get-fans-468x60

Tuesday, June 21, 2011

শেখ সাদীর গুলিস্তা

শেখ সাদীর গুলিস্তা

পূর্বযুগের এক বাদশাহ জনৈক বুযুর্গকে করেন জিজ্ঞাসা, যার ছিলো অনেক পোষ্যমুখ, আর মনে ছিলো অনেক চিন্তাদুঃখ। জিজ্ঞাসা করেন, আপনার জীবনের প্রিয় সময়গুলো হে জনাব, কীভাবে কাটে দেবেন কি জবাব? তিনি বললেন, সারা রাত কাটে ইবাদত বন্দেগিতে, ভোর রাত কাটে রিযিকের দু‘আ-মুনাজাতে, আর সারাটা দিন যায় রুটি-রুযির ধান্ধায়। বাদশাহর অতি উচ্চ ছিলো চিন্তাধারা, তাই তিনি বুঝে নিলেন তার কথার ইশারা এবং তখনই জারি করলেন হুকুমনামা, দান করো তাকে নতুন জামা-পাজামা, আর জারি করে দাও প্রতি মাসের পর্যাপ্ত ভাতা, যাতে চিন্তুামুক্ত হয়ে সিজদায় পড়ে থাকে তাঁর মাথা। কবিতা- পরিবারের শেকলে বাঁধা তুমি সকাল-বিকাল/ঝেড়ে ফেলো নিশ্চিন্ত ইবাদতের খোশ খেয়াল/ রুটি-রুজির চিন্তা করে যার শান্তিহরণ/ঊর্ধ্বজগতে কেমন করে হবে তার বিচরণ?/ একই ঘোরে নিত্য যে ঘুরি, আর বলি হে মন/ আজ নিশিতে নির্জনে খোদারে করিব স্মরণ/ নিশিতে নামাযে দাঁড়িয়ে হায়, ভাবনা এসে যায়/ সন্তানেরা মোর কী খাবে ভোরে, কী হবে উপায়? শিক্ষা- যারা ইবাদত বন্দেগির স্বাদ পেতে চায়, তাদের কর্তব্য হলো সংসারের ঝামেলায় বেশীমাত্রায় নিজেকে লিপ্ত না করা। নচেৎ দিনরাত পোষ্যপরিজনের চিন্তায় ডুবে থাকতে হবে, ইবাদতের অবসরই আর পাওয়া যাবে না, এমনকি রাজাবাদশা ও দুনিয়াদারদের কাছে হাত পাতারও যিল্লতি ভোগ করতে হতে পারে। *** এক দেশে ছিলেন এক দরবেশ, বুযুর্গিতে ছিলো নামডাক বেশ। একবার তিনি শহরের জীবন ত্যাগ করে চলে গেলন বনের ভিতরে। সেখানেই শুরু করলেন তার নতুন জীবন, দিন-রাত করেন ইবাদত সঁপে দিয়ে তুনমন। বনের ভিতরে তার জায়নামায থাকে পাতা, উদরের ক্ষুধা দূর করেন খেয়ে গাছের পাতা। ঘটনা শুনে দেশের বাদশাহ হন পেরেশান এবং সঙ্গে সঙ্গে দরবেশের খেদমতে ছুটে যান। বলেন তিনি করজোড়ে নিবেদন করে, হুযূর! দয়া করে ফিরে চলুন শহরে। যদি ভালো মনে করেন এবং কবুল করে আপনার যেহেন, তাহলে বলি- আপনার জন্য নির্ধারণ করবো একটি মনোরম প্রাসাদ; সেখানে নির্জনে ইবাদত করবেন মিটিয়ে মনের সাধ। এখানের চেয়ে উত্তম হবে ইবাদতের একাগ্রতা; তাতে কোন সন্দেহ নেই নিশ্চিত তা। তাছাড়া লোকেরা ধন্য হবে আপনার নূরানি ছোহবতে এবং মগ্ন হবে আপনার অনুসরণে বন্দেগিতে। দরবেশের মোটেই পছন্দ হলো না বাদশাহর প্রস্তাব, কারণ তাতে পরে হতে পারে মনস্তাপ। তাই তিনি তার নিবেদন নাকচ করে দিলেন এবং অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তখন বাদশাহর সঙ্গী এক উযির দেখালেন যুক্তি, ঠিক নয় তাকে ফিরিয়ে দেয়া যিনি করেন এত ভক্তি। অন্তত বাদশাহর মনরক্ষার খাতিরে দু’তিন দিন এসে থাকুন শহরে। নিজেই পরীক্ষা করে দেখুন প্রাসাদের পরিবেশ। সেখানে ইবাদতে না হয় যদি মনোনিবেশ, আর সাধারণ মানুষের সঙ্গ, যদি করে আপনার ধ্যান ভঙ্গ, থাকবে তো আপনার অধিকার সবকিছু ছেড়ে চলে আসার। কথিত আছে, দরবেশ শহরে এলেন দুদিনের জন্য। শহরবাসী সকলে তার আগমনে হলো যেন ধন্য। শাহী উদ্যানে এক প্রাসাদ তার জন্য করা হলো খালি। রোয সকালে তার খেদমতে তাজা ফুল হাযির করে মালী। সে বাগানের সৌন্দর্যের কথা আর বলো না; আসলে দুনিয়াতে ছিলো তা জান্নাতের নমুনা। কবিতা- লাল গোলাব যেন প্রিয়তমার গণ্ডদেশ/ ঝুলে থাকা ‘সাম্‌বাল’ যেন তার কৃষ্ণ কেশ/ ‘শীত-সকালে’ ফুলগুলো তরুতাজা দেখতে এমন/ এখনো মায়ের কোলে দুধ না খাওয়া শিশু যেমন/ ডালে ডালে ঐ যে দেখো তুমি শত শত ‘আনারকলি’/ সবুজ গাছে ঝুলে আছে যেন লাল অঙ্গারগুলি। দরবেশের সেবায় বাদশাহ পাঠালেন একদাসী, এমন ছিলো যার সৌন্দর্যরাশি- চাঁদের টুকরো এক, ভাঙ্গে যেন সুফীর ধ্যান/ অপ্সরি, ময়ূরি, তারে হেরি হারায় সবে জ্ঞান/ গুলবাগে চুল খুলে সবুজ ঘাসে করে পায়চারি/ তসবি হাতে রাখতে নারে কেহ ধৈর্য ধরি। দাসীর পরে বাদশা পাঠালেন সুদর্শন এক দাস, যেন এক নাশ, সঙ্গে তার সর্বনাশ। কবিতা- পেয়ালা হাতে সবার মাঝে ঘোরে সে সাকী/ দেয় না কিছু দেখায় শুধু যুলুম এ কী!/ দেখে দেখে আশ না মেটে, শুধু নেশা ধরে/ ফোরাতের তীরে যেন পিপাসায় মরে। দরবেশ তার জায়নামায রেখে একপাশে, মজে থাকে ফলের স্বাদে, ফুলের সুবাসে এবং পানাহারে ভোগবিলাসে। কখনো সুদর্শন দাস, কখনো সুন্দরী দাসী, উপহার দেয় কটাক্ষ আর মধুর হাসি। মুগ্ধ দরবেশ তা করে অবলোকন, তার মন যেন করে ওঠে কেমন! এ কারনেই তো জ্ঞানিগণ বলেন অবিরত, রূপসীর কেশ হলো বুদ্ধির শিকল, জ্ঞানীর জ্ঞান করে দেয় বিকল। কবিতা- তব চরণে করিনু উৎসর্গ ইহ-পরকাল/ আমি মূর্খ পাখী, তুমি যে মনোহর এক জাল। মোটকথা, দীর্ঘ ইবাদতের যা কিছু অর্জন গেলো সব রসাতলে, পুণ্যের সাধনা করলেন বর্জন ভোগের পদতলে। কবিতা- জগতের যত পীর-সাধু, জ্ঞানী, কবি/ ঘোচায় ঘোর আঁধার, হয়ে সত্যের রবি/ দুনিয়ার লোভে যায় যবে যায় অধঃপাতে/ যেন মাছি উড়ে গিয়ে পড়ে যায় মধুতে। এভাবে সুখে-ভোগে দরবেশের দিন কাটে গুলবাগে, বাদশাহর মনে ফের দরবেশের যেয়ারাতের সাধ জাগে। গিয়ে দেখেন, তিনি তখন অন্য মানুষ, ঘীয়ে মাখনে বিলকুল নাদুশনুদুশ! হেলান দিয়ে আছেন মখমলের তাকিয়ায়। রূপসী দাসী মাথার উপর ময়ূরপাখা দোলায়। দরবেশের খোশহাল দেখে বাদশাহ হলেন খোশ; বাড়িয়ে দিলেন মাসোহারা ও খোরপোশ। দরবেশের সঙ্গে বাদশাহর হলো অনেক কথা, অবশেষে বললেন তিনি নত করে মাথা, দু’টি শ্রেণীকে আমি মনে প্রাণে ভালোবাসি, আর কেউ তাদের বাসে না ভালো এত বেশী। এক হলো যারা আলিম, বিদ্যানুরাগী, আর হলো যারা যাহিদ, সংসারত্যাগী। এক উযির অতি বিচক্ষণ, বাদশাহর সঙ্গে থাকেন সর্বক্ষণ, বললেন তিনি ধীরে ধীরে বাদশাহকে সম্বোধন করে, জাহাঁপানা, দাবী হলো ভালোবাসার, উভয়ের সঙ্গে করবেন সদাচার। আলিম যারা তাদের দান করুন বেশুমার, যেন ইলমের প্রতি হয় অনুরাগ সবার। আর যারা যাহিদ সংসার ত্যাগী, দান দ্বারা ঠিক নয় তাদের করা দুনিয়াভোগী। শিক্ষা- দুনিয়ার মোহজাল এবং শয়তানের ধোকা সম্পর্কে সাবধান থাকা উচিত। লোকমুখে গেছে জানা একই রকম ঘটনা। এক বাদশাহর সামনে এলো কঠিন পরিস্থিতি, যা কেড়ে নিলো তার মনের শান্তি-স্থিতি। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন মনে মনে, কেটে গেলে বিপদ দান করবো সাধুজনে। আল্লাহর ইচ্ছায় পূর্ণ হলো বাদশাহর প্রয়োজন এবং তার মনের দুশ্চিন্তার হলো নিরসন তাই খোশদিলে করলেন মান্নত পূরণের আয়োজন। বাদশাহার বিশিষ্ট এক সেবক, হুকুম পালনের পেয়েছে সবক। বাদশাহ দিলেন তাকে ডেকে, ্‌একথলি দিরহাম রাজকোষ থেকে, আর বললেন, রাজ্যের যত সাধুজন, সংসার নিরাসক্ত, তাদের দান করো এ অর্থ, কেউ থাকে না যেন অভুক্ত। লোকে বলে, সেবক ছিলো বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান ভারি। সুচারুরূপে আদেশ পালনে হতো না দেরী। সোনা-চাঁদির থলিয়া নিয়ে সারা দিন শহরে ঘুরে ঘুরে, সন্ধ্যায় ক্লান্তদেহে রাজপ্রাসাদে এলো ফিরে। বাদশাহকে উপযুক্ত সম্বোধন করে এবং তার রাজহস্ত চুম্বন করে, বললো, জাহাঁপনা কী করবো নিবেদন, সারা শহর ঘুরে পেলাম না নিরাসক্ত কোন সাধুজন। বললেন বাদশাহ, একি কথা! খেয়েছো কি বুদ্ধির মাথা! অথচ আমি জানি এবং তা সত্য মানি, দেশে আমার, আছে চারশ যাহিদ নিরাসক্ত। যেমন তাদের সাধনা উপাসনা তেমনি তারা খোদভক্ত। সেবক নিবেদন করে মৃদু হেসে, সোনা-চাঁদির থলি রেখে একপাশে, জাহাঁপানা, নিরাসক্ত যে সে তো হাত পেতে দান নেয় না, আর যে হাত পাতে সে তো নিরাসক্ত হয় না! সভাসদদের উদ্দেশ্যে বাদশাহ বললেন সহাস্যে, খোদাপ্রেমিক এই সাধুজনদের আমি যত করি ভক্তি প্রদর্শন, বেশরম এই গোলামের মাঝে তত দেখি অভক্তির নিদর্শন! তবে কথা তার বড় সত্য, সোন-চাঁদির আসক্তি ছাড়া বড় শক্ত। কবিতা- হাত পেতে নিলো যে দিরহাম-দীনার/ নিজেই গুঁড়িয়ে দিলো সে সাধুতার মিনার/ কথা শক্ত, নয় সে খোদভক্ত সাধু/ অন্য জনে খুঁজে দেখো, খোদাভক্তির মধু। শিক্ষা- যাহিদ ও সংসার- নিরাসক্ত হওয়ার দাবী করা যথেষ্ট নয়, বরং আচরণের মাধ্যমেই প্রকাশ পাবে, কে যাহিদ ও নির্লোভ। সত্যিকার যাহিদ যিনি, তিনি কখনো মানুষের কাছে হাত পাততে পারেন না। *** এক আলিমে দ্বীন, চেহারায় ছিলো বুযুর্গির চি?হ্ন; লোকেরা তাকে করলো কঠিন এক প্রশ্ন- বলুন তো এই যে ওয়াক্‌ফের ভাতা, বৈধ কি গ্রহণ করা তা? সঙ্গে সঙ্গে বললেন তিনি, নিয়ত কী, আগে তা জানি! ইবাদতের নিমগ্নতা লাভের জন্য হলে তো হালাল, লোভের কারণে হলে হাশরে পড়বে ধরা ব-মাল। শিক্ষা- দ্বীনী প্রয়োজনে সঠিক সূত্র থেকে অবশ্যই সাহায্য গ্রহণ করা যায়, তবে নিয়ত হতে হবে খালিছ। দ্বীনী কাজের উদ্দেশ্যে সম্পদ ব্যবহার করবে, সম্পদ আহরণের উদ্দেশ্যে দ্বীনী কাজ করবে না। *** একদরবেশ একবার এলেন এক অঞ্চলে, তার নিবাস ছিলো নির্জনে জঙ্গলে। অঞ্চলের শাসক ছিলেন অতি অভিজাত, কারো মনে কখনো দেন না আঘাত। যেমন দানশীল তেমনি উদার। সবার জন্য খোলা ছিলো তার দুয়ার। জ্ঞানী-গুণীদের একটি দল ছিলো তার মজলিসে, দরবেশ গিয়ে বসলেন নীরবে একপাশে। সবাই তখন বলছিলেন দামী দামী সব কথা। দরবেশ ছিলেন ক্লান্ত শ্রান্ত, আর ছিলো ক্ষুধা। অনেক দূর থেকে এসেছেন, অনেক দিন না খেয়ে থেকেছেন। তাই কিছু না বলে তিনি বসে ছিলেন চুপচাপ, তবে সবার নযর পড়ে গেলেন আপসে আপ। একজনের ইচ্ছে হলো, করবেন পরিহাস, বললেন, কিছু বলুন জনাব, না করে নিরাশ। তিনি বললেন, মুখে ছিলো মৃদু হাসি, আমি মূর্খ মানুষ অরণ্যবাসী। আপনাদের মত জ্ঞানী, গুণী, মহাজন কিছু নই, জানি না হাদীছ-কোরান, পড়িনি জ্ঞানের কোন বই। আমার কথা মানে জ্ঞানীদের সময় নষ্ট, তবে বলতে পারি একপংক্তিতে যদি হন তুষ্ট। সকলে আগ্রহভরে, বলে উঠলেন সমস্বরে, কেন নয়, কেন নয়! বলুন শোনবো নিশ্চয়। তিনি বললেন- (কবিতা) অনাহারে মরণদশা, চায় না কিছু, চায় শুধু রুটি/ ফিরে চাইবে না, দাও যদি তারে চঁদের সমান বেটি। এক পংক্তিতে বুঝে নিলো সবে জ্ঞান তার কত এবং ক্ষুধা-অনাহারে অবস্থা কাহিল কত! সঙ্গে সঙ্গে দস্তরখান বিছানো হলো এবং যা ছিলো তাই সামনে রাখা হলো। মেযবান বললেন, হে ভাই, একটু সময় চাই। দাসীদের হাতে তৈরী হচ্ছে কালিয়া-কোফ্‌তা, যদি দিতে পারি দস্তরখানে হবে আনন্দের ভোগ তা। দরবেশ মাথা তুলে মুচকি