচটি স্তরের নিুলিখিতরূপে নামকরণ করা হয়েছে।
১। লতিফায়েকলব : মানুষ যখন আল্লাহকে স্মরণ করে, আল্লাহর নাম উু চরণ করত: জিকির করে তখন সে এ লতিফায়ে কালবের কর্তব্য পালন করে।
২। লতিফায়ে রু হ : মানুষ যখন আল্লাহর মহৎ গুণাবলীর ধ্যান করে এবং এই ধ্যানের দ্বারা নিজের মধ্যেও ঐ গুণের প্রতিবিম্ব হাসিল করে, যেমন : আল্লাহ দয়ালু, দয়াময় এর ধ্যান করত: এমন অবস্থার সৃষ্টি করে যে, আমাকেও দয়ালু হতে হবে এবং দয়ালুর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে তখন হয় লতিফায়ে রু হের কর্তব্য পালন।
৩। লতিফায়ে সের্র : মানুষ যখন আল্লাহর গুণাবলীর প্রতিবিম্ব নিজের মধ্যে হাসিল করায় সচেষ্ট হয় তখন তার সিনার অভ্যন্তরে আল্লাহর মারেফাতের বা আল্লাহর গুণাবলীর তত্বজ্ঞানের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়, তখন মানুষ আল্লাহর গুণে মুগ্ধ ও অভিভূতহয়ে আল্লাহর আশেক ও প্রেমিকে পরিণত হয়ে যায় এবং নিজের নফসের সব কুপ্রবৃত্তির প্রতি ঘৃণা জন্মে যায় এবং সেগুলোকে ফানা ও বিলুপ্ত করে দেয় অর্থাৎ সেগুলোকে পূর্ণরূপে দখল ও অধিকার করার শক্তি ও সামর্থ অর্জন করে, এটাই হুে ছ লতিফায়ে সের্র এর কর্তব্য।
৪। লতিফায়ে খফী মানুষের মধ্যে যখন আল্লাহর মা'রেফতের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়, তখন মানুষ আল্লাহর গুণে মুগ্ধ ও অভিভুত হয়ে আল্লাহর আশেক ও প্রেমিকে পরিণিত হয়ে যায় এবং নিজের নফসের সব কুপ্রবৃত্তির প্রতি ঘৃণা জন্মে যায় এবং সেগুলোকে ফানা ও বিলুপ্ত করে দেয়। অর্থাৎ সেগুলোকে পূর্ণভাবে দখল ও অধিকার করার শক্তি ও সামর্থ অর্জন করে। এটাই হ্ছে লতিফায়ে খফীর কর্তব্য।
৫। লতিফায়ে আখফা : মানুষ ফানা-ফিল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহরগুণে গুণান্বিত হওয়ার মর্তবায় পৌঁছে, যাকে আল্লাহর খেলাফত লাভ বলে; এটাই হুে ছ লতিফায়েআখফার মর্যাদা। এ অবস্থাতেই রু হ বা বিবেক ও আকলের পূর্ণশুদ্ধি হয়ে যায়। এই অবস্থার পরে আর বিবেককে কুপ্রবৃত্তির বশীভুত হতে হয় না। রাসূল সা. মানুষকে বিবেক সঠিক করার যে প্রেরণা দান করেছেন তার উদ্দেশ্য হুে ছ মানবাত্মার পরম উন্নতিলাভ।শেখ সাদীর গুলিস্তা
এক সাধু দরবেশ, ইবাদতে বন্দেগিতে ছিলো বেশ। কিন্তু একবার ...
এক সাধু দরবেশ, ইবাদতে বন্দেগিতে ছিলো বেশ। কিন্তু একবার একদল দুর্বৃত্ত, তাকে কষ্ট দিতে হলো প্রবৃত্ত। বলল তাকে জানে যত অকথ্য কথা, পারলে যেন চিবিয়ে খায় তার মাথা। বেচারা দরবেশ অবশেষে হয়ে অতিষ্ঠ, পীরের খেদমতে আরয করলো মনের কষ্ট। বললো, জনাব, এই হলো আমার দুরবস্থা, দুষ্টদের হাতে নাজেহাল হেনেস্থা। সব শুনে বললেন পীরে কামেল, তুমি তো বিলকুল মূর্খ জাহেল! জানো না, দরবেশি লেবাস যে করে ধারণ, হাসিমুখে সব তাকে করতে হয় বরণ! এই লেবাসে সইতে পারে না যে যিন্দেগির বুরা-ভালা, মিথ্যা দাবীদার সে, সাজে না তার গলায় দরবেশির মালা।কবিতা- ঢিল ছুঁড়িলে দরিয়ার পানি হয় না ঘোলা/ কষ্টে বেসবূর, সে যে এক ক্ষুদ্র নালা/ তোমার বুকে যে দুর্জন আঘাত হানে/ ক্ষমা করো তারে ওগো সাধু নিজের গুণে/ মাটির সঙ্গে একদিন হবে ভাই মাটি/ তাই মাটি হও আসিবার আগে কবর-ঘাঁটি।
শিক্ষা- যারা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে চায় তাদের কর্তব্য হলো মূর্খ লোকের মূর্খ আচরণের উত্তরে ক্ষমাসুন্দর আচরণ করা।
***শোনো বাগদাদের রাজ দরবারের খবর, শাহী ঝাণ্ডা ও শাহী পর্দা করে বিতণ্ডা জবর। অনুযোগের স্বরে পর্দাকে বলে ঝাণ্ডা, আমার কথার জবাব দাও মাথা রেখে ঠাণ্ডা। আমি-তুমি করি একই বাদশাহর গোলামি, অথচ দেখো, কিসমতের এ কী যালিমি! যুদ্ধের মাঠে আমার একদণ্ড নাই অবসর, যখন তখন অভিযান, হই ধুলিধূসর। অথচ তুমি! না দেখেছো যুদ্ধের বিভীষিকা, না মরুভূমির পিপাসা ও মরীচিকা। দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণা আমি সয়ে যাই অম্লান, অথচ তোমার ভাগে জোটে সব মান-সম্মান। তুমি চাঁদ-বদন, গুলবদন দাস-দাসীর আবরণ, আমি থাকি পড়ে রুক্ষ সিপাহির হাতে, করি লড়াই জীবন-মরণ। বলো কী এর কারণ, সত্য সত্য দিও বিবরণ। বলে পর্দা লাজ-শরমে, যেন মরে যায় মরমে, বিনয়ে আমি ঝুলে থাকি নিম্নমুখী, গর্বে তুমি থাকো সদা ঊর্ধ্বমুখী। অযথা উঁচিয়ে রাখে যে তার মাথা, হবেই হবে একসময় ঘাড়ে তার ব্যথা।
শিক্ষা- যে বিনয় অবলম্বন করে সে অল্প পরিশ্রমেই মর্যাদার উচ্চ শিখরে আসীন হয়, আর অহংকারী যত দৌড়ঝাঁপ করুক, লাঞ্ছনাই হবে তার ভাগ্যলিপি। সুতরাং সর্ববিষয়ে বিনয় অবলম্বন করো এবং অহংকার পরিহার করে চলো।
***অন্তর্জ্ঞানী এক বুযুর্গান, একদিন দেখেন এক পাহলোয়ান, ক্রোধে দিশেহারা, আত্মহারা, যাকে পায় তাকে করে তাড়া। বুযুর্গান করেন জিজ্ঞাসা, কেন এহেন দশা, কী তার সমস্যা? লোকেরা বলে, কেউ দিয়েছে গালি, তাই মাথায় চেপেছে খুন, রেগে মেগে হয়ে আছে আগুন। তিনি অবাক হলেন এবং বললেন, হায়, উঠাতে পারে লোহার দশমন ভার, পারে না সইতে একটু ভার দু'টো কথার! কবিতা-
পাহলোয়ানির বড়াই তুমি করো না/ ভাই কুশ্তি-লড়াই তোমার সাজে না/ কে বলে তারে বীর নফস যার কামীনা!/ মর্দ নয় সে চুড়িপরা ভীরু যানানা/ মানুষের মুখে পারো যদি তুলে দাও মিষ্টি/ বাহাদুরি নয় শুধু আঘাত করা তুলে মুষ্টি/ ফুলিয়ে ছাতি কাবু করো হাতি/ নিজেরে ভাবো তুমি ভদ্র মানুষ অতি/ যুগ যুগের সত্য বচন যেনো সুনিশ্চয়/ মনুষত্ব নেই, তবে মানুষ সে নয়/ আদমের বেটা মাটির গড়া, নয় আগুন/ মানুষ বলি তারে কী করে, যদি না পায় মাটির গুণ।
শিক্ষা- জনৈক বুযুর্গকে জিজ্ঞাসা করলাম খাঁটি বন্ধুর পরিচয়, তিনি বললেন, বন্ধুকে ভুলে আত্মস্বার্থে মগ্ন যে, সে নীচ অতিশয়। জ্ঞানিগণ বলে গেছেন এই বচন, নিজেকে নিয়ে সদা মগ্ন যেজন, সে তোমার না বন্ধু, না স্বজন। কবিতা- ‘সফরে তোমায় ফেলে আগে আগে চলে/ সে নয় সঙ্গী তোমার তারে যাও ভুলে/ দিলে যার নাই ধার্মিকতা ও খোদা-ভীরুতা/ আত্মীয় বলে তার সনে করো না অন্তরঙ্গতা।
মনে পড়ে, জ্ঞানের দাবীদার এক জ্ঞানী, খণ্ডন করেছে আমার এই কবিতার বাণী। সে বলে, ‘কোরআনে তো রয়েছে খোদার ফরমান, আত্মীয়তা যেন ছিন্ন না করি, যদিও করতে হয় জান কোরবান। অথচ তোমার কথা হে কবী, হে গুণী, খোদার কালাম কোরআনের নাফরমানি।’ তাকে বললাম, জ্ঞান তোমার অগাধ, মানি, তবে তুমি কি আয়াত পড়োনি, যদি বাধ্য করে তোমাকে তারা আমার সঙ্গে শরীক করতে এমন কিছুকে যার সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তাহলে তাদের কথা তুমি মান্য করো না।
কবিতা- খোদার বেগানা তোমার আত্মীয়, শত শত/ অনাত্মীয় এক খোদাভীরু শ্রেয় যেনো নিশ্চিত ।
শিক্ষা- আমাদের কর্তব্য হলো রক্তের বন্ধনের চেয়ে দ্বীনের বন্ধনকে অগ্রাধিকার প্রদান করা।
***বাগদাদের এক ধনী বৃদ্ধ ধনে জনে ছিলেন সমৃদ্ধ। হঠাৎ কী যে হলো তার দুর্মতি, রূপসী কন্যার কপালে ডেকে আনেন দুর্গতি। এক ইতর চামারের সঙ্গে দিলেন তার বিবাহ। চামারের অত্যাচারে কন্যার জীবন হলো দুর্বিষহ। শেষে একদিন বললেন কন্যার পিতা, শোনো হে ইতর জামাতা, তোমার একি পাশবিকতা, কন্যার দশা করে ছেড়েছো যা তা! হাজার দিনার নাও হে চামার, ছেড়ে দাও মাসুম কন্যা আমার।
এঘটনা বলার উদ্দেশ্য আমার নয় শুধু পরিহাস ও বিনোদন। হাস্যরস ভুলে এর উপদেশটুকু করো গ্রহণ। স্বভাব যদি হয় মন্দ কখনো তা দূর হয় না, মৃত্যুর আগে খাছলত কখনো বদল হয় না। জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে বিসর্জন, ইতরের সঙ্গ যদি করো গ্রহণ। তবে নিজেকেই শুধু করো তিরস্কার, অন্যকে কিছু বলার নেই তোমার অধিকার।
শিক্ষা- এঘটনার উপদেশ পরিষ্কার। স্বভাব যাদের মন্দ তাদের সঙ্গ পরিত্যাজ্য, অন্যথায় নিজেকেই তার খেসারত দিতে হয়।
শিক্ষা- যারা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে চায় তাদের কর্তব্য হলো মূর্খ লোকের মূর্খ আচরণের উত্তরে ক্ষমাসুন্দর আচরণ করা।
***শোনো বাগদাদের রাজ দরবারের খবর, শাহী ঝাণ্ডা ও শাহী পর্দা করে বিতণ্ডা জবর। অনুযোগের স্বরে পর্দাকে বলে ঝাণ্ডা, আমার কথার জবাব দাও মাথা রেখে ঠাণ্ডা। আমি-তুমি করি একই বাদশাহর গোলামি, অথচ দেখো, কিসমতের এ কী যালিমি! যুদ্ধের মাঠে আমার একদণ্ড নাই অবসর, যখন তখন অভিযান, হই ধুলিধূসর। অথচ তুমি! না দেখেছো যুদ্ধের বিভীষিকা, না মরুভূমির পিপাসা ও মরীচিকা। দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণা আমি সয়ে যাই অম্লান, অথচ তোমার ভাগে জোটে সব মান-সম্মান। তুমি চাঁদ-বদন, গুলবদন দাস-দাসীর আবরণ, আমি থাকি পড়ে রুক্ষ সিপাহির হাতে, করি লড়াই জীবন-মরণ। বলো কী এর কারণ, সত্য সত্য দিও বিবরণ। বলে পর্দা লাজ-শরমে, যেন মরে যায় মরমে, বিনয়ে আমি ঝুলে থাকি নিম্নমুখী, গর্বে তুমি থাকো সদা ঊর্ধ্বমুখী। অযথা উঁচিয়ে রাখে যে তার মাথা, হবেই হবে একসময় ঘাড়ে তার ব্যথা।
শিক্ষা- যে বিনয় অবলম্বন করে সে অল্প পরিশ্রমেই মর্যাদার উচ্চ শিখরে আসীন হয়, আর অহংকারী যত দৌড়ঝাঁপ করুক, লাঞ্ছনাই হবে তার ভাগ্যলিপি। সুতরাং সর্ববিষয়ে বিনয় অবলম্বন করো এবং অহংকার পরিহার করে চলো।
***অন্তর্জ্ঞানী এক বুযুর্গান, একদিন দেখেন এক পাহলোয়ান, ক্রোধে দিশেহারা, আত্মহারা, যাকে পায় তাকে করে তাড়া। বুযুর্গান করেন জিজ্ঞাসা, কেন এহেন দশা, কী তার সমস্যা? লোকেরা বলে, কেউ দিয়েছে গালি, তাই মাথায় চেপেছে খুন, রেগে মেগে হয়ে আছে আগুন। তিনি অবাক হলেন এবং বললেন, হায়, উঠাতে পারে লোহার দশমন ভার, পারে না সইতে একটু ভার দু'টো কথার! কবিতা-
পাহলোয়ানির বড়াই তুমি করো না/ ভাই কুশ্তি-লড়াই তোমার সাজে না/ কে বলে তারে বীর নফস যার কামীনা!/ মর্দ নয় সে চুড়িপরা ভীরু যানানা/ মানুষের মুখে পারো যদি তুলে দাও মিষ্টি/ বাহাদুরি নয় শুধু আঘাত করা তুলে মুষ্টি/ ফুলিয়ে ছাতি কাবু করো হাতি/ নিজেরে ভাবো তুমি ভদ্র মানুষ অতি/ যুগ যুগের সত্য বচন যেনো সুনিশ্চয়/ মনুষত্ব নেই, তবে মানুষ সে নয়/ আদমের বেটা মাটির গড়া, নয় আগুন/ মানুষ বলি তারে কী করে, যদি না পায় মাটির গুণ।
শিক্ষা- জনৈক বুযুর্গকে জিজ্ঞাসা করলাম খাঁটি বন্ধুর পরিচয়, তিনি বললেন, বন্ধুকে ভুলে আত্মস্বার্থে মগ্ন যে, সে নীচ অতিশয়। জ্ঞানিগণ বলে গেছেন এই বচন, নিজেকে নিয়ে সদা মগ্ন যেজন, সে তোমার না বন্ধু, না স্বজন। কবিতা- ‘সফরে তোমায় ফেলে আগে আগে চলে/ সে নয় সঙ্গী তোমার তারে যাও ভুলে/ দিলে যার নাই ধার্মিকতা ও খোদা-ভীরুতা/ আত্মীয় বলে তার সনে করো না অন্তরঙ্গতা।
মনে পড়ে, জ্ঞানের দাবীদার এক জ্ঞানী, খণ্ডন করেছে আমার এই কবিতার বাণী। সে বলে, ‘কোরআনে তো রয়েছে খোদার ফরমান, আত্মীয়তা যেন ছিন্ন না করি, যদিও করতে হয় জান কোরবান। অথচ তোমার কথা হে কবী, হে গুণী, খোদার কালাম কোরআনের নাফরমানি।’ তাকে বললাম, জ্ঞান তোমার অগাধ, মানি, তবে তুমি কি আয়াত পড়োনি, যদি বাধ্য করে তোমাকে তারা আমার সঙ্গে শরীক করতে এমন কিছুকে যার সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তাহলে তাদের কথা তুমি মান্য করো না।
কবিতা- খোদার বেগানা তোমার আত্মীয়, শত শত/ অনাত্মীয় এক খোদাভীরু শ্রেয় যেনো নিশ্চিত ।
শিক্ষা- আমাদের কর্তব্য হলো রক্তের বন্ধনের চেয়ে দ্বীনের বন্ধনকে অগ্রাধিকার প্রদান করা।
