মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও দু’দল মুসলমান
একবার মহানবী (সা.) মসজিদে নববীতে গিয়ে দেখলেন দু’দল লোক গোল হয়ে বসে কোন কাজে ব্যস্ত আছে। একদল আল্লাহর যিকির-আযকার ও ইবাদত-বন্দেগী করছিল। আরেক দল লোক (ইসলামী) জ্ঞানচর্চার কাজে মশগুল ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা.) দু’দলকে দেখেই খুশী হলেন এবং তাঁর সাথের লোকদের বললেন, ‘এ দু’দল লোকই ভালো কাজে ব্যস্ত আছে এবং দু’দলের অন্তর্ভুক্ত সকল লোকই উত্তম ও পুণ্যবান।’ তারপর তিনি বললেন, ‘কিন্তু আমাকে পাঠানো হয়েছে লোকদেরকে শিক্ষা দিয়ে জ্ঞানী করে গড়ে তোলার জন্য।’ এ কথা বলেই তিনি সেই দলের দিকে এগিয়ে গেলেন যারা জ্ঞানচর্চার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনিও তাঁদের সাথে বসলেন এবং শিক্ষা দানের কাজে লেগে গেলেন।
কঠিন কাজের দায়িত্ব নেয়া
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ও তাঁর সঙ্গীরা নিজ নিজ বাহনের পিঠ থেকে নিচে নামলেন। মালপত্রও নামিয়ে মাটিতে রাখলেন। তারপর সকলে ঠিক করলেন যে, একটি দুম্বা জবাই করে খাবার তৈরি করা হবে। একজন সাহাবী বললেন, ‘দুম্বা জবাই করা আমার দায়িত্ব।’ আরেক জন বললেন, ‘দুম্বার চামড়া ছাড়ানো এবং গোশত কাটার দায়িত্ব আমার।’ তৃতীয় জন বললেন, ‘গোশত রান্না করার দায়িত্ব আমার।’ চতুর্থ জন অন্য কথা বললেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বললেন, ‘কাঠ সংগ্রহ করার দায়িত্ব আমার।’ সকল সাহাবী একসাথে বলে উঠলেন, ‘হে আল্লাহ্র রাসূল! আমরা উপস্থিত থাকতে আপনি কষ্ট করবেন কেন? আপনি বিশ্রাম নিন। আমরা আনন্দের সাথে সমস্ত কাজ ঠিকমতোই সেরে নেব।’ রাসূলুল্লাহ্ বললেন, ‘আমি জানি এ কাজ তোমরা করে নিতে পারবে। কিন্তু মহান আল্লাহ্ সে বান্দাকে কখনো ভালোবাসেন না যে নিজের বন্ধুদের মাঝে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ও উত্তম মনে করে এবং নিজেকে বিশেষ ব্যক্তিত্ব জ্ঞান করে।’ এ কথা বলে তিনি বনের দিকে চলে গেলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে জ্বালানী কাঠ ও খড়-কুটো নিয়ে ফিরে এলেন।
এক মুসলমান ও এক আহলে কিতাব
সে সময় কুফা নগরী ছিল ইসলামী শাসনের প্রাণকেন্দ্র। সিরিয়া ছাড়ও ইসলামী রাষ্ট্রের অন্য সকল স্থানের সকল লোকের নযর তখন সে নগরীর দিকেই একারনে নিবদ্ধ থাকতো যে, সেখান থেকে কখন কোন্ নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ হুকুম জারী করা হয়।
এ শহর থেকে অনেক দূরে দু’ব্যক্তির মধ্যে রাস্তায় দেখা হলো। একজন মুসলমান, অপরজন আহলে কিতাব (ইয়াহুদী, খ্রিস্টান কিংবা যারথুস্ত্রীয়)। দু’জন একে অপরের গন্তব্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। জানা গেল যে, মুসলমান ব্যক্তি কুফা শহরে যাবেন। আর আহলে কিতাব কুফার নিকটেই অন্য এক স্থানে যাবেন। দু’জনে মিলে স্থির করলেন যে, তাঁরা এক সাথে সফর করবেন। কেননা, অনেক দূর পর্যন্ত দু’জনের রাস্তা একই। এক সাথে কথাবার্তা বলতে বলতে পথা চলা যাবে।
দু’জনের আন্তরিক আলাপ-আলোচনা ও বিভিন্ন কথাবার্তার মধ্য দিয়ে পথ শেষ হয়ে হয়ে এলো। অবশেষে তাঁরা দু’রাস্তার মোড়ে এসে উপস্থিত হলেন যেখান থেকে দু’জনের রাস্তা দু’দিকে চলে গেছে। আহলে কিতাব তাঁর নিজের পথ ধরে চলতে লাগলেন। কিছুদূর পথ চলার পর পিছনে ফিরে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। দেখলেন, তাঁর মুসলমান বন্ধুটি কুফার দিকে না গিয়ে তাঁরই পিছনে পিছনে চলে আসছেন। এ অবস্থা দেখে তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন এবং তাঁর মুসলমান বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলেন : ‘কি ব্যাপার ভাই! তুমি না বলেছিলে, তুমি কুফা যাবে?’ জবাবে মুসলমান বন্ধু বললেন, ‘আমি তো এখনো বলছি, আমি কুফা যাবো।’ তিনি বললেন, ‘তাহলে তুমি এদিকে আসছো কেন? এটা তো কুফার রাস্তা নয়। কুফা যাবার রাস্তা তো ঐটা।’ মুসলমান বন্ধুটি বললেন, ‘আমি জানি। কিন্তু আমার মন চাইলো যে, কিছুদূর পর্যন্ত আমি তোমাকে সঙ্গ দেবো। কেননা, আমাদের নবী বলেছেন, “যখন দুই ব্যক্তি এক সাথে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে পথ চলে তখন একে অপরের প্রতি অধিকার লাভ করে।” এখন তোমারও আমার ওপর অধিকার জন্মেছে। আমি সে অধিকার আদায় করার উদ্দেশ্যে কিছুদূর পর্যন্ত তোমার সাথে চলতে চাই। এরপর আমি আমার পথেই ফিরে যাবো।’ আহলে কিতাব বললেন, ‘ওহ! তোমাদের নবী যে মানুষের ওপর এতো প্রভাব বিস্তার করেছিলেন এবং ইসলাম এতো দ্রুত বিশ্বে প্রসার লাভ করেছিল, এটা নিশ্চয়ই তাঁর এ উত্তম চরিত্রের কারণেই সম্ভব হয়েছিল।’
আহলে কিতাব আরো অবাক হলেন যখন জানতে পারলেন যে, তাঁর সফরসঙ্গী মুসলমান বন্ধুটি আর কেউ নন, বরং মুসলিম জাহানের ক্ষমতাসীন খলীফা হযরত আলী ইবনে আবী তালিব। তৎক্ষণাৎ আহলে কিতাব ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে গেলেন এবং হযরত আলীর বিশ্বস্ত ও অনুগত সঙ্গীদের অন্তর্ভুক্ত হলেন।
উটের রশি বাঁধা
কাফেলাটি বহুক্ষণ পথ চলছিল। সকলের চেহারাতেই ক্লান্তির ছাপ। বহনকারী পশুগুলোও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাঁরা এমন একটি স্থানে উপস্থিত হলেন যেখানে কিছু পানি ছিল। কাফেলা থেমে গেল। রাসূলুল্লাহ্ (সা.)ও এ কাফেলার সাথে ছিলেন। তিনি উটের পিঠ থেকে নেমে এলেন। সকলেই তাড়াতাড়ি পানির কাছে গিয়ে ওযূ ও অন্যান্য কাজ সেরে নামাযের জন্য প্রস্তুত হওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
মহানবীও উট থেকে নামার পর পানির দিকে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু কয়েক ধাপ চলার পর কাউকে কিছু না বলে আবার নিজের উটের দিকে ফিরে এলেন। তাঁর সাহাবিগণ আশ্চর্য হয়ে পরস্পর বলাবলি করতে লাগলেন, মনে হয় যাত্রাবিরতির জন্য এ স্থান আল্লাহ্র নবীর পছন্দ হয়নি। এখনই হয়তো তিনি রওয়ানা হওয়ার নির্দেশ দেবেন। সকলেই তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলেন এবং নতুন নির্দেশের অপেক্ষা করতে লাগলেন। তাঁরা আরো বেশি আশ্চর্য হলেন যখন দেখলেন যে, মহানবী (সা.) নিজের উটের রশি হাতে নিলেন এবং তা বাঁধতে শুরু করলেন। বাঁধার কাজ শেষ করে তিনি আবার পানির দিকে গেলেন।
