get-fans-468x60

Tuesday, May 24, 2011

ইসলামে নারীর মর্যাদা, অধিকার ও ক্ষমতায়ন

ইসলামে নারীর মর্যাদা, অধিকার ও ক্ষমতায়ন
লিখেছেন শাহ আব্দুল হান্নান   

সমাজে নারীর অবস্থান এবং অধিকার নিয়ে আমরা নানা কথা শুনে থাকি৷ নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা বিষয়ে বর্তমানে যে কথাগুলো বলা হয় , তার মধ্যে অনেকগুলোই গ্রহণযোগ্য৷ আবার কিছু কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করার অবকাশ আছে৷ নারী-পুরুষ সকলেরই অধিকার প্রতিষ্ঠা হওয়া অনস্বীকার্য৷ কারণ সমাজ দিনে দিনে সামনে এগুচ্ছে৷ তাই শুধু নারী বা পুরুষের নয়, বরং সকল মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে হবে৷গত পঞ্চাশ বছরে সমাজ অনেকটা এগিয়েছে৷ এ সময়ে পুরুষের সাথে নারীরাও সমান-সমান না হলেও, এগিয়ে এসেছে৷ বেগম রোকেয়ার সময়ে যে সমাজ ছিল , সে সমাজকে আমরা অনেক পেছনে ফেলে এসেছি৷ তিনি দেখেছিলেন যে, সে সময়ে মেয়েরা লেখাপড়ার কোন সুযোগই পেতনা৷ সে সময়ে বেগম রোকেয়া জন্ম না নিলে এবং নারী শিক্ষার ব্যাপারে সাহসী উদ্যোগ না নিলে আজ আপনারা, নারীরা কেউই কিন্তু পড়ালেখা শিখতে পারতেন না৷ অবশ্য আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয়ই তখন অন্য কোন নারীকে পৃথিবীতে পাঠাতেন যিনি এই কাজটি করতেন৷ যা হোক, আমি সেদিকে গেলাম না৷ কারণ একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আমার আলোচনা শেষ করতে চাই৷
সারা পৃথিবীতে, বিশেষ করে আমাদের দেশে মানুষের উপর, বিশেষ করে নারীর উপর যে অত্যাচার চলছে তার একটা ফাউন্ডেশন আছে , ভিত্তি আছে৷ অত্যাচারটা আকাশ থেকে আসছে না৷ নারীর উপরে পুরুষের , কোন কোন ক্ষেত্রে নারীর যে অত্যাচার তার 'আইডিওলজিক্যাল ফাউন্ডেশন' টা হলোঃ সাধারণভাবে মানুষ বিশ্বাস করে- বিশেষ করে পুরুষরা বিশ্বাস করে যে- নারী পুরুষের চেয়ে ছোট , তাদের কোয়ালিটি খারাপ এবং তারা নিচু৷ এই বিশ্বাস অবশ্য নারীর মধ্যেও কিছুটা বিদ্যমান৷ মানুষের মধ্যে কতগুলো বিভ্রান্তি থেকে এ বিশ্বাসের জন্ম৷ আর এই বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে আছে নারীর উপর অবহেলা, বঞ্চনা এবং নির্যাতন৷
এখন আমাদের দেশ থেকে যদি নারী নির্যাতন বন্ধ করতে হয়, তবে ইসলামকে বাদ দিয়ে তা করা যাবে না৷ আমি এটা খুব পরিষ্কারভাবে আপনাদের বলতে চাই যে , ইসলামকে বাদ দিয়ে আমাদের মত দেশে (যে দেশে মূলত নব্বই ভাগ মানুষ মুসলিম) চলা যাবে না৷ যারা ইসলাম থেকে বিদ্রোহ করেছে তারা কিন্তু টিকতে পারেনি , পারছে না৷ এক মহিলা বিদ্রোহ করেছিলেন-আমি নাম বলবো না- তার পরিণতি ভাল হয়নি৷ খারাপ হয়েছে৷ বিনীতভাবে বলতে চাই যে , ইসলামের 'ফ্রেমওয়ার্ক'- এর মধ্যে আমরা যদি এগুতে পারি, তবে তা সব চাইতে ভাল হবে৷ আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ইসলামে এরকম একটি 'ফ্রেমওয়ার্ক' আছে, যা নারীদের সামনে এগিয়ে দিতে পারে৷
আমি ইসলামকে বিকৃত করতে চাইনা, বিকৃত করার পক্ষেও নই এবং ইসলামের কোনো টেম্পোরারী ব্যাখ্যা দেয়ার পক্ষে নই৷ সত্যিকার অর্থেই ইসলাম নারীকে ক্ষমতায়িত করেছে এবং নারীকে সম্মানিত করেছে৷ নারীকে অধিকার দিয়েছে৷ সেগুলো ব্যাখ্যা করার আগে আমি আইডিওলজিক্যাল ফাউন্ডেশন-এর নতুন ভিত্তি যেটা হতে পারে সেটা বলতে চাই৷
কি সেই ভিত্তি? যে ভিত্তির ওপর নারী-পুরুষের মৌলিক সাম্য বিদ্যমান? আল্লাহ মানুষের চেহারা এক রকম করেন নাই৷ সকল দিক থেকে রহ in every dot যে কোনো দু'টি মানুষ সমান নয়৷ ওজন, উচ্চতা, রঙ, শিক্ষা ইত্যাদি সবকিছুতে একটি মানুষ থেকে আরেকটি মানুষ আলাদা৷ কিন্তু মৌলিকভাবে প্রতিটি মানুষ সমান৷ আল্লাহ্র কাছে সমান৷ তার চারটি প্রমাণ আমি আপনাদের দিচ্ছি৷
১. আল্লাহ তায়ালা এ কথা খুব স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, মূল মানুষ হচ্ছে ' রূহ' ৷ যাকে আমরা ' আত্মা' বলি৷ মূল মানুষ কিন্তু শরীর না৷ দেহ তো কবরে পঁচে যাবে৷ আমরা যারা ইসলাম বিশ্বাস করি তারা জানি , মূল মানুষ হচ্ছে ' রূহ' ৷ আল্লাহ সকল মানুষকে, তার রূহকে একত্রে সৃষ্টি করেন, একই রকম করে সৃষ্টি করেন এবং একটিই প্রশ্ন করেন৷ আল্লাহর প্রশ্নের উত্তরও নারী-পুরুষ সকলে একই দিয়েছিল৷ আমি সূরা আরাফের একটি আয়াত বলিঃ ( বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম) ' ওয়া ইজা আখাজা রাব্বুকা' ( যখন আল্লাহ তায়ালা বের করলেন), ' মিম বানি আদামা' ( আদমের সন্তানদের থেকে), ' মিন জুহুরিহিম' ( তাদের পৃষ্ঠদেশ থেকে-এটা একটা রূপক কথা) ' জুররিয়াতাহুম' ( তাদের সন্তানদেরকে৷ অর্থাত্‍ সকল আত্মাকে) এবং সাক্ষ্য নিলেন তাদের ওপরে , 'আমি কি তোমাদের প্রভু নই?' তারা সকলে বললো- সকল পুরুষ এবং নারী বললো, ' বালা' ( হ্যাঁ), ' সাহেদনা' ( আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আমাদের প্রভু)৷ ( আয়াত নং-১৭২, সূরা আরাফ) তার মানে আল্লাহ্র সঙ্গে একটি পয়েন্টে সকল নারী এবং পুরুষের একটি চুক্তি হলো যে, আপনি আমাদের প্রভু; আমরা আপনাকে মেনে চলবো৷ এক্ষেত্রে পুরুষের চুক্তি আলাদা হয়নি৷ নারীর চুক্তি আলাদা হয়নি৷ সুতরাং আমরা দেখলাম , আমাদের Ideological foundation এর প্রথম কথা হচ্ছে এই যে, মূল মানুষ হচ্ছে ' রূহ' এবং তা সমান৷ এই সাম্যের পরে যদি কোনো অসাম্য থেকে থাকে তাহলে তা অত্যন নগন্য Insignificant, Very Small ; তার মানে হচ্ছে , মানুষের আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব এক এবং সে মানুষ হিসেবে এক৷ এটি হলো নারী-পুরুষের সাম্যের প্রথম ভিত্তি৷
২. আমরা পুরুষরা গর্ব করি যে, আমাদের শারীরিক গঠন বোধহয় নারীর তুলনায় ভালো, আল্লাহ বোধহয় আমাদেরকে তুলনামূলকভাবে শ্রেষ্ঠ করে বানিয়েছেন এবং মেয়েরা আনকোয়ালিফায়েড৷ কিন্তু আল্লাহ একটি কথা কোরআনে খুব পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন যে , সকল মানুষের মধ্যে পার্থক্য আছে, কিন্তু প্রতিটি মানুষ ফার্ষ্ট ক্লাশ৷ যারা নামাজ পড়েন তারা এই আয়াতটা জানেন , সূরা ' ত্বীন'- এ আল্লাহ বলছেন (বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম) ' লাকাদ খালাক্বনাল ইনছানা ফি আহছানি তাক্বওয়ীম' ( নিশ্চয়ই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সর্বোত্তম কাঠামোতে-পুরুষকে বলেন নাই)৷ তার মানে আমাদের গঠনে পার্থক্য আছে , আমরা এক না, আমরা ভিন্ন কাঠামোর৷ কিন্তু সবাই ফার্ষ্ট ক্লাস, স-বা-ই ফার্ষ্ট ক্লাস ৷ সুতরাং নারী-পুরুষের মৌলিক সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য, নতুন নারী আন্দোলনের জন্য অথবা নতুন মানব আন্দোলনের জন্য পুরুষদের এ কথা বলা ঠিক না যে , মেয়েদের স্ট্রাকচার খারাপ৷ আল্লাহ্ তাতে অসন্তুষ্ট হবেন৷ আপনারা যারা মোমেন, যারা বিশ্বাসী-তারা এ কথা বলবেন না৷ সুতরাং নারী-পুরুষের মৌলিক সাম্যের এটা হলো দ্বিতীয় প্রমাণ৷ মৌলিক এ কারণে বলছি যে , নারী-পুরুষের মধে ছোটোখাটো পার্থক্য বিদ্যমান৷
৩. আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্টভাবে বলছেন যে, সকল মানুষ এক পরিবারের৷ আদম এবং হাওয়া পরিবারের৷ সূরা নিসার প্রথম আয়াতে আল্লাহ বলছেন , "হে মানব জাতি , সেই রবকে তুমি মানো যিনি তোমাদেরকে একটি মূল সত্ত্বা (নফস) থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং সেই সত্ত্বা থেকে তার সাথীকে সৃষ্টি করেছেন এবং এই দুই জন থেকে তিনি অসংখ্য নারী ও পুরুষ সৃষ্টি করেছেন"৷ তার মানে আমরা এক পরিবারের৷
আমরা হচ্ছি বনি আদম৷ আদমের সন্তান৷ আল্লাহ পাক কোরআন শরীফে অন্ততঃ ২০/৩০ বার বলেছেন , ' ইয়া বনি আদামা' ( হে আদমের সন্তানেরা)৷ বাপ-মা এবং সন্তানেরা মিলে যেমন পরিবার তৈরী হয়, তেমনি ইসলামের দৃষ্টিতে মানব জাতি একটি পরিবার৷ সব পরিবারের ওপর হলো মানব জাতির পরিবার৷ তার মানে আমাদের মৌলিক সম্মান ও মর্যাদা , তা সমান৷ ছোট খাটো কারণে আমাদের মধ্যে পার্থক্য হয়ে যায়৷ তবে জাগতিক মর্যাদা আসল মর্যাদা না৷
আইনের ভাষায় যেমন বলা হয়, আইনের চোখে সকল মানুষ সমান, তেমনি আল্লাহর কাছেও সবাই সমান৷ আল্লাহ্র কাছে সম্মানের একমাত্র ভিত্তি হলো ' তাক্বওয়া' ৷ আল্লাহ বলেন নাই যে, তার কাছে পুরুষ সম্মানিত বা নারী সম্মানিত৷ আল্লাহ বলছেন, ' ইন্না আকরামাকুম ইন্দাল্লাহি (আল্লাহর কাছে), ' আতক্বাকুম' ( যে মেনে চলে আল্লাহকে)৷ আল্লাহ্র কাছে যদি মর্যাদার এই ভিত্তি হয়, তাহলে মানুষের পার্থক্যে কি কিছু যায় আসে? আল্লাহ বলছেন তিনি ' তাক্বওয়া' ছাড়া (আল্লাহকে কে মানে আর কে মানেনা) কোনো পার্থক্য করেন না৷ অতঃপর আমরা এক পরিবারের সন্তান, আমাদের মৌলিক মর্যাদা সমান৷ (সূরা হুজুরাত, আয়াত-১৩) আরেকটি কথা, কোরআনের সূরা নিসার একটি আয়াতের শেষ অংশে আল্লাহ বলছেন "এবং ভয় পাও সেই আল্লাহকে বা মান্য করো সেই আল্লাহকে , যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে অধিকার দাবী করে থাক৷ এবং ভয় পাও ' গর্ভ'- কে বা ' মা'- কে৷ আল্লাহ বলছেন ' গর্ভ'- কে ভয় পাও৷ কোরআন শরীফের এই আয়াতটির তফসিরে সৈয়দ কুতুব নামে মিশরের একজন বিখ্যাত আলেম লেখেন , এই ভাষা পৃথিবীর কোনো সাহিত্যে কোরআনের আগে লেখা হয় নাই৷ আল্লাহ ' গর্ভ '-কে ভয় করতে বলে মা '- কে সম্মান করার কথা বলেছেন, নারী জাতিকে সম্মান করার কথা বলেছেন৷ সুতরাং আমাদের মৌলিক সামাজিক মর্যাদা এক্ষেত্রেও সমান বলে প্রতীয়মান হলো৷ এটা আমাদের নতুন আইডিওলজিক্যাল ফাউন্ডেশনের তৃতীয় প্রমাণ৷
৪. আল্লাহ্ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টির সময় বলে দিলেন যে, " তোমরা সবাই খলিফা"৷ তিনি বললেন, " ইন্নি জায়লুন ফিল আরদে খলিফা"৷ আল্লাহ বলেন নাই যে, নারী পাঠাচ্ছেন বা পুরুষ পাঠাচ্ছেন৷ এমনকি তিনি বলেন নাই যে , তিনি মানুষ পাঠাচ্ছেন; আল্লাহ বললেন, তিনি খলিফা পাঠাচ্ছেন৷ পাঠালেন মানুষ, বললেন খলিফা৷ মানুষকে তিনি খলিফা নামে অভিহিত করলেন৷ খলিফা মানে প্রতিনিধি৷ আমরা পুরো মানব জাতি হচ্ছি আল্লাহর প্রতিনিধি৷ পুরুষ , নারী নির্বিশেষে আমরা প্রত্যেকে তাঁর প্রতিনিধি-আল্লাহর প্রতিনিধি৷ তবে এ কথা ঠিক যে , যদি আমরা গুণাহ্ করি, অন্যায় করি, খুন করি, অত্যাচার করি, জুলুম করি, ঈমান হারিয়ে ফেলি, তাহলে আমাদের খলিফার মর্যাদা থাকে না৷ কিন্তু মূলতঃ আমরা আল্লাহ পাকের খলিফা৷ (কুরআন ২:৩০; ৩৫:৩৯)
এই খলিফার মর্যাদার মধ্যেই রয়েছে সকল ক্ষমতায়ন; যে ক্ষমতায়নের কথা আমরা বলি৷ ক্ষমতা ছাড়া কেউ কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারে না৷ খেলাফতের দায়িত্ব পালন করতে গেলে প্রত্যেক নারী এবং পুরুষের কিছু ক্ষমতা লাগবে৷ নারীর ক্ষমতায়নের ভিত্তি এই খেলাফতের মধ্যে রয়েছে৷ শুধু নারী নয়, ' খেলাফত' শব্দের মধ্যে নারী, পুরুষ, গরিব, দুর্বল সকলের ক্ষমতায়নের ভিত্তি রয়েছে৷ সুতরাং নারী পুরুষ মৌলিক সাম্যের এটি হলো চতুর্থ প্রমাণ৷
ইসলাম চায় every man, every woman, every person should be empowered ; কিন্তু এই মুহ র্তে যদি নারীরা বঞ্চিত থেকে যায়, তবে তাদেরকে ক্ষমতায়িত করতে হবে৷ পুরুষরা কোনোদিন বঞ্চিত হলে তাদেরকে ক্ষমতায়িত করতে হবে৷ তবে যে বঞ্চিত তার কথা আমাদের আগে ভাবতে হবে ; নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য বর্তমানে আমাদের আগে কাজ করতে হবে৷
আজকে আপনাদের আলোচনায় মেয়েদের আসল কাজ কি, তা নিয়ে কথা উঠেছে৷ তারা কি ঘরে বসে থাকবে? এমন প্রশ্ন উঠেছে৷ কোনো মেয়ে যদি তার স্বাধীন সিদ্ধানে ঘরে থাকতে চায়, তার সেটা করার অধিকার আছে৷ পুরুষের ক্ষেত্রেও বিষয়টি প্রযোজ্য৷ কিন্তু আল্লাহ কোথাও বলেন নাই যে, নারীদের ঘরে বসে থাকতে হবে , বাইরের কাজ নারীরা করতে পারবে না৷ বরং আল্লাহ মূল দায়িত্ব নারী-পুরুষের একই দিয়েছেন৷ সূরা ' তওবা' র ৭১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন যে, নারী পুরুষের দায়িত্ব ৬টি৷ আয়াতটি এরকম: মোমেন পুরুষ এবং মোমেন নারী একে অপরের অভিভাবক (ওয়ালী) , একে অপরের বন্ধু, একে অপরের সাহায্যকারী (এই আয়াত কোরআন শরীফের সর্বশেষ সূরাসম হের একটি৷ উল্লেখিত বিষয়ে আগে যে সকল আয়াত আছে সেগুলোকে এই আয়াতের আলোকে ব্যাখ্যা করতে হবে)৷ এই আয়াতে বলা হয়েছে যে, নারী পুরুষ একে অপরের অভিভাবক, গার্জিয়ান৷ অনেকে বলে যে, নারী গার্জিয়ান হতে পারে না৷ কিন্তু আল্লাহ বলেছেন, নারী গার্জিয়ান হতে পারবে৷ মূল কোরআনে এ ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য নেই৷ নারী-পুরুষের নির্ধারিত ৬টি ডিউটি হলোঃ
ক. তারা ভালো কাজের আদেশ দিবে৷
খ. মন্দ কাজের ব্যাপারে নিষেধ করবে৷
গ. উভয়ে নামাজ কায়েম করবে৷
ঘ. যাকাত দিবে৷
ঙ. আল্লাহকে মানবে৷
চ. রসুলকে মানবে৷
এসব কথার মাধ্যমে আল্লাহ নারীদের সকল ভাল কাজে অংশগ্রহণের কথা বলেছেন৷ এটাই ইসলামের নীতি৷ এ বিষয়ে আল্লাহ বলেছেন যে , যারা এই ৬টি দায়িত্ব পালন করবে তাদের ওপর আল্লাহ তায়ালা রহমত করবেন৷ কোরআনের বেশ কয়েকটি তফসির পড়ে এবং পবিত্র কোরআন ও সুন্নাতে রাসুলে পুরোপুরি বিশ্বাসী একজন মানুষ হিসেবে আমি বিশ্বাস করি যে, এই ছয়টি দায়িত্বের মধ্যে নারী পুরুষ সবাই সমান৷ রাজনীতি , সমাজসেবা ইত্যাদি সব কাজই এ ৬টির আওতায় পড়ে৷
আমার মনে হয় আমরা ইসলামের মূল জিনিস পরিত্যাগ করে ছোট-খাটো জিনিস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি৷ মানুষের তৈরী বিভিন্ন কিতাবের ওপর নির্ভর করছি৷ আল্লাহর মূল কিতাবকে আমরা সেই তুলনায় গুরুত্ব দিচ্ছি বলে মনে হচ্ছে না৷ শেষে একটি কথা বলি , ইসলামকে যদি আপনারা অন্যের মাধ্যমে শেখেন , তবে আপনারা কখনোও মুক্তি পাবেন না৷ আপনাদেরকে কোরআনের পাঁচ-ছয়টি তাফসির নিজে পড়তে হবে৷ অনেকে অনুবাদের মধ্যে তাদের নিজেদের কথা ঢুকিয়ে দেয়৷ ফলে পাঁচ-ছয়টি বই পড়লে আপনারা বুঝতে পারবেন কোথায় মানুষের কথা ঢুকছে; আর আল্লাহর কথাটা কি৷ কয়েক রকম ব্যাখ্যা পড়লে আপনি ঠিক করতে পারবেন কোন ব্যাখ্যাটা ঠিক৷ মেয়েদের মধ্যে বড় তাফসিরকারক হয়নি৷ এটা মেয়েদের ব্যর্থতা , মেয়ে তাফসিরকারকদের থাকলে হয়তো gender bias হতো না৷ তবে কোরআন শরীফের কিছু তাফসীর আছে যেগুলো free from gender bias ; যেমন মোহাম্মদ আসাদের "দি ম্যাসেজ অব কোরআন"৷
লেখক সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার
দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর ২৩তম উজ্জীবক প্রশিক্ষণে দেয়া শাহ্ আব্দুল হান্নানের বক্তব্যের সংকলিত অংশ৷

মসজিদে নববী যিয়ারতের কিছু আদব-কায়দা

মসজিদে নববী যিয়ারতের কিছু আদব-কায়দা
লিখেছেন মসজিদে নববীর পরিচালনা-পরিষদ   
বিস্‌মিল্লাহির রাহ্‌মানির রাহিম

মসজিদে নববীর সাথে সংশ্লিষ্ট আদবসমূহ

অনুবাদ: নূরুল্লাহ্ তা'রীফ
সমস্ত প্রশংসা বিশ্ব-জাহানের প্রতিপালক ‘আল্লাহ্‌ তাআলার’ জন্য। প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক।
প্রিয় মুসলিম ভাই,
সে মহান আল্লাহর প্রশংসা করুন যিনি আপনাকে রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মসজিদে পৌঁছিয়েছেন। যে মসজিদের এক রাকাত নামাজ অন্য মসজিদের হাজার রাকাত নামাজের চেয়ে বেশী উত্তম, শুধু ‘মসজিদে-হারাম’ ছাড়া। যেখানে কল্যাণকর কিছু শিখতে আসা অথবা শিখানোর উদ্দেশ্যে আসা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার তুল্য। অতএব মসজিদে নববীতে যত বেশী নামাজ আদায় করা যায় সে জন্য আপনার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকা উচিত এবং মসজিদে যে সকল ইলমের আসর রয়েছে সেগুলো থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য আপনার আগ্রহ থাকা উচিত, যেন আপনি স্বচ্ছ জ্ঞানের ভিত্তিতে আল্লাহর ইবাদত পালন করতে পারেন এবং অজানা বিষয়গুলো প্রশ্ন করে জেনে নিতে পারেন।
বিস্‌মিল্লাহির রাহ্‌মানির রাহিম
মসজিদে নববী যিয়ারতের কিছু আদব-কায়দা

فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لا تَعْلَمُونَ) (الانبياء:7
“আর তোমরা যদি না জান তবে আলেমদের জিজ্ঞেস কর।” [সূরা আম্বিয়া-৭] জেনে রাখুন, এ মসজিদের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু আদব-আখলাক রয়েছে যেগুলো আমাদের বজায় রাখা উচিত। এর কয়েকটি আমরা আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি-
(১) মুসলিম নর-নারী পরিপূর্ণ ভাব-গাম্ভীর্যতা বজায় রেখে, ধীর-স্থিরে, পবিত্রতার সাথে, সুন্দর বেশ-ভূষা নিয়ে মসজিদে আসবেন। বিড়ি-সিগারেট, পেঁয়াজ, রসূন ইত্যাদির র্দুগন্ধ থেকে মুক্ত হয়ে ভাল ঘ্রাণ নিয়ে তারা আল্লাহর ঘরে আসবেন। কারণ বনী আদম যা থেকে কষ্ট পায় আল্লাহর ফেরেশতারাও তা থেকে কষ্ট পায়।
(২) ডান পা দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করবেন এবং মসজিদে প্রবেশের দোয়া পড়বেন। বলবেন-
بِسْمِ اللهِ وَ الصَّلاَةُ وَ السَّلاَمُ عَلَى رَسُوْلِ اللهِ، أَعُوْذُ بِاللهِ الْعَظِيْمِ وَ بِوَجْهِهِ الْكَرِيْمِ وَ سُلْطَانِهِ الْقَدِْيمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ، اَلَّلهُمَّ افْتَحْ لِيْ أَبْوَابَ رَحْمَتِكَ.
মসজিদে ঢুকে প্রথমে ‘তাহিয়্যাতুল’ মসজিদ দুই রাকাত নামাজ পড়বেন, তারপর যিকির-আযকার, ইবাদত-বন্দেগী বা কুরআন তেলাওয়াতে মশগুল হবেন।
(৩) আপনি যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবরে সালাম দিতে যাবেন তখন আদবের সাথে তাঁর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে নিম্নস্বরে বলবেনঃ
السَّلَامُ عَلَيْكَ أَيُّهَا النَّبِيُُّ وَ رَحْمَةُ اللهِ وَ بَرَكَاتُهُ. أَشْهَدُ أنَّكَ بَلَّغْتَ الرِّسَالََةََ وَ أدَّيْتَ الأمَانَةَ وَ نَصَحْتَ الأُمَّةَ وَ جَاهَدْتَ فِيْ اللهِ حَقَّ جِهَادِه، فَجَزَاكَ اللهُ عَنِّي وَ عَنِ الْمُسْلِمِيْنَ خَيْرَ الْجَزَاء.
“হে নবীজি, আপনার প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি রিসালত পৌঁছিয়েছেন, আপনার দায়িত্ব পালন করেছেন, উম্মতকে নসীহত করেছেন, আল্লাহর রাস্তায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। আল্লাহ আপনাকে আমার পক্ষ থেকে এবং সকল মুসলিমের পক্ষ থেকে উত্তম বিনিময় দান করুন।”
এরপর আবু বকর ও উমর রাদিআল্লাহু আনহুমার নাম উল্লেখ করে তাদেরকে সালাম দিবেন। তারপর আপনি মসজিদের যে কোন নিরিবিলি স্থানে গিয়ে আল্লাহর কাছে যা ইচ্ছা দোয়া করুন। এই একীন ও এই বিশ্বাসের সাথে দোয়া করবেন - ভাল-মন্দের মালিক একমাত্র আল্লাহ্‌। অতএব অন্য কারো ধর্ণা না ধরে দুনিয়া-আখেরাতের যাবতীয় প্রয়োজন সরাসরি তাঁর কাছে পেশ করুন। প্রিয় নবীজি [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] ইরশাদ করেছেন, “যখন তুমি প্রার্থনা কর তখন সরাসরি আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা কর। যখন তুমি সাহায্য কামনা কর তখনও সরাসরি আল্লাহর কাছেই সাহায্য কামনা কর।” বরকতের নিয়তে মসজিদের গ্রিল বা দেয়াল স্পর্শ করবেন না, চুমা খাবেন না। রাসূলকে [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] সালাম দেয়ার সময় নামাযে দাঁড়াবার মত হাত বেধে দাঁড়াবেন না এবং দূর থেকে সালাম দিবেন না, কারণ এটা সাহাবায়ে কেরামের আমলের বরখেলাফ।
(৪) মসজিদে থাকাকালীন সময়টাকে পরিপূর্ণ কাজে লাগান। ফরজ নামাজ শেষে নামাজের জায়গায় বসে তাসবীহ পড়ুন, যিকির করুন অথবা কুরআন তেলাওয়াত করুন। সবসময় ভিড়মুক্ত স্থান নির্বাচন করুন, যেন ভিড় সৃষ্টিতে আপনার কোন অংশগ্রহন না থাকে এবং অপর মুসলিম ভাইকে কষ্ট দিয়ে আপনি গুনার-ভাগী না হন।
(৫) কাতারের খালি জায়গা পূর্ণ করার জন্য উৎসাহী হোন। চাপাচাপি না হলে ফজীলত পাওয়ার জন্য সবসময় সামনের কাতারে দাঁড়াবার চেষ্টা করুন। যাতায়াতের পথে অথবা দরজার সামনে বসবেন না। এতে রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে অন্য মুসলিম ভায়ের কষ্ট হয়। বাইরের আঙ্গিনায় নামাজ পড়াকালে ইমামের সমান্তরালের সামনে গিয়ে কাতার করবেন না। পিলারগুলোর সাথে লাগানো সাইনবোর্ড দেখে ইমামের সমান্তরাল রেখা জেনে নিন।
(৬) আল্লাহর কিতাবকে যথাযথ সম্মান করুন। কুরআনের উপরে বা ভিতরে কিছু লিখবেন না, এর পাতা নিয়ে অনর্থক খেলা করবেন না। কুরআন শরীফের পাশে জুতা রাখবেন না।
(৭) কফ, থুথু ও ময়লা-আবর্জনা থেকে মসজিদ এবং মসজিদের আঙ্গিনাকে পরিচ্ছন্ন রাখুন। আপনার শিশুকে মসজিদের আদব-কায়দা শিক্ষা দিন। অনর্থক খেল-তামশা ও হৈ-হুল্লোড় থেকে তাদেরকে বিরত রাখুন।
(৮) মসজিদ থেকে একটু বিলম্বে বের হতে পারেন, যাতে মসজিদের গেটগুলোতে ভিড় অপেক্ষাকৃত কম হয়।
(৯) জেনে রাখুন মসজিদ ঘুমাবার জায়গা নয়। ভিক্ষা করা বা হারানো বস্তু তালাশ করার জন্য মসজিদ নয়।
(১০) খাবার পানি দিয়ে অজু করবেন না এবং মসজিদের কার্পেটগুলোকে গোল করে বালিশ বানাবেন না অথবা গায়ে দিবেন না। এ কার্পেটগুলো নামাজ পড়ার জন্য ওয়াক্‌ফ করা হয়েছে, বিছানা বানাবার জন্য নয়। তদ্রূপ কুরআন শরীফের রেহালগুলো মাথার নীচে দিয়ে ঘুমাবেন না, কারণ এগুলো শুধুমাত্র কুরআন শরীফ রাখার জন্য ওয়াক্‌ফকৃত।
পরিশেষে বলতে চাই, মসজিদ নববীর পরিচালনা-পরিষদের সাথে আপনার সহযোগিতা এবং যে কোন ধরণের সু-পরামর্শ বা মন্তব্য এ পবিত্র স্থানের যিয়ারতকারীদের সেবার মানকে আরো উন্নত করতে সহায়তা করবে। অতএব নির্দ্বিধায় এ জাতীয় যে কোন মন্তব্য বা পরামর্শ কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করুন। আল্লাহ্‌ আপনার আমল কবুল করে নিন, আপনার প্রতিদান বহুগুনে বৃদ্ধি করুন।
আস্‌সালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ।
মসজিদে নববীর পরিচালনা-পরিষদ
মদীনা মোনাওয়ারা
সৌদি আরব

বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে স্রষ্টাকে ভুলে যাওয়া

লিখেছেন শাহ আব্দুল হান্নান  
দার্শনিকভাবে দেখলে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আল্লাহকে ভুলে যাওয়া, স্রষ্টাকে ভুলে যাওয়া৷ যিনি আমাকে বানিয়েছেন তাঁকে ভুলে যাওয়া৷ আল্লাহ নিজেই বলেছেন: "ইয়া আইয়্যুহাল ইনসানু মা গার্রাকা বি রাব্বিকাল কারিম" অর্থাৎ, হে মানুষ কিসে তোমাকে তোমার মহিমান্বিত রব সম্পর্কে উদাসীন করল? (৮২:৬ )সত্যিকার অর্থেই বেশীর ভাগ মানুষ বাস্তবে স্রষ্টাকে ভুলে গিয়েছে৷ ইউরোপ-আমেরিকায় নাস্তিকের সংখ্যা অনেক৷ রাশিয়া পূর্বে অফিসিয়ালি নাস্তিক ছিল৷ এখনও সেখানে নাস্তিকতার হার কম নয়, বরং অনেক হবে৷ অন্যদিকে যারা বিশ্বাসী বলে দাবী করে তাদের মধ্যেও অনেকে সন্দেহবাদী (skeptic)৷ অর্থাৎ বলবে না যে স্রষ্টা নেই, কিন্তু বাস্তবে স্রষ্টাকে স্মরণ করবে না বা তার আদেশ মেনে চলবে না৷ স্রষ্টাকে মেনে চলবে এরকম লোকের সংখ্যা খুব কম৷
খ্রিষ্টানদের মধ্যে যারা স্রষ্টাকে বিশ্বাস করে , তাদের মধ্যে স্রষ্টার কার্যকর আনুগত্য কম৷ সে তুলনায় মুসলমানদের অবস্থা ভালো৷ এখানে নাস্তিক নেই বললেই চলে এবং যারা বিশ্বাসী তারা কোন না কোন পর্যায়ে আমল করে৷ যারা নিজেদেরকে সেক্যুলার বলে দাবী করে , তাদেরও বেশীরভাগ একটা নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত আমল করে৷ তারাও নামাজ পড়ে, ইফতার করে, সাহরী খায়, হালাল-হারাম দেখে চলে৷ তারাও কুরবানী, হজ্জ, ওমরা ও ঈদ পালন করে৷ সুতরাং মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের অনুশীলন তুলনামূলকভাবে ভাল৷
স্রষ্টাকে ভুলে যাওয়ার ফলে দু'টি সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। একটি হলো বস্তুবাদ ও নাস্তিকতা। আরেকটি হলো গোড়া সেক্যুলারিজম - সেটিও স্রষ্টাকে প্রায় অস্বীকার করার কাছাকাছি একটি অবস্থা। বিশ্ব সংকটের মূলে কাজ করছে এ দু'টি - একদিকে বস্তুবাদ ও নাস্তিকতা এবং অন্যদিকে সেক্যুলারিজম।
স্রষ্টাকে ভুলে যাওয়ার প্রভাব শিক্ষা ব্যবস্থার উপরও পড়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে সেক্যুলারিজমের উপর দাড়িয়ে আছে। বর্তমান বিজ্ঞান শিক্ষাতে রয়েছে সেক্যুলারিজমের গভীর ছাপ। ইউরোপের পন্ডিতরা এমনকি বর্তমানে মুসলমান বিজ্ঞানীরাও তাদের বইগুলো 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম' দিয়ে শুরু করেন না। কিন্তু মুসলমানরা যখন বিজ্ঞানে উন্নতি করল (চীন ও ভারত থেকে গ্রহন করে), তখন তারা অনেক দিকে বিজ্ঞানের বিস্তার ঘটাল। সেসময় ঐসব মুসলমানরা তাদের বিজ্ঞানের প্রত্যেক বইগুলো 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম' দিয়ে শুরু করতেন। তারা স্রষ্টায় বিশ্বাসী ছিলেন গভীরভাবে। কিন্তু ইউরোপীয় বিজ্ঞানিরা বিশ্বাসী না হওয়ায় (অথবা সেক্যুলার হওয়ায় কিংবা স্রষ্টায় বিশ্বাস করা তাদের কাছে একটি লজ্জার বিষয় হওয়ায়), তারা স্রষ্টার কথা উল্লেখ করেননা। আমাদের মুসলিম বিজ্ঞানীরা এটি এখন লিখতে পারেন। কিন্তু তারাও লিখছেননা। এখন না লেখা রেওয়াজ হয়ে গেছে। অথচ আগে লেখাটাই রীতি ছিল। এখন বিজ্ঞানের বইগুলোতে আল্লাহ বা গড শব্দের উল্লেখ নেই। স্রষ্টা (creator) শব্দটি লেখা হয় না। এটি একটি অদ্ভুত ব্যাপার। কোথাও কোথাও প্রকৃতি (Nature) শব্দের উল্লেখ আছে। কিন্তু এই প্রকৃতি কি সেটি একেবারেই স্পষ্ট নয়। তারা একবারও ভাবেনা যে, এসব প্রাকৃতিক আইন আছে কিভাবে, আইন প্রণেতা ছাড়া কি কোন আইন হয়? তারা নাকি খুব যুক্তিবাদী, কিন্তু আমি তো কোন যুক্তি দেখছি না।
আধুনিক বিজ্ঞানের অনেক ভালো দিক আছে, অনেক অবদান আছে আমরা মানি। কিন্তু এর পেছনে কাজ করছে এমন একটি মন যেটি স্রষ্টার প্রশ্নে, আল্লাহ তায়ালার ব্যাপারে সন্দেহ-সংশয়বাদীতায় ভুগছে। স্রষ্টাকে স্পষ্ট স্বীকৃতি দিচ্ছে না। আল্লাহর নাম উল্লেখ করছে না। এটি উল্লেখ করা সভ্যতা বিরোধী মনে করছে। এটি একটি পশ্চাৎপদ ব্যাপার মনে করছে। এই যে ধারণা এটা আমাদের কালচারকে খারাপ করে ফেলছে। আমাদের কালচারে সংশয়বাদ ও নাস্তিকতার প্রভাব পড়ছে।
সমাজবিজ্ঞানেরও একই রকম অবস্থা। সমাজতত্ত্ব ধরেই নেবে যে ধর্ম একটি মানব সৃষ্ট বিষয়। অথচ তারা এভাবে দেখাতে পারত যে, স্রষ্টাই আমাদের সৃষ্টি করেছেন। আমাদের একটি সামাজিক প্রবণতা বা সামাজিক মন দিয়েছেন। স্রষ্টার সার্বিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই আমাদের মধ্যে সমাজবদ্ধ হবার মানসিকতা রয়েছে। এজন্য আমরা একতাবদ্ধ হই এবং সমাজ গঠন করি। শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যান্য সেক্টরেরও একই অবস্থা। যেমন নৃবিজ্ঞানও স্বীকার করছেনা যে , মানুষকে আল্লাহর সৃষ্টি করেছেন। এটিকে তারা একেবারেই বাদ দিয়ে দিচ্ছে। নৃবিজ্ঞান মানব সৃষ্টির ইতিহাস বের করার চেষ্টা করছে মাটি খুড়ে বের করা হাড় এবং অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক চিহ্ন থেকে। এসব থেকে তারা যে ইতিহাস লিখছে তাতে তারা বলছে, মানুষ এমনি এমনিই হয়েছে; কোন স্রষ্টা নেই। এখানে উল্লেখ করতে চাই যে, দারিদ্র বিশ্বের একটি বড় সংকট, দারিদ্রের জন্য মানুষের একটি বিরাট অংশ ভাল হতে পারেনা। এ সংকটের মূলেও রয়েছে ঐ আল্লাহকে না মানা, বস্তুবাদ এবং সেক্যুলারিজম।
মানুষ বস্তুবাদী হয়ে গেছে। গরীবের জন্য, দারিদ্র দূর করার জন্য কাজ করার প্রয়োজনীয়তা সে উপলব্ধি করছেনা। অনেকেই দারিদ্র দূর করার জন্য ওয়াদা করে থাকে। আসলে তারা ওয়াদা করার জন্য ওয়াদা করে, কথা বলার জন্য বলে। সত্যিই কি কার্যকরভাবে তারা এগুলো চায়? বিশেষ করে দেশের পুঁজিবাদীরা এগুলো চায়না বলেই মনে হয়। কারণ পুঁজিবাদের তত্ত্বে গরীবের কথা নেই। প্রফিটের কথা আছে, মুক্ত বাজারের কথা আছে। সেখানে সরকারী হস্তক্ষেপ না করার কথা বলা হয়েছে। বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে বাজারের বিকৃতি (Market distortion) দূর করার কথা পুঁজিবাদী তত্ত্বের কোথাও নেই। গরীবের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে এটা পুঁজিবাদের কোথাও বলা নেই। যদিও এটা এখন পুঁজিবাদী দেশে করা হচ্ছে। কিন্তু এ ব্যবস্থা তারা পুঁজিবাদের কাঠামো থেকে বের হয়ে এসেই নিচ্ছে ।
কলোনিয়ালিজম এবং ইম্পেরিয়ালিজমও এসেছে বস্তুবাদ থেকেই। নিজের ভোগ ও জাতির ভোগের প্রেরণা থেকেই এসবের উৎপত্তি। এসবকিছুর মূল উদ্দেশ্য মানুষকে শোষণ (exploit) করা। এই যে বস্তুবাদী স্বার্থপরতা এবং পুঁজিবাদ - এসব পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়। এসবকিছু মিলে মানুষকে দায়িত্বহীন বানিয়েছে , তাকে ভোগবাদী করে তুলেছে। দায়িত্বশীল কাদের বলা যেতে পারে? যারা আল্লাহকে ভয় করে এবং দুনিয়াকে এক্সপ্লয়েট করেনা। সুতরাং সকল সমস্যার মূল কারণ যদি বলতে হয়, আমি বলব স্রষ্টাকে ভুলে যাওয়া। এজন্য যুগে যুগে নবী-রাসূলরা আহবান করেছেন আল্লাহকে মানো এবং বল, 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' - আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই। এ সমস্যার সমাধান হচ্ছে মানুষের মধ্যে স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা। মুসলিমদের এমনকি অমুসলিমদের জন্যও বলবো, যে কোন ধর্মের প্রতি বিশ্বাস নাস্তিকতা থেকে ভাল। কারণ প্রত্যেক ধর্মের একটা এথিক্স বা নীতিবোধ আছে। নাস্তিকতার কোন নীতিবোধ নেই। সে তো নিজেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন মনে করে। সে বিশ্বাস করে তার কোন বিচার হবে না, তার কোন জবাবদিহিতা নেই; সুতরাং দুনিয়ায় যা ইচ্ছা সে করতে পারে। এ ধরণের লোক সমাজের জন্য ভয়ংকর। এজন্য সবার মধ্যে স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। আল্লাহকে চেনাতে হবে যতদূব সম্ভব। সঠিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এভাবেই সমাজ তথা বিশ্ব থেকে স্বার্থপরতা দূর হতে পারে, মূল রোগ তথা মূল সমস্যা দূর হতে পারে।

আল্লাহ কোথায় আছেন ?


























গোটা আকাশ ও যমীনে যা কিছু রয়েছে সমস্ত কিছুই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের । এই আকীদার প্রশ্নে মুসলমানকে বুঝতে হবে জানতে হবে আল্লাহ কোথায় আছেন ? এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ মুসলমানদের মধ্যে রয়েছে একটি মারাত্মক বিভ্রান্তি । কোরআন ও সহীহ হাদীসে এ ব্যাপারে স্পষ্ট বক্তব্য এসেছে , তবুও না জানার কারণে মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্তি বিরাজ করছে। যে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং প্রতিপালন করছেন ,তাঁর অবস্থান সম্পর্কে জানা প্রত্যেক মুসলমানের একান্ত কর্তব্য। অনেকে বলে থাকেন যে , মহান আল্লহ তা’য়ালা সর্বত্র বিরাজমান এবং হাজির নাজির। এই ধারণা ও বিশ্বাস সঠিক নয়, কোরআন ও হাদীসের বিপরীত । কোরআন -হাদীসের দৃষ্টিতে সঠিক কথা হলো আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অবস্থান আরশের ওপর কিন্তু তিনি তাঁর অসীম জ্ঞান ,ক্ষমতা ,কুদরত ও দেখা শোনার মাধ্যমে সর্বত্র বিরাজমান। তিনি সত্তাগতভাবে সর্বত্র বিরাজমান নন।
আল্লাহ কোথায় আছেন ,এই প্রশ্নের জবাব কোনো মানুষের পক্ষে দেয়া সম্ভব হবে না বিধায় স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালাই তাঁর বান্দাদের জানিয়ে দিয়েছেন ,তিনি কোথায় আছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতা’য়ালা নিজের অবস্থান সম্পর্কে সাতবার বলেছেন যে, তিনি আরশে আযীমে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রসঙ্গ উল্লেখ র্পূবক মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন- () এরপর স্বীয় আরশের ওপর আসীন হয়েছেন । (সূরা আল আ’রাফ -৫৪ )এই একই বিষয় আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কোরআনের সূরা ইউনুস ,সূরা রা’দ ,সূরা ত্বাহা , সূরা ফোরকান ,সূরা সিজদা ও সূরা হাদীদে উল্লেখ করেছেন। সমস্ত কিছু সৃষ্টি করার পর তিনি আরশে সমাসীন হয়েছেন -আল্লাহ তা’য়ালার এ কথার বাস্তব রূপ অনুধাবন করা কোন মানুষের পক্ষে কক্ষণই সম্ভব নয়। তবে একটি বিষয় আল্লাহ তা’য়ালা এই কথার মাধ্যমে স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, এই মহাবিশ্ব এবং এর বাইরে যা কিছু রয়েছে ,এসব সৃষ্টি করে আল্লাহ তা’য়ালা ক্লান্ত হয়ে পড়েননি বা তিনি সৃষ্টি কাজ সমাপ্ত কের তাঁর সৃষ্টি থেকে তিনি সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেননি। তিনি নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে অচেতন , বেখবর ,অসজাগ ,অসতর্ক বা দৃষ্টি ফিরিয়ে নেননি। অথবা সৃষ্টি করে তিনি তার সৃষ্টি জগৎ পরিচালনার দায়িত্ব ও কারো প্রতি অর্পন করেনি। এই বিষয়টি স্পষ্ট করে দেয়ার লক্ষেই তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে,তিনি আরশে সমাসীন হয়েছেন । অর্থাৎ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন গোটা মহাবিশ্বেও শুধুমাত্র সৃষ্টি কর্তাই নন, তিনি এই মহাবিশ্বেও প্রতিপালক ,নিয়ন্ত্রক ,ব্যবস্থাপক ,পরিচালক ,পর্যবেক্ষক ,সমস্ত সৃষ্টির প্রয়োজন পূরণকারী ,আবেদন শ্রবণকারী, দোয়া কবুলকারী এবং সম্স্ত সৃষ্টির প্রয়োজনীয় আইন কানুন ও বিধান দানকারী।
আল্লাহ তা’য়ালা আরশের ওপর সমাসীন হয়েছেন এই বিষয়টি মানুষকে জানিয়ে দিয়ে তিনি এ কথাই স্পস্ট করে দিয়েছেন যে. তিনি এই মহাবিশ্বকে অস্তিত্বশীল করে অবসর গ্রহণ করেননিএবং মহাবিশ্ব থেকে নিঃসম্পর্ক হয়ে যাননি। বরং মহাবিশ্ব লোকের ক্ষুদ্র থেকে সর্ববৃহৎ অংশ পর্যন্ত সবস্তরের বিষয়াদিও ওপর কর্তৃত্ব তিনিই করছেন। শাসন কার্য পরিচালনা ও সার্বভৌমত্বও সমস্ত ক্ষমতা ও ইখতিয়ার একমাত্র তাঁরই মুষ্ঠিতে নিবদ্ধ। মহাবিশ্ব ও এর বাইরে যা কিছু রয়েছে ,সবকিছু তাঁরই অধীন ও মুখাপেক্ষী । প্রত্যেকটি অণু পরমাণু তাঁর বিধানের অধীনে ক্রিয়াশীল । সৃষ্টিসমূহের ভাগ্য চিরস্থায়ীভাবে তাঁর বিধানের অধীনে বন্দী।
আল্লাহতা’য়ালা কয়েকটি স্তরের মহাবিশ্ব সৃষ্টি করে আরশে সমাসীন হয়েছেন এই কথার মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পৃথিবীর মানুষের কাছে এ কথা স্পস্ট করে দিয়েছেন যে ,তাঁর সৃষ্টি কাজে যেমন কারো কোনো অংশীদার ছিলনা ,অনুরূপভাবে সৃষ্টি কাজের পরিচালন ,প্রতিপালন ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে কারো সমান্যতম অংশীদারিত্ব নেই। তাঁর আরশ বা সিংহাসন যা সমস্ত সৃষ্টির কেন্দ্রে ,সেখানে থেকেই তিনি সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন। মানুষকেও তিনি স্বাধীন ক্ষমতা দিয়ে ছেড়ে দেননি। মানুষের প্রত্যেকটি স্পন্দনের প্রতি তিনি সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন। মানুষের জীবন পরিচালনার জন্য যেসব বিধি বিধান প্রয়োজন,সে বিধানও তিনি আরশ বা সিংহাসন থেকে অবতীর্ণ করেছেন। সুতরাং মানুষের স্বেচ্ছাচারী হওয়া বা নিজের ভাগ্যেও মালিক নিজেকে মনে করার কোন অবকাশ নেই এই কথাটিই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্পস্ট করে দিয়েছেন এভাবে যে,তিনি আরশে সমাসীন হয়েছেন । অর্থাৎ মূল কেন্দ্রে থেকে তিনিই সমস্ত কিছুর নিয়ন্ত্রণ করছেন্ । নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসল্লাম বলেছেন -() নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’য়ালা নিজ আরশের ওপর রয়েছেন । তাঁর আরশ হচ্ছে সমস্ত আকাশের ওপর । (আবু দাউদ )
মহান আল্লাহ তা’য়ালা আরশে আসীন হয়েছেন আর আরশ হলো অগণিত আকাশের ওপরে । আল্লাহ তা’য়ালা যে তাঁর মহান আরশে অধিষ্ঠিত এবং আরশ যে ওপরে অবস্থিত এ বিষয়ে কোরআন ও হাদীসে অসংখ্য প্রামণ রয়েছে। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে বলা হয়েছে- () “ফেরেশতাগণ এবং রুহ আল্লাহ তা’য়ালার দিকে ঊর্ধ্বগামী হয়। (সূরা মায়ারিজ ৪)
তাঁরই দিকে আরোহন করে উত্তম কথা এবং সৎকর্ম তাকে তুলে নেয়। (সূরা ফাতির ১০ )
বরং আল্লাহ তাঁকে (ঈসাকে )উঠিয়ে নিয়েছেন নিজের দিকে । (সূরা আন নিসা ১৫৮ )
বিশ্বমানবতার মুক্তি সনদ মহাগ্রন্থ আল কোরআন সম্পর্কে বলা হয়েছে,- এই কিতাব অবতীর্ণ করা হয়েছে।
পাশাপাশি কোনো স্থান থেকে বা নীচু স্থানে থেকে কোন কিছু প্রেরণ করা হলে অবতীর্ণ করা করা বুঝায় না। ওপর থেকে কোনো কিছু প্রেরণ করা হলে তা অবতীর্ণ করা বুঝায় । আল্লাহ তা’য়ালা কোরআন সম্পর্কে বলেছেন -() এই একটি কিতাব যা আমি তোমার প্রতি অবর্তীণ করেছি যাতে তুমি মানুষকে অন্ধাকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে এসো। (সূরা ইবরাহীম ১) ()
নিশ্চয়ই আমি তোমার প্রতি সত্যসহ কিতাব অবতরণ করেছি ,যাতে আল্লাহ তোমাকে যা বুঝিয়েছেন তা দিয়ে তুমি মানুষের মধ্যে শাসন ও ফয়সালা করতে পারো। (সূরা নিসা ১০৫ )
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার পর বায়তুল মাকদাসকে কিবলা হিসেবে নামায আদায় করতেন। তিনি মনে মনে কামনা করতেন ,মক্কার কা’বাঘরকে যদি কিবলা বানানো হতো । এ জন্য তিনি বার বার আকাশের দিকে দৃষ্টি দিতেন। তাঁর দৃষ্টি দেয়ার অর্থ এটা ছিলো যে,ওপর থেকেআল্লাহতা’য়ালা যদি কোনো আদেশ দিতেন । মহান আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর রাসূলের মনের অবস্থা দেখলেন এবং রাসূলকে জানিয়ে দিলেন- () নিশ্চয়ই আমি তোমাকে বার বার আকাশের দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে দেখি । (সূরা বাকারা ১৪৪)
আল্লাহর রাসূলের থেকে মহান আল্লাহর পরিচয় আর কে বেশী জানতে পারে ? তিনিই সব থেকে বেশী আল্লাহর পরিচয় ও অবস্থান সম্পর্কে অবগত ছিলেন । তিনি জানেনে যে ,মহান আল্লাহ তা’য়ালা ওপরে আরশে আযীমে অবস্থান করছেন। এ জন্যই তিনি বার বার ওপরের দিকে তাকাতেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্জে আরাফার দিনে উপস্থিত সমস্ত সাহাবায়ে কেরামকে লক্ষ্য করে বললেন আল্লাহ পক্ষ থেকে আমার কাছে যা কিছু অবতীর্ন হয়েছে ,আমি কি তা তোমাদের কাছে পৌঁছিয়েছি ? উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ জবাব দিলেন অবশ্যই ।তখন তিনি উপস্থিত সাহাবায়ে কেরামকে ইশারা করে আকাশের দিকে শাহাদাত আঙ্গুলি উঠিয়ে বললেন, হে আল্লাহ ! তুমি সাক্ষী থেকো। (মুসলিম )
এ কথা যদি বলা হয় যে,আল্লাহ তা’য়ালা সব জায়গায় আছেন বা তিনি সর্বত্র বিরাজমান। তাহলে তিনি পাহাড় -পর্বত ,নদী- নালা ,খাল- বিল, হাওড়- সাগর মহাসগর, আকাশ- বাতাস, আগুন -পানি ,ময়লা -আবর্জনার, ভাগাড়, মল -মূত্রের ভান্ড তথা বাঞ্ছিত-অবাঞ্ছিত সকল স্তরেই তিনি রয়েছেন । সেসব জায়গা অবাঞ্ছনীয়, অবান্তর সেসব জায়াগতেও আল্লাহকে থাকতে হয়। পৃথিবীর সব থেকে নিকৃষ্টি, দুগন্ধময়,অপবিত্র তথা যেখানে বা যে স্থান কোনো মানুষের পক্ষে বাস করা সম্ভব নয় সেখানেও আল্লাহ তা’য়ালা রয়েছে।
হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত মুয়াবিয়া ইবনে হাকাম আসলামী রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুর দাসীকে প্রশ্ন করলেন -() বলো আল্লাহ তা’য়ালা কোথায় ? দাসী জবাব দিলো আল্লাহতা’য়ালা আকাশের ওপর ।তিনি পুনরায় সেই দাসীকে প্রশ্ন করলেন বলো আমি কে ?দাবী জাবাব দিলো আপনি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসূল। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন হযত মুয়াবিয়া ইবনে হাকামকে আদেশ দিলেন এই দাসীকে মুক্ত করে দাও। কারণ সে ঈমানদার (মুসলিম )

বিচার

বিচার

বসরা শহরের এক গৃহস্থের দুই পুত্র ছিল। বড়জনের নাম হাতেম ও ছোটজনের নাম কাযেম। একবার ব্যবসায় তারা কিছু বাড়তি অর্থ লাভ করল এবং মনে করল বিদেশে সফরে যাবে। দিন তারিখ দেখে তারা দু’ভাই এক সাথে বেরিয়ে পড়ল। তিনদিন সফরের পর তারা এক মুসাফির খানায় আশ্রয় নিল। সেখানে রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে আবার যাত্রা শুরু করল।
কিছু দূর যেতেই তারা নদীতে একটি পুটলী ভেসে যেতে দেখে উপরে তুলল। খুলে দেখে তারা অবাক হয়ে গেল। পুটলীতে এক হাযার সোনার মোহর ও দু’টি হীরকখন্ড পেয়ে তারা আল্লাহ্র প্রশংসা করল। স্বর্ণমুদ্রা ও হীরকখন্ড নিজেরা সমানভাবে ভাগ করে নিল। এরপর আবার চলতে শুরু করল। কিন্তু সঙ্গে এত অর্থ ও মূল্যবান হীরক নিয়ে চলা তারা নিরাপদ মনে করল না। তাই দু’জনে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিল যে, ছোট ভাই এগুলোকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবে। আর বড় ভাই কিসরা নগরে যাবে। হাতেম বলল, এগুলি নিয়ে তুমি বাড়ি গিয়ে তোমার ভাবীর হাতে দিবে। ছোট ভাই কাযেম বাড়ি গিয়ে ভাইয়ের দেওয়া স্বর্ণমুদ্রাগুলি ভাবীর কাছে দিল। কিন্তু হীরকখন্ড না দিয়ে নিজের কাছে রেখে দিল। এ সম্পর্কে হাতেমের স্ত্রী কিছুই জানতে পারল না।
এদিকে বড় ভাই হাতেম নানা দেশ ঘুরে ব্যবসা-বাণিজ্য করে টাকা-পয়সা ও মালামাল নিয়ে তিন বছর পর দেশে ফিরে এলো। কয়েকদিন পর সে স্ত্রীকে সোনার মোহর ও হীরকখন্ড সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল যে, কাযেম হীরকখন্ড দেয়নি। তখন হাতেম কাযেমকে জিজ্ঞেস করল, হীরক খন্ডের খবর কি? তা তুমি তোমার ভাবীর হাতে দাওনি। কাযেম কসম করে বলল, ভাই আপনার স্ত্রী মিথ্যা বলেছে। কাযেমের কথা বিশ্বাস করে হাতেম তার স্ত্রীকে তিরস্কার করল। হাতেমের স্ত্রী গালাগাল শুনে অপমানিত হয়ে স্বামীকে না জানিয়ে উক্ত শহরের কাযীর কাছে গেল এবং আনুপূর্বিক ঘটনা বর্ণনা করে সুবিচার প্রার্থনা করল।
কাযী হাতেম ও কাযেমকে ডেকে আনলেন এবং তাদের কাছে ঘটনার বিবরণ জানতে চেয়ে সত্য কথা বলার জন্য অনুরোধ করলেন। কাযী কাযেমকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি যখন হীরকখন্ড হাতেমের স্ত্রীর কাছে হস্তান্তর কর তখন কোন সাক্ষী ছিল কি? সে বলল, হ্যাঁ, দুই জন সাক্ষী ছিল।
কাযী সাক্ষীদেরকে আদালতে হাযির করার হুকুম দিলেন। কাযেম গিয়ে দু’জন লোককে কিছু অর্থ দিয়ে বলল, ভাই তোমরা আমার সঙ্গে আস। কাযীর দরবারে তোমরা সাক্ষ্য দিবে যে, তিনবছর পূর্বে অমুক দিন তোমাদের উপস্থিতিতে আমি আমার বড় ভাইয়ের স্ত্রীকে পাঁচশত সোনার মোহর ও একখন্ড হীরক দিয়েছিলাম। অর্থের বিনিময়ে সে দুই সাক্ষী কাযীর কাছে মিথ্যা সাক্ষ্য দিল।
কাযী সাক্ষীর পরিপ্রেক্ষিতে রায় দিলেন যে, হাতেমের স্ত্রীর কাছে হীরকখন্ড রয়েছে। হাতেমকে হুকুম দিলেন তার স্ত্রীর কাছে থেকে তা উদ্ধার করতে।
এমতাবস্থায় হাতেমের স্ত্রী নিরুপায় হয়ে বাদশাহর দরবারে গিয়ে কান্নাকাটি করে বিস্তারিত ঘটনা জানিয়ে সুবিচার চাইল। বাদশাহ বললেন, তুমি কাযীর কাছে গেলে না কেন? সে বলল, হুজুর গিয়েছিলাম। কিন্তু সুবিচার পাইনি। এখন আপনার কাছেও সুবিচার না পেলে স্বামীর ঘরে থাকা আমার দায় হয়ে পড়বে।
বাদশাহ হাতেম, কাযেম ও সাক্ষীদ্বয়কে দরবারে ডাকলেন এবং তাদের কাছে সবকিছু বিস্তারিত জানলেন। কাযেম ও তার সাক্ষীরা আগের মতই সাক্ষ্য দিল।
বাদশাহ হাতেম, কাযেম, দু’সাক্ষী ও হাতেমের স্ত্রীকে জেল-হাজতে ঢুকালেন। তাদের প্রত্যেককে আলাদা আলাদা সেল বা কক্ষে রাখার ব্যবস্থা করলেন। আর প্রত্যেককে কিছু মোম দিয়ে হুকুম দিলেন, হীরকখন্ডের আকৃতি তৈরী কর, তাহ’লে ছেড়ে দেওয়া হবে।
হাতেম ও কাযেম দুই ভাই মোম দ্বারা অভিন্ন আকৃতির হীরক তৈরী করল। আর সাক্ষীদ্বয়ের হীরকের আকৃতি হ’ল ভিন্ন ভিন্ন। এদিকে হাতেমের স্ত্রী কিছুই তৈরী করতে পারল না। বাদশাহ সবাইকে দরবারে ডেকে মোম নির্মিত হীরকের আকৃতি উপস্থিত করার নির্দেশ দিলেন। দুই ভাই ও সাক্ষীদ্বয়ের তৈরীকৃত হীরক আকৃতি বাদশাহ্র সম্মুখে পেশ করা হ’ল। দরবারের সকলেই দেখল যে, দুই ভাইয়ের হীরকের আকৃতি এক। কিন্তু সাক্ষীদের হীরকের আকৃতি ভিন্ন ভিন্ন।
তখন বাদশাহ ও দরবারের সকলেই বুঝতে পারলেন যে, সাক্ষীরা মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে। তারা হীরক আদৌ দেখেনি। তাই তাদের তৈরী হীরকের আকৃতিতে মিল নেই। তখন বাদশাহ বললেন, হাতেমের স্ত্রীর তৈরী হীরক আকৃতি কোথায়? হাতেমের স্ত্রী ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, হুজুর। আমি তো হীরক কখনই দেখিনি। আমি কিভাবে হীরক আকৃতি তৈরী করব? তাই আমি কিছুই তৈরী করতে পারিনি। বাদশাহ এবং দরবারে উপস্থিত সকলেই বুঝলেন যে, ছোট ভাই কাযেমই হীরকখন্ড রেখে দিয়েছে এবং অর্থের বিনিময়ে দু’জন মিথ্যা সাক্ষীও হাযির করেছে।
কাযেম হীরকখন্ডদ্বয় দরবারে হাযির করল এবং দুই হাতে দুই কান ধরে কসম করল যে, আর কোন দিন মিথ্যা কথা বলব না। আমার অন্যায় হয়েছে, আমাকে ক্ষমা করুন। বাদশাহ তাকে মাফ করে দিলেন।
বাদশাহ দু’ভাইকে দু’খন্ড হীরক দিয়ে বিদায় দিলেন। আর হাতেমের স্ত্রীকে তার সততা ও সাহসের জন্য পুরস্কৃত করলেন। আর সাক্ষীদ্বয়কে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য যথাযোগ্য শাস্তি দিয়ে কয়েদখানায় পাঠিয়ে দিলেন। অতঃপর কাযীকে ডেকে বললেন, আপনি সবদিক জেনে-শুনে বুদ্ধি-বিবেচনা করে বিচার করলেন না কেন? সত্য ঘটনা না জেনেই সেই মহিলার কাছ থেকে হীরকখন্ড আদায় করতে বললেন। এরূপ রায় দেওয়া আপনার উচিত হয়নি।

কোরআন এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ আয়াত সম্পর্কে

সুরা হাশরের সর্বশেষ তিন আয়াত

هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ هُوَ الرَّحْمَنُ الرَّحِيمُ
“হু আল্লা হুল্লাজী লা(আ) ইলাহা ইল্লা হু। আলিমুল গাইবী ওয়াশ শাহাদাতী হুয়ার রাহমানুর রাহীম।
هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْمَلِكُ الْقُدُّوسُ السَّلَامُ الْمُؤْمِنُ الْمُهَيْمِنُ الْعَزِيزُ الْجَبَّارُ الْمُتَكَبِّرُ سُبْحَانَ اللَّهِ عَمَّا يُشْرِكُونَ
হু আল্লা হুল্লাজী লা(আ) ইলাহা ইল্লা হু। আল মালিকুল কুদ্দুসুস সালামুল ম্যু মিনুল মুহাইমিনুল আজিজুল জাব্বারুল মুতাকাব্বির। ছুব হানাল্লাহী আম্মা ইউশরিকুন।
هُوَ اللَّهُ الْخَالِقُ الْبَارِئُ الْمُصَوِّرُ لَهُ الْأَسْمَاء الْحُسْنَى يُسَبِّحُ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
হু আল্লাহুল খালেকুল বারিয়্যুল মুছাওরেলাহুল আছমা(আ)উল হুছনা। ইউ ছাব্বিহু লাহু মা ফিছ ছামা ওয়াতি ওয়াল আরদ্ ওয়া হুয়াল আজীজুল হাকীম।“


সুরা হাশরের সর্বশেষ তিন আয়াত পাঠ করিবে । আল্লাহ তায়ালা তাহার জন্য ৭০ হাজার ফেরেশতা নিযুক্ত করে দিবেন,তারা সন্ধ্যা পর্যন্ত পাঠকারীর জন্য রহমতের দোয়া করবে। যেদিন এই আয়াত তিনটি পাঠ করিবে সেদিন পাঠকারী মারাগেলে শহীদের মউত হাসিল করিবে। যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় এভাবে পাঠ করিবে সেও একই মর্তবা লাভ করিবে। (সুবহানআল্লাহ)
 আয়াতূল কুরছী

হাদীস শরীফ এ বর্ণিত আছে, যে লোক সকালে ও শয়নের পূর্বে আয়াতূল কুরছী পাঠ করবে, আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং তার তত্ত্বাবধানকারী। কাজেই সারাদিনের মধ্যে শয়তান তার নিকট ঘেঁষতে পারে না। কেননা, আয়াতুল কুরছী পাঠকারীর নিকট শয়তান আগমন করবে না বলে ওয়াদাবদ্ধ রয়েছে।

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, প্রত্যেক বস্তুর একটি শীর্ষস্থান থাকে। পবিত্র কোরআনের শীর্ষস্থান হলো সুরা বাকারা। আর এ সুরায় এমন একটি আয়াত বিদ্যমান যা পবিত্র কোরআনের সমস্ত আয়াতের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। তা হল আয়াতুল কুরছী। (তিরমযী শরীফ)

প্রত্যেক নামাযের পর চৌদ্দবার আয়াতুল কুরছী পাঠ করলে যাবতীয় বালা-মুসীবত ও বিপদাপদের থেকে মুক্তি লাভ হয়।

اللّهُ لاَ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ لاَ تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلاَ نَوْمٌ لَّهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الأَرْضِ مَن ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلاَّ بِإِذْنِهِ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلاَ يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِّنْ عِلْمِهِ إِلاَّ بِمَا شَاء وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ وَلاَ يَؤُودُهُ حِفْظُهُمَا وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ


আল্লাহু লা (আ)ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুম লা তা খুজুহু সিনাত্যু ওয়ালা নাওম। লাহু মা ফিছ ছামা ওয়াতি ওয়ামা ফিল আরদ্।মান জাল্লাজী ইয়াস ফায়ু ইন দাহু(উ) ইল্লা বি ইজনিহি ইয়া লামু মা বাইনা আইদিহিম ওয়ামা খাল ফাহুম ওয়ালা ইউ হিতুনা বিশাই ইম মিন ইল্ মিহি(হি) ইল্লা বিমা সা (আ) ওয়াসিয়া কুরসি ইউ হুস ছামা ওয়াতি ওয়াল আরদ্ ওয়ালা ইয়া উদুহু হিফজুহুমা ওয়াহুয়াল আলিউল আজীম।

আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই, তিনি জীবিত, সবকিছুর ধারক। তাঁকে তন্দ্রাও স্পর্শ করতে পারে না এবং নিদ্রাও নয়। আসমান ও যমীনে যা কিছু রয়েছে, সবই তাঁর। কে আছ এমন, যে সুপারিশ করবে তাঁর কাছে তাঁর অনুমতি ছাড়া? দৃষ্টির সামনে কিংবা পিছনে যা কিছু রয়েছে সে সবই তিনি জানেন। তাঁর জ্ঞানসীমা থেকে তারা কোন কিছুকেই পরিবেষ্টিত করতে পারে না, কিন্তু যতটুকু তিনি ইচ্ছা করেন। তাঁর সিংহাসন সমস্ত আসমান ও যমীনকে পরিবেষ্টিত করে আছে। আর সেগুলোকে ধারণ করা তাঁর পক্ষে কঠিন নয়। তিনিই সর্বোচ্চ এবং সর্বাপেক্ষা মহান।
আয়াতুল কুরছির মাহাত্ম্য
আল কোরআন পৃথিবীর বুকে সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান এই আল কোরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ আয়াতগুলো নিয়েই আয়াতুল কুরছি। মহান আল্লাহর একাত্মবাদ, প্রভুত্ব, স্থায়িত্ব, কুদরত, ইচ্ছা, অধিকার, জ্ঞান, ক্ষমতা ইত্যাদি গুণাবলীর বর্ণনা ও আলোচনার সুস্পষ্ট নিদর্শন আয়াতুল কুরছি। কোরআনের বিভিন্ন স্থানে মহান আল্লাহর আরও নানা বৈচিত্র্যমণ্ডিত গুণাবলীর কথা প্রকাশ থাকলেও একত্রে মৌলিক গুণাবলীর সমাহার এবং বর্ণনা আয়াতুল কুরছির মতো কোথাও প্রকাশ হয়নি। এ জন্যই আয়াতুল কুরছির মর্যাদা অতুলনীয়, অনস্বীকার্য।

আবু দাউদ শরিফে বর্ণিত, হজরত উয়াইলা ইবনে আসক্কা (রা•) প্রকাশ, একদা নবী করিম (স•) মোহাজেরদের জমাতে আগমন করলে এক ব্যক্তি তাকে জিজ্ঞেস করল-  ‘হে আমাদের রাসূল! পবিত্র কোরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ আয়াত কোনটি?’ উত্তরে মহানবী (স•) বলেছিলেন-  ‘আয়াতুল কুরছি।’

আগেই বলা হয়েছে, আয়াতুল কুরছির শ্রেষ্ঠত্বের কারণ মূলত মহান আল্লাহতালার ‘ইসমে জাত’ ও ‘ইসমে সিফাতের’ অভূতপূর্ণ সম্মেলন। আয়াতুল কুরছি এভাবেও যথেষ্ট মর্যাদাবান যে, এটি পবিত্র কালামুল্লাহ শরিফের সূরা বাকারাহ’র অংশ। তিরমিজি শরিফে হজরত আবু হোরায়রা (রা•) থেকে বর্ণিত, ‘প্রতিটি বস্তুর একটি শীর্ষ চূড়া রয়েছে। পবিত্র কালামুল্লাহ শরিফের শীর্ষ সূরা হল সূরায়ে বাকারাহ এবং সর্দার আয়াত হল আয়াতুল কুরছি।’

আয়াতুল কুরছিতে মহান আল্লাহপাকের দশটি বিশেষ মৌলিক ও শ্রেষ্ঠতম গুণের কথা বিস্তৃত হয়েছে। এ জন্যই বুজুর্গ ব্যক্তিবর্গ আয়াতুল কুরছিকে ‘দশ রত্নের সমাহার’ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। আয়াতুল কুরছি মহান আল্লাহর যে দশটি সুস্পষ্ট বিশেষ গুণের বর্ণনা করে সেগুলো হলঃ

১• ‘আল্লাহ ব্যতীত কোনই উপাস্য নেই’ এই বাক্যের মাধ্যমে মহান আল্লাহর একাত্ববাদ ও অদ্বিতীয়ত্বের ঘোষণা করা হয়েছে। অন্য সবকিছুর অংশীদারিত্ব ও প্রভুত্বের মূলোৎপাটন করা হয়েছে।
২• ‘যিনি চির জীবন্ত ও সদা বিরাজমান’ বাক্য দ্বারা যারা (কাফের ও মুশরেক) আল্লাহ সচেতন ও অন্ধ বলে ধারণা পোষণ করত তাদের অবুঝ ও ভ্রান্ত ধারণার জবাব প্রকাশ করা হয়েছে।
৩• ‘তন্দ্রা এবং নিন্দ্রা তাকে স্পর্শ করতে পারে না।’ বাক্য দ্বারা মহান আল্লাহ প্রমাণ করেছেন, তার সৃষ্ট অন্যান্য জীবের গুণ ও স্বভাব ধর্ম, দোষ দুর্বলতা প্রভৃতি থেকে স্বয়ং আল্লাহপাক মুক্ত ও পবিত্র।
৪• নভোমণ্ডলে ও ভূমণ্ডলে যা কিছু আছে সব তাঁহারই’। এখানে, আল্লাহ অধিপতি বলে ঘোষণা করেছেন। এই মহাজগতে আমরা যা দর্শন করি এবং যা করি না সব কিছুর মালিক যে একমাত্র আল্লাহতায়ালা তারই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।
৫• ‘তাঁহার অনুমতি ব্যতীত কেউই তাঁহার নিকট অপরের মুক্তির জন্য সুপারিশ করতে পারবে না’ বাক্যটি দ্বারা প্রকাশ, আল্লাহ ছাড়া মুক্তিদাতা, সাহায্য প্রদানে সক্ষম আর কেউই নেই, কিছুই নেই।
৬• ‘অগ্র-পশ্চাৎ সম্পর্কে তিনি সুপরিজ্ঞাত’ বাক্যটি দ্বারা প্রমাণিত যে, আল্লাহ পাক অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পুরোপুরিভাবে অবগত। তাঁর অজান্তে, অলক্ষ্যে কোন কিছুই ঘটে না। প্রতিটি কার্যক্রম তিনি অবলোকন করেন।
৭• ‘তাঁহার ইচ্ছা ব্যতীত তাঁহার অনন্ত জ্ঞানের কোন বিষয়ই কেউ ধারণা করতে পারে না।’ বাক্যটিতে মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কথা বিস্তৃত হয়েছে। সব জ্ঞানের আধার স্বয়ং আল্লাহপাক, মানুষ তাঁর সৃষ্টি এবং মানুষের জ্ঞান অসীম স্রষ্টার অসীম জ্ঞানের কাছে অতি সামান্য, নগণ্য।
৮• ‘তাঁহার আসন ও সাম্রাজ্য নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে’ এই বাক্যটি দ্বারা আর কোন সন্দেহ ছাড়াই প্রকাশ হয়। জীব ও জড় জগতের মধ্যে তার জ্ঞান, শক্তি, প্রতিপত্তি ও সাম্রাজ্য পরিবেষ্টিত। তাঁর শক্তি ও শাসন অতিক্রমে সক্ষমে কিছুই নেই, কারও অধিকার নেই তার এই শাসনের বাইরে চলে যায়। তিনিই সব কিছুর একমাত্র অধিপতি, অসীম ক্ষমতাবান, মহাশক্তিধর।
৯• ‘এতদুভয়ের সংরক্ষণের তাঁহাকে বিব্রতবোধ করতে হয় না’ বাক্যটিতে প্রমাণিত হয় যে, তার এই বিশাল সাম্রাজ্য পরচালনায় কোন প্রকার বিঘ্ন সৃষ্ট হয় না, তিনি মোটেও বিব্রতবোধ করেন না। আল্লাহর অসীম শক্তি, অনন্ত মহিমার বলে এই মহাবিশ্বের জীব ও জড় জগতের প্রতিপালন ও রক্ষণাবেক্ষণ তার কাছে অতি সহজ।
১০• ‘আর তিনি সমুন্নত ও মহীয়ান’। বাক্যের মাধ্যমে ঘোষিত, একমাত্র আল্লাহতায়ালাই অন- ঐশী শক্তির অধিকারী। আল্লাহর ন্যায় গৌরব ও সম্মানের অধিকারী অন্য আর কিছুই নেই, এর সমকক্ষও নেই, এর অংশীদারও নেই। স্বয়ং আল্লাহপাকই সব গৌরব, সম্মান ও মর্যাদার একমাত্র অধিকারী। আল্লাহপাকের অন-, অসীম সম্মান, শ্রেষ্ঠত্ব ও অন্যান্য অবিস্মরণীয় গুণাবলীর প্রকাশই আয়াতুল কুরছির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় বলেই আয়াতুল কুরছির মর্যাদা এত বেশি। তিরমিজি ও বোখারি শরিফে প্রকাশ, ‘যে ব্যক্তি সকালে ও শয়নকালে আয়াতুল কুরছি পাঠ করে, আল্লাহতায়ালা তার রক্ষক। সুতরাং দিবস রজনীর মধ্যে শয়তান তার নিকটতর হতে পারে না।’

আয়াতুল কুরছির মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের পরিমাণ প্রকাশ মূলত অসম্ভব। আমাদের হাতের দশ আঙুল, আয়াতুল কুরছির দশ দিক দশ লতিফা ইত্যাদি হেফাজতের শ্রেষ্ঠতম আয়াত বলে বর্ণিত।

হযরত উবাই ইবনে কা’ব থেকে বর্ণিত আছে, আয়াতুল কুরছির একটি জিহ্বা ও দুইটি মুখ রয়েছে। এটি ফেরেশতার আকারে আল্লাহপাকের মর্যাদাশীল আরশের ছাদে বসে আল্লাহপাকের পবিত্রতা ও গুণাবলী বর্ণনা করছে।’

আল কোরআন, আল্লাহপাকের বিস্ময়কর ও অনন্য সৃষ্টি। সমগ্র মুসলিম জাতির মুক্তির ধারক, পথপ্রদর্শক এই কোরআন। আয়াতুল কুরছি সেই কোরআনেরই অন্যতম আয়াতের সমাবেশ। আমাদের সবাইকেই আয়াতুল কুরছির মাহাত্ম্য, মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব মেনে, বুঝে জীবন পরিচালনা করা উচিত। তবেই মিলবে মুক্তির পথ।


কোরআনের হৃদয় সূরা ইয়াসিন
হৃৎপিণ্ড আছে মানুষের, হৃৎপিণ্ড আছে কোরআনের। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, সূরা ইয়াসিন কোরআনের হৃৎপিণ্ড। এ হাদিসে আরও আছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালের কল্যাণ লাভের নিয়তে সূরা ইয়াসিন পাঠ করে, তার মাগফিরাত হয়ে যায়। তোমরা তোমাদের মৃতদের প্রতি এ সূরা পাঠ কর (তাফসিরে মাজহারি)। ইমাম গাজ্জালি (রহঃ) বলেন, সূরা ইয়াসিনকে কোরআনের হৎপিণ্ড বলার কারণ এমনও হতে পারে যে, এ সূরায় কিয়ামত ও হাশর-নাশরের বিষয় ব্যাপকভাবে ব্যাখ্যা অলংকার সহকারে বর্ণিত হয়েছে। পরকালে বিশ্বাস ঈমানের এমন একটি মূলনীতি, যার ওপর মানুষের সব আমল ও আচরণের বিশুদ্ধতা নির্ভরশীল। পরকাল ভীতিই মানুষকে সৎকর্মে উদ্বুদ্ধ করে এবং অবৈধ বাসনা ও হারাম কাজ থেকে বিরত রাখে। অতএব, দেহের সুস্থতা যেমন অন্তরের সুস্থতার ওপর নির্ভরশীল, তেমনি ঈমানের সুস্থতা পরকাল চিন্তার ওপর নির্ভরশীল। (তাফসিরে রূহুল মা’আনি)।
কোন কোন রেওয়াতে এ সূরার নাম ‘কাজিয়া’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ, এ সূরা পাঠকের প্রয়োজন মেটায়। মহানবী (সাঃ) বলেন, তাওরাতে এ সূরার নাম ‘মুয়িম্মাহ’ বলে উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ, এ সূরা তার পাঠকের জন্য ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ এবং বরকত ব্যাপক করে দেয়। হজরত আবুজর গিফারি (রাঃ) থেকে বর্ণিত, মুমূর্ষু ব্যক্তির কাছে বসে সূরা ইয়াসিন পাঠ করা হলে তার মৃত্যু সহজ হয়। (মাজহারি)। আসুন আমরা সবাই সূরা ইয়াসিনের মর্মকথা বুঝতে সচেষ্ট হই। ইহকালের মঙ্গল লাভের পাশাপাশি পরকালের পথ সুগম করি।
সূরা কাফিরূন ও ইখলাস আমাদের যা শেখায়  
মূল: ফায়িয বিন সাঈদ আয-যাহরানী
অনুবাদ: ইকবাল হোছাইন মাছুম


بسم الله الرحمن الرحيم
قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ ﴿1﴾ لَا أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ ﴿2﴾ وَلَا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ ﴿3﴾ وَلَا أَنَا عَابِدٌ مَا عَبَدْتُمْ ﴿4﴾ وَلَا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ ﴿5﴾ لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِيَ دِين ﴿6﴾
১.  বল, হে কাফিররা,
২.  তোমরা যার ইবাদাত কর আমি তার ইবাদাত করি না।
৩.  এবং আমি যার ইবাদাত করি তোমরা তার ইবাদাতকারী নও।
৪.  আর তোমরা যার ইবাদত করছ আমি তার ইবাদাতকারী হব না।
৫.  আর আমি যার ইবাদাত করি তোমরা তার ইবাদাতকারী হবে না।
৬. তোমাদের জন্য তোমাদের দীন আর আমার জন্য আমার দীন।

بسم الله الرحمن الرحيم
قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ ﴿1﴾ اللَّهُ الصَّمَدُ ﴿2﴾ لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ ﴿3﴾ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ ﴿4﴾
১.       বল, তিনিই আল্লাহ, এক-অদ্বিতীয়।
২.       আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন।
৩.      তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও জন্ম দেয়া হয়নি।
৪.       আর তাঁর কোন সমকক্ষও নেই।

সূরাদ্বয়ের ফযিলতে অনেকগুলো হাদিস বর্ণিত হয়েছে, এ ক্ষেত্রে বোধ করি এতটুকু বলাই যথেষ্ট হবে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দিন শুরু করতেন এ সূরাদ্বয়ের তেলাওয়াতের মাধ্যমে আর সূরাদ্বয়ের তেলাওয়াতের মাধ্যমেই শেষ করতেন দিন। কারণ তিনি অধিকাংশ সময়  ফজরের সুন্নাত ও সালাতুল বিতরে এ সূরাদু’টো তেলাওয়াত করতেন। রমযান মাসে পৃথিবী ব্যাপি মসজিদগুলোতে এ সূরাদ্বয়ের তেলাওয়াতের গুঞ্জরণ চারিদিক মুখরিত করে তুলে। সূরা কাফিরূন দ্বীপ্ত ঘোষণা উচ্চারণ করে যে, তাওহিদ ও শিরকের আকিদার মাঝে কোনোরূপ সামঞ্জস্য নেই। উভয় আকিদার মাঝে ন্যূনতম সাদৃশ্যকেও এ সূরা প্রত্যাখ্যান করে। আর সূরা ইখলাস তাওহিদের আকিদাকে দৃঢ় ও প্রতিষ্ঠিত করে। এ দিক থেকে উভয় সূরাই তাওহিদের নিগুঢ় তত্ত্বকে প্রমাণ করে সুস্পষ্টরূপে। (তাফসির ফী যিলালিল কোরআন ৬/৪০০৫)
চলমান নিবন্ধে আমরা ‌‌ ‍‌‌‌'আল-কোরআনের প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ও তার রূপরেখা’র আলোকে কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় উৎসারিত করে নিবন্ধটি কয়েকটি পর্বে সাজাতে চেষ্টা করেছি। মহান আল্লাহর নিকট আকুল আবেদন, তিনি আমাদেরকে সঠিক পথে অগ্রসর হবার তাওফিক দিন এবং বিষয় উন্মোচণে যথাযথ থাকতে সহায়তা করুন... ।
প্রথম পর্ব:
আল্লাহ সম্বন্ধে যথাযথ জ্ঞানের অভাবই সূরাদ্বয় অবতারণের মূল কারণ । তাই শানে নুযুল বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমেই নিবন্ধের সূচনা করছি। তাছাড়া আল-কোরআনের বিভিন্ন আয়াত ও সূরার অর্থ ও তার তত্ত্বগত বিষয়াদি অনুধাবনের ক্ষেত্রে শানে নুযুলের বিশাল ভূমিকা থাকে।
সূরা ইখলাসের শানে নুযুল: 
আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে অজ্ঞতা ও ভুল ধারণা এ সূরা অবতীর্ণ হবার মূল কারণ। কতিপয় ইহুদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বলল, তুমি আমাদেরকে তোমার রব সম্পর্কে বলতো-তাঁর কিছু বিবরণ দাও। আল্লাহ তাআলা তাওরাতে তাঁর পরিচয় তুলে ধরেছেন এবং কতিপয় গুণাবলী বর্ণনা করেছেন। সুতরাং তুমি আমাদের বল, তিনি কিসের তৈরি ? কোন শ্রেণী ভুক্ত তিনি ? তিনি কি স্বর্ণ না রৌপ্য নাকি তাম্র? তিনি কি খাবার ও পানীয় গ্রহণকরেন ? পৃথিবীর উত্তরাধিকার তিনি কার থেকে পেয়েছেন আর তাঁর উত্তরাধিকারীই বা হবে কে ? এর জবাবে আল্লাহ তাআলা এ সূরা নাযিল করেছেন।
সাহাবি উবাইয় বিন কা’ব রা. বলেন, মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলল, তুমি আমাদেরকে তোমরা রবের বংশ পরম্পরা বর্ণনা করে শুনাও, তখন আল্লাহ তাআলা নাযিল করলেন, ( قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ . اللَّهُ الصَّمَدُ) (আসবাবুন্নুযূল লিল-ওয়াহিদি)
তারা বিশ্বাস করত আল্লাহ তাআলার বংশ পরম্পরা ও মেয়ে রয়েছে। ফেরেশতারা হচ্ছে তাঁর মেয়ে। ইহুদি-খ্রিষ্টানরাও অভিন্ন মত পোষণ করত।
وَقَالَتِ الْيَهُودُ عُزَيْرٌ ابْنُ اللَّهِ وَقَالَتِ النَّصَارَى الْمَسِيحُ ابْنُ اللَّهِ ذَلِكَ قَوْلُهُمْ بِأَفْوَاهِهِمْ يُضَاهِئُونَ قَوْلَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ قَبْلُ قَاتَلَهُمُ اللَّهُ أَنَّى يُؤْفَكُونَ ﴿30﴾  (التوبة:30)
আর ইয়াহুদিরা বলে, উযাইর আল্লাহর পুত্র এবং নাসারারা বলে, মাসিহ আল্লাহর পুত্র। এটা তাদের মুখের কথা, তারা সেসব লোকের কথার অনুরূপ বলছে যারা ইতঃপূর্বে কুফরি করেছে। আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুন, কোথায় ফেরানো হচ্ছে এদেরকে ? (তাওবা : ৩০)
আর সূরা কাফিরূন নাযিল হয়েছে কোরাইশের কিছু লোকের একটি আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে । তারা এসে বলল, হে মুহাম্মাদ- এসো তুমি আমাদের ধর্মের অনুসরণ কর, আমরা তোমার দ্বীনের অনুসরণ করব। তুমি আমাদের উপাস্যদের উপসনা কর এক বছর, আমরা তোমার মাবূদের ইবাদত করব এক বছর। এর মাধ্যমে তোমার আনীত দ্বীন যদি আমাদের অনুসৃত ধর্ম-কর্ম হতে উৎকৃষ্ট হয় তাহলে আমরা তাতে অংশ গ্রহণ করতে পারলাম এবং তা হতে আমাদের নির্ধারিত অংশ নিতে পারলাম। আর যদি তোমার ধর্ম হতে আমাদেরটি উত্তম হয় তাহলে তুমি তাতে অংশ নিতে পারলে এবং তোমার নির্ধারিত অংশ গ্রহণ করতে পারলে। নবীজি বললেন, নাউযুবিল্লাহ- তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরিক করা হতে পানাহ চাই। এরপর আল্লাহ তাআলা নাযিল করলেন,
قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ ﴿1﴾ لَا أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ ﴿2﴾ وَلَا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ ﴿3﴾ وَلَا أَنَا عَابِدٌ مَا عَبَدْتُمْ ﴿4﴾ وَلَا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ ﴿5﴾ لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِيَ دِينِ ﴿6﴾
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকালে মসজিদে তাশরিফ রাখলেন। পূর্ব হতেই কোরাইশ সম্প্রদায়ের লোকজনে মসজিদ প্রাঙ্গন ছিল পরিপূর্ণ। তিনি তাদের সম্মুখে পূর্ণ সূরা তেলাওয়াত করে শুনালেন। তাদের হেদায়াতের প্রতি রাসূলুল্লাহর সীমাহীন আগ্রহ দেখে তারা আশা করছিল হয়ত তিনি তাদের প্রস্তাবে সম্মত হবেন। কিন্তু সেদিন সকালের পর থেকে তারা আশা ছেড়ে দিল বরং বলা চলে একেবারে নিরাশ হয়ে গেল। (আসবাবুন্নুযূল লিল-ওয়াহিদি)

 দ্বিতীয় পর্ব: আল্লাহ সম্বন্ধে সঠিক ধারণা
আল্লাহ কে ? কী তাঁর পরিচয় ? মহা বরকতময় মহান রব সম্বন্ধে সঠিক ধারণাটি কী?
اللَّهُ الصَّمَدُ . لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ . وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ .   
আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন, সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী। আর তাঁর কোন সমকক্ষও নেই।তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও জন্ম দেয়া হয়নি।
সাহাবি আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা.-এর মতে الصَّمَد ( অমুখাপেক্ষী) অর্থ,
সাইয়েদ-নেতৃত্বের অধিকারী, যিনি নিজ নেতৃত্বে পূর্ণতায় সমাসীন।
শরীফ- মর্যাদাবান, যিনি আপন মর্যাদায় শীর্ষে অবস্থান করছেন।
আযীম-মহান, যিনি স্বমহিমায় চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত।
হালীম-সহনশীল, যিনি সহনশীলতায় সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে আছেন।
গণী-অভাবহীন, যিনি নিজ অমুখাপেক্ষিতায় পূর্ণাতায় পৌঁছেছেন।
জাব্বার-মহা পরাক্রমশালী, যিনি প্রভাব-বলয়ে পূর্ণতায় অধিষ্ঠিত।
আলিম-জ্ঞানবান, নিজ জ্ঞানে যিনি পূর্ণতায় উপনীত।
হাকীম-প্রজ্ঞাময়, নিজ প্রজ্ঞায় যিনি সকলকে ছাড়িয়ে আছেন।
তিনি এমনই সত্তা, মর্যাদা ও বড়ত্বের সর্বশাখায় যিনি শীর্ষে আছেন। যার সকল গুণাগুণ পূর্ণাঙ্গতার মাপকাঠিতে সর্বাধিক উত্তীর্ণ। মহান আল্লাহ, এ-ই হচ্ছে তাঁর গুণাগুণ। যা তিনি ব্যতীত আর কারো জন্য প্রযোজ্য নয়।
তিনি চিরঞ্জীব সুপ্রতিষ্ঠিত ধারক, মহা দয়ালু অতি মেহেরবান, যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, এবং অনেক সৃষ্টিকে আমাদের অধীন করে দিয়েছেন...।
إِنَّ اللَّهَ فَالِقُ الْحَبِّ وَالنَّوَى يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَمُخْرِجُ الْمَيِّتِ مِنَ الْحَيِّ ذَلِكُمُ اللَّهُ فَأَنَّى تُؤْفَكُونَ ﴿95﴾ فَالِقُ الْإِصْبَاحِ وَجَعَلَ اللَّيْلَ سَكَنًا وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ حُسْبَانًا ذَلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ ﴿96﴾ وَهُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ النُّجُومَ لِتَهْتَدُوا بِهَا فِي ظُلُمَاتِ الْبَرِّ وَالْبَحْرِ قَدْ فَصَّلْنَا الْآَيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ ﴿97﴾ وَهُوَ الَّذِي أَنْشَأَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ فَمُسْتَقَرٌّ وَمُسْتَوْدَعٌ قَدْ فَصَّلْنَا الْآَيَاتِ لِقَوْمٍ يَفْقَهُونَ ﴿98﴾ وَهُوَ الَّذِي أَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجْنَا بِهِ نَبَاتَ كُلِّ شَيْءٍ فَأَخْرَجْنَا مِنْهُ خَضِرًا نُخْرِجُ مِنْهُ حَبًّا مُتَرَاكِبًا وَمِنَ النَّخْلِ مِنْ طَلْعِهَا قِنْوَانٌ دَانِيَةٌ وَجَنَّاتٍ مِنْ أَعْنَابٍ وَالزَّيْتُونَ وَالرُّمَّانَ مُشْتَبِهًا وَغَيْرَ مُتَشَابِهٍ انْظُرُوا إِلَى ثَمَرِهِ إِذَا أَثْمَرَ وَيَنْعِهِ إِنَّ فِي ذَلِكُمْ لَآَيَاتٍ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ﴿99﴾
৯৫. নিশ্চয় আল্লাহ বীজ ও আঁটি বিদীর্ণকারী। তিনি মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন এবং জীবিত থেকে মৃতকে বেরকারী। তিনিই আল্লাহ, সুতরাং (সৎপথ থেকে) কোথায় তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে ?
৯৬. (তিনি) প্রভাত উদ্ভাসিতকারী। তিনি বানিয়েছেন রাতকে প্রশান্তি এবং সূর্য ও চন্দ্রকে সময় নিরূপক। এটা সর্বজ্ঞ পরাক্রমশালীর নির্ধারণ।
৯৭. আর তিনিই সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য তারকারাজি, যাতে তোমরা এ দ্বারা পথপ্রাপ্ত হও স্থল ও সমুদ্রের অন্ধকারে। নিশ্চয় আমি আয়াতসমূহকে বিস্তারিত বর্ণনা করেছি এমন কওমের জন্য যারা জানে।
৯৮. আর তিনিই সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এক নফস থেকে। অতঃপর রয়েছে আবাসস্থল ও সমাধিস্থল। অবশ্যই আমি আয়াতসমূহ বিস্তারিত বর্ণনা করেছি, এমন কওমের জন্য যারা ভালভাবে বুঝে।
৯৯. আর তিনিই আসমান থেকে বর্ষণ করেছেন বৃষ্টি। অতঃপর আমি এ দ্বারা উৎপন্ন করেছি সব জাতের উদ্ভিদ। অতঃপর আমি তা থেকে বের করেছি সবুজ ডাল-পালা। আমি তা থেকে বের করি ঘন সন্নিবিষ্ট শস্যদানা। আর খেজুর বৃক্ষের মাথি থেকে (বের করি) ঝুলন্ত থোকা। আর (তা দ্বারা উৎপন্ন করি) আঙ্গুরের বাগান এবং সাদৃশ্যপূর্ণ ও সাদৃশ্যহীন যয়তুন ও আনার। দেখ তার ফলের দিকে, যখন সে ফলবান হয় এবং তার পাকার প্রতি। নিশ্চয় এতে নিদর্শন রয়েছে এমন কওমের জন্য যারা ঈমান আনে। (সূরা আনআম : ৯৫-৯৯)
إِنَّ رَبَّكُمُ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ يُغْشِي اللَّيْلَ النَّهَارَ يَطْلُبُهُ حَثِيثًا وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ وَالنُّجُومَ مُسَخَّرَاتٍ بِأَمْرِهِ أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ ﴿54﴾
নিশ্চয় তোমাদের রব আসমানসমূহ ও যমীন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশে উঠেছেন। তিনি রাত দ্বারা দিনকে ঢেকে দেন। প্রত্যেকটি একে অপরকে দ্রুত অনুসরণ করে। আর (সৃষ্টি করেছেন) সূর্য, চাঁদ ও তারকারাজী, যা তাঁর নির্দেশে নিয়োজিত। জেনে রাখ, সৃষ্টি ও নির্দেশ তাঁরই। আল্লাহ মহান, যিনি সকল সৃষ্টির রব। ( আরাফ : ৫৪)
هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً لَكُمْ مِنْهُ شَرَابٌ وَمِنْهُ شَجَرٌ فِيهِ تُسِيمُونَ ﴿10﴾ يُنْبِتُ لَكُمْ بِهِ الزَّرْعَ وَالزَّيْتُونَ وَالنَّخِيلَ وَالْأَعْنَابَ وَمِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَةً لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ ﴿11﴾ وَسَخَّرَ لَكُمُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ وَالنُّجُومُ مُسَخَّرَاتٌ بِأَمْرِهِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ ﴿12﴾ وَمَا ذَرَأَ لَكُمْ فِي الْأَرْضِ مُخْتَلِفًا أَلْوَانُهُ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَةً لِقَوْمٍ يَذَّكَّرُونَ ﴿13﴾ وَهُوَ الَّذِي سَخَّرَ الْبَحْرَ لِتَأْكُلُوا مِنْهُ لَحْمًا طَرِيًّا وَتَسْتَخْرِجُوا مِنْهُ حِلْيَةً تَلْبَسُونَهَا وَتَرَى الْفُلْكَ مَوَاخِرَ فِيهِ وَلِتَبْتَغُوا مِنْ فَضْلِهِ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ ﴿14﴾ وَأَلْقَى فِي الْأَرْضِ رَوَاسِيَ أَنْ تَمِيدَ بِكُمْ وَأَنْهَارًا وَسُبُلًا لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ ﴿15﴾ وَعَلَامَاتٍ وَبِالنَّجْمِ هُمْ يَهْتَدُونَ ﴿16﴾ أَفَمَنْ يَخْلُقُ كَمَنْ لَا يَخْلُقُ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ ﴿17﴾ وَإِنْ تَعُدُّوا نِعْمَةَ اللَّهِ لَا تُحْصُوهَا إِنَّ اللَّهَ لَغَفُورٌ رَحِيمٌ ﴿18﴾
১০. তিনিই সে সত্তা, যিনি আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেন, যাতে রয়েছে তোমাদের জন্য পানীয় এবং তা থেকে হয় উদ্ভিত, যাতে তোমরা জন্তু চরাও।
১১.তার মাধ্যমে তিনি তোমাদের জন্য উৎপন্ন করেন ফসল, যাইতুন, খেজুর গাছ, আঙ্গুর এবং সকল ফল-ফলাদি। নিশ্চয় এতে নিদর্শন রয়েছে এমন কওমের জন্য, যারা চিন্তা করে।
১২. আর তিনি তোমাদের জন্য নিয়োজিত করেছেন রাত ও দিনকে এবং সূর্য ও চাঁদকে আর তারকাসমূহও তাঁর নির্দেশে নিয়োজিত। নিশ্চয় এতে অনেক নিদর্শন রয়েছে এমন কওমের জন্য যারা বুঝে।
১৩. আর তিনি তোমাদের জন্য যমীনে যা সৃষ্টি করেছেন, বিচিত্র রঙের করে, নিশ্চয় তাতেও নিদর্শন রয়েছে এমন কওমের জন্য, যারা উপদেশ গ্রহণ করে।
১৪. আর তিনিই সে সত্তা, যিনি সমুদ্রকে নিয়োজিত করেছেন, যাতে তোমরা তা থেকে তাজা (মাছের) গোশ্‌ত খেতে পার এবং তা থেকে বের করতে পার অলংকারাদি, যা তোমরা পরিধান কর। আর তুমি তাতে নৌযান দেখবে তা পানি চিরে চলছে এবং যাতে তোমরা তার অনুগ্রহ অন্বেষণ করতে পার এবং যাতে তোমরা শুকরিয়া আদায় কর।
১৫. আর যমীনে তিনি স্থাপন করেছেন সুদৃঢ় পর্বতমালা, যাতে তোমাদের নিয়ে যমীন হেলে না যায় এবং নদ-নদী ও পথসমূহ, যাতে তোমরা পথপ্রাপ্ত হও।
১৬. আর (দিনের) পথ-নির্দেশক চি‎হ্নসমূহ, আর (রাতে) তারকার মাধ্যমে তারা পথ পায়।
সুতরাং যে সৃষ্টি করে, সে কি তার মত, যে সৃষ্টি করে না ? অতএব তোমরা কি উপদেশ গ্রহণ করবে না ?
১৭. আর যদি তোমরা আল্লাহর নিআমত গণনা কর, তবে তার ইয়ত্তা পাবে না। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। {সূরা নাহল:১০-১৭}
وَاللَّهُ أَخْرَجَكُمْ مِنْ بُطُونِ أُمَّهَاتِكُمْ لَا تَعْلَمُونَ شَيْئًا وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ ﴿78﴾ أَلَمْ يَرَوْا إِلَى الطَّيْرِ مُسَخَّرَاتٍ فِي جَوِّ السَّمَاءِ مَا يُمْسِكُهُنَّ إِلَّا اللَّهُ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ ﴿79﴾ وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُمْ مِنْ بُيُوتِكُمْ سَكَنًا وَجَعَلَ لَكُمْ مِنْ جُلُودِ الْأَنْعَامِ بُيُوتًا تَسْتَخِفُّونَهَا يَوْمَ ظَعْنِكُمْ وَيَوْمَ إِقَامَتِكُمْ وَمِنْ أَصْوَافِهَا وَأَوْبَارِهَا وَأَشْعَارِهَا أَثَاثًا وَمَتَاعًا إِلَى حِينٍ ﴿80﴾ وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُمْ مِمَّا خَلَقَ ظِلَالًا وَجَعَلَ لَكُمْ مِنَ الْجِبَالِ أَكْنَانًا وَجَعَلَ لَكُمْ سَرَابِيلَ تَقِيكُمُ الْحَرَّ وَسَرَابِيلَ تَقِيكُمْ بَأْسَكُمْ كَذَلِكَ يُتِمُّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكُمْ لَعَلَّكُمْ تُسْلِمُونَ ﴿81﴾
৭৮.আর আল্লাহ তোমাদেরকে বের করেছেন, তোমাদের মাতৃগর্ভ থেকে এমতাবস্থায় যে, তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন শ্রবণশক্তি, চক্ষু ও অন্তর। যাতে তোমরা শুকরিয়া আদায় কর।
৭৯. তারা কি আকাশে (উড়ন্ত অবস্থায়) নিয়োজিত পাখিগুলোর দিকে তাকায় না ? আল্লাহ ছাড়া কেউ তাদেরকে ধরে রাখে না। নিশ্চয় তাতে নিদর্শনাবলী রয়েছে সেই কওমের জন্য যারা বিশ্বাস করে।
৮০.আর আল্লাহ তোমাদের ঘরগুলোকে তোমাদের জন্য আবাস করেছেন এবং তোমাদের পশুর চামড়া দিয়ে তাবুর ব্যবস্থা করেছেন, যা খুব সহজেই তোমরা সফরকালে ও অবস্থানকালে বহন করতে পার। আর তাদের পশম, তাদের লোম ও তাদের চুল দ্বারা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য গৃহসামগ্রী ও ভোগ-উপকরণ (তৈরি করেছেন)।
৮১. আর আল্লাহ যা সৃষ্টি করেছেন, তা থেকে তোমাদের জন্য ছায়ার ব্যবস্থা করেছেন এবং পাহাড় থেকে তোমাদের জন্য আশ্রয়স্থল বানিয়েছেন, আর ব্যবস্থা করেছেন পোশাকের, যা তোমাদেরকে গরম থেকে রক্ষা করে এবং বর্মেরও ব্যবস্থা করেছেন যা তোমাদেরকে রক্ষা করে যুদ্ধে। এভাবেই তিনি তোমাদের উপর তার নিয়ামতকে পূর্ণ করবেন, যাতে তোমরা অনুগত হও। {সূরা নাহল:৭৮-৮১}
আল্লাহ নিজ সম্বন্ধে মানুষদের যা জানিয়েছেন উপরোল্লেখিত অংশটুকুর আনুপাতিক হার সিন্ধুর তুলনায় বিন্দুর অনুরূপ।
এগুলো নিদর্শনাবলী, আল্লাহর পরিচয় লাভের সহায়ক। এসব নিদর্শন মহান রবের সাথে মানুষের সম্পর্ক তৈরি করে সুনিপুনভাবে এবং একান্ত স্বার্থকভাবে সৃষ্টি করে তাদের অন্তরে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ।
আল্লাহ সম্বন্ধে খ্রীষ্টান-নাসারাদের ধারণা কী ? তাঁর সাথে নিখিল বিশ্ব ও মানুষের সম্পর্ক কী? 
তারা বিশ্বাস করে আল্লাহর সন্তান আছে।‌ ‘আল্লাহ তা হতে পবিত্র,। জন্ম দেয়া-নেয়া হচ্ছে আবির্ভূত হওয়া, বিস্তার লাভ করা বা শূন্যতার পর একটি অতিরিক্ত অস্তিত্ব যা বলতে গেলে এক প্রকার ঘাটতি। আর এটি মহাপরাক্রমশালী-প্রতাপাপন্ন মাওলার ক্ষেত্রে সর্বতোভাবে অসম্ভব। কারণ তিনি (لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ   অর্থাৎ তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও জন্ম দেয়া হয়নি।) সুতরাং যারা এরূপ বলবে তারা ইসলামি আকিদার দৃষ্টিকোণ থেকে চির জাহান্নামি-কাফের বলে বিবেচিত হবে। আল্লাহ তাদের কোনো আমলই গ্রহণ করবেন না।
وَقَالَتِ الْيَهُودُ عُزَيْرٌ ابْنُ اللَّهِ وَقَالَتِ النَّصَارَى الْمَسِيحُ ابْنُ اللَّهِ ذَلِكَ قَوْلُهُمْ بِأَفْوَاهِهِمْ يُضَاهِئُونَ قَوْلَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ قَبْلُ قَاتَلَهُمُ اللَّهُ أَنَّى يُؤْفَكُونَ ﴿30﴾ 
আর ইহুদিরা বলে, উযাইর আল্লাহর পুত্র এবং নাসারারা বলে, মাসিহ আল্লাহর পুত্র। এটা তাদের মুখের কথা, তারা সেসব লোকের কথার অনুরূপ বলছে যারা ইতঃপূর্বে কুফরি করেছে। আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুন, কোথায় ফেরানো হচ্ছে এদেরকে? {তাওবা:৩০}
সাহাবি আবু মূসা আশআরি রা. হতে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘কোনো কষ্টদায়ক কথা শোনার পর (ধৈর্য্য ধারণের ক্ষেত্রে) আল্লাহ অপেক্ষা অধিক ধৈর্য্যশীল আর কেউ নেই। তারা তাঁর সন্তান আছে মর্মে দাবি করে আর তিনি তাদের ক্ষমা করে দেন এবং জীবনোপকরণ দিয়ে থাকেন।, {বুখারি ও মুসলিম}
তাদের এ ধারণাটি জন্ম নিয়েছে গ্রীক পৌরাণিক প্রমিথিউসের ‘পবিত্র অগ্নি’রূপকথার ধারণা হতে। এসব থিওরির মাধ্যমে সে তাদের চিন্তা-চেতনায় এরূপ অসার বিশ্বাসের ভিত রচনা করছে এবং হেদায়াতের সঠিক রাস্তা হতে দূরে ঠেলে দিয়েছে।
তবে কোনো সন্দেহ নেই, জীবন ও ব্যক্তি সংশোধনের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সংক্রান্ত সঠিক ধারণা ও তাঁর সম্বন্ধে যথাযথ বোধ-বিবেচনার বিরাট ভূমিকা রয়েছে।
তৃতীয় পর্ব: একত্ববাদের বিশ্বাস ও তৎপ্রতি দাওয়াত
আল্লাহ বলেন, (قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ) অর্থাৎ তিনি এক-অদ্বিতীয়, তাঁর কোনো সমকক্ষ নেই অনুরূপভাবে উজির, প্রতিপক্ষ, সদৃশ, বিকল্প বলেও কিছু নেই। إثبات তথা প্রমাণের ক্ষেত্রে أَحَدٌ শব্দটি কেবল আল্লাহ তাআলার ব্যাপারে প্রয়োগ হয়। তবে نفي তথা প্রত্যাখ্যান, এর বিপরীত। যেমন لم يخرج من المسجد أحد-মসজিদ হতে কেউ বের হয়নি বলা অশুদ্ধ নয়। এর মূল কারণ হচ্ছে আল্লাহ তাআলাই কেবল নিজ গুণাগুণ ও কর্মে এককভাবে পরিপূর্ণ।
এ আয়াত এবং সূরা নাস ও সূরা ফালাকের প্রথম দুই আয়াতের মাঝে এক দিক থেকে সাদৃশ্য আছে অন্য দিক থেকে বৈপরীত্ব। সাদৃশ্য হচ্ছে, এতে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে সূরার বিষয়বস্তু সম্বন্ধে উচ্চারণের নির্দেশ দিয়েছেন। একইভাবে (قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ) -এও আল্লাহর পক্ষ হতে নিজের তাওহিদের কথা বলা হয়েছে। যেমনিকরে তাওহিদের প্রচার ও দাওয়াতের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে। (আল-যাওউল মনীর আ’লা তাফসিরি ইবনিল কাইয়িম)
অর্থাৎ হে মুহাম্মাদ, হে মুহাম্মাদের সহচরবৃন্দ, হে মুসলিম সকল, আল্লাহকে এক বলে স্বীকার কর এবং তাঁর একত্ববাদের প্রতি সকল লোককে আহ্বান কর।
সকল নবীর দাওয়াততো এ মহান বিষয়ের প্রতিই ছিল। اعبدواالله ما لكم من إله غيره) তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ব্যতীত তোমাদের জন্য আর কোনো ইলাহ নেই।)
চতুর্থ পর্ব: অমুসলিম-কাফেররা কি ইসলামে প্রবেশ করে আমাদের মনোতুষ্টি সাধন করবে?
আল্লাহ তাআলা বলেন: (وَلَا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ এবং আমি যার ইবাদাত করি তোমরা তার ইবাদাতকারী নও।) অমুসলিমরা আল্লাহ তাআলার ইবাদত করবে এ আয়াত সে সম্ভাবনাকে প্রত্যাখ্যান করছে।
এ আয়াত ও তা বার বার উদ্ধৃত হবার পেছনে বহু অর্থবহ কারণ নিহত আছে। যেমন,
  • আল্লাহর ইবাদত থেকে তাদের বিরত থাকা ইচ্ছাকৃত বা প্রকৃতিগত স্বভাবের কারণে নয় বরং তাদের বিশ্বাসই ছিল তারা আল্লাহর ইবাদত করছে । [ولا يزال كثير منهم كذلك ] (তাদের অধিকাংশের ধারণা ছিল তাই) তবে তারা ছিল আল্লাহ সম্পর্কে অজ্ঞ। {আল-যাওউল মুনীর: ৪৬৬/৬} যতই তারা বিশ্বাস করতো যে আল্লাহর ইবাদত সম্পাদনের মাধ্যমে তারা তাঁর নৈকট্য অর্জন করছে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। কারণ সেগুলো মূলত: ইবাদত ছিল না। ইবাদততো আল্লাহর সাথে শিরককে প্রত্যাখ্যান করে। আর তারা শিরক হতে মুক্ত ছিল না। তাছাড়া ‌লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু -এর দাবি হচ্ছে, সত্য মাবূদ আল্লাহ ব্যতীত সকল উপাস্যকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
  • আমি নিজ অবস্থান (তাওহিদ) থেকে যতই নিচে নেমে আসি না কেন তোমরা আল্লাহর সাথে শিরক বাদ দিয়ে নিজ অবস্থান থেকে নেমে আসবে না। এমনকি আমি তাওহিদ ছেড়ে আল্লাহর সাথে শরিক স্থাপন করে তোমাদের মনোতুষ্টি সাধন করলেও।
{ وَلَنْ تَرْضَى عَنْكَ الْيَهُودُ وَلَا النَّصَارَى حَتَّى تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمْ  অর্থাৎ আর ইহুদি ও নাসারারা কখনো তোমার প্রতি সন্তষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের মিল্লাতের অনুসরণ কর।} সুতরাং আল্লাহর সাথে শরিক স্থাপন করে আমরা তাদের মনোতুষ্টি সাধন করতে পারলেও আল্লাহর ইবাদত ও তাঁর একত্ববাদের স্বীকৃতি দিয়ে তারা আমাদের সন্তুষ্ট করবে এমন কোনো আশা নেই।
তাছাড়া শাব্দিক অলংকরণের প্রতি দৃষ্টি দিলেও বিষয়টি প্রতিভাত হয়। কারণ,
{ وَلَا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ}-বলে ছুবূতের প্রমাণ বহনকারী কর্তাবাচক বাক্য ব্যবহার করে মহান আল্লাহ এটিই বুঝিয়েছেন যে শিরকের অভ্যাস তাদের মজ্জাগত হয়ে গেছে। একবারের জন্য হলেও এটি তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হবার নয়।
পঞ্চম পর্ব:
অমুসলিমদের আগ্রহের প্রতি সাড়া দিয়ে আমারা তাদের মনোতুষ্টি সাধন করতে পারি না এবং করবও না, এমনকি মাত্র একবারের জন্য হলেও। এটিই আমাদের আদর্শ। এটিই আমাদের দীনের শিক্ষা। {لَا أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ  } ও { وَلَا أَنَا عَابِدٌ مَا عَبَدْتُمْ} আয়াতদ্বয়ের মাধ্যমে না করে দেওয়া হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের মিথ্যা উপাস্যদের ইবাদত করবেন না। বাকি প্রসঙ্গটি একাধিকবার উল্লেখ করার পেছনে রহস্য হচ্ছে, একত্ববাদের ধারণা প্রগাঢ় করা ও শিরক থেকে মুক্তির বিষয়টি চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত করা।
শব্দগত দিক থেকে দুই আয়াতে কিছুটা ভিন্নতা আছে। প্রথম আয়াতে না বাচক ক্রিয়া আর দ্বিতীয় আয়াতে কর্তাবাচক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। ক্রিয়াবাচক ও কর্তাবাচক শব্দের মাঝে পার্থক্য হচ্ছে, ক্রিয়াবাচক শব্দে  নবায়ন, ক্রমাগত ও সংঘটনের অর্থ পাওয়া যায়। আর কর্তাবাচক শব্দ আবশ্যিক গুণ ও স্থির অর্থ বুঝিয়ে থাকে। আয়াতদ্বয়ের মাধ্যমে যেন বলা হয়েছে, তোমাদের উপাস্যের ইবাদত করে তোমাদের মনোতুষ্টি সাধন আমার দ্বারা কখনও হবে না। এটি আমার অভ্যাস নয়, কর্মও নয়। {আল-যাওউল মুনীর: ৪৭০/৬}
সুতরাং আয়াতের মূল সম্বোধিত ব্যক্তিবর্গ- রাসূল অনুসারীদের পক্ষে অমুসলিমদের মনোতুষ্টি কল্পে এমন কোনো কাজ করা সঙ্গত হবে না যার মাধ্যমে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিংবা আকিদা বিনষ্ট হয়। যদিও কাজটি অতিশয় নগণ্য বা মাত্র একবারের জন্য হয়।                                                    
অমুসলিম-কাফেরদের অনুসরণ-আনুগত্য মৌলিকভাবে নিষিদ্ধ করে পবিত্র কোরআনের বহু জায়গায় সুস্পষ্ট ভাষায় মুসলমানদের সতর্ক করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِنْ تُطِيعُوا الَّذِينَ كَفَرُوا يَرُدُّوكُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ فَتَنْقَلِبُوا خَاسِرِينَ ﴿149﴾ بَلِ اللَّهُ مَوْلَاكُمْ وَهُوَ خَيْرُ النَّاصِرِينَ ﴿150﴾
হে মুমিনগণ, যদি তোমরা কাফিরদের আনুগত্য কর, তারা তোমাদেরকে তোমাদের পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। ফলে তোমরা ক্ষতিগ্রস- হয়ে ফিরে যাবে। বরং আল্লাহ তোমাদের অভিভাবক এবং তিনি উত্তম সাহায্যকারী। {আলে ইমরান: ১৪৯-১৫০}
এরূপ আরো বহু আয়াত রয়েছে যাতে আল্লাহ তাদের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। তাদের চরিত্রের বাস্তব অবস্থা ও অন্তরে লুকিত দূরভিসন্ধি চিত্রিত করে দিখিয়েছেন। যেমন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا بِطَانَةً مِنْ دُونِكُمْ لَا يَأْلُونَكُمْ خَبَالًا وَدُّوا مَا عَنِتُّمْ قَدْ بَدَتِ الْبَغْضَاءُ مِنْ أَفْوَاهِهِمْ وَمَا تُخْفِي صُدُورُهُمْ أَكْبَرُ قَدْ بَيَّنَّا لَكُمُ الْآَيَاتِ إِنْ كُنْتُمْ تَعْقِلُونَ ﴿118﴾ هَا أَنْتُمْ أُولَاءِ تُحِبُّونَهُمْ وَلَا يُحِبُّونَكُمْ وَتُؤْمِنُونَ بِالْكِتَابِ كُلِّهِ وَإِذَا لَقُوكُمْ قَالُوا آَمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا عَضُّوا عَلَيْكُمُ الْأَنَامِلَ مِنَ الْغَيْظِ قُلْ مُوتُوا بِغَيْظِكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ ﴿119﴾ إِنْ تَمْسَسْكُمْ حَسَنَةٌ تَسُؤْهُمْ وَإِنْ تُصِبْكُمْ سَيِّئَةٌ يَفْرَحُوا بِهَا وَإِنْ تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا لَا يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئًا إِنَّ اللَّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطٌ ﴿120﴾
হে মুমিনগণ, তোমরা তোমাদের ছাড়া অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা তোমাদের সর্বনাশ করতে ত্রুটি করবে না। তারা তোমাদের মারাত্মক ক্ষতি কামনা করে। তাদের মুখ থেকে তো শত্রুতা প্রকাশ পেয়ে গিয়েছে। আর তাদের অন্তরসমূহ যা গোপন করে তা মারাত্মক। অবশ্যই আমি তোমাদের জন্য আয়াতসমূহ স্পষ্ট বর্ণনা করেছি। যদি তোমরা উপলব্ধি করতে।
শোন, তোমরাই তো তাদেরকে ভালবাস এবং তারা তোমাদেরকে ভালবাসে না। অথচ তোমরা সব কিতাবের প্রতি ঈমান রাখ। আর যখন তারা তোমাদের সাথে সাক্ষাৎ করে, তখন বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’। আর যখন তারা একান্তে মিলিত হয়, তোমাদের উপর রাগে আঙ্গুল কামড়ায়। বল, ‘তোমরা তোমাদের রাগ নিয়ে মর’! নিশ্চয় আল্লাহ অন্তরের গোপন বিষয় সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞাত।
যদি তোমাদেরকে কোন কল্যাণ স্পর্শ করে, তখন তাদের কষ্ট হয়। আর যদি তোমাদেরকে মন্দ স্পর্শ করে, তখন তারা তাতে খুশি হয়। আর যদি তোমরা ধৈর্য ধর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, তাহলে তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের কিছু ক্ষতি করবে না। নিশ্চয় আল্লাহ তারা যা করে, তা পরিবেষ্টনকারী।{সূরা আলে ইমরান: ১১৮-১২০}
ষষ্ঠ পর্ব: স্বাতন্ত্রবোধে উজ্জীবিত হওয়া কাম্য, বিগলিত নয়
দ্বীন-ইসলাম একটি স্বতন্ত্র মতবাদ। একটি স্বতন্ত্র বিশ্বাস। আপন স্বকীয়তায় উদ্ভাসিত একটি জীবন ব্যবস্থার নাম। আচার-আচরণ, রীতি-নীতি, প্রথা-ঐতিহ্য, সভ্যতা-সংষ্কৃতি-অভ্যাস বরং জীবনের যাবতীয় ক্ষেত্রেই ইসলামের একটি স্বাতন্ত্র ও নিজস্বতা রয়েছে। সেটি রক্ষা করেই প্রতিটি মুসলিম নিজের যাবতীয় কর্ম সম্পাদন করে থাকে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,
{لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِيَ دِين} অর্থাৎ তোমাদের একটি আলাদা মতবাদ রয়েছে, রয়েছে স্বতন্ত্র বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা ও জীবন বোধ- ব্যক্তিগত চাল চলনে যার প্রভাব তোমাদেরকে প্রভাবিত করে। ঠিক একইভাবে আমাদেরও রয়েছে নিজস্ব মতবাদ, স্বকীয় বিশ্বাস, স্বতন্ত্র জীবনবোধ, রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্য, সংষ্কৃতি ও আচরণবিধি যা প্রতিটি নি:শ্বাসে প্রবাহ পায় সকল মুসলমানের দৈনন্দিন জীবনে। সুতরাং আমরা আমাদের দ্বীন ও মতবাদ ছেড়ে তোমাদের অসার দ্বীন ও মতবাদ গ্রহণ করব, এমনটি হতে পারে না। সেটি কেবল তোমাদেরকেই মানায়। আমরা আমাদের দ্বীন ও বিশ্বাসের সাথে তোমাদের মতবাদের মিশ্রণ ঘটিয়ে শিরক করতে পারি না। নিজেদের স্বকীয়তাকে বিসর্জন দিতে পারি না একটি কাল্পনিক ও ধারণাপ্রসূত বাতিল মতবাদের মাঝে। আর তোমরাও গোঁড়ামি ও নির্বুদ্ধিতার কারণে কখনও আমাদের সত্য ও যুক্তিনির্ভর দ্বীন গ্রহণ করবে না। এটি অমুসলিমদের দ্বীন পরিত্যাগ ও সম্পর্কচ্ছেদ বিষয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ঘোষণা। {আল-যাওউল মুনীর: ৪৭৫/৬}
মুহাজির ও আনসারদের মাঝে সম্পাদিত মৈত্রি-চুক্তিতে খোদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক উচ্চারিত একটি মৌল-ধারা ছিল, পৃথিবীর সকল মানুষ বাদ দিয়ে মুসলমান নিজেরাই একটি স্বতন্ত্র  জাতি।‌
ইহুদি, খ্রিষ্টান কিংবা অগ্নি পূজারি- এককথায় বিশ্বের তাবত মানুষ ধর্ম-কর্ম, আকিদা-বিশ্বাস, শিল্প-সংষ্কৃতি, আচার-আচরণ ইত্যাদি বিষয়ে পারস্পরিক সমঝোতা রক্ষা করে একে অপরের অনুসরণ করে চলে। এ ক্ষেত্রে উম্মতে মুহাম্মাদি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তারা নিজেরা একটি স্বতন্ত্র জাতি। আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। ধর্ম-কর্ম, চাল-চলন, শিল্প-সংষ্কৃতি, বেশ-ভূষা, আকিদা-বিশ্বাসসহ মানব জীবনের যাবতীয় অনুষঙ্গে তাদের রয়েছে স্বকীয় রীতি, নিজস্ব ধারা। কোনো ক্ষেত্রেই তারা অন্য কোনো জাতি ও মানুষের সাদৃশ্য অবলম্বন করে না। এ স্বকীয়তা বজায় রাখার তাগিদে অন্য ধর্মাবলম্বীদের অভ্যাসগত ও জাগতিক রীতি-নীতির অনুসরণকে তারা হারাম জ্ঞান করে। ধর্মীয় বিষয়াদির কথাতো বলারই অপেক্ষা রাখে না।
এ স্বাতন্ত্রবোধ তাদের মর্যাদাগত অবস্থানকে সংহত করেছে সুদৃঢ়ভাবে। আলাদা বৈশিষ্ট্য দিয়েছে সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে। এ স্বাতন্ত্রবোধ তাদের ঐতিহ্যের একটি মৌলিক উপাদান। কেবলা পরিবর্তন ও সমজাতীয় কয়েকটি ব্যাপারে সামান্য চিন্তা করলেই বিষয়টি প্রতিভাত হয় সুন্দরভাবে। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে এমনকি ইসলমের শুরুযুগেও কেবলা ছিল বায়তুল মুকাদ্দাস। পরবর্তী কালে এটি পরিবর্তন করে কেবলা করা হয় পবিত্র কা’বাকে। এতে মুসলমানদের স্বাতন্ত্র প্রমাণ হয় সুস্পষ্টরূপে। নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও নানা বিষয়ে সে স্বাতন্ত্র বজায় রেখেছেন নিয়মিত। ইহুদি মতবাদে  মোজা পরে সালাত আদায় ছিল অবৈধ, নবীজি তাঁর সাহাবাদের মোজা পরে সালাতের অনুমতি প্রদান করলেন। তারা পাকা চুল, দাড়িতে রং লাগাতো না, নবীজি মুসলমানদেরকে মেহেদি ও কাতম জাতীয় পদার্থ দ্বারা সাদা চুল-দাড়িকে রঞ্জিত করার অনুমতি দিলেন। আশুরা উপলক্ষে তারা একদিন সওম পালন করত, নবীজি মৃত্যু পূর্ববর্তী বছর তাদের বিরোধিতা কল্পে প্রত্যয় ঘোষণা করলেন, আগামী বছর বেঁচে থাকলে আমি দুই দিন সওম পালন করব।
অমুসলিমদের বিরোধিতাকে রাসূলুল্লাহ মুসলমানদের স্বাতন্ত্র রক্ষার্থে আইনে পরিণত করলেন। বললেন, (যে ব্যক্তি কোনো জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে তাদের মধ্য হতে গণ্য হবে) আরো বললেন, (তোমরা ইহুদিদের সাদৃশ্য অবলম্বন করবে না) এ প্রসঙ্গে হাদিসের ভাণ্ডার খুবই সমৃদ্ধ। {ড. আকরাম আল-উমরি, আল-সিরাতুন্নববিয়্যাহ ১/২৯২, আল্লামা ইবন তাইমিয়া, ইকতেজাউস সিরাতিল মুস্তাকীম}
সপ্তম পর্ব:
কোনো ক্ষেত্রেই আমাদের ও অমুসলিমদের মাঝে কোনো মিল নেই। বরং উভয়ের মাঝে সুস্পষ্ট দূরত্ব ও বৈপরীত্ব বিদ্যমান। সুতরাং কোনো ক্ষেত্রেই তাদের সাথে আমাদের মিলন সম্ভব নয়, না আকিদা-বিশ্বাসে না চিন্তা-চেতনায় না মতবাদে এবং না রীতি-নীতিতে।
আকিদা-বিশ্বাসে সম্ভব নয় কারণ আমরা বিশ্বাস করি আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবূদ নেই আর তারা পাথর, গাছপালা, মানুষ ইত্যাদিকে তাঁর সাথে শরিক করে, যে ব্যাপারে কোনো দলিল-প্রমাণ অবতীর্ণ হয়নি।
আমরা সকল নবী-রাসূলের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করি,
}آَمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آَمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ وَقَالُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ ﴿285﴾
অর্থাৎ, রাসূল তার নিকট তার রবের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত বিষয়ের প্রতি ঈমান এনেছে, আর মুমিনগণও। প্রত্যেকে ঈমান এনেছে আল্লাহর উপর, তাঁর ফেরেশতাকুল, কিতাবসমূহ ও তাঁর রাসূলগণের উপর, আমরা তাঁর রাসূলগণের কারও মধ্যে তারতম্য করি না। আর তারা বলে, আমরা শুনলাম এবং মানলাম। হে আমাদের রব! আমরা আপনারই ক্ষমা প্রার্থনা করি, আর আপনার দিকেই প্রত্যাবর্তন স্থল।}
আর তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাতকে অস্বীকার করে, তাঁকে গালমন্দ ও তিরস্কার করে।
চিন্তা-চেতনায় মিলন অসম্ভব কারণ, আমাদের চিন্তায় এ নিখিল বিশ্ব আমাদের দান করা হয়েছে এবং আমাদের কল্যাণে আমাদেরই অনুগত করে দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে এ প্রসঙ্গে প্রচুর আয়াত নাযিল হয়েছে। যেমন,
وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُمْ مِنْ بُيُوتِكُمْ سَكَنًا وَجَعَلَ لَكُمْ مِنْ جُلُودِ الْأَنْعَامِ بُيُوتًا تَسْتَخِفُّونَهَا يَوْمَ ظَعْنِكُمْ وَيَوْمَ إِقَامَتِكُمْ وَمِنْ أَصْوَافِهَا وَأَوْبَارِهَا وَأَشْعَارِهَا أَثَاثًا وَمَتَاعًا إِلَى حِينٍ ﴿80﴾ وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُمْ مِمَّا خَلَقَ ظِلَالًا وَجَعَلَ لَكُمْ مِنَ الْجِبَالِ أَكْنَانًا وَجَعَلَ لَكُمْ سَرَابِيلَ تَقِيكُمُ الْحَرَّ وَسَرَابِيلَ تَقِيكُمْ بَأْسَكُمْ كَذَلِكَ يُتِمُّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكُمْ لَعَلَّكُمْ تُسْلِمُونَ ﴿81﴾
আর আল্লাহ তোমাদের ঘরগুলোকে তোমাদের জন্য আবাস করেছেন এবং তোমাদের পশুর চামড়া দিয়ে তাবুর ব্যবস্থা করেছেন, যা খুব সহজেই তোমরা সফরকালে ও অবস্থানকালে বহন করতে পার। আর তাদের পশম, তাদের লোম ও তাদের চুল দ্বারা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য গৃহসামগ্রী ও ভোগ-উপকরণ (তৈরি করেছেন)
আর আল্লাহ যা সৃষ্টি করেছেন, তা থেকে তোমাদের জন্য ছায়ার ব্যবস্থা করেছেন এবং পাহাড় থেকে তোমাদের জন্য আশ্রয়স্থল বানিয়েছেন, আর ব্যবস্থা করেছেন পোশাকের, যা তোমাদেরকে গরম থেকে রক্ষা করে এবং বর্মেরও ব্যবস্থা করেছেন যা তোমাদেরকে রক্ষা করে যুদ্ধে। এভাবেই তিনি তোমাদের উপর তার নিয়ামতকে পূর্ণ করবেন, যাতে তোমরা অনুগত হও। (সূরা নাহল : ৮০-৮১)
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ﴿21﴾ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ فِرَاشًا وَالسَّمَاءَ بِنَاءً وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجَ بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَكُمْ فَلَا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ ﴿22﴾
হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবের ইবাদাত কর, যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদেরকে, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।
যিনি তোমাদের জন্য যমীনকে করেছেন বিছানা, আসমানকে ছাদ এবং আসমান থেকে নাযিল করেছেন বৃষ্টি। অতঃপর তাঁর মাধ্যমে উৎপন্ন করেছেন ফল-ফলাদি, তোমাদের জন্য রিয্‌কস্বরূপ। সুতরাং তোমরা জেনে-বুঝে আল্লাহর জন্য সমকক্ষ নির্ধারণ করো না। {বাকারা: ২১-২২}
আল্লাহ তাআলাই এটি আমাদের দান করেছেন। এবং চেষ্টা-শ্রম ব্যয় করে আবাদ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তবে সে চেষ্টা চলবে তাঁর বাতানো রীতি-নীতি অনুযায়ী, নিজ খেয়াল-খুশি মত নয়।
আর অমুসলিমরা বিশ্বাস করে এ নিখিল বিশ্ব প্রাকৃতিক, প্রাকৃতিকভাবেই তার আবির্ভাব ঘটেছে। এর মাধ্যমে তারা আল্লাহর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করল। তাদের বিশ্বাস হচ্ছে, নিজ বিবেক-বুদ্ধির কল্যাণে তারা চাহিদামত নানা জিনিস সৃষ্টি ও আয়ত্তে আনার ক্ষমতা রাখে। এ বিশ্বাসের মাধ্যমে রুবুবিয়্যাতের স্তরে পৌঁছে যাওয়ার দাবি করল। এমন অলীক বিশ্বাসের মাধ্যমে তারা সবকিছু গোলমেলে করে ফেলেছে।
কোরআন-সুন্নাহর কল্যাণে মানুষের জীবনের সামগ্রীক দিক (শুরু-শেষ-গন্তব্য ও পরিণতি) সম্বন্ধে আমাদের জানা আছে সবিস্তারে। অমুসলিমদের এ বিষয়ে স্বচ্ছ জ্ঞান না থাকার কারণে মানুষের আদি অবস্থা নিয়ে অমর্যাদাকর ধারণা করে বসে আছে। বিবর্তণবাদের মন্দ বিশ্বাসের কারণে তারা মনে করে মানুষের প্রাথমিক বিকাশ হচ্ছে বানর।
আমাদের বিশ্বাস পার্থিব জীবন একটি ব্যাপক জীবনের অংশ মাত্র, এর পর রয়েছে কবরের জীবন-বরযখ,  তার পর আছে পরকালীন জীবন-আখেরাত।
দুনিয়ার জীবনকে আমরা আখেরাতের জীবনের সুখ-সমৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্র মনে করি।
  وَإِنَّ الدَّارَ الْآَخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ) ‌‌অর্থাৎ এবং নিশ্চয় আখেরাতের নিবাসই হলো প্রকৃত জীবন।)
আর অমুসলিমরা দুনিয়ার জীবনকেই মূল জীবন মনে করে। তারা বরযখ, আখেরাত, হিসাব, প্রতিদান ইত্যাদিতে বিশ্বাসী নয়।( زَعَمَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنْ لَنْ يُبْعَثُوا অর্থাৎ,কাফিররা ধারণা করেছিল যে, তারা কখনোই পুনরুত্থিত হবে না।) তাই তারা তাতে গোলযোগ সৃষ্টি করে। স্বার্থ চরিতার্থ করতে মৃত্যুকে জয় করতে চায়।
আর মতবাদেও মিল সম্ভব নয়, কারণ আমাদের মতবাদ হচ্ছে কোরআন ও সুন্নাহ যা মূলত: দোষ-ত্রুটিমুক্ত ওহী-এ-এলাহী। বাতেল এর সমপর্যায়ের মতবাদ পেশ করতে পারবে না কখনো। আর অমুসলিমদের মতবাদ হচ্ছে দিকভ্রান্ত মানুষের অসার মস্তিষ্ক প্রসূত দুর্বল ও কাল্পনিক কিছু মতবাদ। যাকে তারা কানুন ও সংবিধানের মর্যাদা দিয়ে রেখেছে।
বাকি থাকল রীতি-নীতি, তাতেও মিলন অসম্ভব। কারণ আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক এক কথায় সার্বিক জীবনাচার ও রীতি ওহী সূত্রে প্রাপ্ত। সে রীতি ও দর্শন আমাদের জীবন, স্বাধীনতা, অভ্যাস ও পারস্পরিক সম্পর্ককে মর্যাদা, শিষ্টতা, দায়বদ্ধতা, আত্মমর্যাদাবোধ ও আল্লাহভীতিতে পরিবেষ্টন করে রেখেছে। ফলে সকল কাজ আমাদেরকে উক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সম্পাদন করতে হয়। ফলে জীবন হয় নিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল।
আর অমুসলিমদের জীবনাচারে তেমন কোনো বাধ্য-বাধকতা নেই। নেই কোনো দায়িত্বশীলতা। না ব্যক্তিগত ব্যাপারে না সমাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যাপারে এবং না অন্য কোনো ক্ষেত্রে। বরং সব ক্ষেত্রেই আছে কেবল স্বার্থপরতা, আত্মম্ভরিতা, দায়িত্বহীনতা ও উশৃঙ্খলতা। কেবল উন্মুক্ত স্বাধীনতা যা সবকিছু বরবাদ করে দেয়। এতো জন্তু-জানোয়ারের জীবন। আল্লাহ বলেন, (তারা চতুষ্পদ জন্তু সদৃশ বরং এর চেয়েও বিভ্রান্ত)। মুক্ত অর্থনীতি ও অবাধ যৌনাচারের নৈরাজ্যকর বৈশ্বিক পরিস্থিতি, পালনকর্তা আল্লাহকে অস্বীকারকারী কাফেরের বিকৃত চিন্তারই নাপাক ফসল।
জীবন চলার পথে তাদের সাথে আমাদের মিলন কিভাবে সম্ভব ? তাদের ও আমাদের মাঝেতো উদয় ও অস্তাচলের দূরত্ব বিদ্যমান।
শ্রুতি মত- উম্মতের উল্লেখযোগ্য সংখ্যার একটি দল যখন তাদের সাথে মিলে-মিশে জীবন যাপন করার বাসনা লালন করছে, চলার পথে তাদের সাথী হতে প্রয়াস চালাচ্ছে। তাদের উদ্দেশে পরিস্কার বলতে পারি, এ বাসনা চরিতার্থ করার মাধ্যমে বাস্তবে তারা নিজেদেরকে তাদের কোলে নিক্ষিপ্ত করছে এবং তাদের পঙ্কিলতার ডোরে আবদ্ধ করারই প্রয়াস চালাচ্ছে। লাঞ্ছনা, অপমান, পরাজয় ও লোকসান ছাড়া প্রাপ্তি বলতে আর কিছুই মিলবে না, এ কথা নিশ্চিত বলা যায়। এছাড়া সেখান থেকে ছাড়া পাওয়ার আর কোনো ব্যবস্থা নেই। সত্য রেসালত এমন সতর্কবাণীই উচ্চারণ করে গেছে সহস্র বছর আগে। ছাওবান রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে এসেছে, (আমার উম্মতের একটি দল মুশরিকদের সাথে মিলিত হওয়া এবং তাদের একাধিক দল মূর্তি পুজা করা অবধি কিয়ামত সঙ্ঘটিত হবে না। {আবু দাউদ:৪২৫২}
অষ্টম পর্ব:  
অমুসলিমদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ও অব্যহতির সুস্পষ্ট ঘোষণা সূরা-কাফিরূনের প্রতিটি আয়াতের দাবী। তাদের ধর্মবোধ ও জীবন পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন যা একান্ত তাদের সাথেই সংশ্লিষ্ট। আর আমাদের ধর্ম ও জীবন পদ্ধতিও সম্পূর্ণ আলাদা, আপন স্বকীয়তায় সমুজ্জ্বল যা কেবল আমাদের সাথেই সংশ্লিষ্ট । কোনোভাবেই অমুসলিমদের সাথে মুসলমানদের মিল নেই, হতেও পারে না। কারণ, প্রত্যেকের ধর্ম ও জীবন পদ্ধতি সম্পূর্ণ আলাদা। তাইতো আমরা দেখতে পাই সূরা নাযিল হবার সাথে সাথেই নবীজি মসজিদুল হারামে তাশরিফ রাখলেন। এবং কোরাইশের একটি সমাবেশে আদ্যপান্ত তেলাওয়াত করে শুনিয়ে দিলেন।
নবম পর্ব: আত্মিক ও মানসিক বিভক্তি
কুফর ও কাফেরদের জীবনাচার, চাল-চলন, সভ্যতা-সংষ্কৃতি এক কথায় তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের প্রতি ঘৃণাবোধ এবং অসার মতবাদ এড়িয়ে চলার মানসিকতা লালন করা ঈমান ও তাওহীদের চূড়ান্ত দাবি। একজন মুসলমান নিজেকে তাওহীদের এ স্তরে উন্নীত করতে সমর্থ হলে ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে পারবে। সহিহ হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, (যে ব্যক্তি তিনটি বিশেষ গুণ অর্জনে সমর্থ হবে সে ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে পারবে। যার নিকট আল্লাহ ও রাসূল অপরাপর সকল মানুষ অপেক্ষা অধিক প্রিয় হবেন, কেবল আল্লাহর জন্যই যে অপরকে ভালবাসবে এবং একবার কুফর হতে নিষ্কৃতি পাবার পর পুনরায় তাতে ফিরে যাওয়াকে (জ্বলন্ত) অগ্নিতে নিক্ষিপ্ত হবার ন্যায় ঘৃণা করবে।) {বর্ণনায় বোখারি ও মুসলিম}
এটিই হচ্ছে একজন মুসলিমের ঈমানের মৌল-দাবি। এমনটিই হওয়া উচিত তার অনুভূতি। তার আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে যে, আপন স্বকীয়তায় সমুজ্জ্বল সে এক স্বতন্ত্র সত্তা-অমুসলিমদের সাথে কোনো ক্ষেত্রেই তার কোনো মিল নেই। তাদের দীন ভিন্ন আর তার দীন ভিন্ন। উভয়ের পথ আলাদা আলাদা। তার ঈমান অমুসলিমদের সাথে তাল মিলিয়ে এক কদম চলারও অনুমতি দেয় না। তার দায়িত্ব হচ্ছে নিজস্ব অবস্থান থেকে বিন্দু পরিমাণও ছাড় না দিয়ে এবং কোনোরূপ তোষামোদ না করে তাবত অমুসলিমকে হেদায়াতের পথে চালানোর ব্রত গ্রহণ করা। {ফী যিলালিল কোরআন ৩৯৯২/৬}
নবীজির সকল সাহাবির অবস্থা ছিল এমনই। নারী কিংবা পুরুষ যে-ই ইসলাম গ্রহণ করেছেন। উচ্চারণ করেছেন শাহাদাতের দীপ্ত কালিমা। জাহেলি আচার-আচরণের আচ্ছাদন শরীর থেকে ঝেড়েফেলেই তা করেছেন। জাহেলি সভ্যতার  যাবতীয় আবিলতা মাড়িয়েই ইসলামের অনাবিল শান্তিময় নীড়ে প্রবেশ করেছেন। মন ও মানসে, বাসনা ও অনুভূতিতে বিরাজিত ছিল কেবল ইসলাম আর ইসলাম। কোরআন তাদেরকে এমন করেই গড়ে তুলেছে। আর তারাও ছিলেন এমনই। আল্লাহই সাহায্য কর্তা।

দশম পর্ব: নীতি-আদর্শে অবিচলতা
কাফেরদের মনোতুষ্টি কল্পে নীতির প্রশ্নে শিথিলতা প্রদর্শন কিংবা তাদের ভয়ে আপন আদর্শ হতে পশ্চাদাপসারণ ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নীতি বিরুদ্ধ কাজ। এমনটি তিনি জীবনে একবারের জন্যও করেননি। জীবন বিপন্ন হলেও এ আদর্শ ধরে রেখেছেন আমৃত্যু। -ইসলাম  তার প্রতিটি অনুসারী হতে এমন দৃঢ়তাই কামনা করে - অথচ মক্কাতে তিনি ছিলেন অসহায় ও দুর্বল।
وَاذْكُرُوا إِذْ أَنْتُمْ قَلِيلٌ مُسْتَضْعَفُونَ فِي الْأَرْضِ تَخَافُونَ أَنْ يَتَخَطَّفَكُمُ النَّاسُ فَآَوَاكُمْ وَأَيَّدَكُمْ بِنَصْرِهِ وَرَزَقَكُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ ﴿26﴾
আর স্মরণ কর, যখন তোমরা ছিলে অল্প, তোমাদেরকে দুর্বল মনে করা হত জমিনে। তোমরা আশঙ্কা করতে যে, লোকেরা তোমাদেরকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যাবে। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে আশ্রয় দিয়েছেন, নিজ সাহায্য দ্বারা তোমাদেরকে শাক্তিশালী করেছেন এবং তোমাদেরকে পবিত্র রিয্‌ক দান করেছেন। যাতে তোমরা শুকরিয়া আদায় কর।{আনফাল:২৬}
বরং নবীজি প্রথম থেকেই জানতেন, তার বিরুদ্ধে আরবরা সব সঙ্ঘবদ্ধ, যে কোনো সময় সমবেতভাবে হামলা করতে পারে। তারপরও তিনি তাদের পরওয়া করেননি। নিজ নীতিতে ছিলেন পর্বতসম দৃঢ়পদ। ভীতি প্রদর্শন ও উৎসাহ প্রদান এক কথায় অমুসলিমদের কোনো চক্রান্তই তাঁকে আপন আদর্শ হতে হটাতে পারেনি বিন্দু পরিমাণও। সামরিক, অর্থনৈতিক কিংবা সাংষ্কৃতিক যত যুদ্ধই আমরা করি না কেন, নীতির প্রশ্নে  অবিচলতা বলে একেই ।
একাদশতম পর্ব : অমুসলিমদেরকে সম্বোধন পদ্ধতি
(يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ) (অর্থাৎ হে কাফের সম্প্রদায়।) কাফেরদের সম্বোধন করার এটি হচ্ছে একটি অভিনব পদ্ধতি। যার সূচনা করেছে মহাগ্রন্থ আল-কোরআন। এ নজির অন্য কোথাও খোঁজে পাওয়া যায় না। কুফর বিশেষণে চিহ্নিত করে এ সম্বোধনের মাধ্যমে তাদেরকে মূলত: খাট করা হয়েছে। তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের যৌক্তিকতাকে প্রমাণিত করা হয়েছে। এবং বিরক্তি ও ক্রোধ উদ্দিপক বিশেষণ উল্লেখ করে সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদের ভয়ে ভীত নন।
আবু বকর ইবনুল আনবারি রহ. বলেন, আয়াতের অর্থ হচ্ছে, যারা কুফরি করেছে তাদের বল, হে কাফেররা। অর্থাৎ তিনি তাদের সমাবেশে তাদেরকে কুফরের পরিচিতি ও স্বীকৃতি দিয়ে বলছেন হে কাফেররা। অথচ কুফরের প্রতি সম্বোধিত হওয়াকে তারা অপছন্দ করে ও বিরক্ত হয়। {তাফসির আল-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর লি-ইবনে আশূর ৫৮১/৩০}
কারণ তাদের আকিদা হচ্ছে প্রকৃত মুমিনতারাই। যেমন বিশ্বাস পোষণ করত কোরাইশ কাফেরবৃন্দ নিজেদেরকে ইবরাহীম আ.-এর অনুসারী বলে। বর্তমান ও পূর্ব যুগের খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস হচ্ছে, তারা ঈসা আ.-এর অনুসারী। মানবজাতিকে কল্যাণ ও আলোর পথে আহ্বানকারী। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, তারা কাফের। এটিই তাদের প্রকৃত পরিচয়। এ ছাড়া আর কোনো পরিচয় নেই তাদের। তারা আসমানি কোনো ধর্মের অনুসারীও নয়। তাদের মূল পরিচয় তারা কাফের। এ নামেই আল্লাহ তাদের অভিহিত করেছেন এবং নিজ নবীকে সম্বোধন করতে আদেশ দিয়েছেন।
আল্লামা ইবনু কাসির রহ. এ প্রসঙ্গে বলেন, (এ সম্বোধন পৃথিবীস্থিত সকল অমুসলিমকে শামিল করেছে।) {তাফসিরুল কুরআনিল আজিম ৭২৬/৪}
দ্বাদশতম পর্ব: প্রকৃত স্বাধীনতা
সূরা ইখলাসে সন্নিবেশিত বিষয়াদি সম্পর্কে বুঝ ও বিশ্বাস অন্তরে প্রগাঢ়রূপে স্থাপিত হলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, অন্তর লোভ-লালসা, কাম-রিপু ও প্রবৃত্তিগত চাহিদার বন্ধন হতে মুক্ত হয়ে যাবতীয় ভয়-ডর-শঙ্কা কাটিয়ে কেবল অদ্বিতীয়-অমুখাপেক্ষী আল্লাহর প্রতি ধাবিত হবে এবং তাঁর কাছেই যাবতীয় আরজি-আরাধনা উপস্থাপন করবে। কেবল তাঁকেই ভয় করবে। তাঁর কাছেই আশা করবে। তাঁর ওপরই নির্ভর করবে।
একজন মানুষ তারই মত দুর্বল-সামর্থহীন অপর মানুষ বা অন্য কোনো সৃষ্টির ওপর নির্ভর করবে কি করে? কিভাবেই বা তাদের নিকট প্রত্যাশার হাত সম্প্রসারিত করবে? তাদের ভয় করবে? অথচ এতটাই অসহায় তারা, অপরতো দূরের কথা নিজেরই উপকার সাধন কিংবা ক্ষতিরোধ করার ক্ষমতা রাখে না। নিজের সাহায্য করতে পারে না। জীবন-মরণ-রিজিকের ব্যাপারে তাদের কোনো দখল নেই... এটিই আল-কোরআনের মৌলিক শিক্ষা। এ শিক্ষায়ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ সাহাবিদের গড়ে তুলেছেন। নির্মাণ করেছেন মহা পরাক্রমশালী আল্লাহর ওপর তাদের বিশ্বাসের সুদৃঢ় সৌধ।
বিশিষ্ট সাহাবি আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. বলেন, একদিন আমি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেছনে ছিলাম, তিনি আমার উদ্দেশে বললেন, হে বালক, আমি তোমায় কয়েকটি কথা শেখাব, তুমি আল্লাহর (বিধি-বিধান) বিষয়ে যত্নবান হও আল্লাহ তোমাকে হিফাযত করবেন। আল্লাহর বিষয়ে যত্নবান হও, তাঁকে তোমার কাছে পাবে। যখন কিছু প্রার্থনা করবে তখন তাঁর কাছেই প্রার্থনা করবে। আর যখন সাহায্য চাইবে কেবল তাঁর কাছেই চাইবে। শোন_ তোমার উপকার্থে যদি মানব জাতি সকলেই এক হয়ে চেষ্টা করে, তারা কেবল সে উপকারটুকুই করতে পারবে যা আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। আর যদি অপকার করার জন্য একত্রিত হয় তাহলে সে অপকারটুকুই কেবল করতে পারবে যা আল্লাহ তোমার বিপক্ষে লিখে রেখেছেন। কলম উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে, আর (লিখিত) কাগজ শুকিয়ে গেছে। {তিরমিজি, সূত্র হাসান}
হাদিসটি জামে তিরমিজি ব্যতীত অন্যান্য গ্রন্থেও কিছুটা ভিন্নতায় বর্ণিত হয়েছে, যেমন, তুমি আল্লাহর (বিধি-বিধান) বিষয়ে যত্নবান হও তাঁকে তোমার সামনে পাবে। সাচ্ছন্দের সময় আল্লাহর (বিধি-বিধান)-কে স্মরণে রেখে চলবে দুর্দিনে আল্লাহ তোমাকে স্মরণে রাখবেন। জেনে রাখ, যা তোমার হয়নি তা হওয়ার ছিল না। আর যা হয়েছে তা না হওয়ার ছিল না। আরো জেনে রাখ, সাহায্য ধৈর্য্য-সবরের সাথে (সম্পৃক্ত)। আর দুর্দশা-পেরেশানির সাথেই রয়েছে স্বস্তি-আনন্দ । কষ্টের সাথেই রয়েছে সুখ। {বর্ণনায়, তিরমিজি ২৫১৬, ইমাম আহমদ ১/২৯৩ ক্রমিক নং ২৬৬৯}
এটিই হচ্ছে প্রকৃত স্বাধীনতা, নিখাদ আজাদি। যা এখনো আমাদের অনেকেই বুঝে উঠতে পারছে না। তাইতো অন্তরে দুনিয়া প্রীতিকে সাধনার আসনে বসিয়ে রেখেছে একান্ত নিবিষ্টতায়। আয় আল্লাহ, আমাদের বুদ্ধির মুক্তি দান করুন।
ত্রয়দশতম পর্ব:
কোরআনি মৌলনীতির আলোকে জীবন যাপন করতে হলে আমাদের জন্য অনিবার্য করণীয় হচ্ছে, নিজ সন্তান-সন্ততি, স্ত্রী-পরিজন ও সমাজকে কোরআনের এ দীপ্তিময় শিক্ষায় প্রশিক্ষণ প্রদান। যেমনটি করেছেন স্বয়ং আল্লাহ নিজ নবী ও তাঁর সাহাবিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে। আর এটিই উদ্ভাসিত হয়েছে কোরআনের নিম্নোক্ত বাণীতে।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ ﴿208﴾
হে মুমিনগণ, তোমরা ইসলামে পূর্ণরূপে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না । নিশ্চয় সে তোমাদের জন্য স্পষ্ট শত্রু। (সূরা বাকারা:২০৮)
তাফসির কারকগণ বলেন, অর্থাৎ দ্বীনের প্রতিটি অনুষঙ্গে, তার কোনো একটিকেও বাদ দেওয়া চলবে না। {তাইসিরুল কারিমির রহমান লিস-সা’দি :৭৭}
আমাদের আরো করণীয় হচ্ছে, নিম্নোক্ত আয়াতে গভীর মনোনিবেশ করা।
وَإِنْ كَادُوا لَيَفْتِنُونَكَ عَنِ الَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ لِتَفْتَرِيَ عَلَيْنَا غَيْرَهُ وَإِذًا لَاتَّخَذُوكَ خَلِيلًا ﴿73﴾ وَلَوْلَا أَنْ ثَبَّتْنَاكَ لَقَدْ كِدْتَ تَرْكَنُ إِلَيْهِمْ شَيْئًا قَلِيلًا ﴿74﴾ إِذًا لَأَذَقْنَاكَ ضِعْفَ الْحَيَاةِ وَضِعْفَ الْمَمَاتِ ثُمَّ لَا تَجِدُ لَكَ عَلَيْنَا نَصِيرًا ﴿75﴾
আর তাদের অবস্থা এমন ছিল যে, আমি তোমাকে যে ওহী দিয়েছি, তা থেকে তারা তোমাকে প্রায় ফিতনায় ফেলে দিয়েছিল, যাতে তুমি আমার নামে এর বিপরীত মিথ্যা রটাতে পার এবং তখন তারা অবশ্যই তোমাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করত। আর আমি যদি তোমাকে অবিচল না রাখতাম, তবে অবশ্যই তুমি তাদের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়তে। তখন আমি অবশ্যই তোমাকে আস্বাদন করাতাম জীবনের দ্বিগুণ ও মরণের দ্বিগুণ আযাব। তারপর তুমি তোমার জন্য আমার বিরুদ্ধে কোন সাহায্যকারী পাবে না। (সূরা আল-ইসরা:৭৩-৭৫)
এমন আশঙ্কার কারণ, তাদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা ছিল রাসূলুল্লাহ তাদের প্রবৃত্তির চাহিদা চরিতার্থ করবেন যে ব্যাপারে আল্লাহ অনুমতি প্রদান করেননি। অনুরূপভাবে নবীজি আপন হৃদয়ে তাদের হেদায়াতের অদম্য বাসনা পোষণ করতেন। {তাফসির আস-সা’দি:৪১৫}
নবীজির পবিত্র জীবন চরিত ও সাহাবাদের দৈনন্দিন যাপিত জীবনের চিত্র ছিল আলোচ্য কোরআনি বুঝের আদর্শরূপ।
এ বুঝের আলোকে আল্লাহ আমাদের জীবন গড়ার তাওফিক দান করুন।
http://boltechai.com/posts/abul-hiqmah-al-makkih/112

মুনাজাতে আমীরুল মু’মিনীন আলী (আ.)

মুনাজাতে আমীরুল মু’মিনীন আলী (আ.) PDFPrintE-mail
dua

হে আল্লাহ্! আমি আপনার নিকট ঐ দিনের নিরাপত্তা চাচ্ছি যেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন কাজে আসবে না, তবে যে ব্যক্তি বিশুদ্ধচিত্তে আল্লাহ্ দিকে এসেছে তার ক্ষেত্র ব্যতীত। আমি আপনার নিকট ঐ দিনের নিরাপত্তা চাচ্ছি যেদিন জালেম তার দুহাত কামড়িয়ে বলতে থাকবে : হায়! যদি আমি রাসূল (সা.)-এর পথ অবলম্বন করতাম। আমি আপনার নিকট ঐ দিনের নিরাপত্তা চাচ্ছি যেদিন অপরাধীরা তাদের চেহারার দ্বারা শনাক্ত হবে। অতঃপর তাদের পা এবং মাথার চুল মুঠি করে ধরে পাকড়াও করা হবে। আমি আপনার নিকট ঐ দিনের নিরাপত্তা চাচ্ছি যেদিন পিতা তার সন্তানকে কোন প্রতিদান দেবে না এবং কোন সন্তানও পিতাকে কোন প্রতিদান দেবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ওয়াদা সত্য। আমি আপনার নিকট ঐ দিনের নিরাপত্তা চাচ্ছি যেদিন জালেমদের অজুহাত তাদের কোন কাজে আসবে না- তাদের জন্য অভিশাপ এবং নিকৃষ্ট আবাসস্থল। আমি আপনার নিকট ঐ দিনের নিরাপত্তা চাচ্ছি যেদিন কোন সত্তাই অপর কোন সত্তার কোন কিছুরই অধিকারী হবে না। সেদিন সকল বিষয় কেবল মহান আল্লাহ্র। আমি আপনার নিকট ঐ দিনের নিরাপত্তা চাচ্ছি যেদিন মানুষ তার ভাই, মা, বাবা, স্ত্রী এবং সন্তানদের থেকে পালিয়ে বেড়াবে। সেদিন তাদের প্রত্যেকের এমন অবস্থা হবে যা তাকে সবার (নিকটাত্মীয়) থেকে বিমুখ করে দেবে। আমি আপনার নিকট ঐ দিনের নিরাপত্তা চাচ্ছি যেদিন অপরাধী তার নিজ সন্তান-সন্ততি, ভাই এবং তাকে আশ্রয়দানকারী গোত্র ও পৃথিবীর সকল অধিবাসীর বিনিময়ে জাহান্নামের শাস্তি থেকে বাঁচতে এবং নিজেকে উদ্ধার করতে চাইবে। কখনোই নয়। নিশ্চয়ই এটা জাহান্নামের অগ্নি। এটা এমন এক প্রজ্বলিত অগ্নি যা মাংসকে পোড়ানোর জন্য ধাবিত হয়।
প্রভু! হে প্রভু! আপনি প্রভু, আমি দাস। দাসের উপর প্রভু ছাড়া আর কে দয়া করবে? প্রভু! হে প্রভু! আপনি অধিপতি, আমি অধীন। অধীনের উপর অধিপতি ছাড়া আর কে দয়া করবে? প্রভু! হে প্রভু! আপনি পরাক্রমশালী, আমি হীন-নীচ। হীন-নীচের উপর পরাক্রমশালী ছাড়া আর কে দয়া করবে? প্রভু! হে প্রভু! আপনি স্রষ্টা, আমি সৃষ্ট। সৃষ্টের উপর স্রষ্টা ছাড়া আর কে দয়া করবে? প্রভু! হে প্রভু! আপনি মহান, আমি অপাঙ্ক্তেয়, মূল্যহীন। অপাঙ্ক্তেয়, মূল্যহীনের উপর মহান ছাড়া আর কে দয়া করবে? প্রভু! হে প্রভু! আপনি সবল, আমি দুর্বল। দুর্বলের উপর সবল ছাড়া আর কে দয়া করবে? প্রভু! হে প্রভু! আপনি ধনী, আমি দরিদ্র। দরিদ্রের উপর ধনী ছাড়া আর কে দয়া করবে? প্রভু! হে প্রভু! আপনি দাতা, আমি প্রার্থনাকারী। প্রার্থনাকারীর উপর দাতা ছাড়া আর কে দয়া করবে? প্রভু! হে প্রভু! আপনি চিরঞ্জীব, আমি মৃত। মৃতের উপর চিরঞ্জীব ছাড়া আর কে দয়া করবে? প্রভু! হে প্রভু! আপনি স্থায়ী, আমি ধ্বংসশীল। ধ্বংসশীলের উপর স্থায়ী ছাড়া আর কে দয়া করবে? প্রভু! হে প্রভু! আপনি চিরস্থায়ী, আমি ক্ষণস্থায়ী। ক্ষণস্থায়ীর উপর চিরস্থায়ী ছাড়া আর কে দয়া করবে? প্রভু! হে প্রভু! আপনি রিযিকদাতা, আমি রিযিকপ্রাপ্ত। রিযিকপ্রাপ্তের উপর রিযিকদাতা ছাড়া আর কে দয়া করবে? আপনি দানশীল, আমি কৃপণ। কৃপণের উপর দানশীল ছাড়া আর কে দয়া করবে? প্রভু! হে প্রভু! আপনি আরোগ্যদানকারী, আমি রোগগ্রস্ত। রোগগ্রস্তের উপর আরোগ্যদানকারী ছাড়া আর কে দয়া করবে? আপনি বৃহ, আমি ক্ষুদ্র। ক্ষুদ্রের উপর বৃহ ছাড়া আর কে দয়া করবে? প্রভু! হে প্রভু! আপনি সুপথ প্রদর্শনকারী, আমি পথভ্রষ্ট। পথভ্রষ্টের উপর সুপথ প্রদর্শনকারী ছাড়া আর কে দয়া করবে? প্রভু! হে প্রভু! আপনি দয়ালু, আমি দয়াপ্রাপ্ত। দয়াপ্রাপ্তের উপর দয়ালু ছাড়া আর কে দয়া করবে? প্রভু! হে প্রভু! আপনি বাদশাহ, আমি পরীক্ষিত। পরীক্ষিতের উপর বাদশাহ ছাড়া আর কে দয়া করবে? প্রভু! হে প্রভু! আপনি সুস্পষ্ট প্রমাণ, আমি উদভ্রান্ত, দিশেহারা। উদভ্রান্ত, দিশেহারার উপর সুস্পষ্ট প্রমাণ ছাড়া আর কে দয়া করবে? প্রভু! হে প্রভু! আপনি ক্ষমাশীল, আমি পাপী। পাপীর উপর ক্ষমাশীল ছাড়া আর কে দয়া করবে? প্রভু! হে প্রভু! আপনি বিজয়ী, আমি পরাজিত। পরাজিতের উপর বিজয়ী ছাড়া আর কে দয়া করবে? প্রভু! হে প্রভু! আপনি প্রতিপালক, আমি প্রতিপালিত। প্রতিপালিতের উপর প্রতিপালক ছাড়া আর কে দয়া করবে? প্রভু! হে প্রভু! আপনি গৌরবান্বিত, আমি বিনয়ী। বিনয়ীর উপর গৌরবান্বিত ছাড়া আর কে দয়া করবে? প্রভু! হে প্রভু! আপনার রহমতের দ্বারা আমার উপর দয়া করুন এবং আপনার দান, মহানুভবতা এবং কৃপার দ্বারা আমার উপর সন্তুষ্ট হোন, হে দাতা, দয়ালু এবং অবারিত দানশীল ও অনুগ্রহকারী সত্তা! আপনার রহমতের দ্বারা, হে সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু! 

[এ দোয়াটি আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর প্রসিদ্ধ দোয়াসমূহের অন্যতম। শেখ আব্বাস কুমী সংকলিত মাফাতিহুল জিনানগ্রন্থে দোয়াটি বর্ণিত হয়েছে। মূল আরবী থেকে এটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মো. মুনীর হোসেন খান।]