হেসে উঠলেন বলে- (কবিতা) সামনে আমার নাই স্বাদের কোফ্‌তা-কাবাব/ দুঃখ নাই তাতে শোনো বন্ধু মোর জবাব/ রুটির টুকরা হোক না সস্তা ও খাস্তা/ তার তরে কোফ্‌তা তাই, ক্ষুধার আগুনে যে ‘কোফ্‌তা’। শিক্ষা- সুস্বাদু খাবারের অপেক্ষায় বসে থাকা আল্লাহওয়ালা মানুষের শান নয়। ক্ষধার সময় সামনে যা আসে আল্লাহর নেয়ামত মনে করে তাই গ্রহণ করা উচিত। তাছাড়া ক্ষুধা যে কোন খাবারকে সুস্বাদু করে দেয়। *** এক মুরিদ হয়ে বেহাল-পেরেশান, পীরের খেদমতে ছুটে যান। বললেন, হুযূর হয়ে মজবূর এসেছি ছুটে, ভক্তদের ভিড়ে যিকির-ইবাদত যায় বুঝি টুটে। মানুষ দলে দলে আসে, তাতে হয় কষ্ট। নির্জনতায় বিঘ্ন ঘটে, সময়ও নষ্ট। তাই বড় পেরেশান। হুযূর, দিন কোন সমাধান। জ্ঞানী পীর, বললেন ধীর-স্থির, গরীব ভক্তদের দাও কিছু ঋণ; শোধের ভয়ে তারা আসবে না কোনদিন। আর যারা সচ্ছল ধনী, জেনে নাও তাদেরও অস্ত্রখানি; সুযোগ বুঝে হাত পেতে, চাও কিছু মাল, উবে যাবে ভক্তি, হারিয়ে যাবে চিরকাল। কবিতা- ঋণ যদি দাও, তুমি রহমতের ফেরেশতা/ গাইবে তোমার গুণ হবে ফেরেফতা/ ফেরত যদি চাও, তুমি হলে যমদূতের ভাই/ তোমার চেয়ে মন্দ কেহ ত্রিভুবনে নাই/ যদি বলো হাত পাতি, পয়সা কিছু চাই/ বলবে সালাম, করবে পালাই পালাই। শিক্ষা- অপ্রয়োজনীয় মানুষের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখার জন্য নির্দোষ কিছু কৌশল অবলম্বন করা কর্তব্য, বিশেষত যখন কাজে বিঘ্ন ঘটে এবং অযথা সময় নষ্ট হয়। *** এক যুবক আলিম, দিলে তার বহু পেরেশানি, পিতাকে বললেন ছুয়ে তার পা-খানি, বয়ানীদের এত রঙদার বয়ানে, কোন আছর হয় না আমার মনে। কারণ কথায় যত জৌলুস কর্মে তাদের তত কলুষ। কথায়-কাজে যদি না থাকে মিল, অভক্তিতে ভরে যায় দিল। কবিতা- বলো ধর্মের কথা, দুনিয়ার করো নিন্দা/ দাওয়াতি খানায় চাহিদা শুধু ভুনা পরিন্দা/ মানুষের তরে বয়ান, ‘যত পারো করো দান’/ নিজে জমাও সোনা-চাঁদি, ঘর আলিশান/ কথা যদি হয় শুধু মুখে, কিছু নাই অন্তরে/ হোক যত মিষ্টি-মধুর যাবে না কিছু অন্দরে/ আলিম করে না কারো নিন্দা কভু/ নিজে করে যা পরেরে তাই বলে শুধু। যেমন আলকোরআনে বলা হয়েছে, তোমরা মানুষকে আদেশ করো, অথচ নিজেদের বিষয় ভুলে যাও। কবিতা- আলিম যদি মজে থাকে ভোগে আর দেহ-সুখে/ ভ্রষ্ট সে যে, পথের দিশা দেবে কী মুখে মুখে! পিতা ছিলেন জ্ঞানী ও গুণী। বললেন, তোমার মুখে একি শুনি! হে পুত্র, এ তোমার চিন্তার ভুল! একারণে করো না কারো নছিহত না-কবুল। দ্বীনের আলিম যারা তাদের যদি বলো