বিংশ শতকের জাহেলিয়াত পর্ব-১
সমস্ত প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য এবং তাঁর সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ওপর বর্ষিত হোক শান্তি ও কল্যাণ এবং কিয়ামত পর্যন্ত যারাই সত্যের পথ অবলম্বন করবে তাদের ওপর (শান্তি ও কল্যাণ বর্ষিত হোক)।
১৪০০ বছর আগে যখন ইসলামের আবির্ভাব হয় তখনকার সময়কে বলা হত জাহেলিয়াত। মানুষ জাহেলিয়াত ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করত। ইসলামপূর্ব বা অনৈসলামিক চিন্তাচেতনা ও ভুলত্রুটিকে জাহেলিয়াতের অংশ মনে করা হত। জাহেলিয়াতের শাব্দিক অর্থ ‘অজ্ঞতা’ যা আরবী জাহ্ল শব্দ থেকে এসেছে। তবে এক্ষেত্রে অজ্ঞতা বলতে নিরক্ষরতা বোঝানো হতো না। সেসময় আরবে মুখে মুখেই বেশীর ভাগ কাজ সম্পন্ন হত। সমাজ-সভ্যতা গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাবও জাহেলিয়াত নয়। আমরা জানি আরব উপদ্বীপে এ ধরনের জ্ঞান ছিল যা সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সেসবের চিহ্ন আমরা উত্তর ও দক্ষিণ আরবে দেখতে পাই। জাহেলিয়াতের প্রকৃত অর্থ মানুষের জীবনে আসমানী বিধানের অনুপস্থিতি। সেই আরবরা বংশপরম্পরায় নিজেদের তৈরি নিয়মকানুন বা প্রথার অনুসারী ছিল। ইসলাম সে মুহূর্তে জীবনযাপন, সমাজ ও জাতি গঠনের স্বর্গীয় দিকনির্দেশনা নিয়ে এসেছিল।
আমরা যদি আজকের মুসলিম বিশ্বের দিকে তাকাই তাহলে বুঝতে পারব আমরা আসমানী বিধান আগমনের পূর্বাবস্থায় ফিরে গেছি, বর্তমানে আমরা জাহেলিয়াতের মধ্যে বাস করছি। অধিকাংশ মুসলিমই কুরআন ও সুন্নাহ এই দুই আসমানী বিধান দ্বারা পরিচালিত নয়। আমরা আমাদের নিজেদের তৈরী কিংবা বংশপরম্পরায় প্রাপ্ত ধ্যান-ধারণা, রীতিনীতির অনুসারী। আমাদের রীতিনীতিগুলোও অন্যান্য জাতি থেকে ধার করা। এজন্য আজকের মুসলিমরা বিংশ শতকেও কুরআন- সুন্নাহর জ্ঞানহীন জাহেলিয়াতে অবস্থান করছে।
জাহেলিয়াতের প্রধান যে দুটি উৎস বর্তমান মুসলিম বিশ্বকে অন্ধকারে নিমজ্জিত রেখেছে তা হচ্ছে –
কিন্তু আজকের মুসলিমদের মধ্যে “তাক্বলীদ আল আ’মা” বা অন্ধ অনুকরণ গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে আছে। এরকম দেখা যায় ভারত, পাকিস্তান, মিসর ও অন্যান্য মুসলিম দেশের মাজারে যেখানে লোকে মানুষের কবর তাওয়াফ করে, কবরে কোরবানী দেয়, কবরবাসীর কাছে দোআ চায়। এখন কেউ যদি সেখানে গিয়ে কুরআন থেকে বলে, আল্লাহ এরকম কাজে নিষেধ করেছেন বা হাদীস থেকে বলে, কবরের উপর কাঠামো নির্মাণ হারাম, তবে উল্টো কথা শুনতে হবে। তারা মনে করবে এটা বুঝি কোন নতুন ধর্ম, ইসলামের সাথে এর বুঝি কোন সম্পর্ক নেই। তারা বলবে তাদের বাপদাদারা যা বংশপরম্পরায় করে আসছে, তারা কি ভুল করেছে? তাদের থেকে আমরা বেশি জানি? সুতরাং তারা মেনেই নেবেনা। আমরা কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে রাসূলুল্লাহর (সা) ধর্ম প্রচারের সময় মক্কার মূর্তিপূজারীদের এই একই ধরনের প্রতিক্রিয়ার কথা জানতে পারি:
আমার জানামতে এই ঐতিহ্যবাদ বা অন্ধ অনুকরণের তিনটি উৎস আছে, সেগুলো হচ্ছে
সুফি মতবাদ মানুষকে অন্ধ অনুকরণ করার প্রশিক্ষণ দেয়। সুফি মতবাদের সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত অনেক লোককেই সুফিসাধক বলা হয়। সুফিসাধকদের মতে তাদের ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছে রাসুলুল্লাহ (সা) থেকে ( আসতাগফিরুল্লাহ)। তারা দাবী করে তিনিই ছিলেন প্রথম সুফি। এরপর সুফি হলেন আবু বকর (রা)। তিনি কিভাবে সুফি হলেন তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তারা বলে, মক্কা ত্যাগের সময় আবু বকর নবীজীর (সা) সাথে গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন; তখন নবীজী (সা) তাঁর কাছে সেই মারেফতী জ্ঞান দান করেন। এভাবে একজন থেকে আরেকজন করতে করতে স্থানীয় পীর পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতা পৌঁছানো হয় এবং বলা হয় যে এই বিশেষ জ্ঞানের কারণেই তোমার এই পীরসাহেবের অনুসরণ করা কর্তব্য।
সেই পীরের ঐ মারেফতী জ্ঞান ও কর্তৃত্ব থাকার কারণে সবাইকে তার অনুসরণ করতে হবে; তার মুরীদ হতে হবে- মুরীদ হওয়া অর্থ হচ্ছে নিজের ইচ্ছাকে তার ইচ্ছার কাছে সমর্পণ করতে হবে। এজন্য আমরা দেখতে পাই সুফি শেখরা তাদের মুরিদদের আত্মসচেতনতাকে (ইগো) দমন করার নানা পদ্ধতি বাত্লে দেয়, কেননা আত্মসচেতনতা লোপ পেলে আল্লাহর সাথে এক হয়ে যাওয়া যায় (!)। তাদের এসব পদ্ধতি সব রকমের অপমানকর কাজ করতে শেখায়। সুফিদের বই পড়লে দেখা যায় তারা মুরিদদের মাথায় মোজা বেঁেধ খালি পায়ে শহরে যেতে বলে, এরকম যতসব আজগুবি কান্ডকারখানা সমাজের কাছে একজনকে হাস্যকর করে তোলে। এভাবে সবাই আঙ্গুল তুলে দেখালে, ভাঁড় বা পাগল ভাবলে তবেই আত্মসচেতনতা (ইগো) দমন হবে। একেক পীরের ক্ষেত্রে নিদের্শনাও একেক রকম হয়ে থাকে।
তারা একনাগাড়ে যিকিরও করতে শেখায়। সকাল বিকাল হাজার বার কিছু জিনিস বলাকে যিকির বলা হয়। তাদের এই যিকির করতে বসলে সারাদিন পার হয়ে যায়। তারা এই যিকির দুইভাবে করে, প্রথমত আল্লাহর কোন নাম নিয়ে বার বার বলতেই থাকে। রাসুলুল্লাহ (সা) আমাদের কখনো এরকম করতে শেখাননি। আমরা যদি তাঁর নির্দেশিত কোন দোআ পড়ি, তাহলে দেখতে পাব সেটি একটি বাক্য বা উক্তি আকারে আছে, শুধুমাত্র শব্দ দিয়ে দোআ করা হয়নি। কারো সাথে ভাব বিনিময় করতে হলে আমরা মুখে বাক্য বলে থাকি, যেমন “মোহাম্মদ আমাকে কাজে সাহায্য করো।” আমরা শুধু মোহাম্মদ, মোহাম্মদ, মোহাম্মদ.. বলিনা। এরকম করলে লোকে এমবুলেন্স ডেকে মানসিক হাসপাতালে পাঠিয়ে দেবে। যেকোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ বুঝবে আমরা কথা বলতে শিখিনি। আমরা সাহায্য দরকার হলে বলিনা সাহায্য, সাহায্য, সাহায্য.. , কিসের জন্য সাহায্য? এসবের কোন অর্থই হয়না। এভাবে কেউ ভাব বিনিময় করেনা। কিন্তু সুফিরা এই কাজটি করে; তারা আল্লাহর একটি নাম বেছে নেয় – আল খালিক, আল রাজিক, আর রাহিম এবং বার বার বলতে থাকে। বলতে বলতে একসময় পরে বোঝাই যায়না আসলে তারা আল খালেক বলছে না অন্যকিছু।
দ্বিতীয় ধরনের যিকিরে আল্লাহর একটি নাম নেয়া হয়, নকশবন্দীরা (একটি সুফি সমপ্রদায়) এটি বেশি করে; তারা আল্লাহু বলে শুরু করে কিন্তু শেষ করে হু দিয়ে। তাদের যিকির শুনলে মনে হয় কুকুরের বিলাপ .. হু হু হু । তারা মনে করে এতে আল্লাহ খুশি হবেন। একদিকে তারা আল্লাহর কাছে অগ্রহণযোগ্য অদ্ভুত সব এবাদতে লোকদের সামিল করে আর অন্যদিকে তাদের দুর্বলতার সুযোগ নেয়। এসব পীরদের মুরিদরা নিজেদের সর্বস্ব সপেঁ দেয় এবং তাদের গুরুদের খুব কমই শয়তানের কুমন্ত্রণাকে অগ্রাহ্য করতে পারে; যার ফলে মুরিদদের থেকে ফায়দা লুটতে থাকে। এজন্য আমরা আজ সমাজে দেখি ধর্মীয় সমপ্রদায়ের নেতা, চার্চের মুরুব্বীরা শিশুদের নিয়ে নিজেদের যৌন আকাঙ্খা চরিতার্থ করছে। এসব শিশুরা তাদের সবকিছু সরলবিশ্বাসে সঁেপ দেয়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় জিম জোনসের কথা, যে ১৯৭৯ সালে নয়শজন অনুসারী নিয়ে গায়ানাতে আত্মহত্যা করেছিল। তার অনুসারীরা তাকে খোদা মনে করত। যারা বেঁেচ গেছে তারা আমেরিকায় চলে আসে। তারা সবাইকে জানায় সে সংগঠনের ভিতরকার কথা; সে এক সীমাহীন দুরাচার- জনে জনে শিশু, পুরুষ ও নারীদের সাথে দৈহিক সম্পর্ক আর সেই সাথে মাদকদ্রব্যের ছড়াছড়ি। এরকম আরেকজন হচ্ছে আমেরিকার ডেভিড কুরেইশ, যে কিনা কয়েকবছর আগে নিজেকে খোদা দাবী করেছিল, বুঝিয়েছিল যিশু খ্রীস্টরূপে তার আগমন। তার কার্যকলাপও একইরকম ছিল। অন্যরা খোদা মনে করে তার এসব অনাচার মেনে নিত। মুনীদের প্রতিষ্ঠাতাও একই ধরনের। হিন্দুদের মধ্যে রজনিশ কোন রাখঢাক করেনি, তাকে বলা হত “প্রেমগুরু”। তার মতে আধ্যাত্মিক জাগরণ ঘটাতে হলে আগে সবরকমের যৌন বাসনা পূর্ণ করতে হবে; এজন্য সে অবাধ মেলামেশা করতে শিখিয়ে গেছে।
সুফিদের ক্ষেত্রেও এরকম ব্যাপার খুঁেজ পাওয়া যায়। বছরের পর বছর এসব তরীকা অনুসারীদের নিয়ে কি করছে তা জানলে হতবাক হতে হয়। তারা বলে আমরা যদি কোন পীরকে বা খাদেমকে কোন খারাপ কাজ করতে দেখি তবে তা বিচার করার ক্ষমতা আমাদের নেই, আমরা এসব বিচার করার মত আধ্যাত্মিক শক্তি-স্তরে উপনীত হইনি। যেমন ধরা যাক খিজির (আ) ও মুসা (আ) এর কাহিনী। অনেক আলেম খিজিরকে (আ) নবী বলে থাকেন, তবে এ ব্যাপারে তেমন কোন স্পষ্ট প্রমাণ নেই। খিজির (আ) এমন কিছু কাজ করেছিলেন যা মুসা (আ) এর বোধগম্য হয়নি। যেমন তিনি একটি বালককে হত্যা করেছিলেন, নৌকা ছিদ্র করেছিলেন এবং পরে এসব দৃশ্যত খারাপ কাজ মুসা (আ) এর কাছে ব্যাখ্যা করেছিলেন। সুফিদের মতে খিজির (আ) একজন সুফি শেখ এবং তিনি এখনও বেঁেচ আছেন। তিনি পীরদের সাথে বসেন এবং তাদের গাইড করেন। তিনি খ্রীস্টানদের মেলচিডেসেক এর মত চিরজীবন্ত। তিনি পৃথিবীর বুকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং সবচেয়ে শক্তিধর পীরদের বিশেষ পথপ্রদর্শক।
সুফিরা তাদের অনুসারীদের সাথে সম্পর্ককে খিজির (আ) ও মুসা (আ) এর সাথে তুলনা করে। কিন্তু এটা সত্য হতে পারেনা। যখন কোন পীর মদ্যপান করেন তিনি তখন তার মুরিদদের বলেন এটা তোমাদের কাছে সাধারণ মদ মনে হতে পারে কিন্তু আসলে এটি জান্নাতের শরাব ( যদিও এটি নিকটের দোকান থেকে কেনা জনি ওয়াকারের বোতল থেকে সবার সামনে ঢালা হয়েছে); এরপর এর পেছনে একটা মারেফতী কাহিনীও সে শুনিয়ে দেয়া হয়। সারা পৃথিবীতে এভাবে পীরেরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে চলেছে।
গতবছর আমি যখন ইংল্যান্ডে ছিলাম, সেখানের টিভিতে তখন স্থানীয় পীরদের উপর একটা অনুষ্ঠান করা হয়। তারা এক পীরকে বেছে নিয়েছিল যে বেশ কয়েকটা বাচ্চা মেয়ের সম্মানহানী করেছে। একজন সাংবাদিক সেসব মেয়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। তারা কয়েকবছর পর একটা মেয়ের ব্যাগে লুকানো ক্যামেরা দিয়ে ঐ পীরের কাছে পাঠায়। ঐ মেয়েকে পীরসাহেব তের চৌদ্দ বছর বয়সে শ্লীলতাহানী করেছেন। সেই মেয়েকে (তার বয়স তখন বিশের কাছাকাছি) পীরসাহেব চিনতে পারেন। মেয়েটি পীরের কাছে হেদায়েত কামনা করে। পীরসাহেব হেদায়েত দেবার আশ্বাস দেন কিন্তু বলেন এর আগে তার সাথে কোলাকুলি করতে হবে, তার পুরুষাঙ্গ ধুয়ে দিতে হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। পুরো ব্যাপারটাই লুকানো ক্যামেরায় জাতীয় টেলিভিশনে দেখানো হয়। এরপর সেই মহিলা সাংবাদিক পীরের কাছে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে এসব অভিযোগ তোলেন। পীরসাহেব জবাবে বলেন, না না না এটা কিভাবে সম্ভব? আমি সত্তুর বছরের বৃদ্ধ, আমি সবসময় এবাদত বন্দেগিতে মগ্ন থাকি। আমি একজন সাধারণ মানুষ, আমি লোকদের সাহায্য করার চেষ্টা করি। আমি কুরআন ছুঁেয় শপথ করে বলছি আমি কখনো এসব খারাপ কাজ করিনি। সুফি মতবাদের কারণে আজকে মুসলিম উম্মাহর এই দশা!
আমাকে বলা হয়েছিল আমি তাত্ত্বিকভাবে যেকোন মাযহাব অনুসরণ করতে পারি তবে বেশিরভাগ মুসলিমরাই হানাফী; উপরন্তু ইমাম আবু হানিফা হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ ইমাম বা ইমাম-ই-আজম। তাই হানাফীদের পাল্লাই ভারি। এজন্য ইসলাম গ্রহণের পর আমি হানাফী মাযহাবের অনুসারী হলাম। বাড়ি ফিরে আমি স্ত্রীকে বললাম, মন দিয়ে শুনো, আমরা কিন্তু এখন থেকে হানাফী। এরপর আমি জানতে পারলাম হানাফী মহিলারা বিশেষ কায়দায় নামায পড়ে। নারী পুরুষের নামায হানাফী মতে ভিন্ন। আমি জ্ঞানের সন্ধানে বের হয়ে, পড়াশোনা করে মহিলাদের নামায শিখলাম। সাধারণ মানুষের পক্ষে সে নামায পড়া সম্ভব না, আমার কাছে হানাফী মহিলাদের নামায এক্রোব্যাটিক চর্চা মনে হয়েছে। আমি স্ত্রীকে শুদ্ধভাবে নামায পড়তে শেখানোর জন্য তা রপ্ত করেছিলাম। পরবর্তীতে আমি আরো পড়াশোনা করার পর বুঝতে পারলাম এভাবে নামায পড়তে রাসুলুল্লাহ (সা) নিষেধ করেছেন। তিনি কনুই মাটিতে রাখতে, বুক উরুতে রাখতে ও ৪৫০ না ঝুকঁতে নিষেধ করেছেন যা কিনা হানাফী মহিলারা করে থাকেন।
মাযহাব নিয়ে অতীতের গোঁড়ামির ফলাফলও আমাদের জানা আছে। ১৩শ শতকে (১২৫৮ খ্রীস্টাব্দ) বাগদাদের পতনের পর এ গোঁড়ামি চরম আকার ধারণ করে। সেসময় কেউ মাযহাব পরিবর্তন করলে মুসলিম বিচারকদের শাস্তি দেয়ার অধিকার ছিল; অর্থাৎ এ কাজটি ছিল অপরাধতুল্য। হানাফী মতে একজন হানাফী মহিলা একজন শাফিঈ পুরুষকে বিবাহ করতে পারেনা। মসজিদগুলোতে দুই থেকে চারটি মেহরাব দেখা যেত। এখনও সিরিয়ায় গেলে এধরনের মসজিদ দেখা যায়; প্রধানত দুইটি মেহরাব হচ্ছে হানাফি ও শাফিঈদের জন্য। কাবার পুরানো ছবি দেখলে দেখা যাবে কাবা ঘরের চারপাশে চারটি মাকাম (স্তম্ভ ও ছাদসহ দেয়ালহীন কাঠামো) ছিল- মাকাম হানাফী,মাকাম শাফিঈ, মাকাম হাম্বলী ও মাকাম মালিকী। নামাযের সময় হলে হানাফী ইমাম আসেন, ইকামত দেয়া হয় এবং সব হানাফীরা তাওয়াফ করে কাতারে দাঁড়িয়ে যায়। তাদের নামায শেষ হলে শাফিঈ ইমাম উঠে দাঁড়ান এবং শাফিঈদের নামায পড়ান। এভাবে কাবা ঘরে চারটি পৃথক জামাত চালু ছিল। বিশের দশকের মাঝামাঝি, আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে পর্যন্ত এটাই ছিল নিয়ম। এখন সে অবস্থার অবসান হয়েছে। আজকাল হানাফিরা শাফিঈদের বিয়ে করতে পারে, এতে কেউ আপত্তি করেনা। কাবাঘরেও একটাই জামাত অনুষ্ঠিত হয়, আলহামদুলিল্লাহ। তবে এখনও অনেক মানুষের মনে মাযহাব প্রীতি গভীরভাবে প্রোথিত। সব মাযহাবই ঠিক – এই প্রবণতা মুসলিমদের খ্রীস্টানদের মত অবস্থায় ফেলে দিচ্ছে। খ্রীস্টানরা যেমন মানতে বাধ্য ১+১+১=১, তেমনি বিবেক বুদ্ধি জলাঞ্জলি দিয়ে অন্ধভাবে এসব মেনে নিতে হয়। আমাদের মন যদিও বলে ১+১+১=৩ কিন্তু সত্যিকারের খ্রীস্টান হতে হলে একের ভিতর তিন ঈশ্বরকে মেনে নিতে হয়। অনুরূপে মুসলিমরা যখন মাযহাব অনুসরণ করে তখন তারা বাধ্য হয়ে মেনে নেয় একটা জিনিস একই সময়ে ঠিক বা বেঠিক হতে পারে। একজনের একই সময়ে অযু থাকতে পারে আবার নাও পারে। হানাফী মতে কেউ অনিচ্ছাকৃতভাবে কোন মহিলাকে স্পর্শ করলে অযু ভাঙ্গবেনা। কিন্তু শাফিঈ মাযহাব মোতাবেক এমন পরিস্থিতিতে অযু ভাঙ্গবে। তাই দুটিই যদি ঠিক হয় তাহলে একই সময়ে অযু আছে আবার নেই। ব্যাপারটা তাই অযৌক্তিক। মাযহাবের অন্ধ অনুসারীদের এজন্য চিন্তাভাবনার দুয়ার বন্ধ করে দিতে হয়। প্রকৃতপক্ষে তারা ইসলামের মূলধারার থেকে বিছিন্ন। কুরআন সুন্নাহর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলেই এরকম অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। সাধারণ মানুষকে বলা হয় হাদীসের বই না পড়তে, কারণ তা নাকি বোধগম্য নয়। ক্যাথলিক ধর্মগুরুরা যেমন বলে বাইবেল পড়োনা, পড়লে মতভেদ সৃষ্টি হবে; এজন্য তারা যা বলবে তাই গ্রহণ করতে হয়। এক পর্যায়ে গিয়ে আমাদের বলা হয় কুরআন পড়োনা। আমাদের বাধাধরা নিয়মে কুরআন পড়তে বলা হয়, আমরা তাই কুরআন না বুঝে তেলাওয়াত করতে অভ্যস্ত। আল্লাহ কোরানে আমাদের কি বলছেন তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। এজন্য আমরা পশ্চিমা দেশে এমন দুর্নীতিবাজ লোকও পাই যারা কিনা ছোটবেলায় কুরআন খতম দিয়ে এসেছে। কুরআনের কোন প্রভাবই তাদের মধ্যে দেখা যায়না।
কুরআনকে অনেকে মন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। যখন কেউ বাচ্চার নাম রাখতে চায় তখন কুরআনের মধ্যে খুজঁতে শুরু করে। তারা কুরআন নিয়ে প্রথমে একটা পাতা খুলবে, এরপর চোখ বন্ধ করে আঙ্গুল দিয়ে যে কোন শব্দতে আসবে;যে শব্দটা পাওয়া যাবে সেটাই বাচ্চার নাম। এজন্য আমরা দেখি অনেকের নাম বিসমিল্লাহ। আমার সাথে দুই বোনের দেখা হয়েছিল যাদের নাম ছিল নাহ্ল ( নাহল অর্থ মৌমাছি) ও নমল (নমল অর্থ পিপড়া)।
আমাদের যদি কোন সিদ্ধান্ত নিতে হয় তবে আমরা ইস্তিখারার নামায পড়ি। কিন্তু অনেকেই এ কাজটি করতে চাননা। এর বদলে তারা কুরআন নিয়ে কয়েক লাইন নিচে নামে, কি কি করতে হবে এর জন্য একটা বইও পারলে সাথে রাখে। উদাহরণস্বরূপ তারা কুরআনের যেকোন একটা পাতা মেলে তিন লাইন নিচে নামে, চতুর্থ শব্দটার প্রথম বা তৃতীয় অক্ষর দেখে, এরপর অক্ষরটা সারণীতে মিলিয়ে নেয়। যদি অক্ষরটা লাম হয় তবে সেখানে লেখা থাকে কি করতে হবে,কোনটা না করা ভাল অথবা যদি অক্ষরটা মীম হয় তবে ঐটা করতে হবে ইত্যাদি। মানুষ এভাবে কুরআন ব্যবহার করছে। এর তুলনা চলে চীনাদের আইচিং বইয়ের। তারা কতগুলো কাঠি নিক্ষেপ করে এবং কাঠিগুলো কিভাবে পড়ল তা দেখে বইটা থেকে জানতে পারে এভাবে বা ঐভাবে হলে কি অর্থ দাঁড়ায়।
ইস্তিখারা নামাযকেও মানুষ জ্যোতিষিদের ক্রিস্টাল বলের মত করে ফেলেছে। নামায পড়ে স্বপ্নের জন্য মানুষ অপেক্ষা করে, স্বপ্নই বলে দেবে কি করতে হবে। যদি স্বপ্ন না দেখে তবে আগামীদিন আবার ইস্তিখারা পড়ে। এভাবে দশ পনেরোবার নামায পড়ে ফেলে স্বপ্নের আশায়। রাসুলুল্লাহ (সা) কখনো স্বপ্নের কথা বলেননি, কিন্তু অধিকাংশ মুসলিমই ভাবে স্বপ্ন দেখতে হবে। আমার ছেলের কিছু করার থাকলে আমি ইস্তিখারা পড়লাম অথবা কোন মোল্লাকে আমার ছেলের জন্য নামায পড়ে দিতে বললাম, এর সবই রাসুলুল্লাহর (সা) শিক্ষা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। একে ইস্তিখারা নামায বলা যায়না। ইস্তিখারা নামায হচ্ছে যখন কেউ মনে মনে কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় তখন দুই রাকাত নামায পড়ে আল্লাহর কাছে বলে, সর্বজ্ঞানী আল্লাহ যেন তার এই সিদ্ধান্ত এই জীবন ও পরকালের জন্য শুভ হলে কাজটা সহজ করে দেন এবং শুভ না হলে কাজটা কঠিন করে দেন। এই পদ্ধতি অতীব সহজ সরল ও বোধগম্য। আপনি কি করতে হবে বুঝতে না পারলে ইস্তিখারা নামায পড়বেন, ব্যাপারটি তা নয়। এ অবস্থায় এ নামায নয়। আমাদের প্রথমে অবস্থা বুঝে সবচেয়ে ভাল সিদ্ধান্তে পৌছঁতে হবে, এরপর আল্লাহর কাছে দোআ করতে হবে এই সিদ্ধান্ত কি আমার জন্য ঠিক? যদি ঠিক হয় তবে আমার জন্য তা সহজ করো আর ভুল হলে কঠিন করো। এটাই হচ্ছে ইস্তিখারা নামাযের সঠিক পদ্ধতি।
এভাবে আমাদের ধর্মটা মন্ত্র, জ্যোতিষশাস্ত্র, ভবিষ্যতবাণী, তাবিজে-কবজের সমষ্টিতে পরিণত হয়েছে। আমরা আসলেই এক জাহেলিয়াতের মাঝে বসবাস করছি।
১৪০০ বছর আগে যখন ইসলামের আবির্ভাব হয় তখনকার সময়কে বলা হত জাহেলিয়াত। মানুষ জাহেলিয়াত ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করত। ইসলামপূর্ব বা অনৈসলামিক চিন্তাচেতনা ও ভুলত্রুটিকে জাহেলিয়াতের অংশ মনে করা হত। জাহেলিয়াতের শাব্দিক অর্থ ‘অজ্ঞতা’ যা আরবী জাহ্ল শব্দ থেকে এসেছে। তবে এক্ষেত্রে অজ্ঞতা বলতে নিরক্ষরতা বোঝানো হতো না। সেসময় আরবে মুখে মুখেই বেশীর ভাগ কাজ সম্পন্ন হত। সমাজ-সভ্যতা গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাবও জাহেলিয়াত নয়। আমরা জানি আরব উপদ্বীপে এ ধরনের জ্ঞান ছিল যা সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সেসবের চিহ্ন আমরা উত্তর ও দক্ষিণ আরবে দেখতে পাই। জাহেলিয়াতের প্রকৃত অর্থ মানুষের জীবনে আসমানী বিধানের অনুপস্থিতি। সেই আরবরা বংশপরম্পরায় নিজেদের তৈরি নিয়মকানুন বা প্রথার অনুসারী ছিল। ইসলাম সে মুহূর্তে জীবনযাপন, সমাজ ও জাতি গঠনের স্বর্গীয় দিকনির্দেশনা নিয়ে এসেছিল।
আমরা যদি আজকের মুসলিম বিশ্বের দিকে তাকাই তাহলে বুঝতে পারব আমরা আসমানী বিধান আগমনের পূর্বাবস্থায় ফিরে গেছি, বর্তমানে আমরা জাহেলিয়াতের মধ্যে বাস করছি। অধিকাংশ মুসলিমই কুরআন ও সুন্নাহ এই দুই আসমানী বিধান দ্বারা পরিচালিত নয়। আমরা আমাদের নিজেদের তৈরী কিংবা বংশপরম্পরায় প্রাপ্ত ধ্যান-ধারণা, রীতিনীতির অনুসারী। আমাদের রীতিনীতিগুলোও অন্যান্য জাতি থেকে ধার করা। এজন্য আজকের মুসলিমরা বিংশ শতকেও কুরআন- সুন্নাহর জ্ঞানহীন জাহেলিয়াতে অবস্থান করছে।
জাহেলিয়াতের প্রধান যে দুটি উৎস বর্তমান মুসলিম বিশ্বকে অন্ধকারে নিমজ্জিত রেখেছে তা হচ্ছে –
- ঐতিহ্যবাদ (Traditionalism)
- যুক্তিবাদ (Rationalism)
ঐতিহ্যবাদ
ঐতিহ্যবাদ হচ্ছে প্রচলিত প্রথা বা ঐতিহ্যের অন্ধ অনুকরণ, যা কিনা আজ মুসলিম বিশ্বের বহু অংশে প্রচলিত। এই অন্ধ অনুকরণ মৌলিকভাবে কালেমা শাহাদাতের শিক্ষার বিপরীত। আমরা এই কালেমাতে বলে থাকি “আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু (সা)” ,অর্থাৎ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মদ (সা) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। এই সাক্ষ্যদানের প্রকৃত মর্ম হচ্ছে আমরা রাসূলুল্লাহ (সা) ছাড়া আর কারো অন্ধ অনুকরণ করিনা। তিনিই একমাত্র মানব যাঁকে আমরা চোখ বুঁজে অনুসরণ করতে পারি। তিনি আমাদের কিছু করতে বললে আমরা তা করি ও কিছু করতে নিষেধ করলে আমরা তা থেকে বিরত থাকি। এর কারণ হচ্ছে তিনি আমাদের যা করতে বলেন তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই বলা হয়। আমরা যদি কাজটা করার পেছনে যুক্তি খুঁেজ পাই তবে আলহামদুলিল্লাহ, আমরা বিধানটা ভালভাবে বুঝতে পারি এবং সবসময় কার্যকর করতে পারি। কিন্তু যদি কোন কারণ খুঁেজ না পাই তবুও তার অপেক্ষায় আমরা বসে থাকিনা। তিনি অন্ধ অনুকরণের যোগ্য। কেননা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কুরআনে বলেন,এই কথা আর কারো বেলায় বলা যায়না। অন্য আর কাউকে মান্য করা মানেই আল্লাহকে মান্য করা নয়। কেউ যদি আমাদের কুরআন সুন্নাহতে যা আছে তা মনে করিয়ে দেয় তবে এবং সে মোতাবেক কাজের কথা বলে তবে আমরা আসলে তাদের মান্য করিনা, মান্য করি আল্লাহকে। কিন্তু যদি কেউ নিজের মনগড়া মতবাদ প্রচার করে যা কুরআন ও সুন্নাহতে খুঁেজ পাওয়া যাবেনা তবে তাদের কথামত কাজ করলে আল্লাহকে মান্য করা হবেনা।‘যে আল্লাহর রাসূলকে মান্য করে সে আল্লাহকেই মান্য করে।(সূরা আন-নিসা ৪:৮০)
কিন্তু আজকের মুসলিমদের মধ্যে “তাক্বলীদ আল আ’মা” বা অন্ধ অনুকরণ গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে আছে। এরকম দেখা যায় ভারত, পাকিস্তান, মিসর ও অন্যান্য মুসলিম দেশের মাজারে যেখানে লোকে মানুষের কবর তাওয়াফ করে, কবরে কোরবানী দেয়, কবরবাসীর কাছে দোআ চায়। এখন কেউ যদি সেখানে গিয়ে কুরআন থেকে বলে, আল্লাহ এরকম কাজে নিষেধ করেছেন বা হাদীস থেকে বলে, কবরের উপর কাঠামো নির্মাণ হারাম, তবে উল্টো কথা শুনতে হবে। তারা মনে করবে এটা বুঝি কোন নতুন ধর্ম, ইসলামের সাথে এর বুঝি কোন সম্পর্ক নেই। তারা বলবে তাদের বাপদাদারা যা বংশপরম্পরায় করে আসছে, তারা কি ভুল করেছে? তাদের থেকে আমরা বেশি জানি? সুতরাং তারা মেনেই নেবেনা। আমরা কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে রাসূলুল্লাহর (সা) ধর্ম প্রচারের সময় মক্কার মূর্তিপূজারীদের এই একই ধরনের প্রতিক্রিয়ার কথা জানতে পারি:
আজকের দিনে ঠিক একই রকম প্রতিক্রিয়া মুসলিমদের মাঝে দেখা যাচ্ছে। আমরা যা করছি তা নিয়েই আমরা সন্তুষ্ট। অবশ্যই দাওয়াতের কাজে যারা জড়িত তাদের এধরনের সমস্যায় পড়তে হয় এবং এজন্য লোকদের বোঝানোর সঠিক কর্মপন্থা বের করা দরকার। আমরা সে আলোচনায় যাচ্ছিনা, বরং দেখব কি কি ভাবে লোকেরা এ অবস্থায় এসে পৌঁেছছে। লোকেরা ১৪০০ বছর আগেকার অজ্ঞ মূর্তিপূজারীদের মত অবস্থায় ফিরে গেছে। শির্কে লিপ্ত এসব মানুষকে কুরআন সুন্নাহর কথা বলা হলে তারা বাপদাদাদের অনুসরণই যথেষ্ট মনে করে।‘এবং তুমি যদি তাদের আল্লাহ ও তাঁর বাণীর দিকে ডাকো (তখন তারা বলে) আমাদের পূর্বপুরুষরা যা করে গেছে তাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। যদিও তাদের পূর্বপুরুষরা কিছুই বুঝতনা এবং সঠিক পথে ছিলনা? ( সূরা মায়েদা, ৫:১০৪)
আমার জানামতে এই ঐতিহ্যবাদ বা অন্ধ অনুকরণের তিনটি উৎস আছে, সেগুলো হচ্ছে
- ক. বিদআত
- খ. সুফি মতবাদ
- গ. মাযহাব
ক. বিদআত (নব উদ্ভাবন):
ধর্মীয় রীতিনীতি উদ্ভাবনকে বিদআত বলা হয়। পার্শ্ববর্তী অমুসলিম দেশের রীতিনীতি বা মুসলিমদের ভিতর বসবাসকারী অমুসলিমদের প্রভাবে বিদআত জন্ম নেয়। উদাহরণস্বরূপ, রাসুলুল্লাহর (সা) জন্মদিন পালন (খ্রীস্টানদের ক্রিসমাস পালনের মত), কবরের উপর কাঠামো নির্মাণ (অন্যান্য ধর্মের মত), ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত মেয়ের পরিবার থেকে যৌতুক নেয়া ইত্যাদি বিদআতের অন্তর্ভুক্ত। হিন্দুদের মধ্যে যৌতুক প্রথা চালু আছে এবং মন মত যৌতুক না পেলে বউয়ের গায়ে আগুন দিয়ে তারা নতুন বউ খুঁজতে বের হয়। আমরাও এর ব্যতিক্রম নই।খ. সুফি মতবাদ :
মুসলিম বিশ্বে সুফি মতবাদ অন্ধ অনুকরণের প্রধান উৎস। এর প্রভাব এত বেশি যে কোন সুফি, পীর বা শেখের মুরিদ না হওয়া অথবা কোন তরীকার অনুসারী না হওয়াই অস্বাভাবিক ব্যাপার। এজন্য একটি প্রবাদ আছে- যদি তোমার কোন শেখ (পীর) না থাকে তবে তোমার শেখ হলো শয়তান; তোমার কোন আধ্যাত্মিক গুরু না থাকলে শয়তান তোমাকে বিপথে নিয়ে যাবে।সুফি মতবাদ মানুষকে অন্ধ অনুকরণ করার প্রশিক্ষণ দেয়। সুফি মতবাদের সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত অনেক লোককেই সুফিসাধক বলা হয়। সুফিসাধকদের মতে তাদের ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছে রাসুলুল্লাহ (সা) থেকে ( আসতাগফিরুল্লাহ)। তারা দাবী করে তিনিই ছিলেন প্রথম সুফি। এরপর সুফি হলেন আবু বকর (রা)। তিনি কিভাবে সুফি হলেন তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তারা বলে, মক্কা ত্যাগের সময় আবু বকর নবীজীর (সা) সাথে গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন; তখন নবীজী (সা) তাঁর কাছে সেই মারেফতী জ্ঞান দান করেন। এভাবে একজন থেকে আরেকজন করতে করতে স্থানীয় পীর পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতা পৌঁছানো হয় এবং বলা হয় যে এই বিশেষ জ্ঞানের কারণেই তোমার এই পীরসাহেবের অনুসরণ করা কর্তব্য।
সেই পীরের ঐ মারেফতী জ্ঞান ও কর্তৃত্ব থাকার কারণে সবাইকে তার অনুসরণ করতে হবে; তার মুরীদ হতে হবে- মুরীদ হওয়া অর্থ হচ্ছে নিজের ইচ্ছাকে তার ইচ্ছার কাছে সমর্পণ করতে হবে। এজন্য আমরা দেখতে পাই সুফি শেখরা তাদের মুরিদদের আত্মসচেতনতাকে (ইগো) দমন করার নানা পদ্ধতি বাত্লে দেয়, কেননা আত্মসচেতনতা লোপ পেলে আল্লাহর সাথে এক হয়ে যাওয়া যায় (!)। তাদের এসব পদ্ধতি সব রকমের অপমানকর কাজ করতে শেখায়। সুফিদের বই পড়লে দেখা যায় তারা মুরিদদের মাথায় মোজা বেঁেধ খালি পায়ে শহরে যেতে বলে, এরকম যতসব আজগুবি কান্ডকারখানা সমাজের কাছে একজনকে হাস্যকর করে তোলে। এভাবে সবাই আঙ্গুল তুলে দেখালে, ভাঁড় বা পাগল ভাবলে তবেই আত্মসচেতনতা (ইগো) দমন হবে। একেক পীরের ক্ষেত্রে নিদের্শনাও একেক রকম হয়ে থাকে।
তারা একনাগাড়ে যিকিরও করতে শেখায়। সকাল বিকাল হাজার বার কিছু জিনিস বলাকে যিকির বলা হয়। তাদের এই যিকির করতে বসলে সারাদিন পার হয়ে যায়। তারা এই যিকির দুইভাবে করে, প্রথমত আল্লাহর কোন নাম নিয়ে বার বার বলতেই থাকে। রাসুলুল্লাহ (সা) আমাদের কখনো এরকম করতে শেখাননি। আমরা যদি তাঁর নির্দেশিত কোন দোআ পড়ি, তাহলে দেখতে পাব সেটি একটি বাক্য বা উক্তি আকারে আছে, শুধুমাত্র শব্দ দিয়ে দোআ করা হয়নি। কারো সাথে ভাব বিনিময় করতে হলে আমরা মুখে বাক্য বলে থাকি, যেমন “মোহাম্মদ আমাকে কাজে সাহায্য করো।” আমরা শুধু মোহাম্মদ, মোহাম্মদ, মোহাম্মদ.. বলিনা। এরকম করলে লোকে এমবুলেন্স ডেকে মানসিক হাসপাতালে পাঠিয়ে দেবে। যেকোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ বুঝবে আমরা কথা বলতে শিখিনি। আমরা সাহায্য দরকার হলে বলিনা সাহায্য, সাহায্য, সাহায্য.. , কিসের জন্য সাহায্য? এসবের কোন অর্থই হয়না। এভাবে কেউ ভাব বিনিময় করেনা। কিন্তু সুফিরা এই কাজটি করে; তারা আল্লাহর একটি নাম বেছে নেয় – আল খালিক, আল রাজিক, আর রাহিম এবং বার বার বলতে থাকে। বলতে বলতে একসময় পরে বোঝাই যায়না আসলে তারা আল খালেক বলছে না অন্যকিছু।
দ্বিতীয় ধরনের যিকিরে আল্লাহর একটি নাম নেয়া হয়, নকশবন্দীরা (একটি সুফি সমপ্রদায়) এটি বেশি করে; তারা আল্লাহু বলে শুরু করে কিন্তু শেষ করে হু দিয়ে। তাদের যিকির শুনলে মনে হয় কুকুরের বিলাপ .. হু হু হু । তারা মনে করে এতে আল্লাহ খুশি হবেন। একদিকে তারা আল্লাহর কাছে অগ্রহণযোগ্য অদ্ভুত সব এবাদতে লোকদের সামিল করে আর অন্যদিকে তাদের দুর্বলতার সুযোগ নেয়। এসব পীরদের মুরিদরা নিজেদের সর্বস্ব সপেঁ দেয় এবং তাদের গুরুদের খুব কমই শয়তানের কুমন্ত্রণাকে অগ্রাহ্য করতে পারে; যার ফলে মুরিদদের থেকে ফায়দা লুটতে থাকে। এজন্য আমরা আজ সমাজে দেখি ধর্মীয় সমপ্রদায়ের নেতা, চার্চের মুরুব্বীরা শিশুদের নিয়ে নিজেদের যৌন আকাঙ্খা চরিতার্থ করছে। এসব শিশুরা তাদের সবকিছু সরলবিশ্বাসে সঁেপ দেয়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় জিম জোনসের কথা, যে ১৯৭৯ সালে নয়শজন অনুসারী নিয়ে গায়ানাতে আত্মহত্যা করেছিল। তার অনুসারীরা তাকে খোদা মনে করত। যারা বেঁেচ গেছে তারা আমেরিকায় চলে আসে। তারা সবাইকে জানায় সে সংগঠনের ভিতরকার কথা; সে এক সীমাহীন দুরাচার- জনে জনে শিশু, পুরুষ ও নারীদের সাথে দৈহিক সম্পর্ক আর সেই সাথে মাদকদ্রব্যের ছড়াছড়ি। এরকম আরেকজন হচ্ছে আমেরিকার ডেভিড কুরেইশ, যে কিনা কয়েকবছর আগে নিজেকে খোদা দাবী করেছিল, বুঝিয়েছিল যিশু খ্রীস্টরূপে তার আগমন। তার কার্যকলাপও একইরকম ছিল। অন্যরা খোদা মনে করে তার এসব অনাচার মেনে নিত। মুনীদের প্রতিষ্ঠাতাও একই ধরনের। হিন্দুদের মধ্যে রজনিশ কোন রাখঢাক করেনি, তাকে বলা হত “প্রেমগুরু”। তার মতে আধ্যাত্মিক জাগরণ ঘটাতে হলে আগে সবরকমের যৌন বাসনা পূর্ণ করতে হবে; এজন্য সে অবাধ মেলামেশা করতে শিখিয়ে গেছে।
সুফিদের ক্ষেত্রেও এরকম ব্যাপার খুঁেজ পাওয়া যায়। বছরের পর বছর এসব তরীকা অনুসারীদের নিয়ে কি করছে তা জানলে হতবাক হতে হয়। তারা বলে আমরা যদি কোন পীরকে বা খাদেমকে কোন খারাপ কাজ করতে দেখি তবে তা বিচার করার ক্ষমতা আমাদের নেই, আমরা এসব বিচার করার মত আধ্যাত্মিক শক্তি-স্তরে উপনীত হইনি। যেমন ধরা যাক খিজির (আ) ও মুসা (আ) এর কাহিনী। অনেক আলেম খিজিরকে (আ) নবী বলে থাকেন, তবে এ ব্যাপারে তেমন কোন স্পষ্ট প্রমাণ নেই। খিজির (আ) এমন কিছু কাজ করেছিলেন যা মুসা (আ) এর বোধগম্য হয়নি। যেমন তিনি একটি বালককে হত্যা করেছিলেন, নৌকা ছিদ্র করেছিলেন এবং পরে এসব দৃশ্যত খারাপ কাজ মুসা (আ) এর কাছে ব্যাখ্যা করেছিলেন। সুফিদের মতে খিজির (আ) একজন সুফি শেখ এবং তিনি এখনও বেঁেচ আছেন। তিনি পীরদের সাথে বসেন এবং তাদের গাইড করেন। তিনি খ্রীস্টানদের মেলচিডেসেক এর মত চিরজীবন্ত। তিনি পৃথিবীর বুকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং সবচেয়ে শক্তিধর পীরদের বিশেষ পথপ্রদর্শক।
সুফিরা তাদের অনুসারীদের সাথে সম্পর্ককে খিজির (আ) ও মুসা (আ) এর সাথে তুলনা করে। কিন্তু এটা সত্য হতে পারেনা। যখন কোন পীর মদ্যপান করেন তিনি তখন তার মুরিদদের বলেন এটা তোমাদের কাছে সাধারণ মদ মনে হতে পারে কিন্তু আসলে এটি জান্নাতের শরাব ( যদিও এটি নিকটের দোকান থেকে কেনা জনি ওয়াকারের বোতল থেকে সবার সামনে ঢালা হয়েছে); এরপর এর পেছনে একটা মারেফতী কাহিনীও সে শুনিয়ে দেয়া হয়। সারা পৃথিবীতে এভাবে পীরেরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে চলেছে।
গতবছর আমি যখন ইংল্যান্ডে ছিলাম, সেখানের টিভিতে তখন স্থানীয় পীরদের উপর একটা অনুষ্ঠান করা হয়। তারা এক পীরকে বেছে নিয়েছিল যে বেশ কয়েকটা বাচ্চা মেয়ের সম্মানহানী করেছে। একজন সাংবাদিক সেসব মেয়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। তারা কয়েকবছর পর একটা মেয়ের ব্যাগে লুকানো ক্যামেরা দিয়ে ঐ পীরের কাছে পাঠায়। ঐ মেয়েকে পীরসাহেব তের চৌদ্দ বছর বয়সে শ্লীলতাহানী করেছেন। সেই মেয়েকে (তার বয়স তখন বিশের কাছাকাছি) পীরসাহেব চিনতে পারেন। মেয়েটি পীরের কাছে হেদায়েত কামনা করে। পীরসাহেব হেদায়েত দেবার আশ্বাস দেন কিন্তু বলেন এর আগে তার সাথে কোলাকুলি করতে হবে, তার পুরুষাঙ্গ ধুয়ে দিতে হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। পুরো ব্যাপারটাই লুকানো ক্যামেরায় জাতীয় টেলিভিশনে দেখানো হয়। এরপর সেই মহিলা সাংবাদিক পীরের কাছে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে এসব অভিযোগ তোলেন। পীরসাহেব জবাবে বলেন, না না না এটা কিভাবে সম্ভব? আমি সত্তুর বছরের বৃদ্ধ, আমি সবসময় এবাদত বন্দেগিতে মগ্ন থাকি। আমি একজন সাধারণ মানুষ, আমি লোকদের সাহায্য করার চেষ্টা করি। আমি কুরআন ছুঁেয় শপথ করে বলছি আমি কখনো এসব খারাপ কাজ করিনি। সুফি মতবাদের কারণে আজকে মুসলিম উম্মাহর এই দশা!
গ. মাযহাব:
মাযহাব কয়েক প্রকার – হানাফী, শাফিঈ, মালিকি ও হাম্বলী। সুফি মতবাদের মত আমাদের বলা হয় যে কোন মাযহাবের অনুসারী হতে; যার কোন ইমাম নেই তার ইমাম শয়তান; সব মাযহাবই শুদ্ধ, তাই যে কোন একটি অনুসরণ করতেই হবে।আমাকে বলা হয়েছিল আমি তাত্ত্বিকভাবে যেকোন মাযহাব অনুসরণ করতে পারি তবে বেশিরভাগ মুসলিমরাই হানাফী; উপরন্তু ইমাম আবু হানিফা হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ ইমাম বা ইমাম-ই-আজম। তাই হানাফীদের পাল্লাই ভারি। এজন্য ইসলাম গ্রহণের পর আমি হানাফী মাযহাবের অনুসারী হলাম। বাড়ি ফিরে আমি স্ত্রীকে বললাম, মন দিয়ে শুনো, আমরা কিন্তু এখন থেকে হানাফী। এরপর আমি জানতে পারলাম হানাফী মহিলারা বিশেষ কায়দায় নামায পড়ে। নারী পুরুষের নামায হানাফী মতে ভিন্ন। আমি জ্ঞানের সন্ধানে বের হয়ে, পড়াশোনা করে মহিলাদের নামায শিখলাম। সাধারণ মানুষের পক্ষে সে নামায পড়া সম্ভব না, আমার কাছে হানাফী মহিলাদের নামায এক্রোব্যাটিক চর্চা মনে হয়েছে। আমি স্ত্রীকে শুদ্ধভাবে নামায পড়তে শেখানোর জন্য তা রপ্ত করেছিলাম। পরবর্তীতে আমি আরো পড়াশোনা করার পর বুঝতে পারলাম এভাবে নামায পড়তে রাসুলুল্লাহ (সা) নিষেধ করেছেন। তিনি কনুই মাটিতে রাখতে, বুক উরুতে রাখতে ও ৪৫০ না ঝুকঁতে নিষেধ করেছেন যা কিনা হানাফী মহিলারা করে থাকেন।
মাযহাব নিয়ে অতীতের গোঁড়ামির ফলাফলও আমাদের জানা আছে। ১৩শ শতকে (১২৫৮ খ্রীস্টাব্দ) বাগদাদের পতনের পর এ গোঁড়ামি চরম আকার ধারণ করে। সেসময় কেউ মাযহাব পরিবর্তন করলে মুসলিম বিচারকদের শাস্তি দেয়ার অধিকার ছিল; অর্থাৎ এ কাজটি ছিল অপরাধতুল্য। হানাফী মতে একজন হানাফী মহিলা একজন শাফিঈ পুরুষকে বিবাহ করতে পারেনা। মসজিদগুলোতে দুই থেকে চারটি মেহরাব দেখা যেত। এখনও সিরিয়ায় গেলে এধরনের মসজিদ দেখা যায়; প্রধানত দুইটি মেহরাব হচ্ছে হানাফি ও শাফিঈদের জন্য। কাবার পুরানো ছবি দেখলে দেখা যাবে কাবা ঘরের চারপাশে চারটি মাকাম (স্তম্ভ ও ছাদসহ দেয়ালহীন কাঠামো) ছিল- মাকাম হানাফী,মাকাম শাফিঈ, মাকাম হাম্বলী ও মাকাম মালিকী। নামাযের সময় হলে হানাফী ইমাম আসেন, ইকামত দেয়া হয় এবং সব হানাফীরা তাওয়াফ করে কাতারে দাঁড়িয়ে যায়। তাদের নামায শেষ হলে শাফিঈ ইমাম উঠে দাঁড়ান এবং শাফিঈদের নামায পড়ান। এভাবে কাবা ঘরে চারটি পৃথক জামাত চালু ছিল। বিশের দশকের মাঝামাঝি, আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে পর্যন্ত এটাই ছিল নিয়ম। এখন সে অবস্থার অবসান হয়েছে। আজকাল হানাফিরা শাফিঈদের বিয়ে করতে পারে, এতে কেউ আপত্তি করেনা। কাবাঘরেও একটাই জামাত অনুষ্ঠিত হয়, আলহামদুলিল্লাহ। তবে এখনও অনেক মানুষের মনে মাযহাব প্রীতি গভীরভাবে প্রোথিত। সব মাযহাবই ঠিক – এই প্রবণতা