get-fans-468x60

Tuesday, May 17, 2011

কুরআন ও আধুনিক বিজ্ঞান




শেখ আবদুর রহিম গ্রীন
 পর্ব ১: ইসলাম : একটি ধারণা !
পর্ব ২ : সংঘাত অথবা সংঘাত নয়?
পর্ব ৩ : মৌলবাদীদের অদ্ভুত ব্যাপার
পর্ব ৪ : এ সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই!
পর্ব ৫ : সাক্ষ্যপ্রমাণের গুরুত্ব
পর্ব ৬ : একটি সুচিন্তিত অনুসন্ধান
পর্ব ৭ : আহলে কিতাব: ভবিষ্যদ্বাণী, পূর্বাভাস ও অতীত ঘটনাবলী 

পর্ব ১ : ইসলাম : একটি ধারণা !

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, আমরা তাঁর প্রশংসা করি এবং আমরা তাঁর সাহায্য চাই এবং তাঁর ক্ষমা চাই। আমরা আমাদের নফসের মন্দ থেকে এবং আমাদের কর্মের মন্দ থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ একমাত্র ইবাদতের যোগ্য এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা এবং সর্বশেষ রাসূল। আল্লাহ শেষ এবং চূড়ান্ত রাসূল মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবার এবং তাঁর অনুসারীদের প্রতি শান্তি ও রহমত বর্ষণ করুন। আমীন!
শুরুতে: সর্বোত্তম উপদেশ হচ্ছে আল্লাহর কিতাব, এবং সর্বোত্তম পথ হচ্ছে মুহাম্মাদের অনুসৃত পথ, এবং দ্বীনের মাঝে নিকৃষ্টতম বস’ হচ্ছে নতুন উদ্ভাবনসমূহ, কারণ দ্বীনে প্রতিটি নব উদ্ভাবন হচ্ছে বিপথগামীতা, প্রতিটি বিপথগামীতা হচ্ছে সরল পথ থেকে বিচ্যুতি, আর প্রতিটি বিচ্যুতির পরিণাম জাহান্নাম।
আমি ‘দি ইকোনমিস্ট’ ম্যাগাজিনের জরিপের বিষয়বস্তু ‘ইসলাম এবং পশ্চিম’ (আগস্ট ৬, ১৯৯৪ সংখ্যা, বড় আকারে সন্নিবেশিত) সম্পর্কে বিশেষভাবে বিবেচনার পর সমালোচনা লিখতে শুরু করেছি, এবং নিঃসন্দেহে আল্লাহ সর্বোত্তম সাহায্যকারী। নোয়াম চমস্কি যাকে “বানানো সম্মতি” বলছেন, ব্রায়ান ব্রিডহ্যামের পক্ষে তার উপর নির্ভর করা সম্ভব। যেক্ষেত্রে একনায়কতন্ত্র লোকের সম্মতি আদায় করতে ও বিরোধিতা ঠেকাতে শক্তি প্রয়োগ করে, সেখানে “গণতন্ত্র” প্রচার মাধ্যমকে বিশেষ বিশ্বব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করে সম্মতি তৈরী করতে ব্যবহার করে থাকে। যা কমবেশী শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। ছোট, সংক্ষিপ্ত আকারের একটি প্রবন্ধ লিখে সে পার পেয়ে যেতে পারে, কারণ তাকে তার অধিকাংশ বক্তব্যই প্রমাণ করতে হয় না, তাকে শুধু জোড়া দেওয়া, প্রচলিত মামুলি মন্তব্যসমূহের পুনরাবৃত্তি করতে হয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, যখন তিনি আলজেরীয় মুসলিমদের “একদল ইসলামী বিদ্রোহী যারা আপোষহীনতার বৈশিষ্ট্যসূচক, সবচেয়ে নিষ্ঠুর প্রকৃতির মৌলবাদী” হিসাবে বর্ণনা করেন, তাঁকে সেটা প্রমাণ করতে হয় না, কারণ কর্তৃপক্ষ এটা ইতোমধ্যেই নিশ্চিত করেছে যে এটাই সত্য বলে লোকে বিশ্বাস করবে। আসলে বিবৃতিটি মোটেও সত্য নয়। আলজেরীয় মৌলবাদীরা প্রমাণ করেছে যে তারা নির্বাচন করতে এবং ইসলামী শরীয়া পুনঃপ্রতিষ্ঠার শান্তিপূর্ণ উপায় খুঁজে পেতে ইচ্ছুক। সামপ্রতিক ঘটনাবলী, যেমন রোমে “বিদ্রোহী মৌলবাদী”দের অন্তর্ভুক্ত করে বিরোধী গ্রুপগুলির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে-যা ফরাসী সরকার পর্যন্ত সমর্থন করেছে এবং আলজেরীয় সরকার প্রত্যাখ্যান করেছে-এটাই প্রকাশ করছে যে আলজেরীয় সরকারই বরং নিষ্ঠুর মানসিকতার অধিকারী। এ ধরনের স্পষ্ট প্রতীয়মান অসামঞ্জস্য সত্ত্বেও জনাব ব্রিডহ্যাম কোন জবাবদিহিতার সম্মুখীন হন না, কারণ এই ঐকমত্য আগেই তৈরি হয়ে আছে যে মৌলবাদীরাই বিদ্রোহ পরায়ণ ও নিষ্ঠুর মানসিকতার অধিকারী।
একইভাবে তিনি কখনোই অনুভব করেন না যে তাঁকে প্রমাণ করতে হবে যে গণতন্ত্র একটি সুবিধা, এটা প্রায় সম্পূর্ণ স্বতঃসিদ্ধ হিসেবেই ধরে নেওয়া হয়েছে, কারণ তিনি জানেন যে তাঁর শ্রোতাবৃন্দ বলতে গেলে প্রায় “বন্দী”। আওয়াজের হুল-ফোটানোর (হয়তো এক্ষেত্রে শব্দের হুল-ফোটান) এই যুগে, প্রচলিত জ্ঞানের বিরুদ্ধে যাওয়া সহজ নয়, কারণ জনাব ব্রিডহ্যামের মত লোকেরা যা একটি বাক্যে বলেন, তার বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেলে সেটি একটি বই হয়ে যাবে। তারপরও তার কার্যকারিতায় সন্দেহ থেকে যাবে, কারণ সমাজের মূল্যবোধের বিরোধিতা করা আমাদের মত স্বভাবগত সামাজিক জীবের জন্য অত্যন্ত কঠিন পথের একটি। এজন্য আমি একগুচ্ছ প্রবন্ধ লিখব, একটি নয়, যাতে আমার সমালোচনাটিকে অনেকগুলি সাজানো-গোছানো খণ্ডে ভাগ করা যায়। কিছু বিষয় আমি পরিশিষ্টেও উল্লেখ করবো, যাতে ভিডিও এবং অডিও টেপও অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

ইসলাম : একটি ধারণা!

নিঃসন্দেহে কোন মুসলিম ইসলামকে কেবলমাত্র একটি ধারণা হিসাবে গ্রহণ করতে পারে না। জরিপে যা উল্লেখিত হয়েছে তা হলো, ইসলামের ভিত্তি হচ্ছে “আল্লাহর বাণী, যা চৌদ্দশত বছর আগে প্রতিটি শব্দাংশে মুহাম্মাদের উপর অবতীর্ণ হয়েছিল” (পৃ. ৪, অ. ২)। অর্থাৎ এটা ধারণামাত্র নয়, বরং এটাই ধারণা, এটাই আদর্শ, এটাই সত্য, অন্য সব কিছু বাদে। কুরআন যেমন বলছে:
“নিঃসন্দেহে আল্লাহর কাছে দ্বীন হচ্ছে ইসলাম” … “এবং যে কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মকে জীবন বিধান হিসাবে চাইবে, তা কখনও গ্রহণ করা হবে না এবং আখিরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের দলভুক্ত” (সূরা আলে-ইমরান ৩:৮৫)।
দ্বীনকে সম্পূর্ণ এবং বিশুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে, এবং পরিবর্তন বা খাপ খাওয়ানোর কোন প্রয়োজনীয়তা নেই: “আজ আমরা তোমাদের দ্বীনকে তোমাদের জন্য সম্পূর্ণ করে দিয়েছি এবং আমাদের অনুগ্রহ তোমাদের উপর পরিপূর্ণ করেছি এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসাবে মনোনীত করেছি।” নবী (সঃ) আরো বলেছেন: “ আমি এমন কোন কিছু জানাতে বাদ রাখিনি যা তোমাদের জান্নাতের নিকটবর্তী করবে ও জাহান্নাম থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে, এবং এমন কোন কিছু থেকে সতর্ক করতে বাকী রাখিনি যা তোমাদেরকে জান্নাত থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে ও জাহান্নামের নিকটবর্তী করবে।” এটা নিঃসন্দেহে সত্য যে ইসলাম তার অনুসারীদের জীবনের “আভ্যন্তরীণ” ও “বাহ্যিক” বিশ্বাস এবং কর্ম, ধর্ম ও রাজনীতি এসবের মাঝে পার্থক্য করা অনুমোদন করে না, কারণ বাস্তবে এসব পার্থক্য সম্পূর্ণ প্রতারণামূলক। মানুষের বিশ্বাস হচ্ছে তার কর্মের ভিত্তি ও প্রধান চালিকাশক্তি, কারণ যা কিছু অন্তরে সত্যি বলে মনে করা হয়, বাইরে অবশ্যই তার প্রকাশ ঘটে। কার্যতঃ মুহাম্মাদ (সঃ) কে সর্বপ্রথম যে কাজ দেওয়া হয়েছিল, তা হচ্ছে ভুল বিশ্বাসকে সংশোধন করা। মুশরিক আরবরা যে আল্লাহতে, বা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করত না তা নয়। বস্তুতঃ কুরআন মুহাম্মাদ (সঃ) কে বলছে:
“তুমি যদি তাদের জিজ্ঞাসা কর আকাশ থেকে কে বৃষ্টি বর্ষণ করে? তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ!’ বল: ‘সমস্ত প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা আল্লাহরই!’ না! তাদের অধিকাংশেরই কোন চেতনা নেই।” (সূরা আনকাবুত ২৯:৬৩)
“বল: ‘কে তোমাদের আকাশ ও পৃথিবী থেকে জীবনোপকরণ সরবরাহ করে অথবা শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি কার কর্তৃত্বাধীন? কে মৃত থেকে জীবিতকে নির্গত করে এবং সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে?’ তখন তারা বলবে, ‘আল্লাহ!’ বল: ‘তবুও কি তোমরা সাবধান হবে না’?” (সূরা ইউনুস ১০:৩১)
সত্যি বলতে কি মুশরিক আরবরা প্রয়োজন ও কষ্টের সময় আল্লাহর ইবাদত করত, তাঁর কাছে প্রার্থনা করত এবং কুরবানী করত, ইহুদী ও খৃস্টানদের মত, এবং তারা এমনকি আল্লাহকে ভালবাসার দাবীও করতো, কিন্তু তাদের এ সবকিছুই আল্লাহ প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং তাদেরকে নির্বোধ ও বিপথগামী হিসাবে উল্লেখ করেছেন এবং অবিশ্বাসী বলেছেন। অতএব এটাই অধিকাংশ মানুষ ও জ্বিনের বেলায় বাস্তবতা যে তারা দাবী করে যে তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে ও আল্লাহর ইবাদত করে, কিন’ আল্লাহ সম্পর্কে তারা যা বিশ্বাস করে তা অশুদ্ধ, এবং তাদের ইবাদতের পদ্ধতিও সঠিক নয়…
“তাদের অধিকাংশ আল্লাহতে বিশ্বাস করে কিন’ তাঁর শরীক করে” (সূরা ইউনুস ১২:১০৬)
… এবং এর প্রকাশ বিভিন্ন এবং অশুভ ফলাফল অগণিত।
এসব কিছুরই একটি সাধারণ কারণ বা মূল আছে, তা হচ্ছে কোন জ্ঞান ছাড়া আল্লাহ সম্পর্কে চিন্তা করা ও বলা, এভাবে তাঁর প্রতি এমন কিছু আরোপ করা যা তাঁকে আরোপ করা যায় না, যেমন পুত্র অথবা কন্যা, বা মানবীয় গুণ ও দোষসমূহ, বা এমন দাবী করা যে তাঁর কোন সৃষ্টি তাঁর শক্তি ও সামর্থ ধারণ করে, বা এমন কোন কাজে তিনি ক্রুদ্ধ হন বলে মনে করা যা আসলে তাঁকে সন্তুষ্ট করে। সুতরাং এভাবে মূর্তিপূজারীরা এমন কাউকে ডাকে যে তাদের কোন ভাল বা মন্দ কোনটাই করতে পারে না, এবং খৃস্টানরা যীশুকে ডাকে, এবং ইহুদীরা বিশ্বাস করে তাদের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব তাদেরকে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য করবে, এবং যারা বিশ্বাস করে যে সাফল্যের উপায় হলো শক্তি, সম্পদ ইত্যাদি ; তারা সকলেই তাদের বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করেছে অসার জিনিসে – এটা নিজেই একটা বিরাট মন্দ, কারণ তারা শুধু তাদের সময় এবং প্রচেষ্টা বিনষ্ট করেছে, যদিও এটাই সবচেয়ে কম খারাপ পরিণতি। সবচেয়ে যা গুরুতর তা হচ্ছে… যারা আল্লাহর সাথে শিরক করে তাঁর ক্রোধ এবং আযাব অর্জন করেছে, এবং তাদের উপর দুনিয়াতেও লাঞ্ছনা রয়েছে আর আখিরাতে ভয়ঙ্কর পরিণতি
“নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শিরক করার অপরাধ ক্ষমা করেন না। এছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন” (সূরা আন-নিসা ৪:৪৮)।
সুতরাং “শিরক” বা আল্লাহর অংশী স্থাপন করা (তা যেভাবেই হোক না কেন) হচ্ছে ক্ষমার অযোগ্য পাপ, কারণ বাস্তবে এটা সকল অমঙ্গলের মূল, সবচেয়ে বড় অবিচার, নিকৃষ্ট জুলুম এবং কুকাজ। এটা এজন্য যে কেউ যদি আল্লাহ সম্পর্কে না জেনে মন্তব্য করতে দ্বিধা না করে – যে জ্ঞান তাঁর মাধ্যমে ছাড়া অর্জন করা যায় না যেহেতু তিনিই নিজের সম্পর্কে এবং নিজের ইচ্ছা সম্পর্কে এবং কি তাঁকে সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট করে, সে সম্পর্কে সবচেয়ে ভাল জানেন – তাহলে অন্য কার সম্পর্কে কেউ মূর্খের মত কথা বলতে ভয় করবে? সত্যিই, যে প্রকৃতির ধ্বংসকারী শক্তি সম্পর্কে সচেতন, এ দুনিয়ায় ও পরকালে যেসব অকথ্য দুর্ভাগ্য ও দুর্দশা মানুষের জন্য রয়েছে যার উপর আল্লাহ ছাড়া আর কারো কোন শক্তি ও নিয়ন্ত্রণ নেই তা বোঝে, তার কাছে এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে আল্লাহই হচ্ছেন সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং ভয়ের যোগ্য। এবং যে কেউ পৃথিবী ও মহাবিশ্বের ভিতরের অলৌকিক শৃঙ্খলা, খুঁটিনাটি ব্যাপারে যথাযথতা ও জীবজগতের পরস্পর নির্ভরশীলতা খেয়াল করে দেখবে, অবশ্যই সে এসবের সৃষ্টিকর্তার অতুলনীয় জ্ঞান ও বিজ্ঞতা অনুধাবন করবে। সুতরাং কেউ যদি আল্লাহর আইন লংঘন করার ব্যাপারে বেপরোয়া হয় এবং সেগুলিকে ক্ষুদ্র বা তুচ্ছ মনে করে অথবা আরো খারাপ ব্যাপার হচ্ছে যদি সেগুলিকে খারাপ, অশুভ এবং বাতিল বলে মনে করে, তাহলে মানুষের সীমাবদ্ধ ধ্যান-ধারণা-উদ্ভূত আইনের বেলায় কি হবে? কেউ যদি তার সৃষ্টিকর্তা ও রিযিকদাতার প্রতি অকৃতজ্ঞ হতে পারে, তাহলে তার কাছে সৃষ্টির প্রতি অকৃতজ্ঞতা কি অত্যন্ত সামান্য ব্যাপার বলে মনে হবে না? আল্লাহর অধিকার ও তাঁর প্রতি কর্তব্যসমূহ, যা সবচেয়ে বেশী পূরণ-যোগ্য, কেউ যদি তা অস্বীকার করে, তাহলে সে আর কোন অধিকার ও দাবী অস্বীকার করতে ভয় করবে? কল্পনা করুন আপনার কোম্পানীর একজন শ্রমিকের কথা, যে আপনাকে মনে করে ঝাড়-দার এবং ঝাড়-দারকে মনে করে কোম্পানীর পরিচালক! সেখানে কি কুফল দেখা দেবে না? আপনি কি এমন লোককে সহ্য করবেন? যদি করেন, কতক্ষণ পর্যন্ত? এখন ভেবে দেখুন এই নির্বোধ অন্যদের বোঝাচ্ছে ও বাধ্য করছে এতে বিশ্বাস করতে, এবং অধিকাংশই আপনার আদেশ ও নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নিজের পছন্দমত নিয়ম তৈরী করছে এবং ঝাড়ুদারকে নিজেদের নেতা মেনে চলছে যে আসলে বধির ও বোবা!
যেসব মন্দ মানুষকে প্রলুব্ধ করে তার আসল কারণ হচ্ছে অবিশ্বাস, পাপপ্রবণতা ও আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞতা:
“তোমাদের যে বিপদাপদ ঘটে তা তোমাদেরই কৃতকর্মের ফল এবং তোমাদের অনেক অপরাধ তিনি ক্ষমা করে দেন” (সূরা আশ-শূরা, ৪২:৩০)
“মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলেস্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে তাদের কোন কোন কর্মের শাস্তি তাদের আস্বাদন করান হয় যাতে তারা সৎপথে ফিরে আসে” (সূরা আর রুম, ৩০:৪১)
যেমন নবী (সঃ) বলেছেন:
“আল্লাহর চেয়ে বেশী মর্যাদা-বোধ সম্পন্ন (গাইরা: কারো সম্মান বা মর্যাদা আহত হলে বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হলে যে প্রচণ্ড রাগ ও ক্রোধের অনুভূতি হয়) কেউ নেই, এবং তাই তিনি লজ্জাজনক কাজ ও পাপকাজ নিষেধ করেছেন। এবং আল্লাহর চেয়ে বেশী প্রশংসা পছন্দকারী কেউ নেই” (সহীহ বুখারী)।
কোন মানুষ তার স্ত্রীকে অন্যের সাথে যিনা করতে দেখলে যত না ক্রুদ্ধ হয়, আল্লাহ তার চেয়েও বেশী ক্রুদ্ধ হন তাঁর বান্দার অবাধ্যতায়। তাহলে যারা তাঁর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বী ও অংশীদার স্থাপন করে তাঁকে অপমান করে, যা থেকে তিনি মুক্ত, তাদের প্রতি তাঁর ক্রোধ কতখানি হতে পারে! এবং এর অশুভ পরিণতি এই জীবনে সীমাবদ্ধ নয়:
“নিশ্চয় যারা অবিশ্বাস করেছে এবং অবিশ্বাসী অবস্থায় মারা গেছে, তাদের পক্ষে পৃথিবী-পূর্ণ স্বর্ণ বিনিময় স্বরূপ প্রদান করলেও কখনো তা কবুল করা হবে না। এ সকল লোকের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি এবং এদের কোন সাহায্যকারীও নেই” (সূরা আলে ইমরান, ৩:৯১)।
নবী (সঃ) ব্যাখ্যা করেছেন:
“বিচার দিবসে একজন অবিশ্বাসীকে জিজ্ঞাসা করা হবে: ‘মনে কর তোমার কাছে পৃথিবী-পূর্ণ স্বর্ণ রয়েছে, তুমি কি তা জাহান্নামের আগুনের বদলে মুক্তিপণ হিসাবে দান করবে?’ সে বলবে: ’হ্যাঁ’। তখন তাকে বলা হবে: ‘তোমাদেরকে এর চেয়েও সহজ কিছু করতে বলা হয়েছিল, তা এই যে তোমরা আল্লাহর ইবাদতে কাউকে শরীক করো না এবং আল্লাহর আনুগত্য কর, কিন্তু তোমরা প্রত্যাখ্যান করেছিলে।” (বুখারী)
নিঃসন্দেহে সকল নবীর বক্তব্য/বাণী ছিল এক ও অভিন্ন:
“আল্লাহর উপাসনা করার ও তাগুতকে (সে সমস্ত সত্তা, যাদেরকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার পাশাপাশি ইলাহ বা প্রভু হিসেবে বিবেচনা করা হয়) বর্জন করার নির্দেশ দেবার জন্য আমি অবশ্যই প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল পাঠিয়েছি” (সূরা আন নাহল, ১৬:৩৬)
এবং নিঃসন্দেহে আল্লাহ এজন্যই মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন:
“আমার দাসত্বের জন্যই আমি মানুষ ও জ্বিনকে সৃষ্টি করেছি।” (সূরা আয-যারিয়াত, ৫১:৫৬)
সুতরাং “শিরক” (আল্লাহ সাথে অংশী স্থাপন করা) সেই কারণের বিপরীত যেজন্য আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন, এবং আমাদের অস্তিত্বের উদ্দেশ্যের বিরোধী, যা হচ্ছে আল্লাহকে এককভাবে ইবাদতের জন্য বেছে নেওয়া, সমস্ত মিথ্যা উপাস্যকে ত্যাগ করা, ত্যাগ, দোয়া, আত্মসমর্পণ, অধীনতা, বাধ্যতা ও সম্মতির সাথে এবং ভালবাসা, ভয়, আশা, বিশ্বাস ও আস্থার সাথে সম্পূর্ণভাবে তাঁর ইবাদত করা, শুধুমাত্র তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করা-তাঁর সৃষ্টির প্রশংসা কামনা না করা, এবং সবকিছুই তাঁর শেষ ও চূড়ান্ত রাসূল মুহাম্মাদ (সঃ) এঁর উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে সেই অনুযায়ী করা, এবং নিজের খেয়াল ও প্রবৃত্তি এবং অনুমানবশতঃ না চলা।
এই আলোচনার সাথে প্রাসঙ্গিকতাপূর্ণ হিসাবে আল্লাহর এই সমস্ত গুণাবলী উল্লেখ করা যায় যা শুধু আল্লাহরই বৈশিষ্ট্য এবং তাঁকে এককত্ব দান করে। যেমন হাকিম-বিচারক, হাকীম-বিজ্ঞ, আলীম-সর্বজ্ঞানী এবং শারঈ-বিধানদাতা। আল্লাহ শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তা, নিয়ন্ত্রণকারী ও পালনকর্তা নন, মানবজাতির বিধান দেওয়ার ব্যাপারে এককভাবে জ্ঞান ও বিজ্ঞানসম্পন্ন এবং ভাল-মন্দ, ভুল-শুদ্ধ, হালাল ও হারামের নির্ধারক এবং কোন আইন অনুসারে আমরা বিচার করব, কোন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা আমরা গ্রহণ করব সেসবের নির্ণায়ক…
“তিনি কাকেও নিজ কর্তৃত্বের অংশী করেন না” (সূরা আল-কাহফ, ১৮:২৬)… “বিধান দেবার অধিকার কেবল আল্লাহরই” (সূরা ইউসুফ, ১২:৪০)।
আল্লাহ ইহুদী ও খৃস্টানদের সতর্ক করেছেন এবং তাদেরকে অবিশ্বাসী বলেছেন, কারণ
“…তারা আল্লাহ ব্যতীত তাদের পণ্ডিতগণকে এবং সংসার বিরাগীগণকে তাদের প্রতিপালকরূপে গ্রহণ করেছে” (সূরা আত-তাওবা, ৯:৩১)।
নবী (সঃ) বর্ণনা করেছেন যে তাদের পণ্ডিত ও ধর্মযাজকরা “আল্লাহ যা অবৈধ করেছেন তাকে বৈধ বানিয়েছে আর আল্লাহ যা বৈধ করেছেন, তাকে অবৈধ করেছে এবং লোকেরা তা গ্রহণ করেছে…। সুতরাং এটাই হচ্ছে তাদেরকে লোকেদের ইবাদত করা।” সুতরাং মানুষকে কর্তৃত্বের ক্ষমতা দেওয়া পরিষ্কার ও স্পষ্ট প্রতীয়মান অবিশ্বাস এবং শিরক করা বা আল্লাহর সাথে অংশী স্থাপন করা যা ক্ষমার অযোগ্য পাপ এবং সৃষ্টির উদ্দেশ্যের বিপরীত। যদি আল্লাহ ইহুদী ও খৃষ্টানদের দোষারোপ করে থাকেন তাদের কিতাব ও ঐশী বিধানের জ্ঞানে জ্ঞানী লোকদের কাছ থেকে বিধিবিধান গ্রহণের জন্য যারা সেগুলিকে পরিবর্তন ও বিকৃত করেছিল এবং হারামকে হালাল ও হালালকে হারাম করেছিল, আজ পর্যন্ত তারা যা করে চলেছে, তাহলে তাদের বেলায় কি বলা যাবে যারা এসব বিধিবিধান টম, ডিক, হ্যারী যে কারো কাছ থেকে গ্রহণ করে যাদের কোন কিতাব নেই বা কোন প্রজ্ঞা নেই কেবল অনুমান, খেয়ালখুশী এবং প্রবৃত্তির আকাঙ্খা ছাড়া যেমন গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে?!?
অতএব, ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিনের জরিপটি স্বীকার করছে যে ইসলাম ভিতরে ও বাইরে, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে পার্থক্য করে না, তবু তারা পরামর্শ দিচ্ছে যে মুসলিমরা যেন এটা বর্জন করে, এবং আল্লাহর বিরুদ্ধে নিকৃষ্টতম ভুল, অবাধ্যতা ও বিদ্রোহ করে এবং শিরক করে তাঁর প্রতি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করে। আল্লাহ সত্যি বলেন যখন তিনি বলেন:
“ইহুদী ও খৃষ্টানরা তোমার প্রতি কখনো সন্তুষ্ট হবে না যতক্ষণ না তুমি তাদের ধর্মাদর্শ অনুসরণ কর” (সূরা আল-বাকারা, ২:১২০)
এবং আমরা এ থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাই, তা না হলে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।
ইসলাম ও পশ্চিমা বিশ্ব কি বিরোধিতার সম্মুখীন?
জনাব হান্টিংটনেরThe clash of the Civilizations‘ দাবী করছে “হ্যাঁ”, কিন্তু  জরিপে এ বিষয়ে কোন “দৃঢ় প্রত্যয়” ব্যক্ত করা হয়নি। এটা সত্যি যে কনফুসিয়হিন্দু সভ্যতার চাইতে মুসলিম ও পশ্চিমা বিশ্ব পরস্পরের কাছাকাছি, কিন্তু বাস্তবে জনাব হান্টিংটন ও জনাব বিডহ্যামের তুলনামূলক আলোচনা এ বিষয়ের সত্যতার উপর আলোকপাত করার ব্যাপারে অপ্রতুল। যা জনাব বিডহ্যাম স্বীকার করেছেন তা হলো যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যগুলি (পশ্চিমাদের অবিশ্বাস যে কুরআন আল্লাহর বাণী ও মুসলিমদের অবিশ্বাস যে যীশু আল্লাহর পুত্র) হচ্ছে মীমাংসার অযোগ্য, অন্ততঃ মুসলিমদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে…
“তারা বলে, ‘আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন’ তোমরা তো এক অদ্ভুত কথা সৃষ্টি করেছ। (যার জন্য) হয়তো আকাশমণ্ডলী বিদীর্ণ হয়ে যাবে, পৃথিবী বিদীর্ণ হবে ও পর্বতমণ্ডলী চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। তারা দয়াময়ের প্রতি সন্তান আরোপ করত। সন্তান গ্রহণ করা দয়াময়ের জন্য শোভন নয়! আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে এমন কেউ নেই, যে দয়াময়ের কাছে দাসরূপে উপস্থিত  হবে না” (সূরা মারিয়াম ১৯:৮৮-৯৩)
ইসলাম সে সমস্ত খৃষ্টানকে “একেশ্বরবাদী” বলে স্বীকার করে না যারা দাবী করে যে যীশু আল্লাহ বা আল্লাহর পুত্র, সেসব হিন্দুদের মত যারা দাবী করে যে কৃষ্ণ “ভগবানের অবতার/ভগবানের প্রকাশ” বা বৌদ্ধদের মত যারা বলে বুদ্ধই ভগবান। এগুলি সবই কুফর এবং বহুঈশ্বরবাদ। এটাই দ্বন্দ্বের ভিত্তি। এই দ্বন্দ্ব শুধু বৈধই নয়, বরং কুরআনে এর হুকুম করা হয়েছে:
“যাদের প্রতি কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে তাদের মধ্যে যারা আল্লাহতে বিশ্বাস করে না ও পরকালেও নয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা নিষিদ্ধ করেছেন তা নিষিদ্ধ করে না এবং সত্য ধর্ম অনুসরণ করে না, তাদের সাথে যুদ্ধ করবে যে পর্যন্ত না তারা নত হয়ে আনুগত্যের নিদর্শন স্বরূপ স্বেচ্ছায় জিজিয়া দেয়।” (সূরা আত-তাওবা, ৯:২৯)
এটা সভ্যতার বিপরীতমুখী অবস্থান নয় বা সংস্কৃতির সংঘাতও নয়। ইসলাম কখনো অতীত শত্রুতার বশে আহত গর্ব পুনরুদ্ধারের ইচ্ছা থেকে বা সম্পদ ও ভূমি স্তূপীকৃত করে রাখার ইচ্ছা থেকে পশ্চিমা বিশ্ব বা অন্য কারো বিরোধিতা করে না। শুধুমাত্র একটি উদ্দেশ্যেই এই সংগ্রাম, সেটা হচ্ছে দ্বীন ইসলামকে সম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত করা, যেমন নবী (সঃ) তাঁর কাছে আগত এক লোকের প্রশ্নের জবাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন:
“আমাদের কেউ গণীমতের লোভে, কেউ তার গোত্রের জন্য, কেউ বা সাহসী হিসাবে গণ্য হওয়ার জন্য যুদ্ধ করে, কার যুদ্ধকে জিহাদ বলা হবে?” নবী (সঃ) উত্তর দিলেন: “কারো না। শুধুমাত্র যে আল্লাহর বাণীকে সমুন্নত রাখার জন্য যুদ্ধ করবে, সেই জিহাদ করেছে।”
যে কোন বিশ্বাসী, যে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহর সাথে পরিচিত, সেই জানে যে জিহাদ (সাধ্যানুসারে চেষ্টা করা) ঈমানের অপরিহার্য অঙ্গ, এবং ইসলামের কর্তব্যসমূহের অন্যতম। নবী (সঃ) বলেছেন, তারিক বিন শিহাব এর বর্ণনানুযায়ী:
“তোমাদের মধ্যে যে কেউ কোন অন্যায় দেখবে, সে তার হাত দিয়ে তা বাধা দেবে ; যদি সে তা না পারে, তবে মুখে তার প্রতিবাদ করবে ; এবং যদি সে তাও না পারে, তবে অন্ততঃ মনে মনে ঘৃণা করবে, এবং এটাই হচ্ছে ঈমানের দুর্বলতম স্তর” (সহীহ মুসলিম, ৭৯ নং হাদীস)।
জিহাদের তিনটি বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমটি হচ্ছে অন্তরের জিহাদ বা নফসের জিহাদ। এটা হচ্ছে সঠিক ধর্মবিশ্বাস অর্জনের জন্য আভ্যন্তরীণ সংগ্রাম, এবং এই ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কিত সকল ভুল ধারণা ও সন্দেহ থেকে নিজের আত্মাকে মুক্ত করা এবং বিশ্বাসীর উপর আদেশ ও নিষেধ আরোপ করা। এটা আত্মাকে সহজাত কামনা-বাসনা থেকে পরিশুদ্ধ করা এবং মহৎ গুণাবলী অর্জন করাকেও অন্তর্ভুক্ত করে। দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে মুখের ভাষা দিয়ে জিহাদ। এটা হচ্ছে মন্দ, অসৎকর্ম এবং ভুল বিশ্বাসের বিরুদ্ধে প্রচারের মাধ্যমে এবং বই লেখা ইত্যাদির মাধ্যমে সংগ্রাম করা। এই ধরনের জিহাদ মুসলিমদের মধ্যে যারা বিপথগামী তাদের বিরুদ্ধে করা হলেও অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধেও এর পরিধি বাড়ানো যায়। জিহাদের চূড়ান্ত স্তর হচ্ছে হাতের দ্বারা জিহাদ, বা তলোয়ার, যেখানে জীবন ও সম্পদ কুরবানী করা হয়। এই ধরনের জিহাদ বিশেষভাবে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে করা হলেও মুসলিম শাসকের অধীনে বিপথগামী সমপ্রদায়ের বিরুদ্ধেও করা যায়। এই হাতের দ্বারা জিহাদ, যা সাধারণত “ধর্মযুদ্ধ” নামে অভিহিত হয়ে থাকে, তিনটি বিভাগে ভাগ করা যায়। এর প্রথমটা হচ্ছে এর নিষিদ্ধতা, যেমন মুহাম্মাদের নবুওয়াতের প্রথম দিকে ছিল। যদি মুসলিমরা দুর্বল হয় এবং যুদ্ধের মাধ্যমে ক্ষতি ছাড়া কোন লাভ অর্জিত না হয়, তাহলে এ থেকে বিরত থাকা উচিত। অমুসলিম ভূমিতে বসবাসকারীদের ক্ষেত্রে এটা বলা যায়। দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে আত্মরক্ষার স্তর, বা যুদ্ধকে সীমাবদ্ধ রাখা তাদের প্রতি
“যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে” (সূরা আল-বাকারা, ২:১৯০)
এবং মুসলিম ভূমিকে শত্রুদের হাত থেকে পুনরুদ্ধার করা। এটা হচ্ছে বর্তমান যুগের মুসলিমদের অবস্থা। চূড়ান্ত স্তর হচ্ছে অবিশ্বাসীদের ভূমিতে আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য যুদ্ধ করা, নবীর সাহাবাগণ এবং পরবর্তী মুসলিম শাসকরা যা করেছিলেন।
“তোমাদের কি হয়েছে যে তোমরা আল্লাহর পথে এবং অসহায় নরনারী ও শিশুদের জন্য সংগ্রাম করবে না? যারা বলছে, ‘হে আমাদের রব! এ অত্যাচারী শাসকের দেশ থেকে আমাদের অন্যত্র নিয়ে যাও, এবং তোমার নিকট থেকে কাউকে আমাদের অভিভাবক কর এবং তোমার নিকট থেকে কাউকে আমাদের সহায় কর।” (সূরা আন নিসা, ৪:৭৬)
এভাবে নবী (সঃ) এঁর একজন সাহাবা, রাবিআ ইবনে আমের বিখ্যাত পারস্য সেনাপতি রুস্তমের অনুরোধে তাঁর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন এবং সেনাপতি তাঁকে উট, নারী উপঢৌকন দিয়ে মরুভূমিতে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। রাবিআ প্রত্যাখান করলেন, রুস্তম জানতে চাইলেন তাহলে কেন তাঁরা যুদ্ধ করছিলেন। রাবিআ উত্তর দিলেন: “আমরা এসেছি মানবজাতিকে অন্ধকার থেকে আলোতে মুক্তি দিতে। মিথ্যা উপাস্য বাদ দিয়ে মানুষকে আল্লাহর ইবাদতে নিয়োজিত করতে, এই দুনিয়ার সংকীর্ণতা থেকে এই পৃথিবী এবং এর পরবর্তী জীবনের উদার ব্যাপ্তিতে এবং মানুষের তৈরি ধর্মের অবিচার থেকে ইসলামের ন্যায়বিচারের ছায়াতলে নিয়ে যেতে।”
সুতরাং এই জিহাদ হচ্ছে লক্ষ্য অর্জনের চূড়ান্ত পর্যায় এবং এর বাস্তবায়ন হচ্ছে আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন, এবং একে পরিত্যাগ করাই হচ্ছে মুসলিমদের লাঞ্ছনা ও পরাজয়ের মূল কারণ। যেমন আল্লাহ বলেছেন:
“যদি তোমরা অভিযানে বের না হও তবে তিনি তোমাদের মর্মন্তুদ শাস্তি দেবেন এবং অপর জাতিকে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন। আল্লাহ সর্বশক্তিমান।” (সূরা আত তাওবা, ৯:৩৯)
এবং নবী (সঃ) এঁর হাদীস:
“যদি তোমরা আল-আইনিয়াতে (গার্হস্থ্য জীবনে তৃপ্ত ও সুখী থাকা) মগ্ন থাক এবং গরুর লেজের পিছনে ব্যস্ত হয়ে যাও এবং জিহাদ পরিত্যাগ কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদের শত্রুদের হাতে তোমাদের লাঞ্ছিত করবেন এবং সেই লাঞ্ছনা সরিয়ে নেবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা তোমাদের দ্বীনে প্রত্যাবর্তন কর।”
আমরা আজকাল তাই এমন সব মুসলিম দেখতে পাই যারা এমনভাবে জীবন যাপন করে যে মনেই হয় না তাদের কোন নবী আছে বা কোন ঐশী বাণী বা অহীতে বিশ্বাস আছে, বা কোন হিসাব নিকাশের আশা আছে বা আখিরাতের কোন ভয় আছে। তারা সেসব ইসলামপূর্ব জাতিসমূহের সদৃশ, যাদের বিরুদ্ধে অতীতে তারা যুদ্ধ করেছিল। তারা তাই ইসলাম থেকে ধর্মত্যাগীদের মত নিজেদের গোড়ালীর উপর ঘুরে গেছে এবং তারা সভ্যতায়, সামাজিক ব্যাপারে, রাজনৈতিক পদ্ধতিতে, তাদের চরিত্রে এবং জীবনের আনন্দ গ্রহণে অজ্ঞ জাতিসমূহের অনুকরণ করছে। তাই আল্লাহ তাদের ঘৃণা করেছেন এবং ভুলে গেছেন, যেমন তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তাঁর কিতাবে স্পষ্টভাবে ও তাঁর রাসূলের (সঃ) বাণীর মাধ্যমে:
“শীঘ্রই জাতিসমূহ তোমাদের কাছ থেকে তাদের প্রাপ্য বুঝে নিতে সমবেত হবে যেভাবে তোমরা ভোজের সময় সকলকে তাদের খাদ্যের ভাগ নিতে আমন্ত্রণ জানাও!” এক ব্যক্তি নবী (সঃ) কে জিজ্ঞাসা করলো: “এটা কি আমরা সংখ্যায় অল্প বলে?” নবী (সঃ) উত্তর দিলেন: “না! তোমরা হবে বহু সংখ্যক, সাগরের ফেনার মত, কিন্তু তোমরা হবে বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়া আবর্জনার মত। এবং নিঃসন্দেহে আল্লাহ তোমাদের শত্রুদের বক্ষ থেকে তোমাদের ভীতি উঠিয়ে নেবেন এবং তোমাদের বক্ষ তিনি দুর্বল করে দেবেন।” এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল: “দুর্বলতা কি?” রাসূল (সঃ) উত্তর দিলেন: “এটা হচ্ছে জীবনকে ভালবাসা ও মৃত্যুকে ভয় করা।”
নবীর ভবিদ্ব্যবাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে, এবং যদি “ইসলামের পুনর্জাগরণ” কখনও হয়, তবে সেটা এজন্য যে চোখ ও কান বিশিষ্ট যে কেউ দেখতে পাবে কিভাবে মুসলিমরা লাঞ্ছিত হচ্ছে-তাদের ভূমিগুলি তাদের শত্রুর দখলে, সেসব আইন ও নিয়ম-কানুন দিয়ে পরিচালিত যার সাথে আল্লাহর অহীর কোন সম্পর্কই নেই। নবী (সঃ) নিজে চৌদ্দশত বছর আগে এই সমস্যার সমাধান দিয়ে গেছেন, “তোমাদের দ্বীনে প্রত্যাবর্তন কর”, যা আল্লাহ আদেশ দিয়েছেন তা কর, যা তিনি নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাক, আখিরাতকে এ জীবনের উপর প্রাধান্য দাও। এবং মুসলিমদের আর একবার তাদের জান্তমাল দিয়ে সংগ্রাম করতে হবে মানুষের তৈরি জীবনবিধানের জুলুম থেকে নিজেদের ও অপরকে বের করে সর্বজ্ঞানী স্রষ্টার প্রবর্তিত ন্যায়বিচারের আওতায় আনার জন্য।
সুতরাং ইসলাম ও পশ্চিমা বিশ্বের দ্বন্দ্বের কারণ যা জরিপে ধারণা করা হয়েছে তা নয়, অর্থাৎ ভৌগোলিক পরিবেশ, অতীত শত্রুতা, সংস্কৃতির সংঘাত বা অন্যান্য কিছু ; অথবা ইসলামী পুনর্জাগরণ, আত্মপরিচয় অনুসন্ধান যাতে কোন ধরনের হীনমন্যতা জড়িত এসবও নয়। বিশ্বাসীদের কাছে এই দ্বন্দ্ব হচ্ছে মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের, জুলুমের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচারের, জাহান্নামের পথের বিরুদ্ধে জান্নাতের পথের, মানবীয় অজ্ঞতার ভ্রষ্ট নির্দেশনার বিরুদ্ধে আল্লাহর প্রদর্শিত পূর্ণাঙ্গ পথের। অধিকন্তু এসবই পরিষ্কার করে দিচ্ছে যে নিঃসন্দেহে এখানে “এমন একটি অনতিক্রম্য কারণ রয়েছে যেজন্য মুসলিমরা ও পশ্চিমারা কখনই পরস্পরের সাথে শান্তিতে বাস করতে পারবে না।” (পৃ. ৫, অ ২) জনাব ব্রিডহ্যামের জরিপ তার সমস্ত আশাবাদ নিয়েও একটা প্রায়ই পুনরাবৃত্ত ভুল করেছে। তিনি মুসলিমদের তাঁর নিজের মান অনুযায়ী বিচার করেছেন একথা ধরে নিয়ে যে তারাও পশ্চিমের মতই কোন না কোন সমঝোতায় পৌঁছাতে চায়। সত্য এই যে ইসলাম তার অনুসারীদের যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যুকামনা করতে শেখায়, কারণ আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত পাওয়ার অন্যতম নিশ্চিত উপায় হচ্ছে জিহাদের ময়দানে মৃত্যুবরণ। খালিদ বিন ওয়ালিদ, যাঁকে নবী (সঃ) “আল্লাহর তরবারি” উপাধি দিয়েছিলেন, এবং যিনি সমস্ত ভাল মুসলিম শিশুর চোখে বীর হিসাবে আদর্শ, রোমানদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে লেখা চিঠির উত্তরে বলেছিলেন: “আমাদের সাথে এমন সব লোক রয়েছে যারা মৃত্যুকে ততখানি ভালবাসে যতখানি তোমরা মদকে ভালবাস।” রোনাল্ড রিগ্যান যথার্থ ভাবেই উল্লেখ করেছেন যে: “তোমরা কিভাবে সেই জাতিকে পরাজিত করার আশা কর যারা বিশ্বাস করে যে নিহত হলে তারা সুন্দরী কুমারী ও শরাবের নহরে পূর্ণ জান্নাতে যাবে?” বিশ্বাসী তার জীবনকালে ফলাফল দেখে যেতে পারবে কিনা সেটা অপ্রাসঙ্গিক, কারণ তাদের কর্তব্য হচ্ছে আল্লাহর ক্রোধ থেকে এ দুনিয়ায় ও আখিরাতে বেঁচে থাকার জন্য জিহাদ করে যাওয়া।
যতদিন পর্যন্ত রব ও সৃষ্টিকর্তার আনুগত্যের বিরুদ্ধে উদ্ধত বাধাদানকারীরা থাকবে, ততদিন এই দ্বন্দ্ব চলবে। এসব কিছু যদি আপোষহীন মনোভাব ও মৌলবাদী ভাবধারা মনে হয়, তবে তা এজন্য যে এটা তাই। ইসলাম মানেই চরম কিছুর সাথে বোঝাপড়া করা। এই দ্বন্দ্ব যে যুদ্ধের মত প্রাণ ও ধনসম্পদ বিনাশী হিংসাত্মক কিছু হবে, এমন কোন কথা নেই। হিংসাত্মক পথ পরিহার করে পরিবর্তন আনার জন্য কার্যকরী অন্য উপায় পাওয়া গেলে ইসলাম কখনোই সেটার জন্য জিদ ধরবে না। সুতরাং জরিপে ব্যক্ত আশাবাদের স্থান থাকলেও সমাধান রয়েছে তাদের নির্দেশিত দিকের বিপরীত দিকে! আল্লাহ তাঁর কিতাবে প্রতিজ্ঞা করেছেন যে মুসলিমরা যদি তাদের কৃত অঙ্গীকার পূরণ করতে এবং নির্বোধ কুফরীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে ব্যর্থ হয়, তাহলে আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করবেন এবং
“এমন এক সমপ্রদায় আনবেন যাদের তিনি ভালবাসেন ও যারা তাঁকে ভালবাসবে, তারা হবে বিশ্বাসীদের প্রতি কোমল ও অবিশ্বাসীদের প্রতি কঠোর। তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোন নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবে না।” (সূরা আল-মায়িদা, ৫:৫৪)
এবং আল্লাহ সত্য বলেন, তাঁর প্রতিজ্ঞা সত্য, এবং অতীতে এটা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে, যখন মুসলিমরা তাদের দ্বীন ত্যাগ করে নিজেদের ভিতর যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে এবং দুনিয়াবী জীবনের শোভায় মুগ্ধ হয়েছে… তখন তাতারদের দুর্যোগ আপতিত হয়েছে তাদের উপর, রাজধানী বাগদাদ ও মুসলিম ভূমি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়েছে। তারপরও এই একই বিজয়ী জাতি থেকে আল্লাহ ইসলামের রক্ষাকারী ও তার পতাকাবাহী তৈরী করেছেন, তাদের পরে তুর্কীদেরকে, এবং যখন তারা স্বধর্মভ্রষ্ট হয়েছে, আল্লাহ ইউরোপীয়ানদের হাতে তাদের ধ্বংস করেছেন। বর্তমানে মুসলিমদের অবস্থান এটাই। এটা সম্পূর্ণ সম্ভব যে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে, এবং যারা ইসলামকে আগে ধ্বংস করতে চেয়েছিল, তাদের মাধ্যমেই আবার ইসলাম শক্তিমান হবে।
মুসলিম পণ্ডিত ও চিন্তাবিদদের মাঝে এটা একটা বিতর্কের বিষয়বস্তু ছিল যে আদৌ পশ্চিম ইসলাম গ্রহণ করবে কি না। এটা অসম্ভব মনে হয় যে পশ্চিমা বিশ্বে কোন রকম সামরিক বিজয় ঘটবে, অন্ততঃ অদূর ভবিষ্যতে, কিন্তু বিজয় সব সময় অস্ত্রের হাত ধরে আসে না। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া কখনো দখলদার মুসলিম সৈন্য দেখেনি। এসব ভূখণ্ডকে ইসলাম সম্পূর্ণ ভিন্ন অস্ত্র দিয়ে “জয়” করেছে। অস্ত্রটি হচ্ছে ইসলাম নিজেই। পশ্চিমা বিশ্ব ও পৃথিবীর অন্যান্য অংশে, যারা ইসলামকে তাদের দেশ পরিচালনায় প্রভাবিত করা থেকে বহুদূরে রাখতে চায়, “মৌলবাদের” উত্থান তাদের কাছে হুমকি বলে মনে হওয়ার সত্যিকার কারণ হচ্ছে প্রকৃত মুসলিম রাষ্ট্রের আকারে ইসলামের কার্যকারিতার প্রত্যক্ষ উদাহরণ দেখতে পাওয়া, দখলদার মুসলিম জঙ্গীদের সমাবেশ নয় এটা যে এই সম্ভাবনার জন্যও এই “মৌলবাদী” রাষ্ট্রসমূহ তাদের সম্পদ ব্যবহার করে বিশ্বকে জানাবে আসলে ইসলাম কি, যা তারা তাদের প্রচারিত মিথ্যা ও বিকৃতি দিয়ে এখন পর্যন্ত চেপে রেখেছে। তাহলে এই প্রকৃত ইসলামী রাষ্ট্র বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কতটুকু, এবং কিভাবে চৌদ্দশত বছর পূর্বের একটি ধর্মের অনুসারীরা এই বিংশ শতাব্দীতে এই সম্ভাবনাকে কাজে পরিণত করবে?

পর্বঃ-২। সংঘাত অথবা সংঘাত নয়?

ইসলাম ও পশ্চিমা বিশ্ব কি বিরোধিতার সম্মুখীন?
জনাব হান্টিংটনেরThe clash of the Civilizations‘ দাবী করছে “হ্যাঁ”, কিন্তু  জরিপে এ বিষয়ে কোন “দৃঢ় প্রত্যয়” ব্যক্ত করা হয়নি। এটা সত্যি যে কনফুসিয়হিন্দু সভ্যতার চাইতে মুসলিম ও পশ্চিমা বিশ্ব পরস্পরের কাছাকাছি, কিন্তু বাস্তবে জনাব হান্টিংটন ও জনাব বিডহ্যামের তুলনামূলক আলোচনা এ বিষয়ের সত্যতার উপর আলোকপাত করার ব্যাপারে অপ্রতুল। যা জনাব বিডহ্যাম স্বীকার করেছেন তা হলো যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যগুলি (পশ্চিমাদের অবিশ্বাস যে কুরআন আল্লাহর বাণী ও মুসলিমদের অবিশ্বাস যে যীশু আল্লাহর পুত্র) হচ্ছে মীমাংসার অযোগ্য, অন্ততঃ মুসলিমদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে…
“তারা বলে, ‘আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন’ তোমরা তো এক অদ্ভুত কথা সৃষ্টি করেছ। (যার জন্য) হয়তো আকাশমণ্ডলী বিদীর্ণ হয়ে যাবে, পৃথিবী বিদীর্ণ হবে ও পর্বতমণ্ডলী চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। তারা দয়াময়ের প্রতি সন্তান আরোপ করত। সন্তান গ্রহণ করা দয়াময়ের জন্য শোভন নয়! আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে এমন কেউ নেই, যে দয়াময়ের কাছে দাসরূপে উপস্থিত  হবে না” (সূরা মারিয়াম ১৯:৮৮-৯৩)
ইসলাম সে সমস্ত খৃষ্টানকে “একেশ্বরবাদী” বলে স্বীকার করে না যারা দাবী করে যে যীশু আল্লাহ বা আল্লাহর পুত্র, সেসব হিন্দুদের মত যারা দাবী করে যে কৃষ্ণ “ভগবানের অবতার/ভগবানের প্রকাশ” বা বৌদ্ধদের মত যারা বলে বুদ্ধই ভগবান। এগুলি সবই কুফর এবং বহুঈশ্বরবাদ। এটাই দ্বন্দ্বের ভিত্তি। এই দ্বন্দ্ব শুধু বৈধই নয়, বরং কুরআনে এর হুকুম করা হয়েছে:
“যাদের প্রতি কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে তাদের মধ্যে যারা আল্লাহতে বিশ্বাস করে না ও পরকালেও নয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা নিষিদ্ধ করেছেন তা নিষিদ্ধ করে না এবং সত্য ধর্ম অনুসরণ করে না, তাদের সাথে যুদ্ধ করবে যে পর্যন্ত না তারা নত হয়ে আনুগত্যের নিদর্শন স্বরূপ স্বেচ্ছায় জিজিয়া দেয়।” (সূরা আত-তাওবা, ৯:২৯)
এটা সভ্যতার বিপরীতমুখী অবস্থান নয় বা সংস্কৃতির সংঘাতও নয়। ইসলাম কখনো অতীত শত্রুতার বশে আহত গর্ব পুনরুদ্ধারের ইচ্ছা থেকে বা সম্পদ ও ভূমি স্তূপীকৃত করে রাখার ইচ্ছা থেকে পশ্চিমা বিশ্ব বা অন্য কারো বিরোধিতা করে না। শুধুমাত্র একটি উদ্দেশ্যেই এই সংগ্রাম, সেটা হচ্ছে দ্বীন ইসলামকে সম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত করা, যেমন নবী (সঃ) তাঁর কাছে আগত এক লোকের প্রশ্নের জবাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন:
“আমাদের কেউ গণীমতের লোভে, কেউ তার গোত্রের জন্য, কেউ বা সাহসী হিসাবে গণ্য হওয়ার জন্য যুদ্ধ করে, কার যুদ্ধকে জিহাদ বলা হবে?” নবী (সঃ) উত্তর দিলেন: “কারো না। শুধুমাত্র যে আল্লাহর বাণীকে সমুন্নত রাখার জন্য যুদ্ধ করবে, সেই জিহাদ করেছে।”
যে কোন বিশ্বাসী, যে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহর সাথে পরিচিত, সেই জানে যে জিহাদ (সাধ্যানুসারে চেষ্টা করা) ঈমানের অপরিহার্য অঙ্গ, এবং ইসলামের কর্তব্যসমূহের অন্যতম। নবী (সঃ) বলেছেন, তারিক বিন শিহাব এর বর্ণনানুযায়ী:
“তোমাদের মধ্যে যে কেউ কোন অন্যায় দেখবে, সে তার হাত দিয়ে তা বাধা দেবে ; যদি সে তা না পারে, তবে মুখে তার প্রতিবাদ করবে ; এবং যদি সে তাও না পারে, তবে অন্ততঃ মনে মনে ঘৃণা করবে, এবং এটাই হচ্ছে ঈমানের দুর্বলতম স্তর” (সহীহ মুসলিম, ৭৯ নং হাদীস)।
জিহাদের তিনটি বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমটি হচ্ছে অন্তরের জিহাদ বা নফসের জিহাদ। এটা হচ্ছে সঠিক ধর্মবিশ্বাস অর্জনের জন্য আভ্যন্তরীণ সংগ্রাম, এবং এই ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কিত সকল ভুল ধারণা ও সন্দেহ থেকে নিজের আত্মাকে মুক্ত করা এবং বিশ্বাসীর উপর আদেশ ও নিষেধ আরোপ করা। এটা আত্মাকে সহজাত কামনা-বাসনা থেকে পরিশুদ্ধ করা এবং মহৎ গুণাবলী অর্জন করাকেও অন্তর্ভুক্ত করে। দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে মুখের ভাষা দিয়ে জিহাদ। এটা হচ্ছে মন্দ, অসৎকর্ম এবং ভুল বিশ্বাসের বিরুদ্ধে প্রচারের মাধ্যমে এবং বই লেখা ইত্যাদির মাধ্যমে সংগ্রাম করা। এই ধরনের জিহাদ মুসলিমদের মধ্যে যারা বিপথগামী তাদের বিরুদ্ধে করা হলেও অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধেও এর পরিধি বাড়ানো যায়। জিহাদের চূড়ান্ত স্তর হচ্ছে হাতের দ্বারা জিহাদ, বা তলোয়ার, যেখানে জীবন ও সম্পদ কুরবানী করা হয়। এই ধরনের জিহাদ বিশেষভাবে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে করা হলেও মুসলিম শাসকের অধীনে বিপথগামী সমপ্রদায়ের বিরুদ্ধেও করা যায়। এই হাতের দ্বারা জিহাদ, যা সাধারণত “ধর্মযুদ্ধ” নামে অভিহিত হয়ে থাকে, তিনটি বিভাগে ভাগ করা যায়। এর প্রথমটা হচ্ছে এর নিষিদ্ধতা, যেমন মুহাম্মাদের নবুওয়াতের প্রথম দিকে ছিল। যদি মুসলিমরা দুর্বল হয় এবং যুদ্ধের মাধ্যমে ক্ষতি ছাড়া কোন লাভ অর্জিত না হয়, তাহলে এ থেকে বিরত থাকা উচিত। অমুসলিম ভূমিতে বসবাসকারীদের ক্ষেত্রে এটা বলা যায়। দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে আত্মরক্ষার স্তর, বা যুদ্ধকে সীমাবদ্ধ রাখা তাদের প্রতি
“যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে” (সূরা আল-বাকারা, ২:১৯০)
এবং মুসলিম ভূমিকে শত্রুদের হাত থেকে পুনরুদ্ধার করা। এটা হচ্ছে বর্তমান যুগের মুসলিমদের অবস্থা। চূড়ান্ত স্তর হচ্ছে অবিশ্বাসীদের ভূমিতে আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য যুদ্ধ করা, নবীর সাহাবাগণ এবং পরবর্তী মুসলিম শাসকরা যা করেছিলেন।
“তোমাদের কি হয়েছে যে তোমরা আল্লাহর পথে এবং অসহায় নরনারী ও শিশুদের জন্য সংগ্রাম করবে না? যারা বলছে, ‘হে আমাদের রব! এ অত্যাচারী শাসকের দেশ থেকে আমাদের অন্যত্র নিয়ে যাও, এবং তোমার নিকট থেকে কাউকে আমাদের অভিভাবক কর এবং তোমার নিকট থেকে কাউকে আমাদের সহায় কর।” (সূরা আন নিসা, ৪:৭৬)
এভাবে নবী (সঃ) এঁর একজন সাহাবা, রাবিআ ইবনে আমের বিখ্যাত পারস্য সেনাপতি রুস্তমের অনুরোধে তাঁর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন এবং সেনাপতি তাঁকে উট, নারী উপঢৌকন দিয়ে মরুভূমিতে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। রাবিআ প্রত্যাখান করলেন, রুস্তম জানতে চাইলেন তাহলে কেন তাঁরা যুদ্ধ করছিলেন। রাবিআ উত্তর দিলেন: “আমরা এসেছি মানবজাতিকে অন্ধকার থেকে আলোতে মুক্তি দিতে। মিথ্যা উপাস্য বাদ দিয়ে মানুষকে আল্লাহর ইবাদতে নিয়োজিত করতে, এই দুনিয়ার সংকীর্ণতা থেকে এই পৃথিবী এবং এর পরবর্তী জীবনের উদার ব্যাপ্তিতে এবং মানুষের তৈরি ধর্মের অবিচার থেকে ইসলামের ন্যায়বিচারের ছায়াতলে নিয়ে যেতে।”
সুতরাং এই জিহাদ হচ্ছে লক্ষ্য অর্জনের চূড়ান্ত পর্যায় এবং এর বাস্তবায়ন হচ্ছে আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন, এবং একে পরিত্যাগ করাই হচ্ছে মুসলিমদের লাঞ্ছনা ও পরাজয়ের মূল কারণ। যেমন আল্লাহ বলেছেন:
“যদি তোমরা অভিযানে বের না হও তবে তিনি তোমাদের মর্মন্তুদ শাস্তি দেবেন এবং অপর জাতিকে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন। আল্লাহ সর্বশক্তিমান।” (সূরা আত তাওবা, ৯:৩৯)
এবং নবী (সঃ) এঁর হাদীস:
“যদি তোমরা আল-আইনিয়াতে (গার্হস্থ্য জীবনে তৃপ্ত ও সুখী থাকা) মগ্ন থাক এবং গরুর লেজের পিছনে ব্যস্ত হয়ে যাও এবং জিহাদ পরিত্যাগ কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদের শত্রুদের হাতে তোমাদের লাঞ্ছিত করবেন এবং সেই লাঞ্ছনা সরিয়ে নেবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা তোমাদের দ্বীনে প্রত্যাবর্তন কর।”
আমরা আজকাল তাই এমন সব মুসলিম দেখতে পাই যারা এমনভাবে জীবন যাপন করে যে মনেই হয় না তাদের কোন নবী আছে বা কোন ঐশী বাণী বা অহীতে বিশ্বাস আছে, বা কোন হিসাব নিকাশের আশা আছে বা আখিরাতের কোন ভয় আছে। তারা সেসব ইসলামপূর্ব জাতিসমূহের সদৃশ, যাদের বিরুদ্ধে অতীতে তারা যুদ্ধ করেছিল। তারা তাই ইসলাম থেকে ধর্মত্যাগীদের মত নিজেদের গোড়ালীর উপর ঘুরে গেছে এবং তারা সভ্যতায়, সামাজিক ব্যাপারে, রাজনৈতিক পদ্ধতিতে, তাদের চরিত্রে এবং জীবনের আনন্দ গ্রহণে অজ্ঞ জাতিসমূহের অনুকরণ করছে। তাই আল্লাহ তাদের ঘৃণা করেছেন এবং ভুলে গেছেন, যেমন তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তাঁর কিতাবে স্পষ্টভাবে ও তাঁর রাসূলের (সঃ) বাণীর মাধ্যমে:
“শীঘ্রই জাতিসমূহ তোমাদের কাছ থেকে তাদের প্রাপ্য বুঝে নিতে সমবেত হবে যেভাবে তোমরা ভোজের সময় সকলকে তাদের খাদ্যের ভাগ নিতে আমন্ত্রণ জানাও!” এক ব্যক্তি নবী (সঃ) কে জিজ্ঞাসা করলো: “এটা কি আমরা সংখ্যায় অল্প বলে?” নবী (সঃ) উত্তর দিলেন: “না! তোমরা হবে বহু সংখ্যক, সাগরের ফেনার মত, কিন্তু তোমরা হবে বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়া আবর্জনার মত। এবং নিঃসন্দেহে আল্লাহ তোমাদের শত্রুদের বক্ষ থেকে তোমাদের ভীতি উঠিয়ে নেবেন এবং তোমাদের বক্ষ তিনি দুর্বল করে দেবেন।” এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল: “দুর্বলতা কি?” রাসূল (সঃ) উত্তর দিলেন: “এটা হচ্ছে জীবনকে ভালবাসা ও মৃত্যুকে ভয় করা।”
নবীর ভবিদ্ব্যবাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে, এবং যদি “ইসলামের পুনর্জাগরণ” কখনও হয়, তবে সেটা এজন্য যে চোখ ও কান বিশিষ্ট যে কেউ দেখতে পাবে কিভাবে মুসলিমরা লাঞ্ছিত হচ্ছে-তাদের ভূমিগুলি তাদের শত্রুর দখলে, সেসব আইন ও নিয়ম-কানুন দিয়ে পরিচালিত যার সাথে আল্লাহর অহীর কোন সম্পর্কই নেই। নবী (সঃ) নিজে চৌদ্দশত বছর আগে এই সমস্যার সমাধান দিয়ে গেছেন, “তোমাদের দ্বীনে প্রত্যাবর্তন কর”, যা আল্লাহ আদেশ দিয়েছেন তা কর, যা তিনি নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাক, আখিরাতকে এ জীবনের উপর প্রাধান্য দাও। এবং মুসলিমদের আর একবার তাদের জান্তমাল দিয়ে সংগ্রাম করতে হবে মানুষের তৈরি জীবনবিধানের জুলুম থেকে নিজেদের ও অপরকে বের করে সর্বজ্ঞানী স্রষ্টার প্রবর্তিত ন্যায়বিচারের আওতায় আনার জন্য।
সুতরাং ইসলাম ও পশ্চিমা বিশ্বের দ্বন্দ্বের কারণ যা জরিপে ধারণা করা হয়েছে তা নয়, অর্থাৎ ভৌগোলিক পরিবেশ, অতীত শত্রুতা, সংস্কৃতির সংঘাত বা অন্যান্য কিছু ; অথবা ইসলামী পুনর্জাগরণ, আত্মপরিচয় অনুসন্ধান যাতে কোন ধরনের হীনমন্যতা জড়িত এসবও নয়। বিশ্বাসীদের কাছে এই দ্বন্দ্ব হচ্ছে মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের, জুলুমের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচারের, জাহান্নামের পথের বিরুদ্ধে জান্নাতের পথের, মানবীয় অজ্ঞতার ভ্রষ্ট নির্দেশনার বিরুদ্ধে আল্লাহর প্রদর্শিত পূর্ণাঙ্গ পথের। অধিকন্তু এসবই পরিষ্কার করে দিচ্ছে যে নিঃসন্দেহে এখানে “এমন একটি অনতিক্রম্য কারণ রয়েছে যেজন্য মুসলিমরা ও পশ্চিমারা কখনই পরস্পরের সাথে শান্তিতে বাস করতে পারবে না।” (পৃ. ৫, অ ২) জনাব ব্রিডহ্যামের জরিপ তার সমস্ত আশাবাদ নিয়েও একটা প্রায়ই পুনরাবৃত্ত ভুল করেছে। তিনি মুসলিমদের তাঁর নিজের মান অনুযায়ী বিচার করেছেন একথা ধরে নিয়ে যে তারাও পশ্চিমের মতই কোন না কোন সমঝোতায় পৌঁছাতে চায়। সত্য এই যে ইসলাম তার অনুসারীদের যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যুকামনা করতে শেখায়, কারণ আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত পাওয়ার অন্যতম নিশ্চিত উপায় হচ্ছে জিহাদের ময়দানে মৃত্যুবরণ। খালিদ বিন ওয়ালিদ, যাঁকে নবী (সঃ) “আল্লাহর তরবারি” উপাধি দিয়েছিলেন, এবং যিনি সমস্ত ভাল মুসলিম শিশুর চোখে বীর হিসাবে আদর্শ, রোমানদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে লেখা চিঠির উত্তরে বলেছিলেন: “আমাদের সাথে এমন সব লোক রয়েছে যারা মৃত্যুকে ততখানি ভালবাসে যতখানি তোমরা মদকে ভালবাস।” রোনাল্ড রিগ্যান যথার্থ ভাবেই উল্লেখ করেছেন যে: “তোমরা কিভাবে সেই জাতিকে পরাজিত করার আশা কর যারা বিশ্বাস করে যে নিহত হলে তারা সুন্দরী কুমারী ও শরাবের নহরে পূর্ণ জান্নাতে যাবে?” বিশ্বাসী তার জীবনকালে ফলাফল দেখে যেতে পারবে কিনা সেটা অপ্রাসঙ্গিক, কারণ তাদের কর্তব্য হচ্ছে আল্লাহর ক্রোধ থেকে এ দুনিয়ায় ও আখিরাতে বেঁচে থাকার জন্য জিহাদ করে যাওয়া।
যতদিন পর্যন্ত রব ও সৃষ্টিকর্তার আনুগত্যের বিরুদ্ধে উদ্ধত বাধাদানকারীরা থাকবে, ততদিন এই দ্বন্দ্ব চলবে। এসব কিছু যদি আপোষহীন মনোভাব ও মৌলবাদী ভাবধারা মনে হয়, তবে তা এজন্য যে এটা তাই। ইসলাম মানেই চরম কিছুর সাথে বোঝাপড়া করা। এই দ্বন্দ্ব যে যুদ্ধের মত প্রাণ ও ধনসম্পদ বিনাশী হিংসাত্মক কিছু হবে, এমন কোন কথা নেই। হিংসাত্মক পথ পরিহার করে পরিবর্তন আনার জন্য কার্যকরী অন্য উপায় পাওয়া গেলে ইসলাম কখনোই সেটার জন্য জিদ ধরবে না। সুতরাং জরিপে ব্যক্ত আশাবাদের স্থান থাকলেও সমাধান রয়েছে তাদের নির্দেশিত দিকের বিপরীত দিকে! আল্লাহ তাঁর কিতাবে প্রতিজ্ঞা করেছেন যে মুসলিমরা যদি তাদের কৃত অঙ্গীকার পূরণ করতে এবং নির্বোধ কুফরীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে ব্যর্থ হয়, তাহলে আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করবেন এবং
“এমন এক সমপ্রদায় আনবেন যাদের তিনি ভালবাসেন ও যারা তাঁকে ভালবাসবে, তারা হবে বিশ্বাসীদের প্রতি কোমল ও অবিশ্বাসীদের প্রতি কঠোর। তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোন নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবে না।” (সূরা আল-মায়িদা, ৫:৫৪)
এবং আল্লাহ সত্য বলেন, তাঁর প্রতিজ্ঞা সত্য, এবং অতীতে এটা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে, যখন মুসলিমরা তাদের দ্বীন ত্যাগ করে নিজেদের ভিতর যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে এবং দুনিয়াবী জীবনের শোভায় মুগ্ধ হয়েছে… তখন তাতারদের দুর্যোগ আপতিত হয়েছে তাদের উপর, রাজধানী বাগদাদ ও মুসলিম ভূমি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়েছে। তারপরও এই একই বিজয়ী জাতি থেকে আল্লাহ ইসলামের রক্ষাকারী ও তার পতাকাবাহী তৈরী করেছেন, তাদের পরে তুর্কীদেরকে, এবং যখন তারা স্বধর্মভ্রষ্ট হয়েছে, আল্লাহ ইউরোপীয়ানদের হাতে তাদের ধ্বংস করেছেন। বর্তমানে মুসলিমদের অবস্থান এটাই। এটা সম্পূর্ণ সম্ভব যে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে, এবং যারা ইসলামকে আগে ধ্বংস করতে চেয়েছিল, তাদের মাধ্যমেই আবার ইসলাম শক্তিমান হবে।
মুসলিম পণ্ডিত ও চিন্তাবিদদের মাঝে এটা একটা বিতর্কের বিষয়বস্তু ছিল যে আদৌ পশ্চিম ইসলাম গ্রহণ করবে কি না। এটা অসম্ভব মনে হয় যে পশ্চিমা বিশ্বে কোন রকম সামরিক বিজয় ঘটবে, অন্ততঃ অদূর ভবিষ্যতে, কিন্তু বিজয় সব সময় অস্ত্রের হাত ধরে আসে না। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া কখনো দখলদার মুসলিম সৈন্য দেখেনি। এসব ভূখণ্ডকে ইসলাম সম্পূর্ণ ভিন্ন অস্ত্র দিয়ে “জয়” করেছে। অস্ত্রটি হচ্ছে ইসলাম নিজেই। পশ্চিমা বিশ্ব ও পৃথিবীর অন্যান্য অংশে, যারা ইসলামকে তাদের দেশ পরিচালনায় প্রভাবিত করা থেকে বহুদূরে রাখতে চায়, “মৌলবাদের” উত্থান তাদের কাছে হুমকি বলে মনে হওয়ার সত্যিকার কারণ হচ্ছে প্রকৃত মুসলিম রাষ্ট্রের আকারে ইসলামের কার্যকারিতার প্রত্যক্ষ উদাহরণ দেখতে পাওয়া, দখলদার মুসলিম জঙ্গীদের সমাবেশ নয় এটা যে এই সম্ভাবনার জন্যও এই “মৌলবাদী” রাষ্ট্রসমূহ তাদের সম্পদ ব্যবহার করে বিশ্বকে জানাবে আসলে ইসলাম কি, যা তারা তাদের প্রচারিত মিথ্যা ও বিকৃতি দিয়ে এখন পর্যন্ত চেপে রেখেছে। তাহলে এই প্রকৃত ইসলামী রাষ্ট্র বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কতটুকু, এবং কিভাবে চৌদ্দশত বছর পূর্বের একটি ধর্মের অনুসারীরা এই বিংশ শতাব্দীতে এই সম্ভাবনাকে কাজে পরিণত করবে?

পর্বঃ-৩ । মৌলবাদীদের অদ্ভুত ব্যাপার

মুসলিম বিশ্ব বর্তমানে প্রতিযোগী জাতি-রাষ্ট্রসমূহের জোড়াতালি বিশেষ, যেগুলি এমন সব বিচার বিভাগীয় ও রাজনৈতিক পদ্ধতি দ্বারা শাসিত যা কোনক্রমেই “ইসলামী” বলা যায় না। নিঃসন্দেহে অধিকাংশ দেশেই আল্লাহ তাঁর রাসূলের কাছে যা অবতীর্ণ করেছেন তার বিরোধী আইন বিদ্যমান। মনে হয় এসব জাতিগুলির একমাত্র ইসলামী বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে তাদের মধ্যে মুসলিম রয়েছে। মুসলিম বিশ্বের এক বিরাট অংশ গত প্রায় দুইশত বছর যাবত কোন না কোন ইউরোপীয় শক্তির শাসনাধীনে বা সংরক্ষণে ছিল, যারা ধীরে ধীরে শরীয়াকে (ইসলামী আইন) বিভিন্ন পশ্চিমা পদ্ধতিতে প্রতিস্থাপন করেছে। তথাকথিত “স্বাধীনতা” পাওয়ার পরও এ সমস্ত বহিরাগত রাজনৈতিক ও বিচার বিভাগীয় পদ্ধতিসমূহ রয়ে গেছে অথবা অন্য কোন পশ্চিম-প্রভাবিত সংকর দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। তুরস্কের আতাতুর্কের “জাতীয়তাবাদ”, ইরাক ও সিরিয়ার ‘বাথবাদ”, মিশরের জামাল আবদুন নাসেরের “প্যান আরব জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্র”, এবং এর বিভিন্ন প্রজাতি যেমন গাদ্দাফীর “ইসলামী সমাজতন্ত্র”। এসমস্ত আন্দোলনসমূহ তাদের লক্ষ্যের সাথে সঙ্গত মনে হলেই অবাধে “ইসলামী” শ্লোগান ব্যবহার করে চলছে। সাধারণ জনতা নতুন পাওয়া “স্বাধীনতার” উৎসাহে উদ্দীপ্ত, এবং তা রক্ষা করার জন্য তাদেরকে বলা হয় যে তাদেরকে অবশ্যই “আধুনিক” হতে হবে। তথাকথিত “বুদ্ধিজীবী”দের কাছে এর অর্থ হচ্ছে অতীতের সবকিছুই বর্জন করা এবং নতুন সবকিছুকেই গ্রহণ করা। এভাবেই “মডার্নিস্ট” আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে, মোহাম্মদ আবদুহু এর মত লোকেরা যার নেতৃত্বে ছিলেন, যে আন্দোলন নবী (সঃ) এঁর সমস্ত অলৌকিক ঘটনাবলীকে এবং এমনকি ইবাদতের বহু মৌল কর্মকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে। প্রথমবারের মত রিবা (সুদ) বৈধ (?) ঘোষণা করা হয় এবং পশ্চিমা পোশাক ও জীবনযাত্রাকে উৎসাহিত করা হয়। ব্যক্তিগত ইজতিহাদ (বিচারের যুক্তি) ও আয়াতের ব্যাখ্যার ব্যাপারে মুসলিম আলিম সমাজের প্রচলিত পদ্ধতিকে পাশ কাটিয়ে তারা এসব কিছুকেই গ্রহণযোগ্য করার প্রচেষ্টা চালান।
অন্যদের কাছে ইসলাম নিজে শুধুমাত্র প্রগতির শত্রু, বিশেষ করে সোভিয়েট ইউনিয়নে যেখানে ঘোমটা পোড়ানো হয়েছিল, মসজিদগুলো নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছিল এবং জ্ঞানীদের সাইবেরিয়াতে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। রাস্তার দেওয়ালগুলিতে রং দিয়ে লিখে দেওয়া হয়েছিল এই শব্দগুলি: “কোন খোদা নেই এবং লেনিন হচ্ছেন তাঁর নবী।” মুসলিম বিশ্বের নানা স্থানে মসজিদগুলো শূন্য হয়ে গেছে এবং মিনি স্কার্ট পরা মহিলারা রাস্তায় হাঁটছে। পরিবর্তন শুরু হয়েছে। পশ্চিমা এবং কমিউনিস্ট শক্তি, ভেষজশাস্ত্র ও যন্ত্রবিদ্যার যাদুকরী উৎকর্ষ, চাঁদে মানুষের উপস্থিতি এবং মানচিত্রকে কয়েক দিনেই প্রদক্ষিণ করার যোগ্য বিমান, বিপুল ধ্বংসযজ্ঞে সক্ষম মারণাস্ত্র যা একত্রে বিশ্বকে সতের বার ধ্বংস করতে সক্ষম হবে, কম্পিউটার চিপ এবং সেসব জাতিসমূহ যেগুলি আপাতঃ দৃষ্টিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী বস্তুগত সমৃদ্ধি ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারী-এসবের মুখেও ইসলামের প্রতি একটা ধীরগতির তবুও অপরিহার্যভাবে লক্ষণীয় প্রত্যাবর্তন দেখা যায়। মনে রাখা দরকার শুধুমাত্র অশিক্ষিত দারিদ্র্যপীড়িত কৃষকদের মধ্যে নয়, শিক্ষিত, ধনী, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মাঝেও। বিশেষতঃ এটা শুধুমাত্র পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের জন্য মসজিদে ফেরা নয়, বা নারীদের জন্য ঘোমটাও নয়, এটা হচ্ছে সামগ্রিকভাবে ইসলামে ফিরে যাওয়া-আরেকবারের জন্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়া। ইকোনমিস্টের জরিপের মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার বহু পূর্বেই মুসলিম জ্ঞানীজনের কাছে এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান ছিল যে কার্যতঃ ইসলাম ব্যক্তিগত ও সর্বসাধারণের মাঝে, ধর্মীয় ও রাজনৈতিকের মাঝে কোন পার্থক্য করে না। এটা বাস্তবে একেবারেই স্পষ্ট যে সংকর সামাজিক-রাজনৈতিক-বিচার বিভাগীয় পদ্ধতির মুসলিম দেশগুলির আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ইসলামের মূল বৈশিষ্ট্যের বিপরীতমুখী। তাই মুসলিমদের সঠিক অবস্থানে আনার জন্য নানা ধরনের আন্দোলন শুরু হয়েছে। অবশ্যই এই আন্দোলনসমূহ এসব পদ্ধতির সমর্থক সরকারগুলির বিশেষ বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে। এই বিরোধিতা, আগেও ছিল, এখনও আছে, কখনও বা চরমভাবে বর্বররূপে। এই সরকারগুলি তাদের পশ্চিমা ও কমিউনিস্ট তত্ত্বাবধায়কদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অনুমোদন পেয়েছে, যারা বাস্তবে বর্তমান অবস্থায় এবং তাদের নিজস্ব কার্যকর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রাধান্যের ব্যাপারে-যা তারা অর্জন করতে এত কঠোর চেষ্টা করেছে-এ ধরনের মুসলিম পুনর্জাগরণের সম্ভাব্য হুমকি সম্পর্কে অধিক সচেতন ছিল। তারা মোটেও যা চায় না তা হলো মুসলিমদের আবার উঠে দাঁড়ানো দেখতে। তবু পুনর্জাগরণ চলছেই….
হয়তো যে কারণে ইসলামী মৌলবাদের এই উত্থান এত বিস্ময়কর তা হচ্ছে যে মৌলবাদীরাই এটাকে তা করেছে, অর্থাৎ, মৌলিক! সবকিছুর পরও, যখন একজন মুসলিম এ সম্পর্কে সচেতন হয় যে আল্লাহর প্রদর্শিত প্রতিষ্ঠিত আইন ও বিধান ছাড়া অন্য কোন ধরনের আইন ও বিধানের স্থায়িত্বের উপর আস্থা রাখার অর্থই হচ্ছে ক্ষমার অযোগ্য পাপ “শিরকে” লিপ্ত হওয়া, তখন, যেমন কুরআনে বলা হয়েছে,
“আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোন বিশ্বাসী পুরুষ কিংবা বিশ্বাসী নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে না।” (সূরা আল আহযাব, ৩৩:৩৬)
“তখন তারা তো কেবল এ কথাই বলে, ