get-fans-468x60

Tuesday, June 21, 2011

কার্গুজারী

চিল্লার জন্য আল্লাহ আমাকে কবুল করেন

আমার জীবনের পরিবর্তনের পিছনে বিশ্ব ইজতেমা বিশেষ ভূমিকা রেখেছে বলে আমি মনে করি। লাখ লাখ মানুষের সমাগম ঘটে এই ইজমেতমায়। প্রত্যেক সাধারণ মুসলমানের মন পরিবর্তনে প্রভাব ফেলে এই আয়োজন। কেননা সারা বিশ্ব থেকে অল্লাহর প্রিয় বান্দাদের আগমন ঘটে । ধনী গরিব ভেদাভেদ ভুলে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির সঙ্গে সকলই ত্যাগ স্বীকার করে এক মজমায় জমা হয়।  আল্লাহর কাছে অসংখ্য শুকরিয় জানাই যিনি আমাকে এ দাওয়াতি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন।
এভাবেই নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন ভাই মুহাম্মাদ আনেয়ার হুসাইন। বর্তমানে তিনি একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। ডিগ্রি পাশ করে বেকার সময় কাটাচ্ছিলেন। পাশাপাশি চাকরি খুঁজছিলেন। কিন্তু কোন কুল কিনারা হচ্ছিল না। এমতাবস্থায় গত ২০০৮ সালে বিশ্ব ইজতেমার সময় চলে আসে। ভাই আনোয়ার জানান,তার এলাকার বন্ধু ভাই শামীম তাকে ইজতেমায় যাওয়ার জন্য আহবান করে। তখন আমি কোন চিন্তা করে এক কথাতেই রাজি হয়ে যাই।  কোন কাজ নেই তে!। এলাকা থেকে জামায়াত বন্দী হয়ে টঙ্গীর ময়দানে তিন দিনের জন্য চলে যাই। আমার জীবনের এক স্বরণীয় স্মৃতি হয়ে থাকবে টঙ্গীর ময়দানের সেই তিন দিন। মানুষ যে একমাত্র আল্লাহর জন্যই এমন নিবেদিত প্রাণ হতে পারে তা আমি সরাসরি দেখেছি ইজতেমার ময়দানে। ইজতেমায় থাকাকালীন এবং তার পরে বেশ কিছু দিন  আমার মনে এমন এক প্রশান্তি অনুভব করেছি যা আমি বলে বুঝাতে পারবো না। এমনটি আগে কখনও হয়নি।
যাই হোক, আমি নামাজে নিয়মিত হওয়ার চেষ্ট করে যাচ্ছিলাম এবং দ্বীন শেখার ব্যাপারে চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। কিছুদিন পর আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসি। নামাজ কালাম সব বন্ধ হয়ে যায়। চাকরির পিছনে পিছনে ছুটছি কিন্তু চাকরি হবার কোন নাম নেই। আমার আবার অস্থির সময় ফিরে আসে। মন অবসন্ন থাকে । ভালো লাগে না কিছুই। একদিন ভাই শামীমের সঙ্গে অনেক দিন পরে দেখা হয়, তখন তিনি আমার অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নিলেন। সব খুঁজ নিয়ে তিনি আমাকে বললেন, আনোয়ার তুমি না আমার সঙ্গে ইজতেমায় গিয়েছিলে, সেখানে মুরব্বীরা কী বলেছিল তুমি কি তা সব ভুলে গিয়েছ ? দীন শেখা এবং দীনের দাওয়াতের কাজ একনিষ্ঠভাবে ও ধারাবাহিকভাবে  না করলে এ কাজে তুমি কোন ভাল ফলাফল পাবে না। এক্ষেত্রে তোমার একান্ত ইচ্ছাই যথেষ্ট। সব কাজের ক্ষেত্রে অল্লাহর হুকুম ও রাসূল সা. তরিকা মতো করো এবং ধৈর্য ধারণ করো। ইনশাআল্লাহ  আল্লাহ তোমার সকল অবস্থা পরিবর্তন করে দিবেন । আল্লাহর জন্য হয়ে যাও, আল্লাহ চায় তো সব মুশকিল আসান করে দিবেন। ভাই শামীমের এ সব কথা শোনার পর আমার নিজেকে অনেক বেশি অপরাধী মনে হতে লাগলো। আমি কালবিলম্ব না করে পরের সপ্তাহেই তিন দিনের জামাতের জন্য বের হয়ে যাই। এরপর এক চিল্লার জন্য আল্লাহ আমাকে কবুল করেন। উত্তরাঞ্চলের বিভাগীয় শহর রংপুরে জীবনের প্রথম চিল্লা অতিবাহিত করি। এরপর থেকে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি দাওয়াতে তাবলিগির এ মেহনতের সঙ্গে সদা জড়িত থাকার জন্য। গত বছর আল্লাহর রহমতে তিন চিল্লা যাওয়ার সুযোগ হয়। আল্লাহর অনুগ্রহে  ছোটখাট একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছি। তা দিয়ে আল্লাহ আমাকে ভালোই রাখছেন। জীবনের এ তরু ণ বয়সে আল্লাহ যে আমাকে তার দীন মোতাবেক জীবন পরিচালনার জন্য সহিহ বুঝ দান করেছেন এ জন্য তার শুকরিয়া জানিয়ে শেষ করতে পারবো না। বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে ইজতেমার ময়দানে লাখ লাখ মানুষের সমাগম ঘটবে,তাই সকলের কাছে এ গুনাহগারের দোয়া দরখাস্ত। আল্লাহ আমাদের এ কাজের আঞ্জাম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার তৌফিক দান করুন, আমিন।

বিবেক মানবদেহের সঞ্চালক

বিবেক মানবদেহের সঞ্চালক
 আল্লামা আজিজুল হক