মুসলিমদের খ্রীস্টানদের মত অবস্থায় ফেলে দিচ্ছে। খ্রীস্টানরা যেমন মানতে বাধ্য ১+১+১=১, তেমনি বিবেক বুদ্ধি জলাঞ্জলি দিয়ে অন্ধভাবে এসব মেনে নিতে হয়। আমাদের মন যদিও বলে ১+১+১=৩ কিন্তু সত্যিকারের খ্রীস্টান হতে হলে একের ভিতর তিন ঈশ্বরকে মেনে নিতে হয়। অনুরূপে মুসলিমরা যখন মাযহাব অনুসরণ করে তখন তারা বাধ্য হয়ে মেনে নেয় একটা জিনিস একই সময়ে ঠিক বা বেঠিক হতে পারে। একজনের একই সময়ে অযু থাকতে পারে আবার নাও পারে। হানাফী মতে কেউ অনিচ্ছাকৃতভাবে কোন মহিলাকে স্পর্শ করলে অযু ভাঙ্গবেনা। কিন্তু শাফিঈ মাযহাব মোতাবেক এমন পরিস্থিতিতে অযু ভাঙ্গবে। তাই দুটিই যদি ঠিক হয় তাহলে একই সময়ে অযু আছে আবার নেই। ব্যাপারটা তাই অযৌক্তিক। মাযহাবের অন্ধ অনুসারীদের এজন্য চিন্তাভাবনার দুয়ার বন্ধ করে দিতে হয়। প্রকৃতপক্ষে তারা ইসলামের মূলধারার থেকে বিছিন্ন। কুরআন সুন্নাহর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলেই এরকম অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। সাধারণ মানুষকে বলা হয় হাদীসের বই না পড়তে, কারণ তা নাকি বোধগম্য নয়। ক্যাথলিক ধর্মগুরুরা যেমন বলে বাইবেল পড়োনা, পড়লে মতভেদ সৃষ্টি হবে; এজন্য তারা যা বলবে তাই গ্রহণ করতে হয়। এক পর্যায়ে গিয়ে আমাদের বলা হয় কুরআন পড়োনা। আমাদের বাধাধরা নিয়মে কুরআন পড়তে বলা হয়, আমরা তাই কুরআন না বুঝে তেলাওয়াত করতে অভ্যস্ত। আল্লাহ কোরানে আমাদের কি বলছেন তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। এজন্য আমরা পশ্চিমা দেশে এমন দুর্নীতিবাজ লোকও পাই যারা কিনা ছোটবেলায় কুরআন খতম দিয়ে এসেছে। কুরআনের কোন প্রভাবই তাদের মধ্যে দেখা যায়না।
কুরআনকে অনেকে মন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। যখন কেউ বাচ্চার নাম রাখতে চায় তখন কুরআনের মধ্যে খুজঁতে শুরু করে। তারা কুরআন নিয়ে প্রথমে একটা পাতা খুলবে, এরপর চোখ বন্ধ করে আঙ্গুল দিয়ে যে কোন শব্দতে আসবে;যে শব্দটা পাওয়া যাবে সেটাই বাচ্চার নাম। এজন্য আমরা দেখি অনেকের নাম বিসমিল্লাহ। আমার সাথে দুই বোনের দেখা হয়েছিল যাদের নাম ছিল নাহ্ল ( নাহল অর্থ মৌমাছি) ও নমল (নমল অর্থ পিপড়া)।
আমাদের যদি কোন সিদ্ধান্ত নিতে হয় তবে আমরা ইস্তিখারার নামায পড়ি। কিন্তু অনেকেই এ কাজটি করতে চাননা। এর বদলে তারা কুরআন নিয়ে কয়েক লাইন নিচে নামে, কি কি করতে হবে এর জন্য একটা বইও পারলে সাথে রাখে। উদাহরণস্বরূপ তারা কুরআনের যেকোন একটা পাতা মেলে তিন লাইন নিচে নামে, চতুর্থ শব্দটার প্রথম বা তৃতীয় অক্ষর দেখে, এরপর অক্ষরটা সারণীতে মিলিয়ে নেয়। যদি অক্ষরটা লাম হয় তবে সেখানে লেখা থাকে কি করতে হবে,কোনটা না করা ভাল অথবা যদি অক্ষরটা মীম হয় তবে ঐটা করতে হবে ইত্যাদি। মানুষ এভাবে কুরআন ব্যবহার করছে। এর তুলনা চলে চীনাদের আইচিং বইয়ের। তারা কতগুলো কাঠি নিক্ষেপ করে এবং কাঠিগুলো কিভাবে পড়ল তা দেখে বইটা থেকে জানতে পারে এভাবে বা ঐভাবে হলে কি অর্থ দাঁড়ায়।
ইস্তিখারা নামাযকেও মানুষ জ্যোতিষিদের ক্রিস্টাল বলের মত করে ফেলেছে। নামায পড়ে স্বপ্নের জন্য মানুষ অপেক্ষা করে, স্বপ্নই বলে দেবে কি করতে হবে। যদি স্বপ্ন না দেখে তবে আগামীদিন আবার ইস্তিখারা পড়ে। এভাবে দশ পনেরোবার নামায পড়ে ফেলে স্বপ্নের আশায়। রাসুলুল্লাহ (সা) কখনো স্বপ্নের কথা বলেননি, কিন্তু অধিকাংশ মুসলিমই ভাবে স্বপ্ন দেখতে হবে। আমার ছেলের কিছু করার থাকলে আমি ইস্তিখারা পড়লাম অথবা কোন মোল্লাকে আমার ছেলের জন্য নামায পড়ে দিতে বললাম, এর সবই রাসুলুল্লাহর (সা) শিক্ষা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। একে ইস্তিখারা নামায বলা যায়না। ইস্তিখারা নামায হচ্ছে যখন কেউ মনে মনে কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় তখন দুই রাকাত নামায পড়ে আল্লাহর কাছে বলে, সর্বজ্ঞানী আল্লাহ যেন তার এই সিদ্ধান্ত এই জীবন ও পরকালের জন্য শুভ হলে কাজটা সহজ করে দেন এবং শুভ না হলে কাজটা কঠিন করে দেন। এই পদ্ধতি অতীব সহজ সরল ও বোধগম্য। আপনি কি করতে হবে বুঝতে না পারলে ইস্তিখারা নামায পড়বেন, ব্যাপারটি তা নয়। এ অবস্থায় এ নামায নয়। আমাদের প্রথমে অবস্থা বুঝে সবচেয়ে ভাল সিদ্ধান্তে পৌছঁতে হবে, এরপর আল্লাহর কাছে দোআ করতে হবে এই সিদ্ধান্ত কি আমার জন্য ঠিক? যদি ঠিক হয় তবে আমার জন্য তা সহজ করো আর ভুল হলে কঠিন করো। এটাই হচ্ছে ইস্তিখারা নামাযের সঠিক পদ্ধতি।
এভাবে আমাদের ধর্মটা মন্ত্র, জ্যোতিষশাস্ত্র, ভবিষ্যতবাণী, তাবিজে-কবজের সমষ্টিতে পরিণত হয়েছে। আমরা আসলেই এক জাহেলিয়াতের মাঝে বসবাস করছি।
বিংশ শতকের জাহেলিয়াত পর্ব-২
যুক্তিবাদ
যে মতবাদে মানুষের যুক্তিবুদ্ধিকে আল্লাহর ওহীর উপর স্থান দেয়া হয় তাকে বলা যায় যুক্তিবাদ। মডার্নিজম বা মডার্নিস্ট মুভমেন্ট যুক্তিবাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এই চিন্তাধারায় মানুষ ইসলামকে বিংশ শতাব্দির জন্য উপযোগী করে তুলতে নতুন করে ব্যাখ্যা করতে চায়। এরকম বহু লোক পাওয়া যাবে তা সে মোহাম্মদ আবদুহুই হোক বা স্যার সৈয়দ আহমেদই হোক। সারা বিশ্বে কিছু লোক তাদের ভাষণে বা বইয়ে কয়েক শতাব্দি ধরে জেনে আসা ইসলামী শরীয়তের মূলনীতিগুলো অস্বীকার করে বসছে। তারা সেসবের এমন সব ব্যাখ্যা দাঁড় করাচ্ছে যে তা সেগুলোকে বাতিল করারই সমতুল্য। তাদের প্রিয় একটি বিষয় হচ্ছে ইসলামের বহুবিবাহ। তারা বলে আসলে একটাই বিয়ে করা উচিত। কুরআনের কোথায় বলা হয়েছে যে পুরুষরা মাত্র একটা বিয়ে করতে পারবে? আল্লাহ বলেছেন,“তুমি তাদের (একাধিক স্ত্রীদের) সাথে যতই চেষ্টা করোনা কেন সুবিচার করতে পারবেনা।”এজন্য তারা বলে, যদি কেউ একাধিক বিয়ে করে, তবে সুবিচার করা সম্ভব না,যদি সুবিচার করা যেত, তবে তা ঠিক আছে। কিন্তু যেহেতু তা করা অসম্ভব তাই একাধিক বিয়ে করা ঠিক নয়।
তেমনি ইউসুফ আলীর কুরআনের অনুবাদের পাদটীকায় তিনি লিখেছেন বিংশ শতকের আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার সুদ আর রাসুলুল্লাহর (সা) সময়ের সুদ একরকম নয়, তাই সুদ খাওয়া যাবে। এটা কেমন কথা হলো? অথচ সুদ খাওয়া কবীরা গুনাহর মধ্যে পড়ে। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন সুদের ৭০ টি শাখা আছে এবং এর সবচেয়ে প্রাথমিক রূপের উদাহরণ হলো মায়ের সাথে যিনার সমতুল্য। যে সুদকে এত কঠোর ভাষায় নিন্দা করা হয়েছে তা হঠাৎ করে একজন এসে বলছে হালাল। এসব হচ্ছে মডার্নিস্টদের কার্যকলাপের অংশবিশেষ।
এই আধুনিকতার রেশ হিসেবে দেখা যায় মুসলিম দেশগুলো ধর্মনিরপেক্ষ সরকার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। ইসলামী শরীয়ত সংশোধিত আকারে শুধুমাত্র পারিবারিক মামলা মোকদ্দমায় সীমাবদ্ধ। মুসলিম দেশের আইনকানুন ব্রিটিশ, ফরাসী, জার্মান আইনের অনুরূপ। তারা বলে বর্তমানে ইসলামী আইন অচল। তারা এটা মুখে না বললেও তাদের মন মানসিকতা এরকমই। এর ফলস্বরূপ মুসলিমরা আজ ভোগান্তি পোহাচ্ছে। মুসলিম দেশগুলোতে মদ উৎপাদন, পতিতাবৃত্তির মত কবীরা গুনাহ প্রকাশ্যে সংঘটিত হচ্ছে যা কিনা রাসুলুল্লাহর (সা) সময় কল্পনাও করা যেত না।
যুক্তিবাদীদের তৃতীয় দলটি হচ্ছে চরমপন্থী বা সন্ত্রাসী। পশ্চিমা দেশে যে কেউ ইসলাম পালন করলে তাকে এসব নামে ডাকা হয় — আমি সে অর্থে বলছিনা। যদি আপনি ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক চলতে চান, ইসলামকে নিজের জীবনের পরিচালিকা শক্তিরূপে গ্রহণ করে থাকেন, তবে পশ্চিমারা আপনাকে বলবে মৌলবাদী, সন্ত্রাসী, চরমপন্থী। এভাবে বিচার করলে সব মুসলমানই মৌলবাদী, সন্ত্রাসী। তাই আমি সন্ত্রাসী তাদেরই বলছি যারা শরীয়তের সীমালংঘনকারী। মাঝে মাঝে তাদের নিয়ত ভাল হতে পারে, তারা হয়ত বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থাকে পাল্টাতে চায়। তারা যেকোন উপায়ে লক্ষ্যে পৌছাঁবার নীতি গ্রহণ করেছে। তাদের শ্লোগান তাকবীর নয়, তাদের শ্লোগান হচ্ছে তাকফীর। তাকবীর অর্থ আল্লাহু আকবার আর তাকফীর অর্থ তুই একটা কাফের। নিজেরা বাদে ডানে বায়ে সবাইকে তারা কাফের বলে।
তারা বর্তমান মুসলিমদেরকে ঢালাওভাবে কাফের মনে করে এবং পরিশেষে সাধারণ মুসলিমদের হত্যা করা জায়েজ ধরে নেয়। এর নাম নাকি ইসলামী বিপ্লব। পশ্চিমা দেশকে তারা বলে দারুল হারব অর্থাৎ আমরা যুদ্ধাবস্থায় আছি। তাদের মতে যুদ্ধাবস্থায় যেকোন পথ অবলম্বন করা যায়। তাদের মতে এ অবস্থায় সুদ খাওয়া যায়, অনেকেতো ব্যাংক ডাকাতি করা যায় বলে ফতোয়া দিয়ে বসেছে।
বর্তমানে নিউইর্য়ক জেলে আঠারো থেকে বাইশ বছরের একদল মুসলিম তরুণ বন্দী। একজন নামকরা শেখ (বর্তমানে জেলে) ফতোয়া দিয়েছিলেন মুসলিমদের স্বার্থে আমেরিকায় ব্যাংক ডাকাতি করা জায়েজ। এই তরুণরা দেখল মুসলিমরা আমেরিকায় কষ্টে আছে, জমি ব্যয়বহুল বলে মসজিদ তৈরিতে অনেক টাকার দরকার; তাই তারা শর্টকাট হিসেবে ফতোয়াটা লুফে নিল। তারা কানেকটিকাট থেকে ফ্লোরিডা পর্যন্ত চৌদ্দ পনেরোটা ব্যাংক ডাকাতি করল এবং টাকাটা নিজেরা রাখল না। কিন্তু তাদের একজন ধরা পড়ে গিয়েছিল এবং সে সব ফাঁস করে দেয়ায় বাকি সবাই ধরা পড়ে যায়। এই তরুণরা যারা কলেজ পড়ুয়া, নববিবাহিত তারা এখন ৪৫ বছরের জন্য জেল খাটবে।
এ হলো আমাদের জাহেলিয়াতের অংশবিশেষ। আমাদের ধৈর্য বলতে কিছু নেই। ইসলামী আন্দোলন এমন কিছু নয় যার ফলাফল আমরা আগামীকালই আমাদের প্রজন্মে চোখের সামনে দেখতে পাব। এটা একমাত্র আল্লাহর হাতে। আমাদের কাজ হচ্ছে শুধু এর বীজটা বপন করা। আল্লাহ একে বাড়তে দিলে এটা বাড়বে। বীজটা বাড়লো কি বাড়লোনা এর জন্য আল্লাহ আমাদের দায়ী করবেন না, বরং আমরা বীজটা বুনেছিলাম কিনা তার জন্য জবাবদিহি করতে হবে। ইসলামের প্রসার ও ইসলামকে কায়েম করতে আমাদের তাই ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে।
যুক্তিবাদী চিন্তাধারায় মানুষ কুরআন ও সুন্নাহকে বিবেক বুদ্ধি দিয়ে বিচার করছে এবং যা তার প্রয়োজন তা গ্রহণ করছে আর যা দরকার নেই তা অস্বীকার করছে। এর সহজ উদাহরণ হচ্ছে ‘বাইবেল, কুরআন ও বিজ্ঞান’ বইটি। এই বইটি আমরা অমুসলিমদের মধ্যে বিতরণ করে থাকি। বইটির প্রথম নব্বই ভাগ কিছু ভুল থাকা সত্তেও চমৎকার, কিন্তু শেষ দশভাগে রাসুলুল্লাহর সুন্নতের উপর সরাসরি আক্রমণ করা হয়েছে। লেখক (মরিস বুকাইলি) বলেছেন, কুরআন যেহেতু আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিল হয়েছে তাই এটি বিজ্ঞানের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু তিনি কয়েকটি সহীহ হাদিস নিয়ে দেখাতে চেয়েছেন যে সেগুলো বিজ্ঞানের সাথে মিলছেনা, তাই তাঁর কাছে মনে হয়েছে এ কারণে সুন্নত পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য নয়। মাছির হাদীসের কথাই ধরা যাক, রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন
“যদি তোমাদের পাত্রে মাছি পড়ে তবে সেটি পাত্রে ডুবিয়ে ফেলে দিবে এবং এরপর পান করো; কারণ মাছির এক ডানায় রোগ ও অপর ডানায় এর উপশম আছে।” (আবু হুরায়রা কর্তৃক বর্ণিত সহীহ বুখারী ৪র্থ খন্ড ৫৩৭ নং হাদীস)একজন ডাক্তার হিসেবে লেখক বলেছেন মাছি শুধু রোগই ছড়ায়, এর উপশমের কোন তথ্য তাঁর জানা নেই। এজন্য তিনি বলেছেন হাদীসটি গ্রহণযোগ্য নয়। এটিকে বলা যায় যুক্তিবাদী চিনতাভাবনা। এরকম চিন্তায় অবশ্যই ত্রুটি আছে। আপনি যদি একশ বছর আগে কোন ডাক্তারকে বলতেন বিষ খেলে মানুষের হৃদরোগ ভালো হয়ে যাবে, তবে তিনি আপনাকে পাগল ভাববেন। কিন্তু সাপের বিষ যা স্নায়ুতন্ত্রের উপর কাজ করে তা দিয়ে আজকাল হৃদপিন্ড চালু রাখা হচ্ছে, বিষ দেয়া বন্ধ করলে রোগী মারা যাবে। আজকাল বাংলাদেশ ও অন্যান্য অঞ্চলে সাপের চাষ করা হয়, বিষ সংগ্রহ করে অস্ট্রিয়া এবং অন্যান্য দেশে পাঠানো হচ্ছে, সেই সাপের বিষ থেকে একটা অংশ নিয়ে হৃদরোগীর ওষুধও তৈরি হচ্ছে। এরকম আরেকটা উদাহরণ দিই। যারা বিস্ফোরক নিয়ে কাজ করেন, তারা জানেন নাইট্রোগ্লিসারিন কি করতে পারে। এটি আগের আমলের প্রথম সারির বিস্ফোরক। কেউ যদি বলে নাইট্রোগ্লিসারিন হৃদরোগীর জন্য পান করা ভাল, তবে অন্যরা হেসে বলবে ঝাঁকি খেলেই তো বিস্ফোরণে টুকরো টুকরো হয়ে যাব। কিন্তু আজকাল এই নাইট্রোগ্লিসারিন হৃদরোগীদের ওষুধ। তাই আজ যে সম্পর্কে আমরা বুঝে উঠতে পারছি না, যেমন মাছির মধ্যে উপশম দেখছি না, তার মানে এই নয় যে তা আসলেই নেই। এর অর্থ হচ্ছে আমাদের পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই।
আমরা জানি সাপের নিজের বিষের জন্য প্রতিষেধক আছে। যদি এর প্রতিষেধক না থাকতো তবে মৃত্যু নিশ্চিত ছিল। যদি এটি বিষ দিয়ে মারা কোন প্রাণী খায় তবে মারা যাওয়ার কথা। অনুরূপে প্রকৃতিতে অনেকেই ক্ষতি এবং এর প্রতিকার বহন করে। তাই সঠিক যুক্তিবুদ্ধি প্রয়োগ করলে আমাদের ডাক্তার সাহেব সুন্নতকে তর্কের খাতিরে আক্রমণ করতে পারতেন না।
এ প্রসঙ্গে আমি প্রায়ই একটি উদাহরণ দিয়ে থাকি আর তা হচ্ছে উপুড় হয়ে ঘুমানো। একটি হাদীসে আছে একজন সাহাবী উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা) তাকে বললেন উপুড় হয়ে ঘুমিয়ো না, আল্লাহ এরকরম পছন্দ করেননা। কেন আমরা উপুড় হয়ে ঘুমাবো না? অনেকে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন কিন্তু আমার কাছে তা যথাযথ মনে হয়নি। তাবলীগের লোকরা বলে সফরে গেলে উপুড় হয়ে ঘুমালে স্বপ্নদোষ হয়। তাহলে মহিলাদের উপুড় হয়ে ঘুমাতে সমস্যা কোথায়? আমি এই ব্যাখ্যা শুনে চুপ থেকেছি আর কাউকে জানাতে চাইনি। এর কয়েকদিন পর আমি প্লেনে ভ্রমণ করছিলাম, সেখানে দেখলাম টাইম ম্যাগাজিনে স্পাইনাল কর্ড অপারেশনের ক্ষেত্রে বড় বড় চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির কথা ছাপা হয়েছে। অপারেশনের নতুন ধরনের কলাকৌশল; ফাঁক হয়ে যাওয়া কশেরুকায় স্টীল পিন লাগানো ইত্যাদি চমৎকার সব ব্যাপার। অপারেশনের সবরকমের সমস্যা দেখে সবশেষে ডাক্তারদের পরামর্শও দেয়া হয়েছিল যার এক নম্বরে ছিল “উপুড় হয়ে ঘুমাবেন না”। যখন আমরা উপুড় হয়ে ঘুমাই তখন আমাদের শরীরের সবচেয়ে ভারী হাড় সমষ্টি মেরুদন্ডকে বহন করার জন্য চর্বি জাতীয় অঙ্গ ছাড়া আর কিছুই থাকেনা। ফলে মেরুদন্ড নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ে। বৃদ্ধ বয়সে কুঁজো হয়ে যাওয়ার এটাই প্রধান কারণ। ডাক্তাররা তাই পরামর্শ দেন এক পাশে কাত হয়ে হাটু ভাঁজ করে ঘুমাতে; রাসুলল্লাহ (সা) ঠিক তাই করতেন। মুসলিম উম্মাহ ১৪০০ বছর ধরে এ সুন্নত পালন করে আসছে।
এছাড়া চার বছর আগে ইংল্যান্ডে সাডেন ডেথ সিনড্রোম (এস.ডি.এস) বা কট-ডেথ নিয়ে গবেষণা হয়। এই রোগে দুই তিন বছরের শিশুরা ঘুমের মধ্যে কোন নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই মারা যায়। গবেষকরা যেসব পিতামাতার সন্তানরা এই রোগে মারা গেছে তাদের সাক্ষাৎকার নেন এবং যাবতীয় তথ্য (যেমন ঘরের তাপমাত্রা, বিছানার ধরন, আবরণ ছিল কি না ছিল ইত্যাদি) সংগ্রহ করেন। তারা সবক্ষেত্রেই দেখতে পান একটা ব্যাপার মিলে যাচ্ছে; বাচ্চাদের উপুড় করে শোয়ানো হয়েছিল। এটা নিয়ে হুলস্থুল বেঁেধ গিয়েছিল, পত্রিকার হেডলাইনে এসেছিল “শিশুদের উপুড় করে ঘুম পাড়াতে ডাক্তাররা মায়েদের নিষেধ করছেন”।
আবু দাউদে একটি সহীহ হাদীসে আলী (রা) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে
যদি ধর্মটা পুরোপুরি যুক্তির উপর ভিত্তি করে হতো তবে মোজার উপরে মাসেহ না করে তলদেশ মাসেহ করা হতো। আমরা অযুর সময় নিজেদের ধুয়ে পরিস্কার করি। যখন জুতা খুলে হাঁটি তখন মোজার কোন অংশটা ময়লা হয়? অবশ্যই নিচের অংশ। তাই অযু করার সময় তলা মাসেহ করাই তো যুক্তিযুক্ত। কিন্তু আলী (রা) বলেছেন “আমি রাসুলুল্লাহকে (সা) মোজার উপর মাসেহ করতে দেখেছি, তলা নয়।”আলী (রা) আমাদের যা বুঝিয়ে দিলেন তা আমাদের মনে রাখতে হবে। ধর্মের মধ্যে যুক্তি বুদ্ধি অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু যেখানে নবীজী কিছু বলেছেন তা আমরা যুক্তি দিয়ে সমালোচনা করিনা, আমরা তার কথা শুরুতেই মেনে নিই। তিনি মোজার উপর মাসেহ করতেন, আমরাও তা করি। কেউ বলতে পারেনা এ কাজটা যুক্তিযুক্ত হয়নি। আমাদের আসমানী ওহীকে যুক্তির উপর প্রাধান্য দিতে হবে। আমরা যুক্তিকে বাতিল করে দিচ্ছিনা কিন’ কোন কিছু না বুঝলেও আমরা ওহীর কথাই মেনে নিব।
আমরা বর্তমানকালের জাহেলিয়াত বা অজ্ঞতার কারণস্বরূপ যেসব সমস্যার কথা আলোচনা করলাম তা হচ্ছে –
- ১. ঐতিহ্যবাদ : এই মতবাদ থেকে বেদ’আত জন্ম নিয়েছে যা আমাদের শিরকের দিকে ধাবিত করছে। সুফি মতবাদ সৃষ্টি করছে দুর্নীতি। ঐতিহ্যবাদের তৃতীয় রূপ হচ্ছে মাযহাব যা কুরআন্তসুন্নাহর থেকে মানুষকে দূরে ঠেলে দিয়েছে এবং জন্ম দিয়েছে অনাকাঙ্খিত দ্বন্দ্বের।
- ২.যুক্তিবাদ: যুক্তিবাদীদের অবদান আধুনিকতা, চরমপন্থা ও ধর্মনিরপেক্ষতা।
সমাধান:
এই সব সমস্যার সমাধানও আমাদের জানা দরকার। সমস্যা আসলে খুব সহজ, মানুষ আজ ওহী দ্বারা পরিচালিত নয়; সমাধানও সহজ, মানুষকে ওহীর আলোকে পরিচালিত করতে হবে অর্থাৎ আমাদের ইসলামী শিক্ষার দিকে মন দিতে হবে। বর্তমানের মুসলিমদের এই অবস্থা পরিবর্তন করা সম্ভব নয় যতক্ষণ না মুসলিমদের সঠিকভাবে ইসলমী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা হচ্ছে। একজন খলীফা হলেই সব কিছু পাল্টে যাবেনা – যেমনটি অনেকে দাবী করে থাকে। কোন নেতাকে উৎখাত করে একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক বসাতে পারলেই সব পরিবর্তন হয়ে যাবে তা নয়। ত্রিনিদাদে এরকম চেষ্টা করা হয়েছিল, ইয়াসিন ও তার ভাইয়েরা কুদেতার মাধ্যমে বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিল। অধিকাংশ লোকই যদি ইসলাম সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ থাকে, ইসলামের নামে মিসলাম বা অন্যকিছু পালন করে তবে তারা ক্ষমতায় এসে জোর করে কিছু চাপাতে পারতো? এজন্য নবীদের কর্মপন্থা ছিল আগে ভিত্তি তৈরি করা, যথেষ্ট পরিমাণ লোককে ইসলাম সম্পর্কে শিক্ষিত করে তোলা; এর পর তারাই নেতৃত্ব ঠিক করে নেবে। যেমনটি একটি হাদীসের ভাবার্থ হচ্ছে, নেতা তেমনই হবে যেমনটা তার অনুসারীরা। সর্বোপরি জনসাধারণই নেতা নির্বাচন করে। কিন্তু তারা যদি অজ্ঞ হয় তবে তাদের নেতাও হবে অজ্ঞ। এভাবে অজ্ঞতারই জয় হয়। তারা যদি সচেতন হয়ে উঠে তবে তারা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী নেতা দাবী করবে। তাই সঠিক পদ্ধতি হচ্ছে নিচের থেকে উপরে উঠা, উপর থেকে নিচের দিকে নামা নয়।বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে আমাদের সারা মুসলিম জাহানে মুসলিম স্কুল গড়ে তুলতে হবে। সেসব স্কুলে ইসলামী শিক্ষা ও বর্তমানে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাকে একত্র করতে হবে। মূলত এই দুই শিক্ষা একই জিনিস, আমরা একে পৃথক করে দেখি। আমরা যে স্কুলে গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যা পড়াই সেখানে এক পিরিয়ড রাখি ইসলামী শিক্ষা বা কুরআনের জন্য। কিন্তু এটা কোন সমাধান হতে পারেনা। এই পদ্ধতি অবলম্বন করলে ছাত্রদের মধ্যে এক মানসিক রোগ সৃষ্টি হয়, তারা ভাবে ধর্ম ও জীবন আলাদা তাই প্রাত্যহিক জীবনে আমাদের গতানুগতিক শিক্ষার দরকার, ধর্মের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই!
আমরা যখন বিজ্ঞান,ইংরেজি,গণিত পড়াবো তখন মুসলিমদের দিয়ে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে পড়াতে হবে। গণিতকে আবার ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে পড়ানো যায় নাকি? বেশ, এটা বাচ্চাদের বুঝতে দিন যে গণিতের বিকাশে মুসলিমদের বড় ও মৌলিক অবদান রয়েছে। কোন মুসলিম পন্ডিতের নাম আসলে আপনারা তাদের জানান, মুসলিমরাই এসব আবিস্কার করেছে, ধর্ম ও জ্ঞান পৃথক নয়। কুরআন ও হাদীসে অনেক গাণিতিক বিষয় আছে, এগুলোও পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এভাবে ছাত্রছাত্রীরা ধর্ম ও শিক্ষার সম্পর্ক বুঝতে পারবে।
প্রতিটা বিষয়ে কিভাবে ধর্মের সাথে সম্পর্কযুক্ত করা যায়? এই ক্ষেত্রটিতে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরী। বিশ্বাস করুন কাজটি অসম্ভব নয়। অতীতের মুসলিম বিজ্ঞানীরা আলোকবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, এলজ্যাবরা, পদার্থবিদ্যাতেই শুধু পারদর্শী ছিলেননা তারা হাদীসশাস্ত্র, ফিকহবিদ্যাতেও দক্ষ ছিলেন। যা কিছু সত্য তা আল্লাহর কাছ থেকেই আগত। আমাদের নতুন শিক্ষানীতি দরকার যার লক্ষ্য হবে এমন মুসলিম স্নাতক তৈরী করা যারা মুসলিম সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবে। তারা নিজেদের বন্ধনমুক্ত মনে করবেনা, যা খুশি তাই করবেনা। তারা চিন্তা করবে আল্লাহর দয়ায় এবং মুসলিম ভাইদের জন্য আমি আজ এ পর্যায়ে পৌঁছাতে পেরেছি। মুসলিম সমাজ আমার জন্য যে আত্মত্যাগ স্বীকার করেছে তার জন্য আমি ঋণী, আমি যা শিখেছি তা আমার তাদের উপকারে লাগানো উচিত। আমি মুসলিমদের মঙ্গলের জন্য সেবা করবো এবং নিজের কিছু সময় গরিবদের বিনামূল্যে সেবার জন্য (ডাক্তার, উকিল ইত্যাদি পেশায়) দিব। আমার পেশাই আমার সদকা। এভাবেই আমরা ভবিষ্যতকে পরিবর্তন করতে পারি।
সমাপ্ত