***বাগদাদের এক ধনী বৃদ্ধ ধনে জনে ছিলেন সমৃদ্ধ। হঠাৎ কী যে হলো তার দুর্মতি, রূপসী কন্যার কপালে ডেকে আনেন দুর্গতি। এক ইতর চামারের সঙ্গে দিলেন তার বিবাহ। চামারের অত্যাচারে কন্যার জীবন হলো দুর্বিষহ। শেষে একদিন বললেন কন্যার পিতা, শোনো হে ইতর জামাতা, তোমার একি পাশবিকতা, কন্যার দশা করে ছেড়েছো যা তা! হাজার দিনার নাও হে চামার, ছেড়ে দাও মাসুম কন্যা আমার।
এঘটনা বলার উদ্দেশ্য আমার নয় শুধু পরিহাস ও বিনোদন। হাস্যরস ভুলে এর উপদেশটুকু করো গ্রহণ। স্বভাব যদি হয় মন্দ কখনো তা দূর হয় না, মৃত্যুর আগে খাছলত কখনো বদল হয় না। জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে বিসর্জন, ইতরের সঙ্গ যদি করো গ্রহণ। তবে নিজেকেই শুধু করো তিরস্কার, অন্যকে কিছু বলার নেই তোমার অধিকার।
শিক্ষা- এঘটনার উপদেশ পরিষ্কার। স্বভাব যাদের মন্দ তাদের সঙ্গ পরিত্যাজ্য, অন্যথায় নিজেকেই তার খেসারত দিতে হয়।
শেখ সাদীর গুলিস্তা
শেখ সাদীর গুলিস্তা
পূর্বযুগের এক বাদশাহ জনৈক বুযুর্গকে করেন জিজ্ঞাসা, যার ছিলো অনেক পোষ্যমুখ, আর মনে ছিলো অনেক চিন্তাদুঃখ। জিজ্ঞাসা করেন, আপনার জীবনের প্রিয় সময়গুলো হে জনাব, কীভাবে কাটে দেবেন কি জবাব? তিনি বললেন, সারা রাত কাটে ইবাদত বন্দেগিতে, ভোর রাত কাটে রিযিকের দু‘আ-মুনাজাতে, আর সারাটা দিন যায় রুটি-রুযির ধান্ধায়। বাদশাহর অতি উচ্চ ছিলো চিন্তাধারা, তাই তিনি বুঝে নিলেন তার কথার ইশারা এবং তখনই জারি করলেন হুকুমনামা, দান করো তাকে নতুন জামা-পাজামা, আর জারি করে দাও প্রতি মাসের পর্যাপ্ত ভাতা, যাতে চিন্তুামুক্ত হয়ে সিজদায় পড়ে থাকে তাঁর মাথা। কবিতা- পরিবারের শেকলে বাঁধা তুমি সকাল-বিকাল/ঝেড়ে ফেলো নিশ্চিন্ত ইবাদতের খোশ খেয়াল/ রুটি-রুজির চিন্তা করে যার শান্তিহরণ/ঊর্ধ্বজগতে কেমন করে হবে তার বিচরণ?/ একই ঘোরে নিত্য যে ঘুরি, আর বলি হে মন/ আজ নিশিতে নির্জনে খোদারে করিব স্মরণ/ নিশিতে নামাযে দাঁড়িয়ে হায়, ভাবনা এসে যায়/ সন্তানেরা মোর কী খাবে ভোরে, কী হবে উপায়? শিক্ষা- যারা ইবাদত বন্দেগির স্বাদ পেতে চায়, তাদের কর্তব্য হলো সংসারের ঝামেলায় বেশীমাত্রায় নিজেকে লিপ্ত না করা। নচেৎ দিনরাত পোষ্যপরিজনের চিন্তায় ডুবে থাকতে হবে, ইবাদতের অবসরই আর পাওয়া যাবে না, এমনকি রাজাবাদশা ও দুনিয়াদারদের কাছে হাত পাতারও যিল্লতি ভোগ করতে হতে পারে। *** এক দেশে ছিলেন এক দরবেশ, বুযুর্গিতে ছিলো নামডাক বেশ। একবার তিনি শহরের জীবন ত্যাগ করে চলে গেলন বনের ভিতরে। সেখানেই শুরু করলেন তার নতুন জীবন, দিন-রাত করেন ইবাদত সঁপে দিয়ে তুনমন। বনের ভিতরে তার জায়নামায থাকে পাতা, উদরের ক্ষুধা দূর করেন খেয়ে গাছের পাতা। ঘটনা শুনে দেশের বাদশাহ হন পেরেশান এবং সঙ্গে সঙ্গে দরবেশের খেদমতে ছুটে যান। বলেন তিনি করজোড়ে নিবেদন করে, হুযূর! দয়া করে ফিরে চলুন শহরে। যদি ভালো মনে করেন এবং কবুল করে আপনার যেহেন, তাহলে বলি- আপনার জন্য নির্ধারণ করবো একটি মনোরম প্রাসাদ; সেখানে নির্জনে ইবাদত করবেন মিটিয়ে মনের সাধ। এখানের চেয়ে উত্তম হবে ইবাদতের একাগ্রতা; তাতে কোন সন্দেহ নেই নিশ্চিত তা। তাছাড়া লোকেরা ধন্য হবে আপনার নূরানি ছোহবতে এবং মগ্ন হবে আপনার অনুসরণে বন্দেগিতে। দরবেশের মোটেই পছন্দ হলো না বাদশাহর প্রস্তাব, কারণ তাতে পরে হতে পারে মনস্তাপ। তাই তিনি তার নিবেদন নাকচ করে দিলেন এবং অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তখন বাদশাহর সঙ্গী এক উযির দেখালেন যুক্তি, ঠিক নয় তাকে ফিরিয়ে দেয়া যিনি করেন এত ভক্তি। অন্তত বাদশাহর মনরক্ষার খাতিরে দু’তিন দিন এসে থাকুন শহরে। নিজেই পরীক্ষা করে দেখুন প্রাসাদের পরিবেশ। সেখানে ইবাদতে না হয় যদি মনোনিবেশ, আর সাধারণ মানুষের সঙ্গ, যদি করে আপনার ধ্যান ভঙ্গ, থাকবে তো আপনার অধিকার সবকিছু ছেড়ে চলে আসার। কথিত আছে, দরবেশ শহরে এলেন দুদিনের জন্য। শহরবাসী সকলে তার আগমনে হলো যেন ধন্য। শাহী উদ্যানে এক প্রাসাদ তার জন্য করা হলো খালি। রোয সকালে তার খেদমতে তাজা ফুল হাযির করে মালী। সে বাগানের সৌন্দর্যের কথা আর বলো না; আসলে দুনিয়াতে ছিলো তা জান্নাতের নমুনা। কবিতা- লাল গোলাব যেন প্রিয়তমার গণ্ডদেশ/ ঝুলে থাকা ‘সাম্বাল’ যেন তার কৃষ্ণ কেশ/ ‘শীত-সকালে’ ফুলগুলো তরুতাজা দেখতে এমন/ এখনো মায়ের কোলে দুধ না খাওয়া শিশু যেমন/ ডালে ডালে ঐ যে দেখো তুমি শত শত ‘আনারকলি’/ সবুজ গাছে ঝুলে আছে যেন লাল অঙ্গারগুলি। দরবেশের সেবায় বাদশাহ পাঠালেন একদাসী, এমন ছিলো যার সৌন্দর্যরাশি- চাঁদের টুকরো এক, ভাঙ্গে যেন সুফীর ধ্যান/ অপ্সরি, ময়ূরি, তারে হেরি হারায় সবে জ্ঞান/ গুলবাগে চুল খুলে সবুজ ঘাসে করে পায়চারি/ তসবি হাতে রাখতে নারে কেহ ধৈর্য ধরি। দাসীর পরে বাদশা পাঠালেন সুদর্শন এক দাস, যেন এক নাশ, সঙ্গে তার সর্বনাশ। কবিতা- পেয়ালা হাতে সবার মাঝে ঘোরে সে সাকী/ দেয় না কিছু দেখায় শুধু যুলুম এ কী!/ দেখে দেখে আশ না মেটে, শুধু নেশা ধরে/ ফোরাতের তীরে যেন পিপাসায় মরে। দরবেশ তার জায়নামায রেখে একপাশে, মজে থাকে ফলের স্বাদে, ফুলের সুবাসে এবং পানাহারে ভোগবিলাসে। কখনো সুদর্শন দাস, কখনো সুন্দরী দাসী, উপহার দেয় কটাক্ষ আর মধুর হাসি। মুগ্ধ দরবেশ তা করে অবলোকন, তার মন যেন করে ওঠে কেমন! এ কারনেই তো জ্ঞানিগণ বলেন অবিরত, রূপসীর কেশ হলো বুদ্ধির শিকল, জ্ঞানীর জ্ঞান করে দেয় বিকল। কবিতা- তব চরণে করিনু উৎসর্গ ইহ-পরকাল/ আমি মূর্খ পাখী, তুমি যে মনোহর এক জাল। মোটকথা, দীর্ঘ ইবাদতের যা কিছু অর্জন গেলো সব রসাতলে, পুণ্যের সাধনা করলেন বর্জন ভোগের পদতলে। কবিতা- জগতের যত পীর-সাধু, জ্ঞানী, কবি/ ঘোচায় ঘোর আঁধার, হয়ে সত্যের রবি/ দুনিয়ার লোভে যায় যবে যায় অধঃপাতে/ যেন মাছি উড়ে গিয়ে পড়ে যায় মধুতে। এভাবে সুখে-ভোগে দরবেশের দিন কাটে গুলবাগে, বাদশাহর মনে ফের দরবেশের যেয়ারাতের সাধ জাগে। গিয়ে দেখেন, তিনি তখন অন্য মানুষ, ঘীয়ে মাখনে বিলকুল নাদুশনুদুশ! হেলান দিয়ে আছেন মখমলের তাকিয়ায়। রূপসী দাসী মাথার উপর ময়ূরপাখা দোলায়। দরবেশের খোশহাল দেখে বাদশাহ হলেন খোশ; বাড়িয়ে দিলেন মাসোহারা ও খোরপোশ। দরবেশের সঙ্গে বাদশাহর হলো অনেক কথা, অবশেষে বললেন তিনি নত করে মাথা, দু’টি শ্রেণীকে আমি মনে প্রাণে ভালোবাসি, আর কেউ তাদের বাসে না ভালো এত বেশী। এক হলো যারা আলিম, বিদ্যানুরাগী, আর হলো যারা যাহিদ, সংসারত্যাগী। এক উযির অতি বিচক্ষণ, বাদশাহর সঙ্গে থাকেন সর্বক্ষণ, বললেন তিনি ধীরে ধীরে বাদশাহকে সম্বোধন করে, জাহাঁপানা, দাবী হলো ভালোবাসার, উভয়ের সঙ্গে করবেন সদাচার। আলিম যারা তাদের দান করুন বেশুমার, যেন ইলমের প্রতি হয় অনুরাগ সবার। আর যারা যাহিদ সংসার ত্যাগী, দান দ্বারা ঠিক নয় তাদের করা দুনিয়াভোগী। শিক্ষা- দুনিয়ার মোহজাল এবং শয়তানের ধোকা সম্পর্কে সাবধান থাকা উচিত। লোকমুখে গেছে জানা একই রকম ঘটনা। এক বাদশাহর সামনে এলো কঠিন পরিস্থিতি, যা কেড়ে নিলো তার মনের শান্তি-স্থিতি। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন মনে মনে, কেটে গেলে বিপদ দান করবো সাধুজনে। আল্লাহর ইচ্ছায় পূর্ণ হলো বাদশাহর প্রয়োজন এবং তার মনের দুশ্চিন্তার হলো নিরসন তাই খোশদিলে করলেন মান্নত পূরণের আয়োজন। বাদশাহার বিশিষ্ট এক সেবক, হুকুম পালনের পেয়েছে সবক। বাদশাহ দিলেন তাকে ডেকে, ্একথলি দিরহাম রাজকোষ থেকে, আর বললেন, রাজ্যের যত সাধুজন, সংসার নিরাসক্ত, তাদের দান করো এ অর্থ, কেউ থাকে না যেন অভুক্ত। লোকে বলে, সেবক ছিলো বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান ভারি। সুচারুরূপে আদেশ পালনে হতো না দেরী। সোনা-চাঁদির থলিয়া নিয়ে সারা দিন শহরে ঘুরে ঘুরে, সন্ধ্যায় ক্লান্তদেহে রাজপ্রাসাদে এলো ফিরে। বাদশাহকে উপযুক্ত সম্বোধন করে এবং তার রাজহস্ত চুম্বন করে, বললো, জাহাঁপনা কী করবো নিবেদন, সারা শহর ঘুরে পেলাম না নিরাসক্ত কোন সাধুজন। বললেন বাদশাহ, একি কথা! খেয়েছো কি বুদ্ধির মাথা! অথচ আমি জানি এবং তা সত্য মানি, দেশে আমার, আছে চারশ যাহিদ নিরাসক্ত। যেমন তাদের সাধনা উপাসনা তেমনি তারা খোদভক্ত। সেবক নিবেদন করে মৃদু হেসে, সোনা-চাঁদির থলি রেখে একপাশে, জাহাঁপানা, নিরাসক্ত যে সে তো হাত পেতে দান নেয় না, আর যে হাত পাতে সে তো নিরাসক্ত হয় না! সভাসদদের উদ্দেশ্যে বাদশাহ বললেন সহাস্যে, খোদাপ্রেমিক এই সাধুজনদের আমি যত করি ভক্তি প্রদর্শন, বেশরম এই গোলামের মাঝে তত দেখি অভক্তির নিদর্শন! তবে কথা তার বড় সত্য, সোন-চাঁদির আসক্তি ছাড়া বড় শক্ত। কবিতা- হাত পেতে নিলো যে দিরহাম-দীনার/ নিজেই গুঁড়িয়ে দিলো সে সাধুতার মিনার/ কথা শক্ত, নয় সে খোদভক্ত সাধু/ অন্য জনে খুঁজে দেখো, খোদাভক্তির মধু। শিক্ষা- যাহিদ ও সংসার- নিরাসক্ত হওয়ার দাবী করা যথেষ্ট নয়, বরং আচরণের মাধ্যমেই প্রকাশ পাবে, কে যাহিদ ও নির্লোভ। সত্যিকার যাহিদ যিনি, তিনি কখনো মানুষের কাছে হাত পাততে পারেন না। *** এক আলিমে দ্বীন, চেহারায় ছিলো বুযুর্গির চি?হ্ন; লোকেরা তাকে করলো কঠিন এক প্রশ্ন- বলুন তো এই যে ওয়াক্ফের ভাতা, বৈধ কি গ্রহণ করা তা? সঙ্গে সঙ্গে বললেন তিনি, নিয়ত কী, আগে তা জানি! ইবাদতের নিমগ্নতা লাভের জন্য হলে তো হালাল, লোভের কারণে হলে হাশরে পড়বে ধরা ব-মাল। শিক্ষা- দ্বীনী প্রয়োজনে সঠিক সূত্র থেকে অবশ্যই সাহায্য গ্রহণ করা যায়, তবে নিয়ত হতে হবে খালিছ। দ্বীনী কাজের উদ্দেশ্যে সম্পদ ব্যবহার করবে, সম্পদ আহরণের উদ্দেশ্যে দ্বীনী কাজ করবে না। *** একদরবেশ একবার এলেন এক অঞ্চলে, তার নিবাস ছিলো নির্জনে জঙ্গলে। অঞ্চলের শাসক ছিলেন অতি অভিজাত, কারো মনে কখনো দেন না আঘাত। যেমন দানশীল তেমনি উদার। সবার জন্য খোলা ছিলো তার দুয়ার। জ্ঞানী-গুণীদের একটি দল ছিলো তার মজলিসে, দরবেশ গিয়ে বসলেন নীরবে একপাশে। সবাই তখন বলছিলেন দামী দামী সব কথা। দরবেশ ছিলেন ক্লান্ত শ্রান্ত, আর ছিলো ক্ষুধা। অনেক দূর থেকে এসেছেন, অনেক দিন না খেয়ে থেকেছেন। তাই কিছু না বলে তিনি বসে ছিলেন চুপচাপ, তবে সবার নযর পড়ে গেলেন আপসে আপ। একজনের ইচ্ছে হলো, করবেন পরিহাস, বললেন, কিছু বলুন জনাব, না করে নিরাশ। তিনি বললেন, মুখে ছিলো মৃদু হাসি, আমি মূর্খ মানুষ অরণ্যবাসী। আপনাদের মত জ্ঞানী, গুণী, মহাজন কিছু নই, জানি না হাদীছ-কোরান, পড়িনি জ্ঞানের কোন বই। আমার কথা মানে জ্ঞানীদের সময় নষ্ট, তবে বলতে পারি একপংক্তিতে যদি হন তুষ্ট। সকলে আগ্রহভরে, বলে উঠলেন সমস্বরে, কেন নয়, কেন নয়! বলুন শোনবো নিশ্চয়। তিনি বললেন- (কবিতা) অনাহারে মরণদশা, চায় না কিছু, চায় শুধু রুটি/ ফিরে চাইবে না, দাও যদি তারে চঁদের সমান বেটি। এক পংক্তিতে বুঝে নিলো সবে জ্ঞান তার কত এবং ক্ষুধা-অনাহারে অবস্থা কাহিল কত! সঙ্গে সঙ্গে দস্তরখান বিছানো হলো এবং যা ছিলো তাই সামনে রাখা হলো। মেযবান বললেন, হে ভাই, একটু সময় চাই। দাসীদের হাতে তৈরী হচ্ছে কালিয়া-কোফ্তা, যদি দিতে পারি দস্তরখানে হবে আনন্দের ভোগ তা। দরবেশ মাথা তুলে মুচকি হেসে উঠলেন বলে- (কবিতা) সামনে আমার নাই স্বাদের কোফ্তা-কাবাব/ দুঃখ নাই তাতে শোনো বন্ধু মোর জবাব/ রুটির টুকরা হোক