ভ্রষ্ট, আর খুঁজে বেড়াও নিষ্পাপ আলিম, জীবন হবে নষ্ট। ইলমের ফায়দা থেকে তুমি হবে বঞ্চিত, আর মানুষের সামনে হবে শুধু লজ্জিত। যেমন সেই অন্ধ, দৃষ্টি যার বন্ধ; একদিন রাতে কাদা-পথে হলো তার বড় দুর্গতি। ফরিয়াদ করে বললো, কেউ ধরো না পথে একটু বাতি! মুখরা এক নারী, শুনে মজা পেলো ভারি, বললো হেসে ওরে ও অন্ধ, আকলের দুয়ার করেছো কি বন্ধ! তুমি তো দেখতে পাও না বাতি, বাতির আলোতে তবে দেখবে কি হাতি! যে কারো উপদেশেই পাবে তুমি গোনাহ থেকে মুক্তি, দিলে তোমার উপদেশের প্রতি থাকে যদি ভক্তি। উলঙ্গ মানুষ তোমাকে দেয় যদি কাপড়, তাতে কি ঢাকা হবে না তোমার সতর! কবিতা- আলিমের কথা শোনো দিলের কানে, ভেবো না ফেলনা/ কাজে আর কথায় করুক শত ধোকা-ছলনা/ ঘুম থেকে জাগাতে পারে কে নিজে ঘুমিয়ে থেকে/ বলে যারা, ভুল বলে, ঝেড়ে ফেলো তা মন থেকে/ জ্ঞানী যারা রাখে তারা এই কথা খেয়ালে/ জ্ঞান-বচন লুফে নাও যেথা পাও, হোক লেখা দেয়ালে। খানকার সুফী সাধনার ব্রত ত্যাগিয়া/ বসিলেন মাদরাসার অঙ্গনে আসিয়া/ পুছিনু তারে কী ফরক বলো দুইয়ে মাঝে?/ ঐ সঙ্গ ছাড়ি এখানে আছো পড়ি কী বুঝে/ কহিল, সুফী, হলে নৌকাডুবি, ভাবে কম্বলখানি/ আলিম ভাবে, সবার যেন বাঁচে প্রাণখানি। শিক্ষা- আলিমের মধ্যে কোন ত্রুটি দেখলে তা এড়িয়ে যাওয়া উচিত, কারণ তিনিও তো মানুষ। আলিমের বিচ্যুতির কারণে তার ইলম ও উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া উচিত নয়। কেউ যদি পথে বাতি ধরে দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে তুমি কি সে আলোতে পথ চলবে না শুধু এজন্য যে, বাতিওয়ালা অন্ধ! বাতিওয়ালা অন্ধ হোক বা চক্ষুষ্মান আমাদের কাজ হলো বাতি থেকে আলো গ্রহণ করা। *** এক নেশাখোর, পথের মোড়ে পড়েছিলো বেঘোর। এক দরবেশ দেখে এই পরিবেশ, গালমন্দ করলেন বেশ। নেশাখোর মাথা তুলে তাকিয়ে, করলো নিবেদন সবিনয়ে, হুযূর, কোরআন থেকে কেন সুদূর! কোরআন তো বলে, নেককার যারা, মন্দের পাশ দিয়ে যায় তারা, ভদ্রতা হয় না ছাড়া। কাউকে যখন দেখো, পাপে পঙ্কিল, হও তার আবরণ, হও সহনশীল। কেন করো আমার নিন্দাবাদ ও মুণ্ডুপাত! যাও না পার হয়ে যেমন যায় অভিজাত! কবিতা- সাধু, ধন্য তব সাধুতা, পাপীরে তবু করো না ঘৃণা/ অসহায় ভেবে করো তারে উদ্ধার, করো করুণা/ পাপের পাঁকে পড়িয়া আমি না হয় হইনু দুর্জন/ তুমি সাধু মোরে দয়া করে হও না কেন সুজন। শিক্ষা- পাপকে ঘৃণা করা উচিত, পাপীকে নয়। পাপীর প্রতি বরং হওয়া উচিত সহানুভূতিশীল।

No comments: