শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক
মাতৃজাতি সমাজের অর্ধাংশ এবং অর্ধাঙ্গিনী। তাদের প্রতি ঘৃণা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও উপক্ষো এবং অন্যায়-অত্যাচার সমাজকে পুঙ্গ করে রাখবে। অন্ধকার যুগে তো সমাজ নারীদের প্রতি এতই হিংস্র, নির্দয়-নিষ্ঠুর ও নির্মম ছিল যে, মেয়ে সন্তানকে ভালবাসত না কেউই, অনেকে তাকে জীবিত কবর দিয়ে দিত। বর্তমান যুগ যাকে নারীদের রাজত্বের যুগ বলা যেতে পারে, এই যুগেও মেয়ে সন্তান জন্মের প্রতি অনেক কম লোকেরই আনন্দ হয়। এ কি নারীদের প্রতি বৈরীভাবের লক্ষণ নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম মেয়েদের প্রতিপালন হতে সর্বস্তরে তাদের মান-মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অতুলনীয় শিক্ষা ও আদর্শ রেখেছেন। যার কিছু নিুরূপÑ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি দুইটি মাত্র মেয়েকে সুন্দররূপে ভরণ-পোষণ ও প্রতিপালন করবে সে বেহেশতে আমার এত নিকটবর্তী হবে যেরূপ হাতের আঙ্গুল সমূহ পরস্পর নিকটবর্তী। মুসলিম শরীফ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি তিনটি মেয়ে বা তিনজন ভগ্নির প্রতিপালন ও শিক্ষাদান সুচারুরূপে করবে, যে পর্যন্ত না তাদের নিজ নিজ ব্যবস্থা হয়; তার জন্য বেহশত অবধারিত হবে। দুইজন সম্পর্কে জিজ্ঞাসায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, দুইজনের প্রতিপালনেও তাই। একজনের প্রতিপালন সম্পর্কে জিজ্ঞেস কারা হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তদুত্তরে তাই বলেছেন। মিশকাত শরীফ ৪২৩
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, যার কাছে কোনো মেয়ে থাকে এবং সে মেয়েকে তুচ্ছ না করে, ছেলেকে অগ্রগণ্য না করে আল্লাহ তাকে বেহেশত দান করবেন। আবু দাউদ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, তোমার কোনো মেয়ে স্বামীর পতিত্যক্তা হয়ে নিরাশ্রয়রূপে তোমার আশ্রয়ে ফিরে আসলে তার জন্য তুমি যা ব্যয় করবে তা তোমার জন্য সর্বাধিক উত্তম দান এবং তা আল্লার সন্তুষ্টি উদ্দেশ্যের ব্যয় গণ্য হবে। ইবনে মাজাহ শরীফ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, নারী জাতি সৃষ্টিগতভাবেই একটু বক্র স্বভাবের; পূর্ণ সোজা করতে চাইলে ভেঙ্গে যাবে তথা বিচ্ছেদের পালায় এসে যাবে। সুতরাং তাকে বাঁকা থাকতে দিয়ে তার সাথে তোমাদের জীবন নির্বাহ করতে হবে। তোমাদের প্রতি আমার বিশেষ উপদেশ-তোমরা নারীদের প্রতি উত্তম ও ভালো হয়ে থাকবে। মুসলিম শরীফ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নারীগণ নামাজ-রোজা, সতীত্ব রক্ষা ও স্বামীর আনুগত্য এই সংক্ষিপ্ত আমল দ্বারা আল্লাহ তাআলার কাছে এত বড় মর্যাদা লাভ করবে যে, বেহেশতের যে কোনো শ্রেণীতে সে প্রবেশ করার অধিকার লাভ করবে। মিশকাত শরীফ ২৮১
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, পরিপূর্ণ ঈমানদার ঐ ব্যক্তি যে তার সহধর্মিণীর সাথে সদ্ব্যবহার করে এবং তার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়। তিরমিজী শরীফ
একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম কড়া নির্দেশ দিলেন, গৃহিনীদেরকে কেউ প্রহার করতে পারবে না। অতঃপর একদিন ওমর রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের নিকট প্রকাশ করলেন, নারীগণ অত্যন্ত বেপরোয়া হয়ে গেছে। সেমতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম (প্রয়োজন স্থলে সংযমের সহিত) প্রহারের অনুমতি দিলেন। এরপর বহুসংখ্যক মহিলা তাদের স্বামীর প্রতি অভিযোগ নিয়ে রাসূলুাল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি অসাল্লামের ঘরে ভিড় জমাল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম কঠোর ভাষায় বললেন অনেক মহিলা তাদের স্বামীদের সম্পর্কে অভিযোগ করছে, ঐরূপ স্বামীগণ মোটেই ভালো মানুষ নয়। আবু দাউদ শরীফ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, সহধর্মিনীর সাথে যে উত্তম জীবন-যাপনকারী হয় সেই উত্তম মানুষ। আমি আমার সহধর্মীণীদের সাথে উত্তম জীবনযাপন করি। তিরমিজি শরীফ
সত্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম সহধর্মীণীর প্রতি অতি উত্তম ছিলেন। একবার ছফর অবস্থায় বিবি ছফিয়্যা রাজিয়াল্লাহু তাআলা আনহার জন্য উটে আরোহণ কঠিন হল; (তার পক্ষে উট উচু ছিল)। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম নিজ উরু পেতে দিলেন। ছফিয়্যা রা. সিঁড়ির মতো নবীজির উরু মোবারকের ওপর পা রেখে উটে চড়লেন। বুখারী শরীফ
আর একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম এতেকাফে ছিলেন। ছফিয়্যা রা. রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহ আলাইহি অসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসলেন, তার প্রত্যাবর্তনের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তাকে মর্যাদার সাথে বিদায় দানে তার সঙ্গে মসজিদের দরজা পর্যন্ত আসলেন। বুখারী শরীফ
আয়েশা রা. কম বয়সী ছিলেন; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের ঘরে নয় বছর বয়সে এসেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তার বাল্য বয়সের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখতেন। আয়েশা রা. বর্ণনা করেছেন, কিছু বান্ধবী ছিল যাদের সঙ্গে আমি বাল্যসুলভ খেলাধুলা করতাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম ঘরে আসলে ওরা লুকিয়ে যেত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম ওদেরকে তালাশ করে আমার কাছে পাঠতেন। তারা আবারও আমার সাথে খেলাধূলা করত। বুখারী শরীফ
আয়েশা রা. বর্ণনা করেছেন, একবার ঈদের আনন্দে খঞ্জর চালনার জিহাদী খেলা মসজিদে হচ্ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম আমাকে ঘরের দরোজায় তার পিছনে দাঁড় করিয়ে তার কাঁধের ফাঁক দিয়ে ঐ খেলা দেখালেন। খেলা দেখায় আমার মন ভরে না যাওয়া পর্যন্ত তিনি দাঁড়িয়ে থাকলেন। আয়শা রা. বলেন- খেলা দেখায় লালায়িতা যুবতী কত দীর্ঘকাল দেখবে তা সহজেই অনুমেয়। বুখারী শরীফ
আয়শা রা. বর্ণনা করেছেন একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম আমার সাথে দৌড়-প্রতিযোগিতা করলেন। তাতে আমি জয়ী হলাম। অনেক দিন পর যখন আমার শরীর ভারী হয়ে গিয়েছিল তখন আর একদিন সেই প্রতিযোগিতা করলে আমি পরাজিত হলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তখন কৌতুক করে বললেন, আমার সেই পরাজয়ের বিনিময়ে তোমার এই পরাজয়। আবু দাউদ শরীফ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের কী মধুর সম্পর্ক ছিল সহধর্মিণীদের সঙ্গে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তাদের সাথে সময়ে খোশ-গল্প জুড়ে ছিলেন। হাদিসটি বুখারী শরীফেও উল্লেখ আছে- ‘হাদিসে উম্মে যারা’ নামে। এক সময় আরবের একাদশ সংখ্যক সুসাহিত্যিক মহিলা একত্র হয়ে প্রত্যেকে নিজ নিজ স্বামীর অবস্থা বর্ণনায় ভাষা জ্ঞানের বাহাদুরী দেখাল। তাদের মধ্যে ‘উম্মে যারা’ নামের মহিলা সুদীর্ঘ ও সুললিত ভাষায় নিজ স্বামীর সর্বাধিক বেশি প্রশংসা করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম আয়েশা রা. কে কাছে বসিয়ে সেই একাদশ মহিলার প্রসিদ্ধ গল্পটি শুনালেন এবং বললেন, আয়েশা! উম্মে যারার স্বামী তার জন্য যেরূপ ছিল আমি তোমার জন্য সেরূপ।
নারী সম্প্রদায়ের শিক্ষার প্রতিও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম অনুরাগী ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের আমলে দীন-শিক্ষার একমাত্র কেন্দ্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামই ছিলেন; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের ভাষণসমূহ বিশেষভাবে শরিয়তের বিশেষ বস্তু ছিল। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের ভাষণে নর-নারী নির্বিশেষে সকলের উপস্থিতির আদেশ ছিল। জুমা ও ঈদের নামাজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম খোৎবা বিশেষ ভাষণরূপে দিতেন; সেই ভাষণ শোনার জন্য সকলেই উপস্থিত হতেন, তবে নারীগণ সকলের পেছনে থাকতেন। একবার ঈদের খোৎবা সাধারণ নিয়মে প্রদানের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম লক্ষ্য করলেন, নারীদের পর্যন্ত তার কথা পূর্ণ রূপে পৌঁছেনি। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম খোৎবাস্থল হতে ফিরার পথে বেলাল রা. কে সঙ্গে করে নারীদের অবস্থান স্থলে পৌঁছে তথায় নারীদের লক্ষ্যে পুনঃভাষণ দিলেন। বুখারী শরীফ
আরও একবারের ঘটনা-নারীগগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের কাছে অভিযোগ করল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের মজলিসে তারা পুরুষদের ভিড়ের কারণে পূর্ণ উপকৃত হতে পারে না; সেমতে তাদের অভিলাষ অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তাদের অনুরোধ রক্ষায় ভিন্ন মজলিসের ব্যবস্থা করলেন।
নারীদের প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম কত অধিক সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং তাদের কত বেশি মর্যদা দিতেন! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ-বিদায় হজ্জের নীতি নির্ধারণী ঐতিহাসিক ভাষণে নারীদের মর্যাদা দানের কর্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। সেই ভাষণে তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন-
‘নারীদের ওপর স্বামীদের যেরূপ হক্ব ও দাবি আছে তদ্রুপ স্বামীদের ওপর স্ত্রীদেরও হক্ব এবং দাবি আছে।’ তিনি আরও বলেছেন-নারীদের সম্পর্ক আমার বিশেষ নির্দেশ যে, তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার ও সর্বপ্রকার কল্যাণকর ব্যবস্থা সর্বদা বজায় রাখা। তাদেরকে তোমরা লাভ করেছ আল্লাহর আমানতরূপে, তাদের সতীত্বকে ভোগ করছ আল্লাহর বিধানের অধীনে। সেই আল্লাহর রাসূল আমি, অতএব তাদের সম্পর্কে আমার নির্দেশ পালনে তোমরা বাধ্য।
একদা আবু বকর রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের ঘরে আসছিলেন; বের হতে বিবি আয়েশা রা. উচ্চস্বর শুনতে পেলেনÑ তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের সঙ্গে প্রতিউত্তর করছিলেন। আবু বকর রা. ক্রোধ ভরে ঘরে প্রবেশে আয়েশা রা.কে এই বলে শাসাতে লাগলেন, এত বড় স্পর্ধা! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের আওয়াজের উর্ধ্বে তোমার আওয়াজ! আবু বকর রা. এই বলে আয়েশা রা. কে চড় মারতে উদ্যত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তাকে থামালেন এবং আয়েশাকে প্রীতির ভাষায় বললেন, দেখলে তো মিঞা সাহেব থেকে কত কষ্টে তোমাকে বাঁচিয়াছি? -আবু দাউদ শরীফ
সংগ্রহ