না সস্তা ও খাস্তা/ তার তরে কোফ্তা তাই, ক্ষুধার আগুনে যে ‘কোফ্তা’। শিক্ষা- সুস্বাদু খাবারের অপেক্ষায় বসে থাকা আল্লাহওয়ালা মানুষের শান নয়। ক্ষধার সময় সামনে যা আসে আল্লাহর নেয়ামত মনে করে তাই গ্রহণ করা উচিত। তাছাড়া ক্ষুধা যে কোন খাবারকে সুস্বাদু করে দেয়। *** এক মুরিদ হয়ে বেহাল-পেরেশান, পীরের খেদমতে ছুটে যান। বললেন, হুযূর হয়ে মজবূর এসেছি ছুটে, ভক্তদের ভিড়ে যিকির-ইবাদত যায় বুঝি টুটে। মানুষ দলে দলে আসে, তাতে হয় কষ্ট। নির্জনতায় বিঘ্ন ঘটে, সময়ও নষ্ট। তাই বড় পেরেশান। হুযূর, দিন কোন সমাধান। জ্ঞানী পীর, বললেন ধীর-স্থির, গরীব ভক্তদের দাও কিছু ঋণ; শোধের ভয়ে তারা আসবে না কোনদিন। আর যারা সচ্ছল ধনী, জেনে নাও তাদেরও অস্ত্রখানি; সুযোগ বুঝে হাত পেতে, চাও কিছু মাল, উবে যাবে ভক্তি, হারিয়ে যাবে চিরকাল। কবিতা- ঋণ যদি দাও, তুমি রহমতের ফেরেশতা/ গাইবে তোমার গুণ হবে ফেরেফতা/ ফেরত যদি চাও, তুমি হলে যমদূতের ভাই/ তোমার চেয়ে মন্দ কেহ ত্রিভুবনে নাই/ যদি বলো হাত পাতি, পয়সা কিছু চাই/ বলবে সালাম, করবে পালাই পালাই। শিক্ষা- অপ্রয়োজনীয় মানুষের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখার জন্য নির্দোষ কিছু কৌশল অবলম্বন করা কর্তব্য, বিশেষত যখন কাজে বিঘ্ন ঘটে এবং অযথা সময় নষ্ট হয়। *** এক যুবক আলিম, দিলে তার বহু পেরেশানি, পিতাকে বললেন ছুয়ে তার পা-খানি, বয়ানীদের এত রঙদার বয়ানে, কোন আছর হয় না আমার মনে। কারণ কথায় যত জৌলুস কর্মে তাদের তত কলুষ। কথায়-কাজে যদি না থাকে মিল, অভক্তিতে ভরে যায় দিল। কবিতা- বলো ধর্মের কথা, দুনিয়ার করো নিন্দা/ দাওয়াতি খানায় চাহিদা শুধু ভুনা পরিন্দা/ মানুষের তরে বয়ান, ‘যত পারো করো দান’/ নিজে জমাও সোনা-চাঁদি, ঘর আলিশান/ কথা যদি হয় শুধু মুখে, কিছু নাই অন্তরে/ হোক যত মিষ্টি-মধুর যাবে না কিছু অন্দরে/ আলিম করে না কারো নিন্দা কভু/ নিজে করে যা পরেরে তাই বলে শুধু। যেমন আলকোরআনে বলা হয়েছে, তোমরা মানুষকে আদেশ করো, অথচ নিজেদের বিষয় ভুলে যাও। কবিতা- আলিম যদি মজে থাকে ভোগে আর দেহ-সুখে/ ভ্রষ্ট সে যে, পথের দিশা দেবে কী মুখে মুখে! পিতা ছিলেন জ্ঞানী ও গুণী। বললেন, তোমার মুখে একি শুনি! হে পুত্র, এ তোমার চিন্তার ভুল! একারণে করো না কারো নছিহত না-কবুল। দ্বীনের আলিম যারা তাদের যদি বলো ভ্রষ্ট, আর খুঁজে বেড়াও নিষ্পাপ আলিম, জীবন হবে নষ্ট। ইলমের ফায়দা থেকে তুমি হবে বঞ্চিত, আর মানুষের সামনে হবে শুধু লজ্জিত। যেমন সেই অন্ধ, দৃষ্টি যার বন্ধ; একদিন রাতে কাদা-পথে হলো তার বড় দুর্গতি। ফরিয়াদ করে বললো, কেউ ধরো না পথে একটু বাতি! মুখরা এক নারী, শুনে মজা পেলো ভারি, বললো হেসে ওরে ও অন্ধ, আকলের দুয়ার করেছো কি বন্ধ! তুমি তো দেখতে পাও না বাতি, বাতির আলোতে তবে দেখবে কি হাতি! যে কারো উপদেশেই পাবে তুমি গোনাহ থেকে মুক্তি, দিলে তোমার উপদেশের প্রতি থাকে যদি ভক্তি। উলঙ্গ মানুষ তোমাকে দেয় যদি কাপড়, তাতে কি ঢাকা হবে না তোমার সতর! কবিতা- আলিমের কথা শোনো দিলের কানে, ভেবো না ফেলনা/ কাজে আর কথায় করুক শত ধোকা-ছলনা/ ঘুম থেকে জাগাতে পারে কে নিজে ঘুমিয়ে থেকে/ বলে যারা, ভুল বলে, ঝেড়ে ফেলো তা মন থেকে/ জ্ঞানী যারা রাখে তারা এই কথা খেয়ালে/ জ্ঞান-বচন লুফে নাও যেথা পাও, হোক লেখা দেয়ালে। খানকার সুফী সাধনার ব্রত ত্যাগিয়া/ বসিলেন মাদরাসার অঙ্গনে আসিয়া/ পুছিনু তারে কী ফরক বলো দুইয়ে মাঝে?/ ঐ সঙ্গ ছাড়ি এখানে আছো পড়ি কী বুঝে/ কহিল, সুফী, হলে নৌকাডুবি, ভাবে কম্বলখানি/ আলিম ভাবে, সবার যেন বাঁচে প্রাণখানি। শিক্ষা- আলিমের মধ্যে কোন ত্রুটি দেখলে তা এড়িয়ে যাওয়া উচিত, কারণ তিনিও তো মানুষ। আলিমের বিচ্যুতির কারণে তার ইলম ও উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া উচিত নয়। কেউ যদি পথে বাতি ধরে দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে তুমি কি সে আলোতে পথ চলবে না শুধু এজন্য যে, বাতিওয়ালা অন্ধ! বাতিওয়ালা অন্ধ হোক বা চক্ষুষ্মান আমাদের কাজ হলো বাতি থেকে আলো গ্রহণ করা। *** এক নেশাখোর, পথের মোড়ে পড়েছিলো বেঘোর। এক দরবেশ দেখে এই পরিবেশ, গালমন্দ করলেন বেশ। নেশাখোর মাথা তুলে তাকিয়ে, করলো নিবেদন সবিনয়ে, হুযূর, কোরআন থেকে কেন সুদূর! কোরআন তো বলে, নেককার যারা, মন্দের পাশ দিয়ে যায় তারা, ভদ্রতা হয় না ছাড়া। কাউকে যখন দেখো, পাপে পঙ্কিল, হও তার আবরণ, হও সহনশীল। কেন করো আমার নিন্দাবাদ ও মুণ্ডুপাত! যাও না পার হয়ে যেমন যায় অভিজাত! কবিতা- সাধু, ধন্য তব সাধুতা, পাপীরে তবু করো না ঘৃণা/ অসহায় ভেবে করো তারে উদ্ধার, করো করুণা/ পাপের পাঁকে পড়িয়া আমি না হয় হইনু দুর্জন/ তুমি সাধু মোরে দয়া করে হও না কেন সুজন। শিক্ষা- পাপকে ঘৃণা করা উচিত, পাপীকে নয়। পাপীর প্রতি বরং হওয়া উচিত সহানুভূতিশীল।
Sunday, June 12, 2011
মুফতি নজরুর ইসলাম (মাঃজিঃআঃ)এর বয়ান
মাদ্রাসার মেহনতে আগামী ২৮/০৫/২০১১ ফরিদপুর ও গোপালগঞ্জ এর উদ্দ্যেশ্যে ১০ দিনের সফরে বিশেষ মওকায় বয়ান ধারাবাহিক ভাবে আপলোড করা হচ্ছে মুফতি নজরুল ইসলাম সাহেবের পেইজে।
বিনামূল্যে ডাউনলোড করতে পারবেন আথবা ওয়েব থেকে শুনতে পারবেন।
বিনামূল্যে ডাউনলোড করতে পারবেন আথবা ওয়েব থেকে শুনতে পারবেন।
Friday, June 10, 2011
পড়ালেখা
পরীক্ষা পাশের সাফল্য কথা
মাওলানা আতাউর রহমান
রু টিনের মাধ্যমে সময় কাজে লাগানো
ভাল ফলাফল করতে হলে সারাবছর সময় অত্যন্ত পরিক-িতভাবে কাজে লাগাতে হবে। অপরিক-িত অনেক পরিশ্রমে সফলতা অর্জিত হয় না। বিশেষভাবে পরীক্ষাপূর্ব প্রস্তুতির সময় সুচিন্তিতভাবে একটি রু টিন তৈরি করে নিতে হবে এবং সে অনুযায়ী সময় কাজে লাগাতে হবে। রু টিনটি পড়ার সময় ও পঠিতব্য বিষয়গুলোর পরিমানের মাঝে সামাঞ্জস্য বজায় রেখে তৈরি করতে হবে। যাতে করে কোনো একটি কিতাব বা বিষয় পড়তে পড়তেই সময় শেষ না হয়ে যায়। দরস চলাকালীন সময় ও দরসের ফাঁকে ফাঁকে বহু সময় পাওয়া যায়। সে সময়ও কোনো একটি কিতাবের প্রস্তুতির জন্য কাজে লাগাতে হবে। কমপক্ষে ভালো ফলাফল প্রত্যাশী একজন সচেতন ছাত্রের ক্ষেত্রে তা অবশ্যই কাম্য।
মূলকিতাব সামনে রেখে পড়া
পরীক্ষার পূর্বপ্রস্তুতির সময় অনেক ছাত্র শুধু শরাহ-শুরু হাত ইত্যাদি দেখে পড়ে থাকে। বিশেষত উপরের ক্লাশগুলোতে এ সমস্যা বেশি । এতে মূল কিতাব হতে বিষয়টি ভালোভাবে উপলব্ধি না করার কারণে প্রশ্নের ঢঙ সামান্য পরিবর্তন হলেই নোটনির্ভর ছাত্ররা উত্তর দিতে তালগোল পাকিয়ে ফেলে। তাই অবশ্যই মূল কিতাব থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে শরাহ -শরু হাতের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। তবে তা মূল কিতাব বাদ দিয়ে কখনোই নয়।
গুরু ত্বপূর্ণ বিষয় নোট
প্রস্তুতির সময় গুরু ত্বপূর্ণ অথচ খুঁজে বের করতে হয় এমন বিষয়সমূহের অবশ্যই নোট করতে হবে। যাতে একই বিষয় বারবার খুঁজতে গিয়ে সময় নষ্ট না হয়।
সারসংক্ষেপ বের করা
আমাদের কওমি মাদরাসার কিতাবসমূহ যেহেতু অধিকাংশই প্রাচীনধারায় লিখিত তাই এ সকল কিতাবে অনেক ক্ষেত্রে আলোচ্য বিষয়টি বিন্যস্ত ও পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে না। এজন্য কোনো বিষয় পড়ার পর অবশ্যই তার সারসংক্ষেপ ও মোটকথা চিন্তা করে অত্মস্থ করে নিতে হবে। প্রয়োজনে খাতায় নোট লিখে রাখতে হবে।
শের বা কবিতার ক্ষেত্রে
মাঝে মাঝে উদাহরণ দিতে গিয়ে কিতাবের মধ্যে শের এসে যায়, সেক্ষেত্রে পাঁচটি বিষয় জেনে নিলে ভালো হয়।
১. শব্দের তাহকিক ২. পূর্ণ শের-এর অনুবাদ ও র্মম ৩. মহল্লে ইসতেশহাদ তথা যার মাধ্যে উদাহরণ দেওয়া হয়েছে ৪. মিসাল ও মুমাসসাল এর সামাঞ্জস্যতা ৫. শায়ের বা কবির নাম।
নাহু-সরফের ক্ষেত্রে
নাহু-সরফের কিতাবের ক্ষেত্রে মূল বিষয়টি বুঝে কিতাবে প্রদত্ত্ব উদাহরণের বাইরেও প্রচুর উদাহরণ তৈরি করা আবশ্যক। এতে মূল বিষয়ের বুৎপত্তি অর্জিত হয়। নির্ধরিতসময়ে পঠিত বিষয়ে ইজরা বা নিজেরা পর্যালোচনা করা উচিত।
পরীক্ষার ভাষা
কোন ভাষায় পরীক্ষা দিবে, তা আগেই ঠিক করে নির্ধারণ করা উচিত। যাতে পরীক্ষা জন্য প্রস্তুতি নেয়ার সময় সে হিসেবে প্রস্তুতি নেয়া যায়। পরীক্ষার জন্য ঐ ভাষাটিই নিধারণ করা উচিত, যে ভাষায় সে স্বাু ছ্যন্দে উত্তর লিখতে পরে। অনেকে কোন পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই হঠাৎ আরবিতে উত্তর দিতে গিয়ে মূল বক্তব্য লিখতে পারে না, ফলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়। এজন্য বেফাক পরীক্ষায় আরবিতে উত্তর দিতে হলে পূর্ব থেকে অভ্যাস করতে হবে।
বাংলায় যারা উত্তর লিখি শুদ্ধবানান, বাক্যবিন্যাস,বাক্যসংযমতার প্রতি লক্ষ্য রাখতে।
বিগত সময়ের প্রশ্নপত্র সামনে রাখা
প্রস্তুতির সময় বিগত সময়ের প্রশ্নপত্র সামনে রাখলে অনেক উপকার পাওয়া যায় এবং পরীক্ষার ধরণ সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ হয়। পূর্ববর্তী প্রশ্নসমূহের উত্তর লিখে অনুশীলন করা সম্ভব হলে তা অনেক উপকারি। সম্ভব না হলে কমপক্ষে সমস্ত প্রশ্নের উত্তরগুলো জেনে নেয়া আবশ্যক।
রাত জেগে পড়াশোনায় সর্তকতা
অনেকে পরীক্ষার পূর্বে প্রস্তুরি সময় অধিক রাত্রি জাগরণ করে অসুস্থ হয়ে পড়ে, অবশেষে পরীক্ষাই দিতে পারে না। এমন করা উচিত নয়। তাই প্রস্তুতির সময় স্বাস্থ্য, ঘুম ও খাওয়া-দাওয়ার প্রতি যত্মশীল হওয়াও আবশ্যক।
আত্মপ্রত্যয়ী হওয়া
অনেকের মধ্যে একধরনের হীনমন্যতা বিরাজমান থাকে। যেমন কেউ মনে করে আমার মতো দূর্বল ছাত্র কি করে ভালো ফলাফল করবে? এ ধরনের হীনমন্যতা ভালো ফলাফলের প্রধানঅন্তরায়। এ হীনমান্যতা পরিহার করে আত্মপ্রত্যয়ী হওয়া আবশ্যক। অন্যরা পারলে আমিও পারবো ইনশাআল্লাহ ।
এমন দৃঢ়প্রত্যয় ও নিরলশ প্রচেষ্টার যেখানে সম্বনয় ঘটবে, সফলতা সেখানে পদচুম্বন করবে।
পরীক্ষার সরঞ্জামাদি সংগ্রহ
পরীক্ষার হলে প্রবেশের বেশ আগেই পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণাদি সংগ্রহ করে রাখবে। না হয় পরীক্ষার হলে প্রবেশের আগ মুহূর্তে মারাত্মক টেনশনে পড়তে হয়। কমপক্ষে দু’টি ভালোকলম, একটি সাইনপেন (লাল রঙ ব্যতীত) একটি কারেকশন পেন, একটি স্কয়ার স্কেল, একটি বোর্ড ও প্রয়োজন হলে লাইন সোজা করার জন্য মার্জিন করা একটি কাগজ আগে থেকেই সংগ্রহ করে রাখবে। পরীক্ষার হলে লিখার জন্য একেবারে নতুনকলম ব্যবহার করা ঠিক নয়। কেননা নতুনকলম চালু ও সাবলীল হতে কিছুটা সময় লাগে তাই আগে থেকে লিখে কলম চালু ও সাবলীল করে নিবে। পরীক্ষার হলে অন্যের স্কেল ইত্যাদি নিয়ে টানাটানি করা খুবই বিশ্রি ও বিরক্তিকর কাজ। সকলেরই উচিত নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে আসা।
প্রবেশপত্র
পরীক্ষার হলে যাওয়ার জন্য রু ম ত্যাগ করার সময় বিশেষভাবে খেয়াল করে প্রবেশপত্র নিয়ে নিতে হবে। অনেকে তাড়াহুড়া করতে গিয়ে প্রবেশপত্র নিতে ভুলে যায়। শেষে নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এজন্য সবচেয়ে উত্তম পন্থা প্রবেশপত্র হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা লেমেনেটিং করে স্কটেপ দিয়ে বোর্ডের পিছনে লাগিয়ে নেয়া। এক্ষেত্রে বোর্ডটি খুবই যত্মসহকারে সংরক্ষণ করতে হবে যাতে তা হারিয়ে না যায়। মনে রাখবে, সমস্ত পরীক্ষা সমাপ্ত হয়ে যাওয়ার পরও প্রবেশপত্রটি সংরক্ষণ করা আবশ্যক। কেননা বেফাক থেকে নাম্বারপত্র ইত্যাদির প্রয়োজনে প্রবেশপত্রের দরকার হয়।
অজু-এস্তেঞ্জা করে ধীরস্থিরবাবে পরীক্ষা কেন্দ্রে গমন
অনেকে হলে প্রবেশের একেবারে পূর্বপর্যন্ত কিতাব নিয়ে এতোটা ব্যবস্ত থাকে যে, ওজু এস্তেঞ্জা পর্যন্ত করে না। পরে হলে যেয়ে বাথরু মে যাওয়ার প্রয়োজন হয় , এতে বহুসময় নষ্ট হয়। তাছাড়া তাড়াহুড়া করে কলম, প্রবেশপত্র ইত্যাদি ফেলে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হতে হয়। তাই এমন না করে আগে থেকেই পরিস্কার-পরিু ছন্ন হয়ে অজু-এস্তেঞ্জা সেরে সবকিছু ঠিকঠাক করে নির্ধারিত সময়ের কিছুক্ষণ পূর্বেই পরীক্ষার হলে উপস্থিত হবে। প্রথমপরীক্ষার দিন একটু আগেই যেতে হবে। কেননা প্রথম দিন সিট খুঁজে বের করতে অনেকটা সময় লেগে যায়।
প্রশ্নপত্র হাতে পাওয়ার পর
প্রশ্নপত্র হাতে পাওয়ার মাত্রই লেখা শুরু করে দিবে না বরং প্রশ্নপত্রটি ভালোভাবে পড়বে। কোথাও অস্পষ্ট বা ভুল থাকলে বা বুঝতে না পারলে উপস্থিত হলপরিদর্শক থেকে বুঝে নিবে। তবে এর পেছনে বেশি সময় ব্যয় করা যাবে না।
দোয়া পড়ে লেখা শুরু করা
লেখা শুরু করার পূর্বে স্ব-সময়ের মধ্যে কিছু দোয়া পড়ে আল্লাহর সাহায্য কামনা করে নেবে। এতে বরকত হবে। যেমন : দরূদ শরীফ ‘রব্বী যিদনী ইলমা, রব্বীশরাহলী সদরী.... এই আয়াতগুলো পড়ে তিনবার ও ‘আল্লাহুম্মা আল্লীমনী মা জাহিলতু ও যাকরনী মা নাসিতু’ এ দোয়াটি পড়ে বিসমিল্লাহ বলে লেখা আরম্ভ করবে।
রোল নম্বার সঠিকভাবে লেখা
মনে রাখবে তোমার পরীক্ষার খাতাটিই নম্বার প্রাপ্তির জন্য সবচেয়ে গুরু ত্বপূর্ণ। পরীক্ষার শুরু তেই খাতার প্রথম পাতায় রোল নম্বার, মারহালা, বিষয় ইত্যাদির ঘরগুলো নির্ভুলভাবে পূরণ করে নিতে হবে। পরে লেখার জন্য এ কাজ কোনো ক্রমেই বাকি রাখা যাবে না। প্রশ্নের উত্তরগুলো পরিু ছন্নভাবে সাজিয়ে-ঘুছিয়ে খাতায় উপস্থাপন করতে হবে।
প্রশ্ননির্বাচন
কোন প্রশ্নের উত্তর লিখলে আর কোন প্রশ্নটা বাদ দিলে সুবিধা হবে, তা বাছাইয়ের কাজটি সঠিকভাবে করা জরু রি। সাধারণত যে সব প্রশ্নের উত্তর লিখলে পূর্ণ নম্বার পাওয়া যায় জানা থাকলে সে ধরণের প্রশ্নের উত্তর দেয়া ভালো। একই ধরণের প্রশ্ন হলে যেটির উত্তর অপেক্ষাকৃত ভালোভাবে জানা আছে প্রথমে সেটি লিখবে। তবে সাবধান হওয়া দরকার বে-খেয়ালে কোন প্রশ্ন বাকি রইলো কি না অথাব প্রশ্নের ভেতরের ছোট অংশগুলোর উত্তর দেয়া হলো কি না, লিখা শেষ করে তা অবশ্যই যাচাই করবে।
সুন্দর হাতের লেখা
হাতের লেখা সুন্দর ও স্পষ্ট হওয়া উচিত। ভালো ফলাফলের জন্য সুন্দর হাতের লেখা অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করে। শব্দের এবং লাইনের মাঝে প্রয়োজনীয় ফাঁক রেখে পরিু ছন্ন ও স্পষ্ট করে লিখতে হবে যাতে সহজে পড়া যায়। খুব ছোট ও হিজিবিজি করে লেখবে না। কোন শব্দ, লাইন বা অনুুে ছদ কেটে দিতে হলে পরিস্কার করে কাটবে হিজিবিজি করে নয়। ভুল শব্দ বা বাক্যাংশের উপর পুনরায় লিখে সংশোধন করা ঠিক নয় বরং এক্ষেত্রে উপরে বা পাশে সঠিক শব্দ বসাতে হবে। এককথায় খাতাটি খুলতেই যেনো পরিক্ষকের মনভরে যায় । এক নি:শ্বাসেই যেনো খাতাটি তিনি পড়ে ফেলতে পারেন। সুন্দর লেখা ও আকষর্ণীয় উপস্থাপনায় জন্য বরাদ্দকৃত চার নাম্বার তখন আশা করা যায়।
সময়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা
কোন প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য কতোটুকু সময় লাগতে পারে সে হিসাব আগে থেকেই করে নেবে। এমন যাতে না হয় যে বেশি বা ভাল জানা আছে বলে কোনো একটি পশ্নের উত্তর খুব দীর্ঘ করে লিখতে গিয়ে অনেক বেশি সময় খরচ করে ফেললে, পরে সময় স্ব-তার কারণে দু’একটি প্রশ্নের উত্তরই দিতে পারলে না বা কোনো রকম দায়সারাভাবে দিলে। এতে বেশ ক্ষতি হবে। কেননা বেশি সময় ধরে লিখে কোন প্রশ্নের দুই এক নম্বর বাড়তি জুটলেও সময়ের অভাবে অন্য প্রশ্নে দশ-পনের নম্বার নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
প্রশ্নের নম্বর সঠিকভাবে লিখা
কতো নম্বর প্রশ্নের কোন অংশের উত্তর লিখছ তা সুষ্পষ্টভাবে খাতায় স্বাভাবিক লেখার চেয়ে সামান্য বড় করে লিখবে। যেনো সহজেই তা পরীক্ষক বুঝতে পারেন। পৃথক প্রশ্নের উত্তর পৃথক অনুুে ছদে লেখা উচিত। এমনকি একই প্রশ্নের ক. খ. ইত্যাদি অংশগুলোও পৃথক অনুুে ছদে ছোট শিরোনাম দিয়ে লেখা উচিত। তবে পরীক্ষার খাতায় অযথা আর্ট ও ডিজাইন করতে যাবে না এতে অনেক সময় নষ্ট হয়।
বিশুদ্ধ ও সঠিক বানান
উত্তর পত্রের লেখাগুলোর বানান নির্ভুল হওয়া বাঞ্চণীয়। এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক। বানান যারা ভালো জানে তারাও হঠাৎ ভুল করে ফেলে। কাজেই সতর্কতা জরু রি। যে সব বানান সচরাচর ভুল হয় সেগুলো অনুশীলন করা দরকার। প্রশিদ্ধ ও পরিচিত নামের বানান যেন ঠিক থাকে। বিশেষ করে আরবি উর্দূ শব্দের বানান অনেকেই হাস্যকর রকম ভুল করে থাকে।
কোনো কিছু যেনো বাদ না যায়
কোনো প্রশ্নের উত্তর ছেড়ে আসবে না। না পারলেও যতোটা সম্ভব চেষ্টা করে লেখে আসবে। পূর্ণ না লিখতে পারলেও যতোটা সম্ভব লিখলে কিছু নাম্বার তো পাওয়া যাবে। লক্ষ্য রাখবে একই প্রশ্নের মধ্যে নানা অংশ থাকে। তার কোন অংশ যেনো বাদ না যায়। দশটা শব্দার্থ লিখতে বললে ভুলে আটটা লিখে চলে আসবে না।
সতর্কতা
ঠান্ডা মাথায় ধীরস্থিরভাবে লিখবে ও লেখার ক্ষেত্রে পূর্ণ সতর্কতা ও সজাগ দৃষ্টি আবশ্যক। বিশেষ করে অংক ও ইতিহাস সংক্রান্ত তারিখ ইত্যাদির ক্ষেত্রে বে-খেয়াল হলেই মারাত্মক ভুল হয়ে নম্বার কাটা যাওয়ার প্রবল সম্ভবনা থাকে।
পৃষ্ঠা নম্বার লাগানো
উত্তরপত্রে পৃষ্টা নাম্বার লাগানো খুবই দরকার। বিশেষ করে লুজ (অতিরিক্ত কাগজ) নিলে অবশ্যই পৃষ্ঠা নম্বার দিয়ে তারপর লেখবে। অন্যথায় পরীক্ষার শেষে পিন লাগাতে গিয়ে পৃষ্ঠা মিলাতে বহু ঝামেলা পোহাতে হবে ও সময় নষ্ট হবে।
পিনাপ যথাযথভাবে করা
খাতা পিন করার ক্ষেত্রে লক্ষ রাখবে যেনো লেখার কোনো অংশ পিনের কারণে এমনভাবে আটকে না যায় যে, তা আর পড়া যাবে না। একজন্য লেখা শুরু করার আগেই পৃষ্ঠার চতুর্পাশে পর্যাপ্ত স্পেস রেখে মার্জিন করে নেয়া উচিত। যাতে পিন লাগালে সমস্যা না হয়।
রাফ করে নিবে
কোনো কোনো পরীক্ষায় রাফ করার প্রয়োজন দেখা দেয়। বিশেষ করে অংক পরীক্ষায়। সেক্ষেত্রে পরীক্ষার খাতাতেই রাফ করবে এবং সঠিকভাবে তোলার পর দুটো দাগ টেনে কেটে দেবে। অনেক ছাত্রকেই প্রশ্নপত্রের ফাকা অংশে রাফ করতে দেখা যায়। এটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এমন করলে অনেক সময় নকলের ধারণায় পরীক্ষক খাতা বাতিল করে দিতে পারেন। তাই যখনই রাফ করবে তা খাতাতেই করবে এবং পরিস্কারভাবে কেটে দিবে।
নজরে সানী বা রিভিশন দেয়া
উত্তর লেখা শেষ করে পূর্ণখাতা রিভিশন দিতে পারলে খুবই ভালো হয়। রিভিশন এভাবে দিবে যে, প্রথমেই দেখবে খাতার প্রথম পৃষ্ঠায় রোল নম্বার, মারহালা ইত্যাদি যথাযথভাবে লেখা হয়েছে কি না। এরপর ধীরস্থিরভাবে দেখবে যেসব প্রশ্নের ক. খ. ইত্যাদি সকল অংশের উত্তর লেখা হয়েছে কি না এবং প্রশ্ন নম্বর ও ক. খ. ইত্যাদি যথাযথভাবে লাগানো হয়েছে কি না। এরপর পূর্ণখাতা ভালভাবে রিভিশন দিবে। ভুল থাকলে ঠিক করে নিবে।
টেনশন করবে না
এবার বলছি সবচেয়ে গুরু ত্বপূর্ণ কথা। ঘাবড়ে না গিয়ে টেনশন না করে শান্তভাবে পরীক্ষা দেবে। তা না হলে জানা ও ভালোভাবে পড়া প্রশ্নের উত্তরও তালগোল পাকিয়ে যেতে পারে। এজন্য পরীক্ষার আগের রাত্রে খুব বেশি রাত্রি জাগরণ উচিত নয়। কেননা এতে পরীক্ষার হলে তন্দ্রাভাব ও ঘুমের চাপ সৃষ্টির দরু ন মাথাব্যাথা, সঠিকভাবে কাজ না করাসহ অনেক রকম সমস্যা থাকে। উপরন্ত লেখাও ভাল হয় না। দরস বা ক্লাস চলাকালীন সময়ে মনোযোগসহ লেখাপড়া করার পর একজন পরীক্ষার্থী যদি উপরোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ রাখে তাহলে পরীক্ষায় শতভাগ সাফল্যের আশা করা যায়। আল্লাহ তা’য়ালা সকলের সহায় হোক।
বিষয় হাতের লেখা
আবুল কালাম আনছারী যাত্রাবাড়ি মাদরাসা ঢাকা
মাওলানা আবু বকর সাদী , শিক্ষাসচিব দারু ল উলুম দিলু রোড ঢাকা
কওমি মাদরাসার পরীক্ষার্থী বন্ধুরা! তোমাদের পরীক্ষার আর বেশি দিন বাকি নেই। তোমরা এখন বছরের শেষ প্রান্তে। পরীক্ষার প্রস্তুতি অবশ্যই নিুে ছা। দরসের চাপ তুলনামূলক এখন অনেক বেশি।
বন্ধুরা! তোমরা যারা দাওরায়ে হাদিস পড়ছো, তাদের অনেকেরই হয়তো একাডেমিক পড়াশোনার দরজায় খিড়কি আঁটতে যাুে ছ। পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই চলে যাবে কোনো কর্মস্থলে। সে অর্থে এটা তোমাদের একাডেমিক জীবনের শেষ পরীক্ষা। আরা যারা সামনে গবেষণাধর্মী পড়াশোনায় আগ্রহী বা নিচের শ্রেণীগুলোতে পড়ো, তাদের টার্গেট তো আরো ব্যাপক। সে জন্য প্রস্তুতিটাও হতে হবে নিখুঁত-সুন্দর। কীভাবে পড়ালেখা করলে তোমরা নির্বিঘেœ কাঙ্খিত মান ও অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে সেদিকে যথেষ্ট খেয়াল রাখতে হবে এবং এখন থেকেই। কারণ সব বিষয়ের ওপর ভালো ফলাফলের নিশ্চয়ই আশা করছো। আমরাও চাই তোমরা ভালো করো।
বন্ধুরা! পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের পেছনে হাতের লেখার গুরু ত্ব অপরিসীম। অনেকেই কিতাব বুঝে বেশ ভালো। কিন্তু লেখতে গেলে তা সুন্দরভাবে সাজিয়ে লেখতে পারে না, বা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লেখার মান বজায় রাখতে পারে না। আবার কারো লেখা খুবই ধীরগতি। নির্ধারিত সময়ে লিখে শেষ করতে পারো না। সে জন্যও পরীক্ষায় নম্বর কম পেয়ে থাকে। এ মুহূর্তে তোমাদের বেসিক হাতের লেখা সুন্দর করতে পারছো না। এক পলকে লেখা দেখে পরীক্ষকের সন্তুষ্টিই যথেষ্ট। আর এজন্য নিুের টিপসগুলো জানা থাকলে পরীক্ষকের অজান্তেই তোমাদের নম্বার বেশি হতে পারে।
> লেখা যেনো খুব ছোট বা অত্যন্ত বড় না হয়। এজন্য প্রতি পৃষ্ঠায় লেখার সাইজ অনুযায়ী ১৬-১৮ লাইন লিখবে।
> বর্ণ ঘন শব্দ ফাঁক রাখবে।
> শব্দ থেকে শব্দের মাঝে ২-৩ বর্ণ সমপরিমাণ ফাঁক রাখবে।
> এক লাইন থেকে অন্য লাইনের মাঝে আধা ইঞ্চি অথবা এক অঙ্গুল ফাঁকা রাখবে।
> প্যারা থেকে প্যারার মাঝে অর্ধ ইঞ্চি অথবা এক লাইন সমপরিমাণ ফাঁকা রাখবে।
> চুতুর দিকে ১ ইঞ্চি পরিমাণ মার্জিন রাখতে হবে।
> উত্তর লেখার সময় তুলনামূলক সহজ প্রশ্নটি আগে লিখবে।
> লেখার পর যদি ভুল বুঝতে পারো, তাহলে একটানে কেটে দেবে।
> প্রয়োজন হলে পূনরায় শুদ্ধ করে উপরে লিখে দেবে।
> অনেকের হাত তুলনামূলক বেশি ঘামায় ফলে কলম পিুি ছল হয়ে যায়। এ কারণে তোমরা লেখা দ্রু ত ও সুন্দর হয় না। এমনকি তোমার ভেজা হাতের কারণে খাতা নষ্ট হতে পারে। এমন পরীক্ষার্থী দুটি শুকনো রু মাল রাখবে। প্রয়োজনে রাবারযুক্ত কলম ব্যবহার করবে।
> কলম খুব শক্ত করে ধরে লিখবে না। এতে অ- সময়েই তোমার হাত ব্যথা করতে পারে।
> তোমার উদ্দিষ্ঠ উত্তরটা যদি ভালো মুখস্থ আত্মস্থ থাকে তাহলে তোমার লেখাও অতিদ্রু ত হবে।
> অনেকের শেষের দিকের লেখা বেশি খারাপ হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে সব পৃষ্ঠার লেখার মান একই রকম রাখতে চাইলে তোমার লেখার গতি দ্রু ত হওয়া উচিত। খুব দ্রু ত বা অতি আস্তে না লিখে সঠিক গতি বজায় রাখবে। অ- লিখে পৃষ্টা সংখ্যা বাড়ানোর প্রবণতা মোটেই কাম্য নয়। কিন্তু এটা যাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে তারা শব্দ থেকে শব্দ লাইন থেকে লাইন ও প্যারা থেকে প্যারায় উল্লেখিত নিয়ম থেকে একটু বেশি ফাঁকা দিতে পারো।
> লেখাগুলো পরিু ছন্ন, স্পষ্ট ও স্বু ছ রাখতে সচেষ্ট থাকবে।
> মনে রাখবে তুমি যা লিখছ সেটি যদি ভালো মুখস্থ থাকে তাহলে তোমার লেখার গতি দ্রু ত ও সুন্দর হবে এবং পরীক্ষকের অজান্তেই নম্বর বেশি পেতে পারো।
পরীক্ষায় কলমের সঠিক ব্যবহার
এ প্রসঙ্গে পরীক্ষার্থী বুন্ধদেরকে আমি বলবো
> কলমের কালি যেনো অবশ্যই গাঢ় ও কালো হয় সে বিষয়ে বিশেষভাবে খেয়াল রাখবে।
> কলমটি যদি বলপেন হয়, তাহলে আংশিক ব্যবহৃত হলে সবচেয়ে ভালো। কারণ, বলপেন আংশিক ব্যবহাহিৃত হওয়ার পর এর কালি গাঢ় হতে থাকে।
> কালি গাঢ় ও কালোর জন্য মনটেক্স এ জাতীয় কলমের জুড়ি নেই বললেই চলে।
> হলরু মে একাধিক কলাম রাখাতে পারলে ভালো। কারণ কোন কলম সমস্যা দিয়ে যেনো সাথে সাথেই যেনো বিক- ব্যবস্থা থাকে।
> কলমের ব্যবহারের এক্ষেত্রে প্রত্যেকেই যে কলম ব্যবহার করে অভ্যস্থ তার সে কলম ব্যবহার করাই উচিত।
পরিশেষে তোমাদের সকলের পরীক্ষা ভালো হোক। সবাই কাঙ্খিত মান ও অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারো এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
পরীক্ষা শুরু র আগে
ইলিয়াস হাসান শিক্ষক ,খাদেমুল উলুম মিরপুর ঢাকা
> উপরের ক্লাসের ছাত্রদের জন্য প্রত্যেক কিতাবের শুরু থেকে নিয়ে পড়ে হল করা সম্ভব এমন একটা পরিমাণ নির্ধারণ করা।
> নির্ধারিত পরিমাণ অবশ্যই শেষ করা এবং এই পড়া থেকে একটা সংক্ষিপ্ত শিট প্রস্তুত করা যা পরীক্ষার দিন স্ব- সময়ে অনেক পড়ার কাজে দিবে।
> কিতাব পড়াকালীন পূরবর্তী বছরগুলোর প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করে তার উত্তর বের করা।
>কিতাবের গুরু ত্বপূর্ণ স্থানগুলো টুকে রাখা যেন এ স্থানগুলো একাধিকবার রিভাইজ দেওয়া যায়।
>৩/৪জন করে গ্রু প তৈরি তাদের সাথে প্রতিটি কিতাব আয়ত্ব করার কৌশল নিয়ে আলোচনা করা এবং পরিক-না করে দলবদ্ধভাবে পড়ালেখা করা।
> পূর্ববর্তী বছরের প্রশ্নপত্র দেখে উত্তর লেখার অনুশীলনী করা এবং সে অনুশীলনী খাতা ভালো কাউকে দেখানো।
>গ্রু প সদস্যের কাছে এক-দুদিন পর রু টিন ও পরিক-না অনুযায়ী পড়ালেখার তথ্য আদান প্রদান করা।
> মেশকাত শরিফের ক্ষেত্রে হাদিসের অনুবাদ আয়ত্ব করণে বিশেষ জোর দেওয়া। প্রয়োজনে কঠিন শব্দ ঠুকে নিয়ে হল করা।
>নামাজ, নাস্তা, ইস্তিঞ্জা ইত্যাদির ছুতায় অনেক সময় নষ্ট হয় এ বিষয়টিা খেয়াল রাখা।
পরীক্ষা চলাকালীন
>পরিক্ষার খাতা মার্জিন করে লেখা
> লাইন সোজা রাখা।
>উত্তরের পার্ট পার্ট ভাগ করে শিরোনাম ও উপশিরোনাম করে লেখা।
> যে প্রশ্নের উত্তরটা সহজ মনে হয় সেটা সবার আগে লিখা।
>প্রশ্নের উত্তরে লেখার ক্ষেত্রে সময় ভাগ করে নেওয়া। কোনটার উত্তর কতক্ষণে লেখা যাবে।
>উত্তর গোছানো ও পরিপাটি করে লেখা।
> বেশি রং চং করতে না যাওয়া ।
> এক প্রশ্নের উত্তরের ‘জুয’ বা অংশ অন্য প্রশ্নের সাথে যুক্ত না করা।
> লেখা পরিু ছন্ন ও সুন্দর এখন থেকে চেষ্টা করা।
তাকমিল জামাতের জন্য পরিকল্পিত পড়ালেখা
মুফতি আশরাফুজ্জামান
মানুষের জীবন সংক্ষিপ্ত কিন্তু কাজ অনেক বেশি। এজন্য উপরের জামাতের নেসাব কিছুটা দীর্ঘ রাখা হয়েছে। তাই এসব জামাতের ছাত্রদেরকে বছরের শুরু থেকে হিসাব করে পড়ালেখা করা উচিত।
তাকমিল জামাত বেফাক বোর্ডের পরীক্ষার সর্বোু চ জামাত। এ জামাতের নেসাব যেমন দীর্ঘ, সে তুলনায় পরীক্ষার প্রস্তুতিমূলক পড়ালেখার সময়-সুযোগ অনেক কম। যার ফলে পরীক্ষার পূর্বে সবক’টি কিতাব পূর্ণ শেষ করে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য তাকমিল জামাতের ছাত্রদের ভাল ফলাফল করতে পরিক-িত নিয়ম-মাফিক পড়ালেখা করা অতি জরু রি।
সকল কিতাব সামনে রেখে প্রত্যেক কিতাবের পড়ার মতো বিষয়গুলো প্রথমে তিন ভাগে ভাগ করতে হবে।
১। প্রত্যেক কিতাবের গুরু ত্বপূর্ণ স্থানগুলো চিহ্নিত করতে হবে।
২। যে বিষয়গুলো একাধিক কিতাবে রয়েছে তা নির্ধারণ করতে হবে।
৩। প্রত্যেক কিতাবে কিছু স্বতন্ত্র বিষয় রয়েছে তা চিহ্নিত করতে হবে।
প্রথম প্রস্তুতি
১। গুরু ত্বপূর্ণ স্থানগুলো নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো শফিক উস্তাদের পরামর্শ নিবে। এছাড়া বেফাকের প্রশ্নপ্রত্র দেখেও নির্ধারণ করা যেতে পারে। অত:পর গুরু ত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তালিকাভুক্ত করার পর যে বিষয়গুলো অতি গুরু ত্বপূর্ণ মনে হয় তা বিশেষ চিহ্নে চিহ্নিত করতে হবে। যাতে পড়ার সময় উক্ত বিষয়গুলো অতিগুরু ত্বসহকারেই পড়া হয়।
২। যে বিষষগুলো একাধিক কিতাবে রয়েছে, তা কিতাবের সূচি সামনে রেখেই তালিকা করবে। যেমন, কিতাবু তাহারাতের মাসআলা প্রায় সব কিতাবেই রয়েছে। কিতাবুল বুয়ূ-এর মাসআলা বুখারি-১ মুসলিম-২ এর মাঝে উল্লেখযোগ্য বিষয়। তেমনি কিতাবুস সালাত, কিতাবুয যাকাত ও একাধিক কিতাবে রয়েছে। যে সব বিষয় একাধিক কিতাবে রয়েছে তার মাঝে গুরু ত্বপূর্ণ বিষয় হলো ইখতিলাফি মাসআলা।
ইখতিলাফি মাসআলা হল
ইখতিলাফি মাসআলা হল করার জন্য প্রত্যেক ছাত্রের করণীয় থাকবে প্রত্যেকটি মাসআলাকে পয়েন্ট ভিত্তিক জমা করা ইমামদের মাযহাব ও আকওয়াল এবং প্রত্যেকের দলিল ভালভাবে মুখস্ত করা।
সহযোগিতা
ইখতিলাফি মাসআলাগুলোকে হল করতে প্রথমে আরবি শরাহগুলোকেই গুরু ত্ব দেয়া। যেমন আওযাজুল মাসালিক এবং ইউসুফু বিননূরী রহ.-এর মাআরিফুস্ সুনান। যদি ‘আরবি শরাহ’ দেখা সম্ভব না হয়, তাহলে উর্দু শরাহ দেখবে যেমন দরসে তিরমিযি ও তানযিমুল আশতাত ইত্যাদি মুতাআলা করা। কেউ বাংলায় উত্তর দিলে বাংলা শরাহগুলো পড়া ও বাংলা উপস্থাপনা সাজানো-গুছানোর পদ্ধতি সেখান থেকেই আয়ত্ব করা। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় হলো সম্ভব হলে আকওয়াল ও দালায়েল নোট করবে। যাতে পরীক্ষার দিন অতি সহজেই নজরে সানি করা যায়।
স্বতন্ত্র বিষয়
প্রতিটি কিতাবেই কিছু স্বতন্ত্র বিষয় রয়েছে এগুলো আলাদা সময় নিয়ে ‘হল’ করতে হবে। যেমন: বুখারি-১ম খন্ডে কিতাবুল ওহি, কিতাবুল ঈমান, কিতাবুল ইলম-এর হাদিসগুলোর এ’রাব, তরজমা, তাশরিহ, তরজমাতুল বাব ও হাদিসের সঙ্গে তার মুনাসাবাত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বুখারির তরজমাতুল বাব, মুনাসাবাত ও কিতাবুল ওহি হল করার জন্য শায়খ যাকারিয়া রহ.-এর ‘আল আবওয়াব ওয়াত্বারাজিম’ খুবই উপকারী। বুখারি-২-এর মধ্যে স্বতন্ত্রভাবে পড়ার মতো বিষয়গুলো হলো ‘কিতাবুল মাগাজি’, ‘কিতাবুত তাফসির, এবং কলা বায়াজুন্নাস। এছাড়াও হাদিসের সাথে সংশ্লিষ্ট ঘটনা জানা থাকা আবশ্যক।
মুসলিম-১ এর জন্য ‘মুকাদ্দামায়ে মুসলিম’ আলাদাভাবে পড়তে হবে। এছাড়া অন্যান্য বাব যেমন ‘কিতাবুল ঈমান’ ইত্যাদি অন্য কিতাবের সাথে মিল রেখে পড়লে অনেকাংশে সহজ হবে।
উলুমূল হাদিসের পরীক্ষা পুরাটাই স্বতন্ত্র। কারণ এ ফনের ওপর দাওরায়ে হাদিসে স্বতন্ত্র কোনো কিতাব পড়ানো হয়না। সুতরাং উলুমূল হাদিসের পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য ‘নুখবাতুল ফিকার’ ও ‘তাইসিরু ল মুসতালাহিল হাদিস’ ইত্যাদির সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে।
আবু দাউদ শরিফে ‘কলা আবু দাউদ’ বিশেষ গুরু ত্ব দিয়ে হল করতে হবে। তিরমিযির মধ্যে বেশ কিছু জায়গায় ‘কল আবু ইসা’ রয়েছে এবং ইমাম তিরমিযি রহ.-এর বিশেষ বিশেষ ব্যাখ্যাও রয়েছে। এগুলো ভিন্নভাবে হল করতে হবে। সাথে সাথে ইমাম তিরমিযি রহ. এর স্বতন্ত্র ইসতিলাহাত হা’যা’ হাদিসুন সাহিহুন গারিবুন ইত্যাদির মতলব জানা থাকতে হবে। শামায়েলে তিরমিযির জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রস্তুতি লাগবে। এর বিষয়বস্তু অন্য কিতাবের সঙ্গে যেহেতু মিল নেই, তাই গুরু ত্বপূর্ণ স্থানগুলো চিহ্নিত করে কঠিন কঠিন শব্দগুলোর তাহকিকসহ পড়তে হবে। বিশেষ করে হযরত হিন্দা ইবনে আবি হালা রা.-এর দীর্ঘ হাদিসটি হল্লে লুগাতসহ পড়বে। এছাড়া সমস্ত হাদিসের তরজমা ও বিভিন্ন শব্দের মতলব অবশ্যই পড়তে হবে। ইবনে মাজাহ-এর মুশকিল হাদিসগুলোর এ’রাব ও তরজমা উভয়টি হল করতে হবে। তহাবি শরিফে নজরে তহাবি বিশেষ গুরু ত্বের সাথে হল করতে হবে। আর ইখতিলাফি মাসআলা অন্যান্য কিতাবের সাথে মিল রেখেই পড়বে। মুয়াতায়ে মুহাম্মদ ও মুয়াতায়ে মালিক থেকে বিষয়ভিত্তিক কিছু হাদিস মুখস্ত করবে।
বি:দ্র: ফিকহি মাসআলার ক্ষেত্রে ইমামগণের ভিন্ন ভিন্ন মতামত দলিল এবং তাদের দলিলের জবাবসহ নিজের মাজহাবের প্রাধান্যতার কারণগুলো বিশেষভাবে জেনে নিতে হবে।
রিভিশন
রিভিশন শুরু করার আগে পরীক্ষা পর্যন্ত কতো সময় হাতে আছে সে হিসাব কষতে হবে এবং কোন কিতাব কখন রিভিশন করতে হবে, সেই পরিক-না নিতে হবে। তারপর অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে রিভিশন শুরু করবে।
প্রথম রিভিশন
প্রথমে প্রত্যেক কিতাবের সববিষয় রিভিশন দিবে। তারপর গুরু ত্বপূর্ণ বিষয়গুলো রিভিশন দিবে। সম্ভব হলে চিহ্নিত করা অতি গুরু ত্বপূর্ণ বিষয়গুলো মুখস্ত লিখে অনুশীলন করবে। একাধিক কিতাবে যেসব বিষয় রয়েছে তা তালিকা অনুযায়ী রিভিশন দিবে। বিশেষ করে ইমামদের মতামত এবং দালায়েল ভালভাবে পূণরায় পড়বে। আর প্রত্যেক কিতাবের স্বতন্ত্র বিষয়গুলো রিভিশন করার সময় চিহ্নিত করে রাখবে। যাতে পরীক্ষার দিন অতি সহজেই পড়া যায়।
দ্বিতীয় রিভিশন
কিতাবের সববিষয় রিভিশন করার চেয়ে শুধু সারাংশ রিভিশন দিবে। এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখবে নতুন কোন বিষয় গুরু ত্বপূর্ণ মনে হলে তা অবশ্যই নোট করবে। যা পরীক্ষার দিন অনেক সহায়ক হবে বলে মনে হয়।
সর্বশেষ রিভিশন
সর্বশেষ রিভিশন করার সময় শুধু মৌলিক পয়েন্টসমূহ দেখাই যথেষ্ট। এক্ষেত্রে একা একা রিভিশন করার চেয়ে কোন ছাত্রের সাথে মিলে রিভিশন করা ভাল। এভাবে রিভিশন করলে একে অপরকে জিজ্ঞাসা করা যায় এবং পরস্পরের দুর্বলতা নির্ণয করা সহজ হয়।
বি: দ্র: অধিকগুরু ত্বপূর্ণ স্থানসমূহ ভালভাবে প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে কি না দ্বিতীয়বার নিজে নিজে যাচাই করা।
পরীক্ষার দিনগুলোতে পড়া-লেখা
পরীক্ষার দিনগুলোতে পরীক্ষার রু টিন মাথায় রেখেই পূর্ণ প্রস্তুতি নিতে হবে। রু টিন অনুযায়ী যে দিন যে কিতাবের পরীক্ষা প্রথমে ঐ কিতাবের গুরু ত্বপূর্ণ স্থানগুলো ভাল করে কয়েক বার পড়ে নিবে। অত:পর ঐ কিতাবের স্বতন্ত্র বিষয়গুলো মনযোগসহকারে পড়বে। সর্বশেষ যেসব বিষয়গুলো একাধিক কিতাবে রয়েছে তা তালিকা অনুযায়ী গুরু ত্বসহকারে পড়বে। বিশেষ করে ইখতেলাফি মাসআলা, ইমামদের মতামত ও দালায়েল পরীক্ষার হলে যাওয়ার পূর্বে সকাল বেলা অবশ্যই দ্বিতীয়বার দেখে যাবে।
সতর্কতা
পরীক্ষার আগের দিন পরীক্ষার সময়সূচি ও পরীক্ষার স্থান ভালভাবে জেনে নিবে। পরীক্ষার রাত বেশি সময় জাগ্রত থাকার চেয়ে পরিমিত ঘুমানো উচিৎ। যাতে করে পরীক্ষার হলে ঘুমের ভাব না থাকে এবং মস্তিষ্ক শান্ত থাকে। পরীক্ষার আগের রাতে শরীর ও মনকে পরিমিত বিশ্রাম দেয়া দরকার । পড়তে পড়তে মাথা জ্যাম করে পরীক্ষার হলে যাওয়ার চেয়ে ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষার হলে যাওয়া উত্তম। কারণ পরীক্ষার রাতে অধিক রাত জেগে পড়াশোনা কারলে কারো কারো বমি বমি ভাবও থাকে, যার কারণে ভালভাবে পরীক্ষার উত্তর লিখা সম্ভব হয়না।
পরীক্ষার হলে করণীয়
পরীক্ষার নির্দিষ্ট সময়ের আধা ঘণ্টা আগে পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছা উত্তম। যাতে একটু রেস্ট নিয়ে পরীক্ষার হলে যাওয়া যায়। পরীক্ষার হলে প্রবেশের পর আপনাকে যে উত্তরপত্র দেওয়া হয়েছে তা যথাযথ কি না তা প্রথমে দেখে নিন। প্রশ্ন ভালভাবে পড়–ন। আপনাকে কয়টি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে তা দেখে নিন। প্রশ্নপত্রে উল্লেখিত সকল প্রশ্নেরই উত্তর দিতে হবে, না অতিরিক্ত প্রশ্ন আছে? অতিরিক্ত প্রশ্ন থাকলে আপনার কাছে অধিক সহজ প্রশ্নগুলোতে টিক চিহ্ন দিন। প্রশ্ন দেখার সময় ভালভাবে লক্ষ্য করবেন, এমন কোনো প্রশ্ন আছে কি না যার জবাব দেয়া বাধ্যতামূলক। উত্তর লেখার পূর্বে প্রত্যেক প্রশ্নের ছোট-বড় উত্তরের জন্য সময় নির্ধারণ করু ন। তথা প্রথম প্রশ্নের আলিফের জন্য দশ মিনিট বা-এর জন্য সাত মিনিট ইত্যাদি।
পরীক্ষার খাতায় অপ্রয়োজনীয় কিছু লিখবেন না। লেখা সুপাঠ্য হওয়া দরকার। অনেক সময় ভালছাত্রের লেখাও পড়তে কষ্ট হয়। তাই তারা ভাল লিখেও কম নম্বর পায়। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আপনার কাছে খুব কঠিন মনে হলেও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়বেন না। কারণ মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়লে আপনার জানা বিষয়ও ভালভাবে লিখতে পারবেন না। বরং আপনার জানা সহজ বিষয়ও কঠিন মনে হবে।
কোনো প্রশ্নের উত্তর লেখার সময় হঠাৎ কোনো তথ্য মনে না এলে তার জন্য চিন্তা করতে করতে সময় অপচয় করবেন না। লেখা চালিয়ে যাবেন, পরবর্তী সময় স্বরণ হলে উক্ত তথ্য যোগ করে দিবেন। আপনি একটি প্রশ্নের উত্তরের জন্য যে সময় বরাদ্দ করবেন উক্ত সময়ের মধ্যে কোনো প্রশ্নের উত্তর শেষ করতে না পারলে জায়গা খালি রেখে পরবর্তী প্রশ্নের উত্তর লেখা শুরু করবেন। কোনো প্রশ্নের উত্তর লেখার পর সময় বেচে গেলে পূর্বের প্রশ্নে খালি থাকা উত্তর পূর্ণ করবেন। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর চিন্তা করা উচিৎ নয়। কারণ, যা হওয়র তা হয়ে গেছে। এখন এ নিয়ে চিন্তা করতে থাকলে পরবর্র্তী পরীক্ষাও খারাপ হওয়ার আশঙ্খা রয়েছে। এজন্য পিছনের পরীক্ষার চিন্তা না করে সামনের পরীক্ষাটা কীভাবে ভাল করা যায়, সে চিন্তা মাথায় নিয়ে নবোদ্যমে পড়ালেখা করবেন।
বি: দ্র : বিশিষ্ট রাবিদের সংক্ষিপ্ত জীবনী ভিন্নভাবে সংগ্রহ ও ইয়াদ করে নিতে হবে। এটা সকল কিতাবের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আর মুসান্নিফগণের জীবনী আগে থেকে মুতাআলা করে রাখলেও পরীক্ষার দিন আবার পড়ে নিবে।
মিশকাত জামাতের পড়ালেখা
মাওলানা হাসান আহমাদ
নাজেমে দারু ল ইকামা , জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া
আমাদের কওমি শিক্ষা ব্যবস্থায় বাস্তবিকই ওপরের জামাতগুলোর পাঠ্য সিলেবাস বা নেসাবে তা’লিম যেভাবে সাজানো হয়েছে তাতে এক এক শিক্ষাবর্সে ২/৩ বছরের পাঠ ঢুকিয়ে দেয়ার এক কঠিন প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। সত্যি বলতে এর কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ চোখে পড়ে না। এর জন্য প্রধানত আমাদের কিছু নেতিবাচক মানসিকতাই দায়ী। এ সমস্যা উত্তরণে কওমি মাদরাসা সমূহের কর্তৃপক্ষের সম্মিলিত উদ্যোগ ও দ্রু ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সময়ের দাবি। বাস্তব সমস্যা ও সমাধানের প্রত্যাশা সকলের। অন্যথায় যে ক্ষতি হয়ে চলছে তা শুধু প্রলম্বিতই হতে থাকবে।
যাহোক, মেশকাত জামাতের ছাত্রদের পড়াশোনার নিয়ম সম্পর্কে বলতে হলে প্রথমেই ছাত্রভাইদের যে বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করবো তা হলো
কিতাবের হাশিয়া’র গুরু ত্ব ও শরাহ’র প্রয়োজনীয়তা
প্রত্যেক কিতাবের সঙ্গেই বিনামূল্যে ও বিনাশ্রমে যে হাশিয়া আমরা পেয়ে থাকি, কিতাব ‘হল’ করার জন্য সেটাই সর্বোত্তম নোট বা গাইডের কাজ দিতে পারে। কারণ এ হাশিয়াগুলো লিখে গিয়েছেন আমাদের আকাবিরগণ। প্রত্যেকটি কিতাবের শরাহ-শরু হাতসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বহু কিতাব ঘাটাঘাটি করে এগুলোর চৌম্বক অংশগুলোর সমন্বয়ে সকল শরাহ’র এক শরাহ বা নির্যাসরূপ। যেহেতু ক্লাস চলাকালীন দিনগুলোতে ব্যক্তিগত মুতালাআ বা পড়াশোনার সময় সুযোগ কমই পাওয়া যায় এবং পরীক্ষার পূর্বে প্রস্তুতির জন্য যে কয়েক দিন সময় দেয়া হয় তাতে সকল কিতাব পূর্ণাঙ্গভাবে আয়ত্ব করাও কঠিন, তাই কম সময়ে সহজে কিতাবের কঠিন বিষয়গুলো বুঝার জন্য সাধারণভাবে সংশ্লিষ্ট কিতাবাদির হাশিয়া ও ‘বাইনাস সুতুর’ দেখা চাই। এর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে প্রচলিত শরাহ-শরু হাতের সহায়তা নেয়া যেতে পারে। কিন্তু সমস্ত পড়ালেখাই যদি শরাহনির্ভর হয় তাহলে সেটা হবে অনেক কঠিন ও সময় সাপেক্ষ। যাতে সব কিতাব পূর্ণাঙ্গভাবে পড়ে শেষ করা সম্ববপর হবে না।
বোর্ড পরীক্ষা বা চূড়ান্ত পরীক্ষার প্রস্তুতি
বোর্ড পরীক্ষায় ভালো করতে চাইলে এই জামাতের পাঠের বিশালতার কারণে বছরের শুরু থেকেই বিশেষ পরিক-না নিয়ে পড়াশোনা করা আবশ্যক। এর জন্যে-
প্রথমত
গুরু ত্ব ও মানোযোগের সাথে উস্তাদকে নিয়মিত ক্লাসে পড়া আদায় করতে হবে এবং ক্লাসেই জরু রি বিষয়গুলো নোট করে নিতে হবে। এই নোট ব্যক্তিগত পড়া, বিশেষত পরীক্ষার পড়া দ্রু ত আগানোর সহায়ক হবে। এক্ষেত্রে ক্লাসের আগেভাগেই যেমন বৃহস্পতি ও শুক্রবারের অবকাশে বেফাক পরীক্সার প্রশ্নপত্রসমূহ দেখে পূর্ব ধারণা নিয়ে রাখলে অনেক উপকার পাওয়া যাবে।
দ্বিতীয়ত
সেমাহি ও শশমাহি (প্রথম ও দ্বিতীয় সাময়িক) পরীক্ষাসমূহের প্রস্তুতি ও এই পরীক্ষাগুলোকে বছর শেষে চূড়ান্ত পরীক্ষার প্রস্তুতির অংশ বলেই বিবেচনা করতে হবে। মূলত: ১ম ও ২য় সাময়িক পরীক্ষার পড়ার মধ্যেই বার্ষিক পরীক্ষায় ৩/৪ টি প্রশ্ন এসে থাকে। তাই এ দুই পরীক্ষার বন্ধে পরীক্ষা উপলক্ষ্যে পঠিত গুরু ত্বপূর্ণ বিষয়গুলো রিভাইজ দিয়ে পূর্ণ আয়ত্ব করে রাখলে এটা বার্ষিক পরীক্ষার জন্য বিরাট পুঁজি হয়ে থাকবে। বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতিকালীন সময়ে এগুলোর জন্য অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে হবে না। তাতে করে পরীক্ষা সংক্রান্ত অন্যান্য খুঁটিনাটি বিষয়ে এবং বছরের শেষের দিকে সাধারণত যে বিশাল নেসাব পড়ানো হয় তার প্রতি বেশি মনোযোগ দেয়া যাবে। প্রতিযোগী ছাত্রদের চূড়ান্ত সাফল্যের ক্ষেত্রে এগুলোই নিয়ামক ভূমিকা রাখে।
তৃতীয়ত
শশমাহি বা ২য় সাময়িক পরীক্ষার পর থেকেই বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতিমূলক পড়া আরম্ভ করে দিতে হবে। এর জন্য নিয়মিত প্রতিদিন কিছু সময় নির্দিষ্ট করে নিতে হবে। যেমন : সকালে এক বা আধঘণ্টা, বাদ আসর কমপক্ষে আধঘণা থেকে পৌনে একঘণ্টা, রাতে কমপক্ষে এক ঘণ্টা করে পড়লে বেশ কয়েকটি কিতাবের আগাম প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলা সম্ভব। তাছাড়া ২য় সাময়িক পরীক্ষার পর সপ্তাহান্তের ছুটিতে বাসায় বা বাড়ি যাওয়ার মানসিকতা ঝেড়ে ফেলে বৃহস্পতি ও শুক্রবারের ছুটির দিনগুলোকে বিশেষ গুরু ত্বের সঙ্গে কাজে লাগাতে হবে।
মুতাআলার পদ্ধতি ও কিতাবের শরাহ নির্বাচন
বেফাক পরীক্ষায় বিগত কয়েক বছর থেকে যে ধারা পরিলক্ষিত হুে ছ তাতে মেশকাত শরিফ উভয় খন্ডেই হাদিসের তরজমার প্রতি সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে। এর জন্য এমদাদিয়া লাইব্রেরি প্রকাশিত ‘বাংলা মেশকাত’ ভাল সহায়ক হবে। এরপর প্রসিদ্ধ এখতেলাফি মাসআলাসমূহ সংক্ষেপে (শুধু চার ইমামের মাজহাব ১/২টি করে দলীলসহ) আয়ত্ব করতে হবে। এর জন্য ‘দরসে মেশকাত’ ও ‘ইযাহুল মেশকাতের’র সহায়তা নেয়া যেতে পারে। আর কঠিন হাদিসসমূহ, কতিপয় হাদিসের কঠিন কিছু বাক্য বা শব্দের তাহকিকের জন্য ‘ মেরকাত, ‘তানযিমুল আশতাত’ অথবা ‘ইযাহুল মেশকাতে’র সহায়তা নিতে হবে। তবে এক্ষেত্রে সবদিক থেকে জুড়িবিহীন ও পূর্ণাঙ্গ শরাহ মেরকাতই।
২. বায়জাবি শরিফে’র জন্য হাশিয়া এবং বিস্তারিত আলোচনার ক্ষেত্রে ‘তাকরিরে হাবি’র সহায়তা নেয়া যেতে পারে।
৩. ‘শরহে আকায়েদে’র কঠিন মাসআলাগুলো সহজে বোঝা ও মুখস্তর জন্য অতি চমৎকার ও উু চমান সম্পন্ন শরাহ হুে ছ মরহুম খতীব আল্লামা ওবায়দুল হক রহ. এর প্রশ্নোত্তর আকারে রচিত উর্দূ নোটটি। অবশিষ্ট ক্ষেত্রে আরবি ‘ইকদুল ফারায়েদের’র হাশিয়াই যথেষ্ট।
৪. হেদায়া ৩য় ও ৪র্থ খন্ডের গরু ত্বপূর্ণএখতেলাফি মাসআলাগুলো আয়ত্ব করার সহজ অবলম্বন ‘আশরাফুল হেদায়া।’ আর সাধারণভাবে কিতাব ও এবারত হল করার জন্য ‘ফাতহুল কাদিরে’র পার্শ্বে লিখিত ‘এনায়া’, তা সম্ভব না হলে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত বাংলা হেদায়ার সাহায্য নেয়া যেতে পারে। আরবি হাশিয়াও এগুলোর বিক- হতে পারে।
৫. ‘শরহে নুখবা’ আয়ত্ব করার জন্য প্রথমেই মুকাদ্দামায়ে শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলবী রহ. প্রয়োজনীয় তা’লিক ও বাক্যসহ সম্পূর্ণভাবে মুখস্ত করে নিতে হবে। শরহে নুখবায় প্রাসঙ্গিকভাবে আলোচিত বেশ কিছু বিষয়ের সার সংক্ষেপ উক্ত মুকাদ্দিমার শেষ দিকে ভিন্ন ভিন্ন ফসল বা পরিুে ছদে সন্নিবেশিত হয়েছে। এটিও সহজে বেশ উপকার দিবে আশা করি।
শরহে নুখবা’র এবারত সহজে হল করার জন্য এর বাইনাস সতুর ও হাশিয়ার জুড়ি নেই।
৬. তাহরিকে দেওবন্দ নামক কিতাবটির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য হলেও বর্তমান অবস্থায় এ জামাতের জন্য এটি মরার ওপর খড়ার ঘায়ের ন্যায় হয়ে আছে। এ কিতাবটির পেছনে যে পরিমাণ সময় দিতে হয় তাতে এ জামাতের আরো অনেক গুরু ত্বপূর্ণ বিষয়াবলী ক্ষতিগ্রস্ত হুে ছ। যাহোক, কিতাবটির বিষয় ও ভাষার ধরন আমাদের কওমি ছাত্রদের জন্য সম্পূর্ণ নতুন হওয়ায় এর অনেকাংশেই ছাত্রদের হুবহু মুখস্ত করা ছাড়া উপায় নেই। তাছাড়া গুটিগুটি অক্ষেের প্রায় তিনশ পৃষ্ঠার বিশাল ঐতিহাসিক গ্রন্থটি লাগাতার পড়ে মুখস্ত করেও মনে রাখা সম্ভব নয়। এসব কারণে এ কিতাবটি বছরের শুরু থেকে প্রতিদিন ১/২ পৃষ্ঠা করে মুখস্ত করতে হবে। সপ্তাহের পড়া প্রতি সপ্তাহে রিভাইজ দিতে হবে। বিশেষ করে ২য় সাময়িক পরীক্ষার পর থেকে দিন হিসাবে ভাগ করে প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ পুর্ণ আয়ত্ব করতে হবে। আর এটি সহজে মুখস্থ করার নিয়ম হলো, প্রত্যেকটি বিষয়ের বর্ণনা তো আধাপৃষ্ঠা, এক বা দেড় পৃষ্ঠা পরিমাণে প্রথমে ১/২ বার আলোচ্য বিষয় বা ঘটনাটি বুঝে পড়তে হবে। তারপর মনে মনে এর মধ্যে কয়টি পয়েন্ট বা অংশ রয়েছে তা নির্ধারণ করে মুখস্ত বলার চেষ্টা করতে হবে। সবশেষে বিষয়টি রাফ খাতায় মুখস্ত লিখে আবার বইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে। আশা করি এভাবে সফলতা পাওয়া সম্ভব।
শরহে বেকায়া জামাতের পড়াশোনা
মাওলানা মনীর হুসাইন
শিক্ষক, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া
শরহে বেকায়া জামাতের তিনটি কঠিন কিতাবের নাম সিরাজি, আত্তরীক ইলাল ইনশা ও মাকামাতে হারিরি। এ তিনটি কিতাব পড়ার কথা ছাত্ররা চিন্তা করে ঘাবড়ে যায়। তাই এই তিনটি কিতাবকে কীভাবে পড়লে খুব সহজেই আয়ত্ব করা ও বোর্ড পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া সম্ভব, এই বিষয়ে কিঞ্চিত আলোকপাত নিুে তুলে ধরছি।
সিরাজি :
এ কিতাবটি অধ্যয়নে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে মেহনত করলে আশা করি ভাল ফলাফল করা যাবে।
এক. আসহাবুল ফারায়েজ, আসাবাত, তাসহিহ, মাখারেজ ও রদ এ বিষয় কয়টি কণ্ঠস্থ করে নিবে। প্রয়োজনে কিতাবে প্রতিদিন এক নজর বুলিয়ে নিবে।
দুই. নিজ থেকে পরিবার বানিয়ে একজনকে মৃত সাব্যস্ত করে মাসআলা করতে থাকবে। বিভিন্ন অবসর সময়ে বা লাগাতার পড়ার ক্লান্তি দূর করতে কিছুক্ষণ দু’একটি মাসআলার তামরিন করা যেতে পারে।
তিন. তাসহিহ, রদ,আউল, ইত্যাদির কিছু সহজ উদাহরণ নিজ থেকে বানিয়ে নেয়া যেতে পারে। কেননা শরাহগুলোর উদাহরণ সাধারণত একটু কঠিন।
চার. ফারায়েজ সংক্রান্ত মুসতালাহাতগুলোর আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ লিখে মুখস্ত করে রাখবে। এক্ষেত্রে ইমাম জুরজানির ‘আত্বতারিফাত’ কিতাবের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে।
পাঁচ. কিতাবটি ইয়াদ থাকলে প্রতিদিন কমপক্ষে দশ মিনিট কিতাবটির ওপর নজর বুলিয়ে দিবে। এতে করে ভুলে যাওয়া থেকে বাঁচা যাবে।
এভাবে নিয়মতান্ত্রিকতা ও বুঝে পড়লে আশা করি কিতাবও হল হবে এবং ভালো নম্বরও পাওয়া যাবে।
আত তরিত ইলাল ইনশা
শরহে বেকায়া জামাতের মধ্যে এ কিতাবটিকে ছাত্ররা কঠিন মনে করে। বাস্তবেও কিতাবটি কঠিন। কিতাবটিকে নিয়ে অনেকেই হিমশিম খায়। কিতাবটি আয়ত্ব করতে হলে প্রথমেই কয়েকটি বিষয় অবিকল কিতাবের মতো মুখস্ত করে নিতে হবে। যেমন: ইলমে ইনশার আভিধানিক ও পারিভাষিক সংজ্ঞা, উদ্দেশ্যও বিষয়বস্তু, ইনশায় উন্নতি করতে যে বিষয়গুলো লক্ষ্য করা কর্তব্য, ইনশার কিছু পাথেয় এবং ইনশার ক্ষেত্রে ঘটিতব্য ত্রু টি-বিচ্যুতিসমূহ অর্থাৎ কিতাবের শুরু থেকে ৬ষ্ঠ পৃষ্টা পর্যন্ত মুখস্ত করে নিয়ে হবে। এছাড়া তাফসিল, তাজযিয়া, মাকালার সংজ্ঞাও তার অংশসমূহের ব্যাখ্যা মুখস্ত করে নিতে হবে।
দুই. বছরের শুরু তে অত্যন্ত সহজ ও ছোট ছোট বাক্য (যাতে ফে’ল, ফায়েল দু’একটি মাফউল ও মুতাআিল্লিক ছাড়া আর কিছু থাকবে না।) দ্বারা প্যারাগ্রাফের অনুশীলন করবে। এক্ষেত্রে বড়, জটিল ও কঠিন বাক্য সম্পূর্ণরূপে পরিহার করবে। কারণ এতে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি থাকে।
তিন. কোনো ছোট কথাকে তাফসিল করতে হলে দু’টি পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে।
১। জুমলার বিভিন্ন অংশের সাথে সিফাত বা ইযাফাত বৃদ্ধিকরা। মুবতাদা-খবরের ক্ষেত্রে একাধিক সমীচিন খবর উল্লেখ করে এবং ফেয়েলের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় মুতাআল্লিকাত বৃদ্ধি করে বাক্য বড় করা যেতে পারে।
২। বাক্যের বিভিন্ন অংশ তথা মুবতাদা, খবর বা ফায়েল, মাফউল ইত্যাদি সম্পর্কে ছোট ছোট একাধিক জুমলার মাধ্যমে তথ্যাদি সংযোজন করে কথাকে তাফসিল করা যায়।
চার. এ কিতাবে কয়েক ধরণের মাকালা রয়েছে। যেমন: শৈ-িক কোনো উদ্ভাবন, জাতীয় সেবায় নিয়োজিত কোনো পেশাজীবী, স্থাস্থ্য, আবিস্কার, ঐতিহাসিক বা প্রসিদ্ধ কোনো স্থান, কীর্তি বা প্রতিষ্ঠান, ঐতিহাসিক ও খ্যাতিমান কোনো ব্যক্তিত্ব । এ সংক্রান্ত কিতাবের মাকালাগুলো সংক্ষেপে যে তামরিন রয়েছে সেগুলো, এমনভাবে পড়তে হবে যাতে মোটামুটি লেখা যায়। আরবিতে তুলনামূলক দুর্বল হলে তার জন্য করণীয় হলো- প্রত্যেক বিষয়ে কমপক্ষে একটি মাকালা সহজ ও সরলবাক্য দ্বারা তৈরি করে (এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টি উস্তাদ বা ভাল ছাত্রদের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে) মুখস্তকরে নিয়ে নিবে। মাকালা লিখার ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর উপকরণের প্রত্যেকটিকে ছোট ছোট হেডিং হিসেবে লিখে তা সম্পর্কে তিন-চারটি সহজ বাক্য উল্লেখ করে সহজেই সুন্দর মাকালা লেখা যায়।
এক্ষেত্রে কিতাবের অবিকল অনুসরণ প্রয়োজন নেই। মনে রাখতে হবে মাকালায় হেডিং উল্লেখ করে লিখলে মাকালার মান বৃদ্ধি পায় এবং সহজেই লিখা যায়।
পাঁচ. চার-পাঁচটি কমন দরখাস্ত লেখা শিখতে হবে। যেমন নিজের অসুস্থতার কারণে ছুটি, মায়ের অসুস্থতার কারণে ছুটি, ভর্তির জন্য আবেদন ইত্যাদি। এক্ষেত্রে দরখাস্তের কয়েকটি অংশ থাকে এবং কোন অংশ কোথায় লিখতে হবে, কার জন্য কি উপাধি ব্যবহার করা যায়। দরখাস্ত শুরু করার ইবারত, তারিখ, বিষয় ইত্যাদি বিষয়গুলো আত্মস্থ করে নিবে।
ছয়. চিঠিপত্র লেখার ক্ষেত্রেও কয়েকটি চিঠির নমুনা কিতাব থেকে অবিকল মুখস্ত করে নিবে। যেমন: পিতার কাছে টাকা চেয়ে চিঠি, উস্তাদের কাছে পড়ালেখার অবস্থা জানিয়ে চিঠি ইত্যাদি। এক্ষেত্রে পিতা-মাতা ও উস্তাদকে সম্ভোধনের শব্দ শিখে নিবে। চিঠি-পত্রের কী কী অংশ থাকে এবং কোন অংশ কোথায় লিখতে হবে তা জেনে নিবে। চিঠি ও দরখাস্ত অনেক দীর্ঘ করবে না এতে নম্বরের চেয়ে সময় বেশি যাবে।
সাত. তরজমা বা আরবি অনুবাদের কিছু কমন নিয়ম আছে তা উস্তাদগণ থেকে শিখে নিবে এবং বেফাকের প্রশ্নাবলীতে যে সকল অনুবাদের প্রশ্ন রয়েছে সেগুলো দিয়েই তামরিন করবে। এ ছাড়া কিতাবের দ্বিতীয় খন্ডের উর্দুগুলোর বাংলা করে তার আরবি অনুবাদের তামরিন করা যেতে পারে। মনে রাখবে অনুবাদের ক্ষেত্রে যোগ্যতা অর্জনের বিক- নেই। কারণ বেফাকের কোনো বিষয়ের তরজমা বা আরবি অনুবাদ আসবে তা কারো অনুমান করা সম্ভব নয়।
আট. ভুল সংশোধনের ভুল শব্দটি আলাদাভাবে লিখে তার ভুলটি কী? তা স্পষ্টভাবে কারণসহ উল্লেখ করবে। এরপর বিশুদ্ধ শব্দটি কি হবে তাও উল্লেখ করবে এবং সবশেষে প্রশ্নে বর্ণিত নসটিকে শুদ্ধভাবে লিখে দেখাবে। মনে রাখবে ভুলগুলো কারণসহ উল্লেখ না করে শুধু শুদ্ধভাবে নসটি উল্লেখ করলে নম্বর কম পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
নয়. মুফাখারা ও হিওয়ার লেখার ক্ষেত্রে পৃষ্ঠার মাঝে দাগ দিয়ে দুই পাশে দুই পক্ষের বক্তব্য লিখলে বিষয়টির সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায় এবং একপাশে একপক্ষের দাবি ও যুক্তি লিখে তার বরাবর অপর পক্ষের দাবি ও জবাব লেখা যেতে পারে। এভাবে কয়েকটি দাবি, যুক্তি ও অপর পাশে সেগুলোর জবাব ও তাদের দাবিগুলো উল্লেখ করলেই একটি মুফাখারা বা হিওয়ার তৈরি হতে পারে এবং বাহ্যিক সৌন্দর্যের কারণে নম্বরও বেশি পাওয়ার আশা রাখা যায়।
মাকামাতে হারিরি:
এ কিতাবটি ভাল নম্বর পেতে হলে পূর্বের প্রশ্নগুলো সংগ্রহ করবে এবং প্রশ্নের ধরণ দেখে প্রস্তুতি নিতে হবে।
পূর্ণকিতাব ভালোভাবে পড়তে হবে। কিতাবের শুরু দিকের বেশ কয়েকটি ‘মাকাম’ তাহকিকের সঙ্গে পড়তে হবে। শব্দ, শব্দার্থ আয়ত্ব করতে হবে। তাছাড়া কিছু বিষয় মুখস্তও করতে হবে।
মাকামাতের ছাত্রদের জন্য বিশেষ পরাপর্শ হলো কিতাবের শব্দ-বাক্য পরিচিত না হওয়ায় মনে থাকে না। তাই প্রতিদিন নির্ধারিত সময় করে নিয়মিত মাকাম পড়া ও আয়ত্ব করা। এভাবে পড়তে থাকলে আশা করা যায় ভাল ফলাফল করা যাবে।
নাহবেমির জামাতের পড়ালেখা
মাওলানা ইউনুস আনওয়ার
শিক্ষক, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া
নাহবেমির:
যেহেতু নাহবেমির কিতাবটি নাহু তথা আরবি ব্যকরণের প্রথম কিতাব তাই কিতাবটি পড়ার সময় প্রচুর অনুশীলন ও কিতাবের বাইরের অনেক উদাহরণ তৈরি করতে হবে।
২। পরিভাষিক সংজ্ঞাসমূহ খুব ভালভাবে বুঝে-শুনে বাংলা ভাসায় সাজিয়ে-গুছিয়ে মুখস্ত করতে হবে।
৩। ইসম, ফে’ল, হরফ নির্ণয় এবং জুমলায়ে ইসমিয় ও ফি’লিয়া তৈরি এবং মু‘রাব ও মাবনী নির্ণয়, জমলার প্রকার নির্ণয় করার জন্য অনেক অনুশীলন করতে হবে।
৪। ‘তরিকে এরাবে’র দিক দিয়ে ইসমে মুতামাক্কিন ষোল প্রকারের প্রত্যেক প্রকারকে তার তরীকে এ’রাবসহ খুব ভালভাবে বুঝে মুখস্ত করতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে কিতাবের বাইরের অনেক উদাহরণ তৈরি করে শুরু তে তার মুনাসেব আমেল এনে অনুশীলন করা আবশ্যক। অনেককে দেখা যায় যে, শুরু তে এমন আমেল এনে উদাহরণ তৈরি করে যার সাথে অর্থের দিক দিয়ে মা’মুলের কোনো সম্পর্ক থাকে না।
৫। বিভিন্ন আমেলের আমলসমূহ খুবভালভাবে সাজিয়ে আত্মস্ত করতে হবে এবং এক্ষেত্রেও পর্যাপ্ত অনুশীলন করতে হবে।
রাওজাতুল আদব
১। প্রতিটি অধ্যায় খুব ভাল করে পড়তে হবে।
২। প্রতিটি শব্দের অর্থ সামান্য বিশ্লেষণসহ মুখস্ত করতে হবে। যেমন কোনো শব্দ একবচন হলে তার বহুবচন এবং বহুবচন হলে তার একবচন এবং শব্দটি ফে’ল হলে তার বাব, মাদ্দাসহ অর্থ খুব ভালভাবে মুখস্ত করতে হবে।
৩। আরবি বাক্যের বাংলা অনুবাদ করার নিয়ম এবং বাংলা থেকে আরবি বাক্য গঠন করার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে।
৪। কিতাবে উল্লে¬খিত বিভিন্ন আমেলের আমল বুঝে আত্মস্ত করে নিজের থেকে আরবি বাক্য গঠনে অভ্যস্ত হতে হবে। যাতে কিতাবের বাইরের কোনো বাংলা আসলে তার আরবিতে অনুবাদ করতে অসুবিধা না হয়।
৫। কিতাবের বিভিন্ন বাক্যের তারকিব সম্পর্কে পূর্ণধারণা রাখতে হবে। লিখে লিখে তারকিবের অনুশীলন করতে হবে।
৬। কিতাবে উল্লেখিত আরবি প্রবাদগুলোর অর্থ সামান্য ব্যাখ্যাসহ খুব ভালভাবে বুঝে ইয়াদ করতে হবে।
সিরাতে খাতামুল আম্বিয়া
‘সিরাতে খাতামুল আম্বিয়া’ কিতাবটি নাহবেমির জামাতের একটি গুরু ত্বপূর্ণ কিতাব। কিতাবটির নেসাব কিছুটা দীর্ঘ- তাই, কিতাবের ঘটনা পড়ার সময় উক্ত ঘটনার মূল পয়েন্টগুলো (নাম, স্থানের নাম, সন, তারিখ ইত্যাদি) মুখস্ত করে ঘটনাটি কিতাব থেকে মনোযোগসহকারে কয়েকবার পড়বে। তাহলে দেখা যাবে পূর্ণঘটনাটি মুখস্ত হয়ে গেছে। এভাবে কিতাবের ঘটনা পড়লে আশা করা যায় খুব সহজেই কিতাবটি আত্মস্ত হয়ে যাবে।
মালাবুদ্দা মিনহু
১। যে কোনো মাসআলা পড়া হোক না কেন, তা বুঝে পড়ার চেষ্টা করা।
২। মাসআলাসমূহ ভালভাবে আত্মস্ত করার জন্য পরস্পরে মুযাকারা বা আলোচনা করা জরু রি।
৩। যে সকল মাসআলায় ইমামগণের মতবিরোধ রয়েছে, খিয়াল করে সেগুলো ভালভাবে মুখস্ত করতে হবে।
৪। খুঁটিনাটি ছোট-খাট মাসআলাসমূহকেও গুরু ত্বসহকারে মুখস্ত করতে হবে। এগুলোকে অবহেলার দৃষ্টিতে এড়িয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।
৫। বিভিন্ন প্রসঙ্গে উল্লে¬খিত আরবি দোয়াসমূহ এমনভাবে মুখস্ত করতে হবে। যাতে হরকত ও অর্থসহ আরবিতে মুখস্ত লেখা যায়। এমনিভাবে বিভিন্ন অধ্যায়ে বর্ণিত হাদিসগুলোও মুখস্ত করতে হবে।
৭। কিতাবের বাইরেও গুরু ত্বপূর্ণ মাসায়েল যা আমাদের নিত্যদিন প্রয়োজন পড়ে সেগুলোও খেয়াল রাখতে হবে। অনেক সময় এ জাতীয় প্রশ্ন আসলে পরীক্ষার্থী ঘাবড়িয়ে যায়। অথচ একটু খেয়াল করলেই উত্তরটি সে দিতে পারতো। তাই বাইরের প্রয়োজনীয় মাসায়েল সম্পর্কে জ্ঞান রাখতে হবে।
উল্লেখিত বিষসমূহের প্রতি যতœবান হয়ে পরীক্ষার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই পরীক্ষার প্রস্তুতিমূলক লেখা-পড়া ও অনুশীলন করতে থাকলে এবং আল্ল¬াহর কাছে ভাল ফলাফল চেয়ে দোয়া করতে থাকলে ইনশাআল্লাহ ভাল ফলাফলের আশা করা যায়।
গুলিস্তা
১। কিতাবটি পড়ার সময় ফার্সি ফে’লসমূহের সীগা ও বাহাসের দিকে পূর্ণদৃষ্টি রাখতে হবে।
২। হিকমাতগুলো ভালভাবে অর্থসহ পড়। সম্ভব হলে ৮ ম খন্ডের অধিকাংশ হিকমাত ও কবিতা ফার্সিতেও মুখস্ত করা।
৩। বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রশ্নগুলোর জবাব ফার্সিতে মুখস্ত করা।
৪। বিভিন্ন প্রসঙ্গে উল্লে¬খিত আরবি বাক্যগুলোর অর্থ মুখস্ত করতে হবে এবং তা কি প্রসঙ্গে উল্লে¬খ করা হয়েছে তা ভালভাবে বুঝে আত্মস্ত করতে হবে।
৫। কিতাবে উল্লেখিত ঘটনাসমূহ এমনভাবে মুখস্ত করতে হবে। যাতে কোনো ঘটনার একটু অংশ উল্লেখ থাকলেই পূর্ণঘটনা লিখতে অসুবিধা না হয়।
৬। ঘটনা বা হিকমাতের মাধ্যমে শিক্ষাণীয় বিষয়গুলো নোট করে পড়া।
এগুলো হলো কিতাব ভালকরে আত্মস্ত করার বিষয়ে আলোচনা। আর পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করার জন্য আরেকটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ রাখতে হবে। তা হলো- কিতাব পড়ার সময় বেফাকের প্রশ্নপত্র সামনে রেখে প্রশ্নের উত্তরসমূহ মুখস্ত করতে হবে। প্রশ্নের উত্তর কিভাবে সাজাতে হবে, উত্তর কতটুকু আসবে, কোথায় থেকে উত্তর শুরু হবে, কোথায় শেষ হবে এবং উত্তর কীভাবে সাজাতে হবে এসব বিষয়ের ক্ষেত্রে একজন দক্ষ,অভিজ্ঞ উস্তাদের তত্ববধানে থেকে পর্যাপ্ত প্রশ্নের উত্তর লিখে অনুশীলন করতে হবে। পাশাপাশি নিজ জামাতের ভাল ছাত্রের উত্তরপত্র বা উপরের জামাতের ভাল ছাত্রের খাতা দেখে সে অনুযায়ী প্রশ্নের উত্তর লিখে অনুশীলন করা যেতে পারে। এটিও পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করার জন্য সহায়ক।
তাইসিরুল মুবতাদী ও ফারসি কি পেহলি
মাওলানা আবু সায়েম
শিক্ষক , জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া ঢাকা
তাইসিরু ল মুবতাদি ও ফারসি কি পেহলি কিতাব দুটি কীভাবে পড়লে কিতাবের বিষয়বস্তু আয়ত্ব করা যায় ও কীভাবে ভাল ফলাফল করা যায় এ ব্যাপারে আলোচনা করতে গেলে মৌলিকভাবে যে বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ রাখতে হবে তা নিুে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো।
১.মুখস্ত করার পাশাপাশি বুঝে পড়া
সাধারণত ছোট ও প্রাথমিক ছাত্রদের পড়ালেখা মুখস্তনির্ভর হয়ে থাকে। এরপর যতই উপরের ক্লসে উঠতে থাকে মুখস্তনির্ভরতা কমেতে থাকে। এর স্থলে বেশি প্রয়োজন হয় বুঝ ও বুদ্ধির। তাই উপরের কিতাবাদিতে মুখস্ত করার তুলনায় কিতাব বুঝার প্রতি বেশি গুরু ত্বারূপ করতে হয়। সে হিসাবে আলোচ্য কিতাবদুটিও মুখস্তনির্ভর হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হুে ছ এ কিতাব দু’টি শুধু মুখস্তনির্ভর নয়, এতে রয়েছে বুঝার অনেক বড় দখল। তাই ছাত্রদের শুধু বিষয়গুলো মুখস্ত করলেই চলবে না, বরং কিতাবের বিষয়গুলো বুঝার উপরও যথেষ্ট গুরু ত্ব দিতে হবে।
২.পর্যাপ্ত পরিমাণে অনুশীলন করা
আরবী ভাষার বুঝার ক্ষেত্রে আমরা মৌলিকভাবে দুটি শাস্ত্র পড়ে থাকি। একটি হুে ছ নাহু, অপরটি হুে ছ সরফ। এ শাস্ত্র দুটি আয়ত্ব করার জন্য সুদীর্ঘ ৩/৪ বছরে এ বিষয়ের ৭-৮টি কিতাব পড়ানো হয়। পক্ষান্তরে ফার্সি সরফ শাস্ত্র ও ফার্সি নাহু শাস্ত্র একই সাথে একটি মাত্র কিতাব এক বছরে পড়ানো হয়! তাইসির কিতাবের প্রথম অধ্যায় ফার্সি সরফ তথা শব্দ গঠনপ্রণালী সর্ম্পকে এবং দ্বিতীয় অধ্যায় ফার্সি নাহু তথা বাক্য গঠন প্রণালী সর্ম্পকে। যদিও ফার্সি নাহু-সরফ পড়ার গুরু ত্ব আমাদের জীবনে কতোটুকু এবং এ শাস্ত্র পড়ার আদৌ কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে কি না সেটি ভিন্ন বিষয়, কিন্তু আরবির সাথে-এর বিষয়বস্তু তো এক ও অভিন্ন। তাই আরবি নাহু-সরফের ক্ষেত্রে বুঝে পড়া এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ অনুশীনল করা যেমন গুরু ত্বপূর্ণ ঠিক একই কথা ফার্সি নাহু ও সরফের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই কাওয়াইদ পড়ার পাশাপাশি তার যথেষ্ট পরিমাণ তামরীন করা চাই এবং পরস্পরে পর্যাপ্ত তাকরার ও মুযাকারা করা চাই।
৩. শুধু মুখস্ত নয়, চাই লিখিত অনুশীলন
এ কিতাব দুটি মুখস্ত করা এবং বুঝার গুরু ত্ব যতোটুকু ঠিক ততোটুকুই লিখার গুরু ত্ব। ছাত্ররা প্রাথমিক হওয়ায় তারা লিখার বিষয়ে খুবই দুর্বল হয়ে থাকে। তাই যা কিছুই পড়া হলো তা বার বার লিখে এবং সংশ্লিষ্ট উস্তাদকে দেখিয়ে লেখার বানান ও উপস্থাপন পদ্ধতি ঠিক করে নেওয়া চাই।
বাংলা সাহিত্য ও ব্যকরণ
মাওলানা আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর
শিক্ষক , জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া ঢাকা
ক. ভাষা অর্থাৎ বাংলা ভাষার ওপর ভাল দখল থাকা। এজন্য পাঠ্যবই পড়ার সময় শব্দের প্রয়োগ ও বানান শুদ্ধ করার প্রতি বিশেষ ভাবে খেয়াল রাখবে। প্রয়োজনে কঠিন বানানগুলো লিখেলিখে মুখস্ত করা।
খ. গদ্য, প্রবন্ধ এবং কবিতার পুরো বিষয়বস্তু ভালোভাবে আয়ত্ব করা। এজন্য মনোযোগের সাথে একাধিকবার পড়তে হবে এবং লেখক বা কবি কি বোঝাতে চাুে ছন তাঁর সারসংক্ষেপ বের করে খাতায় লিখে অনুশীলন করতে হবে।
গ. প্রতিটি কবিতা কবির নামসহ কমপক্ষে ১০-১২ লাইন মুখস্ত করা।
ঘ. মুখস্ত করার সময় প্রতিটি লাইনের দাড়ি, কম, আশ্চর্যবোধক চিহ্ন, জিজ্ঞাসা চিহ্নের মধ্য থেকে যেখানে যেটা দেয়া হয়েছে তা খেয়াল করে মুখস্ত করা।
ঙ.শব্দার্থসমূহ মুখস্ত করা।
চ.বিভিন্ন শব্দ দিয়ে বাক্যরচনা ও বিপরীত শব্দ লেখার অনুশীলন করা।
ছ. বিগত বছরগুলোর প্রশ্ন সামনে রেখে অনুশীলন করা।
জ. পাঠ্য বইয়ের রচনাগুলো মুখস্ত করা। সবগুলো মুখস্ত করা সম্ভব না হলে যেগুলো মুখস্ত হবে না সেগুলো বার বার পড়ে সারসংক্ষেপ বুঝে রাখা।
ঝ. মুখস্ত করার পর প্রতিটি জিনিস অবশ্যই লেখা। তাহলেই বাংলায় ভাল ফলাফল করা যাবে। ইনশাআল্লাহ।
গণিত
অনেক পরীক্ষার্থী গণিতভীতিতে ভোগে। যার নেতিবাচক প্রভাব পরীক্ষায় পড়ে। গণিতটাকে একটা সহজ খেলা ভাববে। নিয়ম জানলে এ ভয়ে উত্তীর্ণ হওয়া কোনো ব্যাপার নয়। থিওরির দিকে একটু বেশি জোর দিবে। অনেক সময় জানা প্রশ্ন একটু ঘুরিয়ে এলে পরীক্ষার্থী ভয় পেয়ে যায়। এজন্য এখন থেকেই গণিতের সংখ্যা পাল্টিয়ে তোমরা চর্চা করবে। তাহলে প্রশ্নে গণিতের সংখ্যা পাল্টালেও উত্তর দিতে পারবে খুব সহজে। এছাড়াও গণিত সংক্রান্ত কিছু পরামর্শ নিুে দেয়া হলো:
ক. প্রথমত অংকের প্রশ্ন বা ডাক ভালভাবে পাঠ করা। একাধিকবার পাঠ করা।
খ. একটি অংক একবারে না হলে তা আবার করার চেষ্টায় থাকা।
গ. প্রতিদিন নিয়মিত অংকের অনুশীলন করা।
ঘ. ভাল ধারণা আসার জন্য একই অংক বারবার করা।
ঙ.সূত্রনির্ভর অংকের ক্ষেত্রে প্রতিদিন কমপক্ষে একবার করে সূত্রগুলো পড়া।
চ.অনুশীলনের পূর্বে বইতে যে উদাহরণ দেওয়া থাকে তা বোঝার চেষ্টা করা। মনে রাখবে গণিত কোনো মুখস্ত করার বিষয় নয়, বোঝার বিষয়।
ছ.সবশেষে পরীক্ষাকের দৃষ্টিতে ভাল ফলাফলের জন্য পরীক্ষার খাতায় অংকটি সঠিক-সুন্দর ও স্পষ্ট ভাবে উপস্থাপন করা।
জ.অংকের ফলাফল পাওয়ার পর তা উত্তর আকারে উপস্থাপন করা।
হিফজখানার ছাত্রদের পড়াশোনা
হাফেজ নূরু ল ইসলাম
শিক্ষক, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া
দুনিয়া-আখেরাতের যে কোনো কাজে সফলতা অর্জনের মূল উপাদান হল সাধনা ও মেহনত অর্থাৎ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সফল না হওয়া পর্যন্ত নিরলসভাবে অনবরত মেহনত করতে থাকা। লক্ষ্য অর্জন বিলম্ব হওয়তে অধৈর্য না হওয়া। মনোবল সর্বদা অটুট রাখা। সর্বদা আল্লাহর উপর ভরসা রাখা। আর আল্লাহর নেজাম হলো এই যে, সাধনা এবং প্রচেষ্টার সাথে আল্লাহর মেহেরবানি থাকবেই । ইনশাআল্লাহ
ইলম অন্বেষণ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি গুরু ত্ব থাকতে হবে। পরীক্ষা মানুষকে সম্মানিত করে আবার পরীক্ষাই মানুষকে লজ্জিত করে। বিধায় পরীক্ষার প্রতি খুববেশি মনোযোগী হতে হবে। পড়ালেখা ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা-ফিকির মাথায় রাখা যাবে না। আমি হিফজ বিভাগের একজন ছাত্র হিসেবে পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করার জন্য নিুে বর্ণিত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখা আবশ্যক।
১। বছরের শুরু থেকে কুরআন শরিফ ইয়াদ করার ব্যাপারে অনেক বেশি চিন্তা থাকতে হবে।
২। সবক শুনানোর সময় নির্ভুলে প্রত্যেকটি হরফের সিফত,মাখরাজ, মাদ ও গুন্নাহ সহকারে তারতিলের সাথে শুনাতে হবে এবং পড়াটাকে শ্রু তিমধুর করার চেষ্ট করতে হবে।
৩। সবক পড়া অবস্থায় পিছনের পারা ইয়াদ রাখার ব্যপারে সচেষ্ট থাকতে হবে। এক্ষেত্রে আমুখতা তেলাওয়াত ও সবিনা (সম্ভব হলে নামাজে তেলাওয়াত) এর বিশেষ গুরু ত্ব দিতে হবে। যদি কখনো পিছনের পারা বেশি কাচা হয়ে যায় তাহলে সবক বন্ধ রেখে ইয়াদ করে নিতে হবে।
৪। সবক শেষ হওয়ার সাথে সাথে উস্তাদের সাথে পরামর্শ করে প্রতিদিন পড়া-শোনার এবং তেলওয়াতের নেজাম করে নিতে হবে।
৫। পরস্পরের মধ্যে বেশি বেশি প্রশ্ন করা, প্রতিদিন পুরা ৩০ পারা থেকে প্রত্যেক পারায় একাধিক প্রশ্ন করার নেজাম করে নিতে হবে। এক্ষেত্রে বিগত বছরের বেফাক পরীক্ষার প্রশ্নগুলো সামনে রাখলে বেশি ফলপ্রসু হবে। উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে স্পষ্টভাবে হদরের তরজে পড়ার চেষ্টা করতে হবে।
৬। নামাজে তারাবির মতো প্রতিদিন কমপক্ষে দু’জনে দুই পারা তেলাওয়াত করা এবং সম্ভব হলে সুন্নত ও নফল নামাজে সাধ্যানুযায়ী তেলাওয়াতের অভ্যাস গড়ে তোলা।
৭। ভালমানের কারি সাহেবের তেলাওয়াত প্রতিদিন কিছু সময় শোনা এবং নকল কারার চেষ্টা করা। সম্ভব হলে ভাল কোনো কারি সাহেবের কাছে মশক করে নিজের ভুলত্রু টিগুলো ঠিক করে নেয়া।
৮। প্রশ্ন হাতে তুলে নেয়ার পর প্রশ্নগুলো ভালভাবে বুঝে নেয়া ও পারা পৃষ্ঠার খেয়াল করা এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করে নির্ভিগ্নে উু চ আওয়াজে তারতিলের সাথে তেলাওয়াত করা।
৯। মাখরাজ, তাজবিদ ও মাসআলাগেুলো ভালভাবে বুঝে মুখস্ত করা এবং পরস্পরে বেশি মুজাকারা করা। বিগত বছরের প্রশ্নগুলো দেখে সঠিক উত্তর বের করে ঠোঁঠস্থ করা। আর যে সমস্ত বিষয়গুলো বুঝে আসে না তা চিহ্নিত করে উস্তাদদের কাছে থেকে বুঝে নেয়া।
১০। উস্তাদদের কথা মতো চলা। আদব ইহতেরাম করা। কোন সময় বেয়াদবীমূলক আচরণ না করা। সর্বদাই মাদরাসায় উপস্থিত থাকা, বাসা-বাড়ি কম যাওয়া। উস্তাদ ও মাদরাসাকে নিজের জন্য গনিমত মনে করা।
১১। গুণাহ থেকে নিজেকে হেফাজত রাখা।
১২। সর্বোপরি বেশি বেশি নামাজ ও দোয়ায় করা।
সে্ৗজন্যেঃ মাসিক রহমানি পয়গাম জুন সংখ্যা ২০১১
Subscribe to:
Posts (Atom)