চারদিক থেকে লোকেরা এসে বললেন, ‘হে আল্লাহ্র রাসূল! আপনি এ কাজের জন্য আমাদেরকে কেন হুকুম দিলেন না? আপনি কেন এ কাজ করতে গেলেন? এ কাজের জন্য আপনি আবার ফিরে গেলেন, অথচ আমরা তো অত্যন্ত গর্বের সাথে এ কাজ করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম।’ প্রিয় নবী তাঁদের কথার জবাবে বললেন, ‘নিজের কাজে কখনো অপরের সাহায্য নেয়া উচিত নয়। আর কারো ভরসা করাও ঠিক নয়। তা একটি মেসওয়াকের ব্যাপারেই হোক না কেন অর্থাৎ কাজটি ছোট হোক অথবা বড়, অপরের ভরসায় বসে থাকার চেয়ে নিজেই করা উচিত।’
ধনী ও দরিদ্র
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁর সব সময়ের নিয়ম মোতাবেক নিজের বাড়ীতে সাহাবীদের নিয়ে বসেছিলেন। সাহাবীরা তাঁকে এমনভাবে ঘিরে রেখেছিলেন যে, তিনি যেন আংটির মাঝে পাথর। এমন সময় ছেঁড়া জামা পরিহিত একজন গরীব লোক তাঁর এ মজলিসে হাযির হলো। ইসলামী রীতিনীতির দৃষ্টিতে মজলিসে উপস্থিত প্রত্যেকেই সমমর্যাদার অধিকারী এবং বৈঠকের আদব হচ্ছে নবাগত ব্যক্তি যেখানেই খালি স্থান দেখবে সেখানেই বসে যাবে। কারো এটা মনে করা উচিত হবে না যে, অমুক স্থান আমার মর্যাদার সাথে মানানসই নয়। সে হিসাবে সে গরীব লোকটি বসার জন্যে একটি খালি জায়গা খুঁজতে লাগলো। সে চারদিকে তাকিয়ে এক কোণায় একটি খালি জায়গা দেখতে পেলো। তাই চুপচাপ সেখানে গিয়ে বসে পড়লো। ঘটনাক্রমে সেখানে এক ধনী লোক বসা ছিল। ঐ গরীব লোককে তার পাশে বসতে দেখে সে তার মূল্যবান জামাকাপড় টেনে নিল এবং এক পাশে সরে গেল। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এ দৃশ্য মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন। ধনী লোকটির এ আচরণ দেখে রাসূল তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তুমি ভয় পেয়েছো যে, এ গরীব লোকের দারিদ্র্য ও অভাব-অনটনের ছায়া হয়তো তোমার ওপরও পড়বে।’ সে বললো, ‘না, হে আল্লাহ্র রাসূল! এমনটা নয়।’ রাসূল বললেন, ‘তাহলে এমন কী কারণ ছিল যে, তুমি এ গরীব লোককে দেখেই এক পাশে সরে গেলে?’ সে বললো, ‘হে আল্লাহ্র রাসূল! আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি আমার অন্যায় স্বীকার করছি। এখন আমি এ অপরাধের কাফফারা দিতে প্রস্তুত আছি। আমি আমার এ অপরাধের কাফফারা হিসাবে আমার সম্পদের অর্ধেক অংশ এ গরীব ভাইকে দান করে দিতে চাই।’ লোকটির এ কথা শুনে গরীব লোকটি বলে উঠলো, ‘কিন্তু আমি তা গ্রহণ করার জন্য মোটেই প্রস্তুত নই।’ রাসূল (সা.)-এর দরবারে বসা অন্য লোকরা জিজ্ঞাসা করলো, ‘কেন?’ উত্তরে সে বললো, ‘আমার ভয় হচ্ছে যে, ধন-সম্পদের প্রাচুর্যে একদিন আমিও এরূপ অহংকারী হয়ে না যাই। আমিও আমার অপর মুসলিম ভাইয়ের সাথে এ ধরনের আচরণ শুরু করে না দেই, যেমনটি আজ এ ব্যক্তি আমার সাথে করেছে।’
ইমাম গাযযালী ও ডাকাত দল
ইসলামী জ্ঞানরাজ্যের প্রখ্যাত পণ্ডিত ব্যক্তি ইমাম গাযযালী ইরানের তূস নগরীর অধিবাসী ছিলেন। পবিত্র মাশহাদের নিকটতম একটি এলাকার নাম তূস।
হিজরী পঞ্চম শতাব্দীর কথা। নিশাপুর শহরটি তখন ইসলামী জ্ঞানচর্চার প্রাণকেন্দ্র হিসাবে পরিগণিত হতো। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা শিক্ষার জন্য এখানে আসত। তাই গাযযালীও জ্ঞান অর্জনের জন্য এখানে এলেন। তিনি দীর্ঘদিন সুযোগ্য ওস্তাদ ও আলেমগণের তত্ত্বাবধানে বিশেষ মনোযোগ ও আগ্রহের সাথে জ্ঞানার্জন করতে লাগলেন। তাঁর অভ্যাস ছিল যে, অভিজ্ঞ আলেম ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে বসে যে সব জ্ঞান অর্জন করতেন তা তিনি খাতায় লিপিবদ্ধ করতেন যাতে ওস্তাদের সে শিক্ষা ভুলে না যান এবং প্রয়োজনের সময় তা দ্বারা আরো বেশি উপকার লাভ করতে পারেন। এভাবে ছাত্রজীবনে গাযযালী বিভিন্ন বিষয়ের ওপর এক মূল্যবান জ্ঞানভাণ্ডার জমা করলেন যা তাঁর নিকট নিজের জীবনের চাইতেও অধিক মূল্যবান ও প্রিয় ছিল।
কয়েক বছর পর্যন্ত নিশাপুরে ছাত্রজীবন অতিবাহিত করার পর যখন গাযযালী দেশে ফিরে যাবার জন্য মনস্থ করলেন তখন তাঁর জমাকৃত জ্ঞানভাণ্ডার একত্র করে একটি পুটুলি বাঁধলেন এবং তা সাথে নিয়ে দেশের দিকে যাত্রা করলেন। পথে একদল ডাকাত তাঁদের কাফেলার ওপর আক্রমণ করলো। ডাকাতরা কাফেলাকে চারদিক থেকে ঘিরে লোকদের জিনিসপত্র ও টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নিয়ে এক জায়গায় জমা করতে লাগলো।
এভাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাকাতদল ইমাম গাযযালীর মালামালের নিকট এসে গেল। ডাকাতরা ইমাম গাযযালী নিকট এসে তাঁর পুটুলি ছিনিয়ে নিতে চাইল। তখন তিনি ডাকাতদের সামনে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন এবং তাদের বললেন, ‘দেখো, এ পুটুলি ব্যতীত তোমরা আর যা কিছু নিতে চাও, সব নিয়ে যাও। কিন্তু আমার অনুরোধ, এটি তোমরা আমার কাছেই রেখে যাও।’ গাযযালীর কথা শুনে ডাকাতরা ভাবলো, মনে হয় পটুলিতে অনেক টাকা-পয়সা রয়েছে। এজন্যই লোকটি এটি হাতছাড়া করতে চায় না। তাই তারা পুটুলিটা কেড়ে নিল। যখন তারা সেটা খুললো তখন দেখলো যে, এর মধ্যে কাগজের জমাকৃত স্তুপ ব্যতীত আর কিছুই নেই। তখন ডাকাতরা ইমাম গাযযালীকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘এ পুটুলিতে কী এমন বিরাট সম্পদ ছিল যা রক্ষা করার জন্য তুমি এভাবে হাউমাউ করে কাঁদছিলে? আমারা ভেবে পাই না যে, এসব কাগজ দিয়ে তুমি কী উপকার লাভ করবে! এ কাগজপত্রগুলো তোমার কী কাজে আসবে?’ ইমাম গাযযালী বললেন, ‘এ পুটুলিতে যা আছে নিঃসন্দেহে তা তোমাদের কোন কাজে আসবে না। কিন্তু আমার জন্য তা অনেক উপকারী ও মূল্যবান সম্পদ।’ তারা বললো, ‘কিন্তু এ কথাও তো বলবে যে, এগুলো তোমার কোন্ কাজের জন্য?’ তিনি বললেন, ‘এ কাগজগুলো আমার এ পর্যন্ত ছাত্রজীবনের মূল্যবান সম্পদ যা আমি আমার উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ওস্তাদগণের সাহায্যে জমা করেছি। তোমরা যদি আমার এ জ্ঞানভাণ্ডার ছিনিয়ে নাও তাহলে আমার সমস্ত জ্ঞান ধ্বংস হয়ে যাবে। আর আমার এতো বছরের মেহনত বৃথা হয়ে যাবে।’ তারা বললো, ‘এটাই কি সত্য কথা যে, তোমার সারা জীবনের সমস্ত জ্ঞান এ পুটুলিতে রয়েছে?’ গাযযালী বললেন, ‘জ্বী হ্যাঁ।’ তারা বললো, ‘যে জ্ঞান কোন পুটুলিতে কিংবা সিন্ধুকের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা যায় বা চোর-ডাকাত ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারে প্রকৃতপক্ষে তা জ্ঞানই নয়। যাও, নিজের অজ্ঞতা ও বোকামি নিয়ে চিন্তা করো। আমরা ভেবে পাই না, সেটা কী ধরনের জ্ঞান যা চোর-ডাকাতরা চুরি করে নিয়ে যেতে পারে!’
ডাকাতদের সহজ-সরল ও সাধারণ কথা গাযযালীর মতো যোগ্য ও পরিশ্রমী ছাত্রের অন্তরে দাগ কাটলো। যে গাযযালী এতদিন ওস্তাদের কাছ থেকে শোনা প্রতিটি কথাই খাতায় লিখে রাখতেন, এখন তিনিই এ চেষ্টায় লিপ্ত হলেন যে, চিন্তা-ভাবনা দ্বারা নিজের জ্ঞান-বুদ্ধির লালন করবেন। আর অনুসন্ধান ও যাচাই-বাছাই করে নিজের স্মৃতির খাতায় লিখে রাখবেন।
ইমাম গাযযালী নিজেই বলেছেন, ‘ডাকাতদের মুখ থেকে নিঃসৃত কথা আমার জন্য ছিল উত্তম উপদেশ; এ উপদেশই আমার জীবনে চিন্তা-গবেষণার দিকনির্দেশনা দান করেছে।’
ভারোত্তোলন প্রতিযোগিতা
একদল মুসলমান যুবক শক্তি পরীক্ষা ও ভারোত্তোলন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। সেখানে খুব ভারী একটা পাথর পড়ে ছিল। যুবক দল সে ভারী পাথরটি উত্তোলন করার ক্ষেত্রে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করছিল। এমন সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা.) সেখানে পৌঁছলেন এবং যুবকদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা কি করছো?’ যুবকরা বললো, আমরা শক্তি পরীক্ষা করছি। আমরা দেখতে চাই যে, আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী কে?’ রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বললেন, ‘তোমরা যদি চাও তাহলে আমি বলে দিতে পারি তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক শক্তিশালী কে?’ তারা বললো, ‘জ্বী, অবশ্যই! এর চেয়ে উত্তম আর কী হতে পারে যে, আপনার মতো ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি আমাদের প্রতিযোগিতার বিচারক হবেন?’ সকলেই আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করছিল যে, রাসূল কাকে সবচেয়ে শক্তিশালী বলে ঘোষণা করেন। কেউ কেউ ভাবছিল যে, এখনই রাসূলুল্লাহ্ তার হাত ধরে সকলের সামনে ঘোষণা দেবেন যে, তোমাদের মধ্য থেকে এ ছেলেটি সবচেয়ে শক্তিশালী। আল্লাহর নবী বললেন, ‘সবচেয়ে শক্তিশালী সেই ব্যক্তি যার কোন জিনিস খুব পছন্দ হয় আর সে ঐ জিনিসের প্রতি আসক্তও হয়ে পড়ে, কিন্তু সে জিনিসের আসক্তি তাকে সত্য পথ ও মানবতা থেকে বিচ্যুত করতে পারে না, আর মন্দের দ্বারা কলুষিত করে না। আর সে ব্যক্তি যদি কোন বিষয়ে অসন্তুষ্ট হয় এবং রাগ ও ক্ষোভের কারণে অগ্নিশর্মা হয়ে যায়, সে অবস্থাতেও সে নিজেকে সংযত রাখে, সত্য ছাড়া মিথ্যা বলে না। সে যদি প্রতাপশালী হয় এবং বাধাসমূহ তার সামনে থেকে সরে যায় তাহলেও তার অধিকারের বাইরে সে হাত বাড়ায় না।’