ফতোয়া ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। উম্মাহ ও এর সদস্যদের নানামুখী সমস্যা ও বিভিন্ন সময়ে উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর সঠিক ও সময়োচিত সমাধানে এটি একটি চলমান ব্যবস্থা। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জাতির বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতরা (আলেমরা) তাদের মেধা, প্রজ্ঞা ও গবেষণার মাধ্যমে জীবন চলার পথে নানা সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা প্রতিকারের মাধ্যমে জাতির স্বাভাবিক চলার পথকে করে তোলেন স্বাচ্ছন্দ্য ও সাবলীল।
ফতোয়া শব্দের অর্থ জিজ্ঞাসার জবাব দেয়া, কোনো বিষয়ে অভিমত দেয়া, সসম্যার সমাধান দেয়া, উপদেশ দেয়া, পরামর্শ দেয়া, Formal legal opinion বা বিধিবদ্ধ আইনি অভিমত ইত্যাদি। যিনি এসব জিজ্ঞাসার জবাব দেন বা কোনো বিষয়ে আইনসঙ্গত অভিমত দেন বা দেয়ার যোগ্যতা রাখেন, তাকে মুফতি বলা হয়। মুফতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে প্রসিদ্ধ আরবি অভিধান আল মুনজিদে বলা হয়েছে ‘মুফতি হলেন সেই ফকিহ বা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি, যিনি ফতোয়া দিয়ে থাকেন এবং শরিয়ত সংশ্লিষ্ট যেসব মাসয়ালামাসায়েল তার ওপর আরোপিত হয়, তার জবাব দেন।’ john Milton Cowan মুফতি অর্থ করেছেন Deliverer of formal legel opinions, official expounder of Islamic law ‘বিধিবদ্ধ আইনি অভিমত প্রদানকারী,’ ইসলামী আইনের অফিসিয়াল বা দায়িত্বশীল ব্যাখ্যা দানকারী।
ফতোয়ার প্রয়োজনীয়তাঃ ফতোয়া ইসলামী বিধানের অপরিহার্য অঙ্গ। ইসলাম থেকে ফতোয়াকে আলাদা করার কোনো সুযোগ নেই। মুসলমানদের ব্যক্তি, সমাজ ও সামাজিক জীবনের সর্বত্রই ফতোয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কারণ ইসলাম এমন এক জীবনবিধান, যেখানে জীবন যাপন করতে হয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী। এ জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিধান কী তা জানা আবশ্যক। প্রতিটি বিষয়ে বিধান জ্ঞান যেহেতু সবার থাকে না, সেহেতু তা জানার জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যিনি বিশেষজ্ঞ তাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়ে তা আমল করতে হয় বা বাস্তবায়ন করতে হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যদি কোনো বিষয়ে তোমরা অবগত না থাকো, তাহলে জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করে জেনে নাও।’ (আন নাহলঃ ৪৩)।
রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন, ‘আমার কাছ থেকে একটি আয়াত হলেও তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও।’ কুরআন নাজিলের সময় কোনো বিষয়ে ফতোয়া জিজ্ঞেস করা হলে ক্ষেত্রবিশেষে আল্লাহ নিজেই ফতোয়া দিয়েছেন। কুরআন কারিমে বলা হয়েছে, ‘লোকেরা আপনার কাছে ফতোয়া চায়, আপনি বলে দিন, আল্লাহ তোমাদের কালালা (পিতা-মাতাহীন ও নিঃসন্তান উত্তরাধিকার) সম্পর্কে ফতোয়া দিচ্ছেন।’ (নিসাঃ ১৭৬)।
‘লোকেরা আপনাকে নারীদের ব্যাপারে ফতোয়া জিজ্ঞেস করে, আপনি বলে দিন, আল্লাহই তাদের ব্যাপারে ফতোয়া দিচ্ছেন।’ (নিসাঃ ১২৭)।