জামেয়া রহমানীয়া মাদ্রাসা
মাতৃজাতি সমাজের অর্ধাংশ এবং অর্ধাঙ্গিনী। তাদের প্রতি ঘৃণা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও উপক্ষো এবং অন্যায়-অত্যাচার সমাজকে পুঙ্গ করে রাখবে। অন্ধকার যুগে তো সমাজ নারীদের প্রতি এতই হিংস্র, নির্দয়-নিষ্ঠুর ও নির্মম ছিল যে, মেয়ে সন্তানকে ভালবাসত না কেউই, অনেকে তাকে জীবিত কবর দিয়ে দিত। বর্তমান যুগ যাকে নারীদের রাজত্বের যুগ বলা যেতে পারে, এই যুগেও মেয়ে সন্তান জন্মের প্রতি অনেক কম লোকেরই আনন্দ হয়। এ কি নারীদের প্রতি বৈরীভাবের লক্ষণ নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম মেয়েদের প্রতিপালন হতে সর্বস্তরে তাদের মান-মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অতুলনীয় শিক্ষা ও আদর্শ রেখেছেন। যার কিছু নিুরূপÑ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি দুইটি মাত্র মেয়েকে সুন্দররূপে ভরণ-পোষণ ও প্রতিপালন করবে সে বেহেশতে আমার এত নিকটবর্তী হবে যেরূপ হাতের আঙ্গুল সমূহ পরস্পর নিকটবর্তী। মুসলিম শরীফ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি তিনটি মেয়ে বা তিনজন ভগ্নির প্রতিপালন ও শিক্ষাদান সুচারুরূপে করবে, যে পর্যন্ত না তাদের নিজ নিজ ব্যবস্থা হয়; তার জন্য বেহশত অবধারিত হবে। দুইজন সম্পর্কে জিজ্ঞাসায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, দুইজনের প্রতিপালনেও তাই। একজনের প্রতিপালন সম্পর্কে জিজ্ঞেস কারা হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তদুত্তরে তাই বলেছেন। মিশকাত শরীফ ৪২৩
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, যার কাছে কোনো মেয়ে থাকে এবং সে মেয়েকে তুচ্ছ না করে, ছেলেকে অগ্রগণ্য না করে আল্লাহ তাকে বেহেশত দান করবেন। আবু দাউদ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, তোমার কোনো মেয়ে স্বামীর পতিত্যক্তা হয়ে নিরাশ্রয়রূপে তোমার আশ্রয়ে ফিরে আসলে তার জন্য তুমি যা ব্যয় করবে তা তোমার জন্য সর্বাধিক উত্তম দান এবং তা আল্লার সন্তুষ্টি উদ্দেশ্যের ব্যয় গণ্য হবে। ইবনে মাজাহ শরীফ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, নারী জাতি সৃষ্টিগতভাবেই একটু বক্র স্বভাবের; পূর্ণ সোজা করতে চাইলে ভেঙ্গে যাবে তথা বিচ্ছেদের পালায় এসে যাবে। সুতরাং তাকে বাঁকা থাকতে দিয়ে তার সাথে তোমাদের জীবন নির্বাহ করতে হবে। তোমাদের প্রতি আমার বিশেষ উপদেশ-তোমরা নারীদের প্রতি উত্তম ও ভালো হয়ে থাকবে। মুসলিম শরীফ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নারীগণ নামাজ-রোজা, সতীত্ব রক্ষা ও স্বামীর আনুগত্য এই সংক্ষিপ্ত আমল দ্বারা আল্লাহ তাআলার কাছে এত বড় মর্যাদা লাভ করবে যে, বেহেশতের যে কোনো শ্রেণীতে সে প্রবেশ করার অধিকার লাভ করবে। মিশকাত শরীফ ২৮১
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, পরিপূর্ণ ঈমানদার ঐ ব্যক্তি যে তার সহধর্মিণীর সাথে সদ্ব্যবহার করে এবং তার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়। তিরমিজী শরীফ
একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম কড়া নির্দেশ দিলেন, গৃহিনীদেরকে কেউ প্রহার করতে পারবে না। অতঃপর একদিন ওমর রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের নিকট প্রকাশ করলেন, নারীগণ অত্যন্ত বেপরোয়া হয়ে গেছে। সেমতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম (প্রয়োজন স্থলে সংযমের সহিত) প্রহারের অনুমতি দিলেন। এরপর বহুসংখ্যক মহিলা তাদের স্বামীর প্রতি অভিযোগ নিয়ে রাসূলুাল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি অসাল্লামের ঘরে ভিড় জমাল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম কঠোর ভাষায় বললেন অনেক মহিলা তাদের স্বামীদের সম্পর্কে অভিযোগ করছে, ঐরূপ স্বামীগণ মোটেই ভালো মানুষ নয়। আবু দাউদ শরীফ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, সহধর্মিনীর সাথে যে উত্তম জীবন-যাপনকারী হয় সেই উত্তম মানুষ। আমি আমার সহধর্মীণীদের সাথে উত্তম জীবনযাপন করি। তিরমিজি শরীফ
সত্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম সহধর্মীণীর প্রতি অতি উত্তম ছিলেন। একবার ছফর অবস্থায় বিবি ছফিয়্যা রাজিয়াল্লাহু তাআলা আনহার জন্য উটে আরোহণ কঠিন হল; (তার পক্ষে উট উচু ছিল)। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম নিজ উরু পেতে দিলেন। ছফিয়্যা রা. সিঁড়ির মতো নবীজির উরু মোবারকের ওপর পা রেখে উটে চড়লেন। বুখারী শরীফ
আর একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম এতেকাফে ছিলেন। ছফিয়্যা রা. রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহ আলাইহি অসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসলেন, তার প্রত্যাবর্তনের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তাকে মর্যাদার সাথে বিদায় দানে তার সঙ্গে মসজিদের দরজা পর্যন্ত আসলেন। বুখারী শরীফ
আয়েশা রা. কম বয়সী ছিলেন; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের ঘরে নয় বছর বয়সে এসেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তার বাল্য বয়সের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখতেন। আয়েশা রা. বর্ণনা করেছেন, কিছু বান্ধবী ছিল যাদের সঙ্গে আমি বাল্যসুলভ খেলাধুলা করতাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম ঘরে আসলে ওরা লুকিয়ে যেত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম ওদেরকে তালাশ করে আমার কাছে পাঠতেন। তারা আবারও আমার সাথে খেলাধূলা করত। বুখারী শরীফ
আয়েশা রা. বর্ণনা করেছেন, একবার ঈদের আনন্দে খঞ্জর চালনার জিহাদী খেলা মসজিদে হচ্ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম আমাকে ঘরের দরোজায় তার পিছনে দাঁড় করিয়ে তার কাঁধের ফাঁক দিয়ে ঐ খেলা দেখালেন। খেলা দেখায় আমার মন ভরে না যাওয়া পর্যন্ত তিনি দাঁড়িয়ে থাকলেন। আয়শা রা. বলেন- খেলা দেখায় লালায়িতা যুবতী কত দীর্ঘকাল দেখবে তা সহজেই অনুমেয়। বুখারী শরীফ
আয়শা রা. বর্ণনা করেছেন একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম আমার সাথে দৌড়-প্রতিযোগিতা করলেন। তাতে আমি জয়ী হলাম। অনেক দিন পর যখন আমার শরীর ভারী হয়ে গিয়েছিল তখন আর একদিন সেই প্রতিযোগিতা করলে আমি পরাজিত হলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তখন কৌতুক করে বললেন, আমার সেই পরাজয়ের বিনিময়ে তোমার এই পরাজয়। আবু দাউদ শরীফ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের কী মধুর সম্পর্ক ছিল সহধর্মিণীদের সঙ্গে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তাদের সাথে সময়ে খোশ-গল্প জুড়ে ছিলেন। হাদিসটি বুখারী শরীফেও উল্লেখ আছে- ‘হাদিসে উম্মে যারা’ নামে। এক সময় আরবের একাদশ সংখ্যক সুসাহিত্যিক মহিলা একত্র হয়ে প্রত্যেকে নিজ নিজ স্বামীর অবস্থা বর্ণনায় ভাষা জ্ঞানের বাহাদুরী দেখাল। তাদের মধ্যে ‘উম্মে যারা’ নামের মহিলা সুদীর্ঘ ও সুললিত ভাষায় নিজ স্বামীর সর্বাধিক বেশি প্রশংসা করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম আয়েশা রা. কে কাছে বসিয়ে সেই একাদশ মহিলার প্রসিদ্ধ গল্পটি শুনালেন এবং বললেন, আয়েশা! উম্মে যারার স্বামী তার জন্য যেরূপ ছিল আমি তোমার জন্য সেরূপ।
নারী সম্প্রদায়ের শিক্ষার প্রতিও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম অনুরাগী ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের আমলে দীন-শিক্ষার একমাত্র কেন্দ্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামই ছিলেন; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের ভাষণসমূহ বিশেষভাবে শরিয়তের বিশেষ বস্তু ছিল। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের ভাষণে নর-নারী নির্বিশেষে সকলের উপস্থিতির আদেশ ছিল। জুমা ও ঈদের নামাজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম খোৎবা বিশেষ ভাষণরূপে দিতেন; সেই ভাষণ শোনার জন্য সকলেই উপস্থিত হতেন, তবে নারীগণ সকলের পেছনে থাকতেন। একবার ঈদের খোৎবা সাধারণ নিয়মে প্রদানের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম লক্ষ্য করলেন, নারীদের পর্যন্ত তার কথা পূর্ণ রূপে পৌঁছেনি। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম খোৎবাস্থল হতে ফিরার পথে বেলাল রা. কে সঙ্গে করে নারীদের অবস্থান স্থলে পৌঁছে তথায় নারীদের লক্ষ্যে পুনঃভাষণ দিলেন। বুখারী শরীফ
আরও একবারের ঘটনা-নারীগগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের কাছে অভিযোগ করল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের মজলিসে তারা পুরুষদের ভিড়ের কারণে পূর্ণ উপকৃত হতে পারে না; সেমতে তাদের অভিলাষ অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তাদের অনুরোধ রক্ষায় ভিন্ন মজলিসের ব্যবস্থা করলেন।
নারীদের প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম কত অধিক সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং তাদের কত বেশি মর্যদা দিতেন! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ-বিদায় হজ্জের নীতি নির্ধারণী ঐতিহাসিক ভাষণে নারীদের মর্যাদা দানের কর্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। সেই ভাষণে তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন-
‘নারীদের ওপর স্বামীদের যেরূপ হক্ব ও দাবি আছে তদ্রুপ স্বামীদের ওপর স্ত্রীদেরও হক্ব এবং দাবি আছে।’ তিনি আরও বলেছেন-নারীদের সম্পর্ক আমার বিশেষ নির্দেশ যে, তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার ও সর্বপ্রকার কল্যাণকর ব্যবস্থা সর্বদা বজায় রাখা। তাদেরকে তোমরা লাভ করেছ আল্লাহর আমানতরূপে, তাদের সতীত্বকে ভোগ করছ আল্লাহর বিধানের অধীনে। সেই আল্লাহর রাসূল আমি, অতএব তাদের সম্পর্কে আমার নির্দেশ পালনে তোমরা বাধ্য।
একদা আবু বকর রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের ঘরে আসছিলেন; বের হতে বিবি আয়েশা রা. উচ্চস্বর শুনতে পেলেনÑ তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের সঙ্গে প্রতিউত্তর করছিলেন। আবু বকর রা. ক্রোধ ভরে ঘরে প্রবেশে আয়েশা রা.কে এই বলে শাসাতে লাগলেন, এত বড় স্পর্ধা! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের আওয়াজের উর্ধ্বে তোমার আওয়াজ! আবু বকর রা. এই বলে আয়েশা রা. কে চড় মারতে উদ্যত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তাকে থামালেন এবং আয়েশাকে প্রীতির ভাষায় বললেন, দেখলে তো মিঞা সাহেব থেকে কত কষ্টে তোমাকে বাঁচিয়াছি? -আবু দাউদ শরীফ
সংগ্রহ
জামেয়া রহমানীয়া মাদ্রাসা
No comments:
Post a Comment