হযরত নোমান ইবনে বশির রা. বলেছেন- আমি রাসূলুল্লাহ সা.-কে বলতে শুনেছি যে ইসলামে  হালাল-হারাম স্পষ্ট।  এ দুটির মাঝে কতোগুলো সন্দেহভাজন  বিষয়বস্তুও আছে। সেগুলো কোন পর্যায়ে তা অধিকাংশ লোকই নিশ্চিতভাবে নির্ধারণ করতে পারে না। যে ব্যক্তি সে সন্দেহজনক বিষয়গুলো থেকে সংযমি হবে তারই দীন-ঈমান ইজ্জত-আবরু  সুরক্ষিত  থাকবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি সন্দেহজনক বিষয়বস্তুসমূহে লিপ্ত হবে, তার অবস্থা হবে  কোনো রাখাল তার পশুপালকে (সরকারী বা কারো) সংরক্ষিত স্থানের নিকটবর্তী  চরিয়ে থাকে; এমতাবস্থায় অ- সময়ের মধ্যেই তার পশুগুলো সে সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকে পড়বে (এবং তার দ্বারা রাখাল বিপদগ্রস্ত হবে। তেমনি মধ্যস্থলিয় সন্দেহযুক্ত বিষয়বস্তুগুলো থেকে যে ব্যক্তি সংযমি না হবে এবং তা থেকে দূরে না থাকবে, অচিরেই অনিবার্যভাবে তার নফস বা প্রবৃত্তি স্পষ্ট হারামে লিপ্ত হয়ে যাবে, ফলে সে দুনিয়া ও আখেরাতে অপদস্থ হবে) তোমরা শুনে রাখ, প্রত্যেক বাদশাহর সংরক্ষিত এলাকা থাকে তেমনি আল্লাহ তায়ালার নিষিদ্ধ বিষয়বস্তুসমূহই দুনিয়ার বুকে তার সংরিক্ষত এলাকা। (সেখানে কারো প্রবেশ করতে নেই, অধিকন্তু তার নিকটবর্তী হওয়া তথা সন্দেহজনক বিষয়ে লিপ্ত হওয়াও উচিত নয়।
  আরো শুনে রাখ  মানবদেহে এমন একটি অংশ রয়েছে যে, সেই অংশটি যখন যথার্থভাবে ঠিক হয়ে যায়, তখন মানুষের পূর্ণ অস্তিত্ব ঠিক হয়ে যায়।  অর্থাৎ সম্পূর্ণ মানবদেহটিই তখন সঠিকভাবে পরিচালিত হতে থাকে। পক্ষান্তরে সেই অংশটি যখন খারাপ হয়ে পড়ে, তখন সমস্ত অস্তিত্বটিই খারাপ হয়ে যায়। অর্থাৎ মানব দেহের কোনো অংশ বা কোনো অঙ্গই তখন সঠিকভাবে পরিচালিত হয় না। খুব ভালো করে জেনে নাও সে অংশটি হুে ছ মানুষের বিবেক।
বিশ্লেষণ : শরিয়তের যাবতীয় হুকুম-আহকাম চার প্রকার দলিল ভিত্তিতে প্রমাণিত হয় । কুরআন,  হাদিস, ইজমা ও কিয়াস। এর যে কোনো একটি দ্বারা যে কোনো বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে হালাল বৈধ ও গ্রহণীয় বলে প্রমাণিত হবে যে এটিই হালাল এবং যে কোনো বিষয় সুষ্পষ্টভাবে হারাম নিষিদ্ধ ও বর্জনীয় বলে প্রমাণিত হবে তা হারাম।
 এ দৃষ্টিকোণ থেকে হালাল এবং হারাম অতি স্পষ্ট  এবং এই সকল দলিল, প্রমাণ ও মাপকাঠি দ্বারা উভয়টিকে বেছে নেয়া অত্যন্ত সহজ। অধিকন্তু এটিও স্পষ্ট যে, হালালকে গ্রহণ করা যাবে এবং হারামকে বর্জন করতে হবে। এতে বিন্দুমাত্রও নড়চড় করার অবকাশ নেই। কিন্তু হালাল ও হারাম পর্যায়দ্বয়ের মধ্যবর্তী আরো কিছু পর্যায় রয়েছে। যথা মাকরূহ, খেলাফেআওলা বা অবাঞ্ছনীয়, ইমাম ও খাঁটি ওলামাদের মতোবিরোধমূলক বিষয়াদি।    
এতদ্ব্যতীত এমন আরো বহু বিষয়াদি আছে যা শরিয়তে লিপিবদ্ধ আছে এবং তা ছাড়াও দৈনন্দিন কার্যকলাপের  ভেতর দিয়ে প্রায়শই এমন বিষয়াদি আমাদের সম্মুখবর্তী হতে থাকে যা নির্দিষ্টভাবে হালাল বলেও নিশ্চিত হওয়া যায় না, কিংবা হারাম বলেও স্থির করা যায় না এ সকল অনিশ্চিত ও সন্দেহভাজন বিষয়গুলোকে সযত্মে পরিহার করে চলাই একান্ত বাঞ্ছনীয়। কেননা এ সমস্ত সন্দেহজনক বিষয়বস্তুসমূহ থেকে বিরত থাকলে এক দিকে জাগতিক ব্যাপারে যেমন লাভবান হওয়া যায়, কারণ সন্দেহের স্থানে পা রাখলেই স্বীয় মান-মর্যাদা কলুষিত হওয়ার এবং নানা প্রকার কুৎসা রটানোর সুযোগ উপস্থিত হয়।
অন্যদিকে তেমনি দীনের ব্যাপারেও লাভের সীমা থাকে না। কারণ যে ব্যক্তি স্বীয় নফ্স ও প্রবৃত্তিকে সন্দেহের স্থান থেকে বিরত রাখতে অভ্যস্ত হবে, সে নিশ্চয় যাবতীয় কুপ্রলোভনের বস্তু থেকে এবং যাবতীয় হারাম কাজ থেকে স্বীয় নফ্সকে ফিরিয়ে রাখতে সক্ষম হবে।
হারাম ও সন্দেহভাজন কাজ থেকে বাঁচতে হলে সর্বপ্রথম নিজের  বিবেককে যথার্থভাবে সুষ্ঠু ও ঠিক করতে হবে। কারণ মানুষের বিবেকই মানবদেহরূপী কারখানার জন্য বৈদ্যুতিক মটর স্বরূপ। মটর ঠিকভাবে চালু থাকলে কারখানার প্রতিটি শাখা তার প্রতিটি অংশ ও সমস্ত কল-কবজার চাকাগুলো রীতিমত চলতে থাকবে। আর মটরে গোলযোগ থাকলে তার সংযোগ রক্ষাকারী সমস্ত মেশিন ও তার অংশগুলোর মধ্যেও গোলযোগ দেখা দিবে। অবশ্য মটরের সঙ্গের চাকাগুলো সক্রিয়সংযোগ রক্ষার প্রতিও তীক্ষè দৃষ্টি রাখতে হবে। তা না হলে মেশিনের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে সংযোগবিহীন শুধু মটর চালালে উদ্দেশ্য সফল হবে না এবং এ ধরনের নিরর্থক ও অনিয়মিত পরিচালনার ফলে কারখানা ফেল হয়ে যাবে। অতএব মেশিনের সমস্ত কল-কবজা ও তার বিভিন্ন অংশগুলোকেও রীতিমত চালু রেখে মোটরের প্রতি সবিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ, তার ভাল-মন্দের প্রভাব সমস্ত কারখানার ওপর পড়ে থাকে। তেমনিভাবে মানুষের কর্তব্য তার বিবেক-বুদ্ধিকে সুষ্ঠু করে তার পর সেই সুষ্ঠু জ্ঞান-বিবেক দ্বারা স্বীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে পরিচালিত করা।

দেহ আলোচনা
উপরোক্ত হাদিসের শেষ বাক্য আলা ইন্নাফিল জাছাদে মুজগাতান মানবদেহের মধ্যে একটি বিশেষ অংশ আছে যার উন্নতি-অবনতির উপর সম্পূর্ণ দেহের উন্নতি ও অবনতি নির্ভর করে। এ তথ্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এতে মানুষের সৃষ্টি তত্ত্ব ও দেহ-তত্ত্বের ইঙ্গিত দানে মানবের প্রকৃত উন্নতির উপায় উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং সতর্ক করা হয়েছে যে, স্থূল দেহের উন্নতি অপেক্ষা সূক্ষè আত্মার উন্নতির ওপরই মানুষের প্রকৃত ও মুখ্য উন্নতি নির্ভর করে। আত্মার উন্নতি সাধিত না হলে মানব জীবন বিফল ও অত্যন্ত বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।
মানুষের অজুদ বা অস্তিত্ব দুই ভাগে বিভক্ত স্থুলদেহ যা বাহ্য দষ্টিতে বা যান্ত্রিক সাহায্যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়ে থাকে এবং সূক্ষèআত্মা যা ঐরূপে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হতে পারে না। মানুষের স্থুলদেহ সৃষ্টির মূলে যেমন বিভিন্ন উপাদান রয়েছে যথা পানি, মাটি, বায়ু ও অগ্নি তেমনি তার এ ভৌতিক দেহাভ্যন্তরে পাঁচ প্রকারের আত্মাও রয়েছে। যথা
১। পশুর আত্মা, যা দ্বারা খাওয়া শোয়া, কামরিপু চরিতার্থ করা ইত্যাদি প্রবৃত্তির উদ্রেক হয়।
২। হিংস্র জীবের  আত্মা : যা দ্বারা দ্বেষ, হিংসা, ক্রোধ ও রাগের বশীভূত হয়ে মারামারি কাটাকাটি করত: প্রতিশোধ গ্রহণের প্রবৃত্তি জন্মে থাকে।
৩। শয়তানের আত্মা : যার প্ররোচনায় পাপাচার, অহঙ্কার, মিথ্যা ও সূক্ষ্ম কূট-কৌশলের দ্বারা মানুষকে ধোকা দেয়া ইত্যাদির প্রবৃত্তি উদিত হয়।
৪। ফেরেশতা আত্মা : যা দ্বারা সদাচার, ন্যায়পরায়ণতা, সততা, সত্যতা, পরোপকারিতা ও আল্লাহর বশ্যতা স্বীকার করা ইত্যাদির আগ্রহ ও আকর্ষণ জন্মে থাকে।
৫। মানুষের আত্মা : যার কর্তব্য হুে ছ প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় আত্মাকে বশ করত: তাদেরকে কুপ্রবৃত্তির দিক থেকে ফিরিয়ে দিয়ে ফেরেশতা আত্মার সদগুণাবলীতে গুণান্বিত ও পরিচালিত করা এবং আল্লাহর   মারেফত ও মহব্বত হাসিল করত: দুনিয়াতে আল্লাহর খেলাফত তথা আল্লাহর হুকুম আহকাম জারির পরিবেশ কায়েম করার আগ্রহ ও আকর্ষণ   সৃষ্টি করা।
প্রথম তিনটি আত্মাকেই তাসাওফের পরিভাষায় নফসে আম্মারা বলা হয় এবং চতুর্থ ও পঞ্চম এ দুটিকে রূহ, ক্বল বা লতিফা বলা হয় এবং এটিই হুে ছ বিবেক, বুদ্ধি ও মানবাত্মা।
দেখা গেল যে, এই  পাঁচ প্রকারের আত্মাই তাসাওফের পরিভাষায় দুই নামে পরিচিত হয়েছে। একটি হল নফসে আম্মারা; এর তিনটি বিভাগ যথা  পশুরআত্মা, হিংস্রজন্তুরআত্মা ও শয়তানেরআত্মা। দ্বিতীয়টি হলো রু হ অর্থাৎ মানবাত্মা বা বিবেক -আকল। এর দুটি বিভাগ যথা ফেরেশতার আত্মা ও মনুষত্বেরআত্মা।
রাসূল সা. আলা ইন্না ফিল জাছাদে মোজগাতান বলে মানব দেহের যে বিশিষ্ট অংশটির প্রতি নির্দেশ করেছেন, সে অংশটিই হুে ছ রু হ বা আকল-বিবেক। এর উন্নতিতে পূর্ণ মানবদেহের উন্নতি এবং এর অবনতিতে সম্পূর্ণ মানবদেহের অবনতি ঘটে থাকে; এটাই রাসূল সা. বলেছেন রু হ বা জ্ঞান-বিবেক রত্মটির উন্নতি হলে সমগ্র মানবদেহের উন্নতি হবে এবং এর অবনতিতে সমগ্র মানবদেহের অবনতি ঘটবে।
এখন দেখতে হবে যে, এই অংশটির উন্নতির অর্থ কী? বস্তুত প্রতিটি জিনিসের উন্নতি বা অবনতির বিচার করা হয় তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের  দ্বারা। তাই এখন দেখতে হবে যে রু হ বা বিবেকের উপর কী কী দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্পিত হয়েছে। এ প্রশ্নের উত্তর অতি সহজ। কারণ, রু হ মানবাত্মা বা বিবেক বলে যে দুটি আত্মার নামকরণ হয়েছিল অর্থাৎ ফেরেশতাআত্মা ও মনুষ্যত্বের আত্মা তাদের কর্তব্য ছিল সদাচার, সততা, সভ্যতা ও আল্লাহর বশবর্তীতা ইত্যাদির প্রতি আকৃষ্ট করা এবং সঙ্গে সঙ্গে নফস নামে যে অপর তিনটি শক্তি বা আত্মা আছে তাদেরকে বশে এনে ফেরেশতা আত্মার সদগুণাবলীতে পরিচালিত করা। অতএব রু হ বা বিবেকের দায়িত্ব ও কর্তব্যও তাই হবে। এ মহান কর্তব্য পালনে রু হ  মানবাত্মা বা বিবেক যতোটুকু উন্নতি করতে পারবে, পূর্ণমানবদেহটি ততটুকুই উন্নতি লাভ করবে। এমনকি অবশেষে এই রু হ মানবাত্মা যে উর্দ্ধজগত থেকে এসেছিল পুনরায় সে মানবদেহকে নিয়ে সেই উর্দ্ধজগতে অর্থাৎ বেহেশতে গিয়ে পৌঁছবে। পক্ষান্তরে রূহ মানবাত্মা নিজের ঐ কর্তব্যে ত্রু টি করত: নিজেই যদি নফস তথা ঐ তিন প্রকার আত্মার বশ্যতা স্বীকার করার অবনতিতে পতিত হয়, তা হলে পূর্ণ মানবদেহই অবনতির তিমির গর্তে পতিত হবে। অবশেষে ঐ রু হ মানবাত্মা মানবদেহকে নিয়ে সর্ব নিু জগতে তথা জাহান্নামে পৌঁছাবে।
আধ্যাত্মিক জ্ঞানবিশারদগণ রু হ বা বিবেকের উন্নতির পাঁচটি স্তর বর্ণনা করেছেন এবং প্রত্যেকটির ভিন্ন ভিন্ন নামকরণ করেছেন। পূর্বেই ইঙ্গিত করা হয়ে ছিল যে, রু হ মানবাত্মা বা আকল ও বিবেককে তাসাওফের পরিভাষায় লতিফা নামেও নামকরণ হয়ে থাকে। সেই অনুসারেই রু হের উন্নতির পাঁচটি স্তরের নিুলিখিতরূপে নামকরণ করা হয়েছে।
১। লতিফায়েকলব : মানুষ যখন আল্লাহকে স্মরণ করে, আল্লাহর নাম উু চরণ করত: জিকির করে তখন সে এ লতিফায়ে কালবের কর্তব্য পালন করে।
২। লতিফায়ে রু হ : মানুষ যখন আল্লাহর মহৎ গুণাবলীর ধ্যান করে এবং এই ধ্যানের দ্বারা নিজের মধ্যেও ঐ গুণের প্রতিবিম্ব হাসিল করে, যেমন : আল্লাহ দয়ালু, দয়াময় এর ধ্যান করত: এমন অবস্থার সৃষ্টি করে যে, আমাকেও দয়ালু হতে হবে এবং দয়ালুর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে তখন হয় লতিফায়ে রু হের কর্তব্য পালন।
৩। লতিফায়ে সের্র : মানুষ যখন  আল্লাহর গুণাবলীর প্রতিবিম্ব নিজের মধ্যে হাসিল করায় সচেষ্ট হয় তখন তার সিনার অভ্যন্তরে আল্লাহর মারেফাতের বা আল্লাহর গুণাবলীর তত্বজ্ঞানের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়, তখন মানুষ আল্লাহর গুণে মুগ্ধ ও অভিভূতহয়ে আল্লাহর আশেক ও প্রেমিকে পরিণত হয়ে যায় এবং নিজের নফসের সব কুপ্রবৃত্তির প্রতি ঘৃণা জন্মে যায় এবং সেগুলোকে ফানা ও বিলুপ্ত করে দেয় অর্থাৎ সেগুলোকে পূর্ণরূপে দখল ও অধিকার করার শক্তি ও সামর্থ অর্জন করে, এটাই হুে ছ লতিফায়ে সের্র এর কর্তব্য।
৪।  লতিফায়ে খফী মানুষের মধ্যে যখন আল্লাহর মা'রেফতের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়, তখন মানুষ আল্লাহর গুণে মুগ্ধ ও অভিভুত হয়ে আল্লাহর আশেক ও প্রেমিকে পরিণিত হয়ে যায় এবং নিজের নফসের সব কুপ্রবৃত্তির প্রতি ঘৃণা জন্মে যায় এবং সেগুলোকে ফানা ও বিলুপ্ত করে দেয়। অর্থাৎ সেগুলোকে পূর্ণভাবে দখল ও অধিকার করার শক্তি ও সামর্থ অর্জন করে। এটাই হ্ছে লতিফায়ে খফীর কর্তব্য।
৫। লতিফায়ে আখফা : মানুষ ফানা-ফিল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহরগুণে গুণান্বিত হওয়ার মর্তবায় পৌঁছে, যাকে আল্লাহর খেলাফত লাভ বলে; এটাই হুে ছ লতিফায়েআখফার  মর্যাদা। এ অবস্থাতেই রু হ বা বিবেক ও আকলের পূর্ণশুদ্ধি হয়ে যায়। এই অবস্থার পরে আর বিবেককে কুপ্রবৃত্তির বশীভুত হতে হয় না। রাসূল সা. মানুষকে বিবেক সঠিক করার যে প্রেরণা দান করেছেন তার উদ্দেশ্য হুে ছ মানবাত্মার পরম উন্নতিলাভ।

শেখ সাদীর গুলিস্তা

এক সাধু দরবেশ, ইবাদতে বন্দেগিতে ছিলো বেশ। কিন্তু একবার ...

এক সাধু দরবেশ, ইবাদতে বন্দেগিতে ছিলো বেশ। কিন্তু একবার একদল দুর্বৃত্ত, তাকে কষ্ট দিতে হলো প্রবৃত্ত। বলল তাকে জানে যত অকথ্য কথা, পারলে যেন চিবিয়ে খায় তার মাথা। বেচারা দরবেশ অবশেষে হয়ে অতিষ্ঠ, পীরের খেদমতে আরয করলো মনের কষ্ট। বললো, জনাব, এই হলো আমার দুরবস্থা, দুষ্টদের হাতে নাজেহাল হেনেস্থা। সব শুনে বললেন পীরে কামেল, তুমি তো বিলকুল মূর্খ জাহেল! জানো না, দরবেশি লেবাস যে করে ধারণ, হাসিমুখে সব তাকে করতে হয় বরণ! এই লেবাসে সইতে পারে না যে যিন্দেগির বুরা-ভালা, মিথ্যা দাবীদার সে, সাজে না তার গলায় দরবেশির মালা।কবিতা- ঢিল ছুঁড়িলে দরিয়ার পানি হয় না ঘোলা/ কষ্টে বেসবূর, সে যে এক ক্ষুদ্র নালা/ তোমার বুকে যে দুর্জন আঘাত হানে/ ক্ষমা করো তারে ওগো সাধু নিজের গুণে/ মাটির সঙ্গে একদিন হবে ভাই মাটি/ তাই মাটি হও আসিবার আগে কবর-ঘাঁটি।
শিক্ষা- যারা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে চায় তাদের কর্তব্য হলো মূর্খ লোকের মূর্খ আচরণের উত্তরে ক্ষমাসুন্দর আচরণ করা।
***শোনো বাগদাদের রাজ দরবারের খবর, শাহী ঝাণ্ডা ও শাহী পর্দা করে বিতণ্ডা জবর। অনুযোগের স্বরে পর্দাকে বলে ঝাণ্ডা, আমার কথার জবাব দাও মাথা রেখে ঠাণ্ডা। আমি-তুমি করি একই বাদশাহর গোলামি, অথচ দেখো, কিসমতের এ কী যালিমি! যুদ্ধের মাঠে আমার একদণ্ড নাই অবসর, যখন তখন অভিযান, হই ধুলিধূসর। অথচ তুমি! না দেখেছো যুদ্ধের বিভীষিকা, না মরুভূমির পিপাসা ও মরীচিকা। দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণা আমি সয়ে যাই অম্লান, অথচ তোমার ভাগে জোটে সব মান-সম্মান। তুমি চাঁদ-বদন, গুলবদন দাস-দাসীর আবরণ, আমি থাকি পড়ে রুক্ষ সিপাহির হাতে, করি লড়াই জীবন-মরণ। বলো কী এর কারণ, সত্য সত্য দিও বিবরণ। বলে পর্দা লাজ-শরমে, যেন মরে যায় মরমে, বিনয়ে আমি ঝুলে থাকি নিম্নমুখী, গর্বে তুমি থাকো সদা ঊর্ধ্বমুখী। অযথা উঁচিয়ে রাখে যে তার মাথা, হবেই হবে একসময় ঘাড়ে তার ব্যথা।
শিক্ষা- যে বিনয় অবলম্বন করে সে অল্প পরিশ্রমেই মর্যাদার উচ্চ শিখরে আসীন হয়, আর অহংকারী যত দৌড়ঝাঁপ করুক, লাঞ্ছনাই হবে তার ভাগ্যলিপি। সুতরাং সর্ববিষয়ে বিনয় অবলম্বন করো এবং অহংকার পরিহার করে চলো।
***অন্তর্জ্ঞানী এক বুযুর্গান, একদিন দেখেন এক পাহলোয়ান, ক্রোধে দিশেহারা, আত্মহারা, যাকে পায় তাকে করে তাড়া। বুযুর্গান করেন জিজ্ঞাসা, কেন এহেন দশা, কী তার সমস্যা? লোকেরা বলে, কেউ দিয়েছে গালি, তাই মাথায় চেপেছে খুন, রেগে মেগে হয়ে আছে আগুন। তিনি অবাক হলেন এবং বললেন, হায়, উঠাতে পারে লোহার দশমন ভার, পারে না সইতে একটু ভার দু'টো কথার! কবিতা-
পাহলোয়ানির বড়াই তুমি করো না/ ভাই কুশ্‌তি-লড়াই তোমার সাজে না/ কে বলে তারে বীর নফস যার কামীনা!/ মর্দ নয় সে চুড়িপরা ভীরু যানানা/ মানুষের মুখে পারো যদি তুলে দাও মিষ্টি/ বাহাদুরি নয় শুধু আঘাত করা তুলে মুষ্টি/ ফুলিয়ে ছাতি কাবু করো হাতি/ নিজেরে ভাবো তুমি ভদ্র মানুষ অতি/ যুগ যুগের সত্য বচন যেনো সুনিশ্চয়/ মনুষত্ব নেই, তবে মানুষ সে নয়/ আদমের বেটা মাটির গড়া, নয় আগুন/ মানুষ বলি তারে কী করে, যদি না পায় মাটির গুণ।
শিক্ষা- জনৈক বুযুর্গকে জিজ্ঞাসা করলাম খাঁটি বন্ধুর পরিচয়, তিনি বললেন, বন্ধুকে ভুলে আত্মস্বার্থে মগ্ন যে, সে নীচ অতিশয়। জ্ঞানিগণ বলে গেছেন এই বচন, নিজেকে নিয়ে সদা মগ্ন যেজন, সে তোমার না বন্ধু, না স্বজন। কবিতা- ‘সফরে তোমায় ফেলে আগে আগে চলে/ সে নয় সঙ্গী তোমার তারে যাও ভুলে/ দিলে যার নাই ধার্মিকতা ও খোদা-ভীরুতা/ আত্মীয় বলে তার সনে করো না অন্তরঙ্গতা।
মনে পড়ে, জ্ঞানের দাবীদার এক জ্ঞানী, খণ্ডন করেছে আমার এই কবিতার বাণী। সে বলে, ‘কোরআনে তো রয়েছে খোদার ফরমান, আত্মীয়তা যেন ছিন্ন না করি, যদিও করতে হয় জান কোরবান। অথচ তোমার কথা হে কবী, হে গুণী, খোদার কালাম কোরআনের নাফরমানি।’ তাকে বললাম, জ্ঞান তোমার অগাধ, মানি, তবে তুমি কি আয়াত পড়োনি, যদি বাধ্য করে তোমাকে তারা আমার সঙ্গে শরীক করতে এমন কিছুকে যার সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তাহলে তাদের কথা তুমি মান্য করো না।
কবিতা- খোদার বেগানা তোমার আত্মীয়, শত শত/ অনাত্মীয় এক খোদাভীরু শ্রেয় যেনো নিশ্চিত ।
শিক্ষা- আমাদের কর্তব্য হলো রক্তের বন্ধনের চেয়ে দ্বীনের বন্ধনকে অগ্রাধিকার প্রদান করা।
***বাগদাদের এক ধনী বৃদ্ধ ধনে জনে ছিলেন সমৃদ্ধ। হঠাৎ কী যে হলো তার দুর্মতি, রূপসী কন্যার কপালে ডেকে আনেন দুর্গতি। এক ইতর চামারের সঙ্গে দিলেন তার বিবাহ। চামারের অত্যাচারে কন্যার জীবন হলো দুর্বিষহ। শেষে একদিন বললেন কন্যার পিতা, শোনো হে ইতর জামাতা, তোমার একি পাশবিকতা, কন্যার দশা করে ছেড়েছো যা তা! হাজার দিনার নাও হে চামার, ছেড়ে দাও মাসুম কন্যা আমার।
এঘটনা বলার উদ্দেশ্য আমার নয় শুধু পরিহাস ও বিনোদন। হাস্যরস ভুলে এর উপদেশটুকু করো গ্রহণ। স্বভাব যদি হয় মন্দ কখনো তা দূর হয় না, মৃত্যুর আগে খাছলত কখনো বদল হয় না। জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে বিসর্জন, ইতরের সঙ্গ যদি করো গ্রহণ। তবে নিজেকেই শুধু করো তিরস্কার, অন্যকে কিছু বলার নেই তোমার অধিকার।
শিক্ষা- এঘটনার উপদেশ পরিষ্কার। স্বভাব যাদের মন্দ তাদের সঙ্গ পরিত্যাজ্য, অন্যথায় নিজেকেই তার খেসারত দিতে হয়।

শেখ সাদীর গুলিস্তা

শেখ সাদীর গুলিস্তা

পূর্বযুগের এক বাদশাহ জনৈক বুযুর্গকে করেন জিজ্ঞাসা, যার ছিলো অনেক পোষ্যমুখ, আর মনে ছিলো অনেক চিন্তাদুঃখ। জিজ্ঞাসা করেন, আপনার জীবনের প্রিয় সময়গুলো হে জনাব, কীভাবে কাটে দেবেন কি জবাব? তিনি বললেন, সারা রাত কাটে ইবাদত বন্দেগিতে, ভোর রাত কাটে রিযিকের দু‘আ-মুনাজাতে, আর সারাটা দিন যায় রুটি-রুযির ধান্ধায়। বাদশাহর অতি উচ্চ ছিলো চিন্তাধারা, তাই তিনি বুঝে নিলেন তার কথার ইশারা এবং তখনই জারি করলেন হুকুমনামা, দান করো তাকে নতুন জামা-পাজামা, আর জারি করে দাও প্রতি মাসের পর্যাপ্ত ভাতা, যাতে চিন্তুামুক্ত হয়ে সিজদায় পড়ে থাকে তাঁর মাথা। কবিতা- পরিবারের শেকলে বাঁধা তুমি সকাল-বিকাল/ঝেড়ে ফেলো নিশ্চিন্ত ইবাদতের খোশ খেয়াল/ রুটি-রুজির চিন্তা করে যার শান্তিহরণ/ঊর্ধ্বজগতে কেমন করে হবে তার বিচরণ?/ একই ঘোরে নিত্য যে ঘুরি, আর বলি হে মন/ আজ নিশিতে নির্জনে খোদারে করিব স্মরণ/ নিশিতে নামাযে দাঁড়িয়ে হায়, ভাবনা এসে যায়/ সন্তানেরা মোর কী খাবে ভোরে, কী হবে উপায়? শিক্ষা- যারা ইবাদত বন্দেগির স্বাদ পেতে চায়, তাদের কর্তব্য হলো সংসারের ঝামেলায় বেশীমাত্রায় নিজেকে লিপ্ত না করা। নচেৎ দিনরাত পোষ্যপরিজনের চিন্তায় ডুবে থাকতে হবে, ইবাদতের অবসরই আর পাওয়া যাবে না, এমনকি রাজাবাদশা ও দুনিয়াদারদের কাছে হাত পাতারও যিল্লতি ভোগ করতে হতে পারে। *** এক দেশে ছিলেন এক দরবেশ, বুযুর্গিতে ছিলো নামডাক বেশ। একবার তিনি শহরের জীবন ত্যাগ করে চলে গেলন বনের ভিতরে। সেখানেই শুরু করলেন তার নতুন জীবন, দিন-রাত করেন ইবাদত সঁপে দিয়ে তুনমন। বনের ভিতরে তার জায়নামায থাকে পাতা, উদরের ক্ষুধা দূর করেন খেয়ে গাছের পাতা। ঘটনা শুনে দেশের বাদশাহ হন পেরেশান এবং সঙ্গে সঙ্গে দরবেশের খেদমতে ছুটে যান। বলেন তিনি করজোড়ে নিবেদন করে, হুযূর! দয়া করে ফিরে চলুন শহরে। যদি ভালো মনে করেন এবং কবুল করে আপনার যেহেন, তাহলে বলি- আপনার জন্য নির্ধারণ করবো একটি মনোরম প্রাসাদ; সেখানে নির্জনে ইবাদত করবেন মিটিয়ে মনের সাধ। এখানের চেয়ে উত্তম হবে ইবাদতের একাগ্রতা; তাতে কোন সন্দেহ নেই নিশ্চিত তা। তাছাড়া লোকেরা ধন্য হবে আপনার নূরানি ছোহবতে এবং মগ্ন হবে আপনার অনুসরণে বন্দেগিতে। দরবেশের মোটেই পছন্দ হলো না বাদশাহর প্রস্তাব, কারণ তাতে পরে হতে পারে মনস্তাপ। তাই তিনি তার নিবেদন নাকচ করে দিলেন এবং অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তখন বাদশাহর সঙ্গী এক উযির দেখালেন যুক্তি, ঠিক নয় তাকে ফিরিয়ে দেয়া যিনি করেন এত ভক্তি। অন্তত বাদশাহর মনরক্ষার খাতিরে দু’তিন দিন এসে থাকুন শহরে। নিজেই পরীক্ষা করে দেখুন প্রাসাদের পরিবেশ। সেখানে ইবাদতে না হয় যদি মনোনিবেশ, আর সাধারণ মানুষের সঙ্গ, যদি করে আপনার ধ্যান ভঙ্গ, থাকবে তো আপনার অধিকার সবকিছু ছেড়ে চলে আসার। কথিত আছে, দরবেশ শহরে এলেন দুদিনের জন্য। শহরবাসী সকলে তার আগমনে হলো যেন ধন্য। শাহী উদ্যানে এক প্রাসাদ তার জন্য করা হলো খালি। রোয সকালে তার খেদমতে তাজা ফুল হাযির করে মালী। সে বাগানের সৌন্দর্যের কথা আর বলো না; আসলে দুনিয়াতে ছিলো তা জান্নাতের নমুনা। কবিতা- লাল গোলাব যেন প্রিয়তমার গণ্ডদেশ/ ঝুলে থাকা ‘সাম্‌বাল’ যেন তার কৃষ্ণ কেশ/ ‘শীত-সকালে’ ফুলগুলো তরুতাজা দেখতে এমন/ এখনো মায়ের কোলে দুধ না খাওয়া শিশু যেমন/ ডালে ডালে ঐ যে দেখো তুমি শত শত ‘আনারকলি’/ সবুজ গাছে ঝুলে আছে যেন লাল অঙ্গারগুলি। দরবেশের সেবায় বাদশাহ পাঠালেন একদাসী, এমন ছিলো যার সৌন্দর্যরাশি- চাঁদের টুকরো এক, ভাঙ্গে যেন সুফীর ধ্যান/ অপ্সরি, ময়ূরি, তারে হেরি হারায় সবে জ্ঞান/ গুলবাগে চুল খুলে সবুজ ঘাসে করে পায়চারি/ তসবি হাতে রাখতে নারে কেহ ধৈর্য ধরি। দাসীর পরে বাদশা পাঠালেন সুদর্শন এক দাস, যেন এক নাশ, সঙ্গে তার সর্বনাশ। কবিতা- পেয়ালা হাতে সবার মাঝে ঘোরে সে সাকী/ দেয় না কিছু দেখায় শুধু যুলুম এ কী!/ দেখে দেখে আশ না মেটে, শুধু নেশা ধরে/ ফোরাতের তীরে যেন পিপাসায় মরে। দরবেশ তার জায়নামায রেখে একপাশে, মজে থাকে ফলের স্বাদে, ফুলের সুবাসে এবং পানাহারে ভোগবিলাসে। কখনো সুদর্শন দাস, কখনো সুন্দরী দাসী, উপহার দেয় কটাক্ষ আর মধুর হাসি। মুগ্ধ দরবেশ তা করে অবলোকন, তার মন যেন করে ওঠে কেমন! এ কারনেই তো জ্ঞানিগণ বলেন অবিরত, রূপসীর কেশ হলো বুদ্ধির শিকল, জ্ঞানীর জ্ঞান করে দেয় বিকল। কবিতা- তব চরণে করিনু উৎসর্গ ইহ-পরকাল/ আমি মূর্খ পাখী, তুমি যে মনোহর এক জাল। মোটকথা, দীর্ঘ ইবাদতের যা কিছু অর্জন গেলো সব রসাতলে, পুণ্যের সাধনা করলেন বর্জন ভোগের পদতলে। কবিতা- জগতের যত পীর-সাধু, জ্ঞানী, কবি/ ঘোচায় ঘোর আঁধার, হয়ে সত্যের রবি/ দুনিয়ার লোভে যায় যবে যায় অধঃপাতে/ যেন মাছি উড়ে গিয়ে পড়ে যায় মধুতে। এভাবে সুখে-ভোগে দরবেশের দিন কাটে গুলবাগে, বাদশাহর মনে ফের দরবেশের যেয়ারাতের সাধ জাগে। গিয়ে দেখেন, তিনি তখন অন্য মানুষ, ঘীয়ে মাখনে বিলকুল নাদুশনুদুশ! হেলান দিয়ে আছেন মখমলের তাকিয়ায়। রূপসী দাসী মাথার উপর ময়ূরপাখা দোলায়। দরবেশের খোশহাল দেখে বাদশাহ হলেন খোশ; বাড়িয়ে দিলেন মাসোহারা ও খোরপোশ। দরবেশের সঙ্গে বাদশাহর হলো অনেক কথা, অবশেষে বললেন তিনি নত করে মাথা, দু’টি শ্রেণীকে আমি মনে প্রাণে ভালোবাসি, আর কেউ তাদের বাসে না ভালো এত বেশী। এক হলো যারা আলিম, বিদ্যানুরাগী, আর হলো যারা যাহিদ, সংসারত্যাগী। এক উযির অতি বিচক্ষণ, বাদশাহর সঙ্গে থাকেন সর্বক্ষণ, বললেন তিনি ধীরে ধীরে বাদশাহকে সম্বোধন করে, জাহাঁপানা, দাবী হলো ভালোবাসার, উভয়ের সঙ্গে করবেন সদাচার। আলিম যারা তাদের দান করুন বেশুমার, যেন ইলমের প্রতি হয় অনুরাগ সবার। আর যারা যাহিদ সংসার ত্যাগী, দান দ্বারা ঠিক নয় তাদের করা দুনিয়াভোগী। শিক্ষা- দুনিয়ার মোহজাল এবং শয়তানের ধোকা সম্পর্কে সাবধান থাকা উচিত। লোকমুখে গেছে জানা একই রকম ঘটনা। এক বাদশাহর সামনে এলো কঠিন পরিস্থিতি, যা কেড়ে নিলো তার মনের শান্তি-স্থিতি। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন মনে মনে, কেটে গেলে বিপদ দান করবো সাধুজনে। আল্লাহর ইচ্ছায় পূর্ণ হলো বাদশাহর প্রয়োজন এবং তার মনের দুশ্চিন্তার হলো নিরসন তাই খোশদিলে করলেন মান্নত পূরণের আয়োজন। বাদশাহার বিশিষ্ট এক সেবক, হুকুম পালনের পেয়েছে সবক। বাদশাহ দিলেন তাকে ডেকে, ্‌একথলি দিরহাম রাজকোষ থেকে, আর বললেন, রাজ্যের যত সাধুজন, সংসার নিরাসক্ত, তাদের দান করো এ অর্থ, কেউ থাকে না যেন অভুক্ত। লোকে বলে, সেবক ছিলো বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান ভারি। সুচারুরূপে আদেশ পালনে হতো না দেরী। সোনা-চাঁদির থলিয়া নিয়ে সারা দিন শহরে ঘুরে ঘুরে, সন্ধ্যায় ক্লান্তদেহে রাজপ্রাসাদে এলো ফিরে। বাদশাহকে উপযুক্ত সম্বোধন করে এবং তার রাজহস্ত চুম্বন করে, বললো, জাহাঁপনা কী করবো নিবেদন, সারা শহর ঘুরে পেলাম না নিরাসক্ত কোন সাধুজন। বললেন বাদশাহ, একি কথা! খেয়েছো কি বুদ্ধির মাথা! অথচ আমি জানি এবং তা সত্য মানি, দেশে আমার, আছে চারশ যাহিদ নিরাসক্ত। যেমন তাদের সাধনা উপাসনা তেমনি তারা খোদভক্ত। সেবক নিবেদন করে মৃদু হেসে, সোনা-চাঁদির থলি রেখে একপাশে, জাহাঁপানা, নিরাসক্ত যে সে তো হাত পেতে দান নেয় না, আর যে হাত পাতে সে তো নিরাসক্ত হয় না! সভাসদদের উদ্দেশ্যে বাদশাহ বললেন সহাস্যে, খোদাপ্রেমিক এই সাধুজনদের আমি যত করি ভক্তি প্রদর্শন, বেশরম এই গোলামের মাঝে তত দেখি অভক্তির নিদর্শন! তবে কথা তার বড় সত্য, সোন-চাঁদির আসক্তি ছাড়া বড় শক্ত। কবিতা- হাত পেতে নিলো যে দিরহাম-দীনার/ নিজেই গুঁড়িয়ে দিলো সে সাধুতার মিনার/ কথা শক্ত, নয় সে খোদভক্ত সাধু/ অন্য জনে খুঁজে দেখো, খোদাভক্তির মধু। শিক্ষা- যাহিদ ও সংসার- নিরাসক্ত হওয়ার দাবী করা যথেষ্ট নয়, বরং আচরণের মাধ্যমেই প্রকাশ পাবে, কে যাহিদ ও নির্লোভ। সত্যিকার যাহিদ যিনি, তিনি কখনো মানুষের কাছে হাত পাততে পারেন না। *** এক আলিমে দ্বীন, চেহারায় ছিলো বুযুর্গির চি?হ্ন; লোকেরা তাকে করলো কঠিন এক প্রশ্ন- বলুন তো এই যে ওয়াক্‌ফের ভাতা, বৈধ কি গ্রহণ করা তা? সঙ্গে সঙ্গে বললেন তিনি, নিয়ত কী, আগে তা জানি! ইবাদতের নিমগ্নতা লাভের জন্য হলে তো হালাল, লোভের কারণে হলে হাশরে পড়বে ধরা ব-মাল। শিক্ষা- দ্বীনী প্রয়োজনে সঠিক সূত্র থেকে অবশ্যই সাহায্য গ্রহণ করা যায়, তবে নিয়ত হতে হবে খালিছ। দ্বীনী কাজের উদ্দেশ্যে সম্পদ ব্যবহার করবে, সম্পদ আহরণের উদ্দেশ্যে দ্বীনী কাজ করবে না। *** একদরবেশ একবার এলেন এক অঞ্চলে, তার নিবাস ছিলো নির্জনে জঙ্গলে। অঞ্চলের শাসক ছিলেন অতি অভিজাত, কারো মনে কখনো দেন না আঘাত। যেমন দানশীল তেমনি উদার। সবার জন্য খোলা ছিলো তার দুয়ার। জ্ঞানী-গুণীদের একটি দল ছিলো তার মজলিসে, দরবেশ গিয়ে বসলেন নীরবে একপাশে। সবাই তখন বলছিলেন দামী দামী সব কথা। দরবেশ ছিলেন ক্লান্ত শ্রান্ত, আর ছিলো ক্ষুধা। অনেক দূর থেকে এসেছেন, অনেক দিন না খেয়ে থেকেছেন। তাই কিছু না বলে তিনি বসে ছিলেন চুপচাপ, তবে সবার নযর পড়ে গেলেন আপসে আপ। একজনের ইচ্ছে হলো, করবেন পরিহাস, বললেন, কিছু বলুন জনাব, না করে নিরাশ। তিনি বললেন, মুখে ছিলো মৃদু হাসি, আমি মূর্খ মানুষ অরণ্যবাসী। আপনাদের মত জ্ঞানী, গুণী, মহাজন কিছু নই, জানি না হাদীছ-কোরান, পড়িনি জ্ঞানের কোন বই। আমার কথা মানে জ্ঞানীদের সময় নষ্ট, তবে বলতে পারি একপংক্তিতে যদি হন তুষ্ট। সকলে আগ্রহভরে, বলে উঠলেন সমস্বরে, কেন নয়, কেন নয়! বলুন শোনবো নিশ্চয়। তিনি বললেন- (কবিতা) অনাহারে মরণদশা, চায় না কিছু, চায় শুধু রুটি/ ফিরে চাইবে না, দাও যদি তারে চঁদের সমান বেটি। এক পংক্তিতে বুঝে নিলো সবে জ্ঞান তার কত এবং ক্ষুধা-অনাহারে অবস্থা কাহিল কত! সঙ্গে সঙ্গে দস্তরখান বিছানো হলো এবং যা ছিলো তাই সামনে রাখা হলো। মেযবান বললেন, হে ভাই, একটু সময় চাই। দাসীদের হাতে তৈরী হচ্ছে কালিয়া-কোফ্‌তা, যদি দিতে পারি দস্তরখানে হবে আনন্দের ভোগ তা। দরবেশ মাথা তুলে মুচকি হেসে উঠলেন বলে- (কবিতা) সামনে আমার নাই স্বাদের কোফ্‌তা-কাবাব/ দুঃখ নাই তাতে শোনো বন্ধু মোর জবাব/ রুটির টুকরা হোক না সস্তা ও খাস্তা/ তার তরে কোফ্‌তা তাই, ক্ষুধার আগুনে যে ‘কোফ্‌তা’। শিক্ষা- সুস্বাদু খাবারের অপেক্ষায় বসে থাকা আল্লাহওয়ালা মানুষের শান নয়। ক্ষধার সময় সামনে যা আসে আল্লাহর নেয়ামত মনে করে তাই গ্রহণ করা উচিত। তাছাড়া ক্ষুধা যে কোন খাবারকে সুস্বাদু করে দেয়। *** এক মুরিদ হয়ে বেহাল-পেরেশান, পীরের খেদমতে ছুটে যান। বললেন, হুযূর হয়ে মজবূর এসেছি ছুটে, ভক্তদের ভিড়ে যিকির-ইবাদত যায় বুঝি টুটে। মানুষ দলে দলে আসে, তাতে হয় কষ্ট। নির্জনতায় বিঘ্ন ঘটে, সময়ও নষ্ট। তাই বড় পেরেশান। হুযূর, দিন কোন সমাধান। জ্ঞানী পীর, বললেন ধীর-স্থির, গরীব ভক্তদের দাও কিছু ঋণ; শোধের ভয়ে তারা আসবে না কোনদিন। আর যারা সচ্ছল ধনী, জেনে নাও তাদেরও অস্ত্রখানি; সুযোগ বুঝে হাত পেতে, চাও কিছু মাল, উবে যাবে ভক্তি, হারিয়ে যাবে চিরকাল। কবিতা- ঋণ যদি দাও, তুমি রহমতের ফেরেশতা/ গাইবে তোমার গুণ হবে ফেরেফতা/ ফেরত যদি চাও, তুমি হলে যমদূতের ভাই/ তোমার চেয়ে মন্দ কেহ ত্রিভুবনে নাই/ যদি বলো হাত পাতি, পয়সা কিছু চাই/ বলবে সালাম, করবে পালাই পালাই। শিক্ষা- অপ্রয়োজনীয় মানুষের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখার জন্য নির্দোষ কিছু কৌশল অবলম্বন করা কর্তব্য, বিশেষত যখন কাজে বিঘ্ন ঘটে এবং অযথা সময় নষ্ট হয়। *** এক যুবক আলিম, দিলে তার বহু পেরেশানি, পিতাকে বললেন ছুয়ে তার পা-খানি, বয়ানীদের এত রঙদার বয়ানে, কোন আছর হয় না আমার মনে। কারণ কথায় যত জৌলুস কর্মে তাদের তত কলুষ। কথায়-কাজে যদি না থাকে মিল, অভক্তিতে ভরে যায় দিল। কবিতা- বলো ধর্মের কথা, দুনিয়ার করো নিন্দা/ দাওয়াতি খানায় চাহিদা শুধু ভুনা পরিন্দা/ মানুষের তরে বয়ান, ‘যত পারো করো দান’/ নিজে জমাও সোনা-চাঁদি, ঘর আলিশান/ কথা যদি হয় শুধু মুখে, কিছু নাই অন্তরে/ হোক যত মিষ্টি-মধুর যাবে না কিছু অন্দরে/ আলিম করে না কারো নিন্দা কভু/ নিজে করে যা পরেরে তাই বলে শুধু। যেমন আলকোরআনে বলা হয়েছে, তোমরা মানুষকে আদেশ করো, অথচ নিজেদের বিষয় ভুলে যাও। কবিতা- আলিম যদি মজে থাকে ভোগে আর দেহ-সুখে/ ভ্রষ্ট সে যে, পথের দিশা দেবে কী মুখে মুখে! পিতা ছিলেন জ্ঞানী ও গুণী। বললেন, তোমার মুখে একি শুনি! হে পুত্র, এ তোমার চিন্তার ভুল! একারণে করো না কারো নছিহত না-কবুল। দ্বীনের আলিম যারা তাদের যদি বলো ভ্রষ্ট, আর খুঁজে বেড়াও নিষ্পাপ আলিম, জীবন হবে নষ্ট। ইলমের ফায়দা থেকে তুমি হবে বঞ্চিত, আর মানুষের সামনে হবে শুধু লজ্জিত। যেমন সেই অন্ধ, দৃষ্টি যার বন্ধ; একদিন রাতে কাদা-পথে হলো তার বড় দুর্গতি। ফরিয়াদ করে বললো, কেউ ধরো না পথে একটু বাতি! মুখরা এক নারী, শুনে মজা পেলো ভারি, বললো হেসে ওরে ও অন্ধ, আকলের দুয়ার করেছো কি বন্ধ! তুমি তো দেখতে পাও না বাতি, বাতির আলোতে তবে দেখবে কি হাতি! যে কারো উপদেশেই পাবে তুমি গোনাহ থেকে মুক্তি, দিলে তোমার উপদেশের প্রতি থাকে যদি ভক্তি। উলঙ্গ মানুষ তোমাকে দেয় যদি কাপড়, তাতে কি ঢাকা হবে না তোমার সতর! কবিতা- আলিমের কথা শোনো দিলের কানে, ভেবো না ফেলনা/ কাজে আর কথায় করুক শত ধোকা-ছলনা/ ঘুম থেকে জাগাতে পারে কে নিজে ঘুমিয়ে থেকে/ বলে যারা, ভুল বলে, ঝেড়ে ফেলো তা মন থেকে/ জ্ঞানী যারা রাখে তারা এই কথা খেয়ালে/ জ্ঞান-বচন লুফে নাও যেথা পাও, হোক লেখা দেয়ালে। খানকার সুফী সাধনার ব্রত ত্যাগিয়া/ বসিলেন মাদরাসার অঙ্গনে আসিয়া/ পুছিনু তারে কী ফরক বলো দুইয়ে মাঝে?/ ঐ সঙ্গ ছাড়ি এখানে আছো পড়ি কী বুঝে/ কহিল, সুফী, হলে নৌকাডুবি, ভাবে কম্বলখানি/ আলিম ভাবে, সবার যেন বাঁচে প্রাণখানি। শিক্ষা- আলিমের মধ্যে কোন ত্রুটি দেখলে তা এড়িয়ে যাওয়া উচিত, কারণ তিনিও তো মানুষ। আলিমের বিচ্যুতির কারণে তার ইলম ও উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া উচিত নয়। কেউ যদি পথে বাতি ধরে দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে তুমি কি সে আলোতে পথ চলবে না শুধু এজন্য যে, বাতিওয়ালা অন্ধ! বাতিওয়ালা অন্ধ হোক বা চক্ষুষ্মান আমাদের কাজ হলো বাতি থেকে আলো গ্রহণ করা। *** এক নেশাখোর, পথের মোড়ে পড়েছিলো বেঘোর। এক দরবেশ দেখে এই পরিবেশ, গালমন্দ করলেন বেশ। নেশাখোর মাথা তুলে তাকিয়ে, করলো নিবেদন সবিনয়ে, হুযূর, কোরআন থেকে কেন সুদূর! কোরআন তো বলে, নেককার যারা, মন্দের পাশ দিয়ে যায় তারা, ভদ্রতা হয় না ছাড়া। কাউকে যখন দেখো, পাপে পঙ্কিল, হও তার আবরণ, হও সহনশীল। কেন করো আমার নিন্দাবাদ ও মুণ্ডুপাত! যাও না পার হয়ে যেমন যায় অভিজাত! কবিতা- সাধু, ধন্য তব সাধুতা, পাপীরে তবু করো না ঘৃণা/ অসহায় ভেবে করো তারে উদ্ধার, করো করুণা/ পাপের পাঁকে পড়িয়া আমি না হয় হইনু দুর্জন/ তুমি সাধু মোরে দয়া করে হও না কেন সুজন। শিক্ষা- পাপকে ঘৃণা করা উচিত, পাপীকে নয়। পাপীর প্রতি বরং হওয়া উচিত সহানুভূতিশীল।