ফতোয়াদান একটি চলমান প্রক্রিয়া। মানবসমাজ যত দিন থাকবে এর প্রয়োজনীয়তাও তত দিন থাকবে। কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে বা কোনো বিষয়ে অস্পষ্টতা ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দিলে তার সমাধান ও সংশয় নিরসনের জন্য অন্যকে জিজ্ঞেস করা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। সাধারণ মানুষ তো বটেই, এমনকি আদালতও কোনো বিষয়ে স্পষ্ট হওয়ার জন্য ‘এমিকাস কিউরি’ নিয়োগ করে তাদের কাছ থেকে ফতোয়া নিয়ে থাকেন।
সুতরাং ফতোয়ার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য এবং এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া আল্লাহর রাসূল, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন, আয়িম্মায়ে মুজতাহিদীন এক কথায় ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার শামিল এবং মানব প্রকৃতি ও আইনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ারও শামিল।
ফতোয়ার হুকুমঃ ফতোয়া ফরজে কিফায়া। একদল বিশেষজ্ঞ আলেমকে এ কাজে নিয়োজিত থাকা বা রাখা জরুরি। কারণ মুসলমানদের সামনে প্রতিনিয়ত দ্বীনি বিধিবিধানের ব্যাপারে বিভিন্ন প্রশ্ন ও সমস্যার অবতারণা হয়ে থাকে, যার জবাব দেয়ার জন্য ফতোয়া দানে পারদর্শী একদল আলিমের নিয়োজিত থাকা প্রয়োজন। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, আর স্মরণ করো সে সময়ের কথা, যখন আল্লাহ আহলে কিতাবদের কাছ থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন যে, তোমরা তা (আল্লাহর বাণী) মানুষের কাছে বর্ণনা করবে এবং কখনোই তা গোপন করবে না। (আলে ইমরানঃ ১৮৭)।
রাসূলুল্লাহ সাঃ ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তিকে কোনো জ্ঞান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়, তারপর সে যদি তা গোপন করে, তাহলে কিয়ামতের দিন তাকে জাহান্নামের একটি লাগাম পরিয়ে দেয়া হবে।’ (তিরমিজি)।
যে ব্যক্তি অজ্ঞ, কোনো বিষয়ের হুকুম সম্পর্কে অবগত নয়, তার ওপর ওয়াজিব হলো জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়া। কারণ শরিয়তের হুকুম পালন করা তার জন্য আবশ্যক।
যারা কুরআন ও হাদিস থেকে দলিল-প্রমাণ উপস্থাপনে পারদর্শী, সমস্যা সমাধানে দক্ষ, ইজতিহাদ তথা চিন্তা-গবেষণা করে মাসয়ালা-মাসায়েল চয়নে সক্ষম তাদের ফতোয়াদানের কাজে নিয়োজিত করতে হবে। প্রতিটি রাষ্ট্রেই একদল মুফতি নিয়োগ করা আবশ্যক, যারা জনগণকে বিভিন্ন মাসয়ালার সমাধান দেবেন এবং যাদের কাছে জনগণ প্রশ্নাদি তুলে ধরবেন। এ ক্ষেত্রে শাফেয়ি মাজহাবের ইমামরা একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে মুফতি নিয়োগের পক্ষে মত দিয়েছেন।
এ আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়, ফতোয়াকে অস্বীকার করা বা নিষিদ্ধ করা ফরজকে অস্বীকার বা নিষিদ্ধ করার শামিল। আর যারা ফরজকে অস্বীকার বা অমান্য করে, ইসলামের দৃষ্টিতে তাদের হুকুম কী, তা সবারই জানা। নিষিদ্ধ করা তো দূরের কথা, কোনো মুসলমান ফতোয়াকে অস্বীকার বা অমান্যও করতে পারে না। সুতরাং জনগণ যাতে সহজেই ফতোয়া পেতে পারে তার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এ জন্য প্রতি জেলা-উপজেলায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক মুফতি নিয়োগ করা জরুরি। আর এ কাজটি মুসলিম দেশের সরকারের দায়িত্ব বিধায় সরকারকে এর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ ও যোগ্য মুফতি নিয়োগের পর অযোগ্য ও অদক্ষ লোকেরা যাতে ফতোয়া না দিতে পারে, তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে ভুল ফতোয়া এবং ফতোয়ার অপপ্রয়োগ থেকে জনগণকে নিরাপদ রাখা সম্ভব হবে। তা না করে সাধারণভাবে ফতোয়াকে নিষিদ্ধ করা হলে সমস্যা আরো বৃদ্ধি পাবে।
হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে রোগী নিরাপদ নয়, এমনকি তার কাছে রোগীর মৃতুøর আশঙ্কাও রয়েছে। কিন্তু এ জন্য চিকিৎসাকে নিষিদ্ধ করা যুক্তিযুক্ত নয়, বরং এ জন্য প্রয়োজন দক্ষ ডাক্তারের ব্যবস্থা করা। দক্ষ ডাক্তারের ব্যবস্থা না করে চিকিৎসাকে নিষিদ্ধ করা বা হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিষিদ্ধ করা হলেও কোনো লাভ হবে না। কারণ একজন গুরুতর অসুস্থ রোগী যখন ভালো ডাক্তার না পায় তখন বিপদের সময় সে হাতুড়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতেই বাধ্য হবে। ঠিক তেমনি যোগ্য মুফতির ব্যবস্থা না করে ফতোয়াকে নিষিদ্ধ করলে বা অযোগ্য লোকের কাছ থেকে ফতোয়া নেয়াকে নিষিদ্ধ করলেও কোনো লাভ হবে না। কারণ গুরুতর প্রয়োজনের সময় ভুক্তভোগী ব্যক্তি তার সমস্যা সমাধানের জন্য কারো না কারো কাছে যাবেই। সুতরাং ফতোয়াকে নিষিদ্ধ না করে বিধিবদ্ধ করা প্রয়োজন। এ জন্য আদালত এবং সরকারের কাছে আমাদের আবেদন নিকাহ রেজিস্ট্রার বা কাজী নিয়োগের অনুরূপ ইসলামী জনতার নিত্যপ্রয়োজনীয় সমস্যাবলির সঠিক সমাধানকল্পে প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ মুফতি নিয়োগ করা হোক।
এখানে আরো একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ফতোয়া এবং বিচারকাজ এক জিনিস নয়। ফতোয়া হলো আইনের ব্যাখ্যা করা বা আইনি মতামত ও পরামর্শ দেয়া, যা বর্তমানে অ্যাডভোকেট বা আইনজীবীরা দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ কোনো বিষয়ের হুকুম জানতে চাইলে মুফতির দায়িত্ব হলো তা জানিয়ে দেয়া। তার আলোকে দণ্ড দেয়া বা বিচার করা হলো আদালতের কাজ।
অনেকেই ফতোয়াকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে থাকেন এবং ‘ফতোয়াবাজ’ প্রভৃতি শব্দ প্রয়োগ করে মুফতি ও আলেমদের তুচ্ছজ্ঞান ও উপহাস করে থাকেন। তাদের জানা উচিত, ফতোয়া, মুফতি প্রভৃতি ইসলামের পবিত্র ভাবধারাসমৃদ্ধ পরিভাষা। ফতোয়া দান কোনো তুচ্ছ কাজ নয়, বরং এটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ কাজ। এ কারণে মুফতিও অত্যন্ত মর্যাদার অধিকারী। কারণ এ কাজ স্বয়ং আল্লাহ করেছেন (আগে এসংক্রান্ত কুরআনের আয়াত উল্লেখ করা হয়েছে) এবং তাঁর রাসূলকে এ কাজের নির্দেশ দিয়েছেন। আল কুরআনে বলা হয়েছে, আমি আপনার প্রতি স্মারক (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি লোকদের সেসব বিষয়ে সুস্পষ্ট বর্ণনা দেন, যা তাদের প্রতি নাজিল করা হয়েছে, আর যাতে তারা চিন্তাভাবনা করতে পারে।’ (আলে ইমরানঃ ১৭৬)। মূলত ফতোয়ার মাধ্যমে মুফতিরা মহান আল্লাহর বিধানকেই মানুষের কাছে বর্ণনা করেন। ইমাম আল কারাফি রহঃ মুফতিকে আল্লাহর মুখপাত্রের সাথে তুলনা করেছেন। আল্লামা ইবনুল কায়িম মুফতিকে মন্ত্রীর মর্যাদায় স্থান দিয়ে তিনি রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষ থেকে স্বাক্ষর করেন বলে মত দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যদি রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষ থেকে স্বাক্ষর করা সম্মান ও মর্যাদার বিষয় হয়, তাহলে মহান আল্লাহর পক্ষে স্বাক্ষর করা কতই না সম্মান ও মর্যাদার।’ সুতরাং এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বা উপহাস করা সম্পূর্ণ ঈমানপরিপন্থী কাজ।
No comments:
Post a Comment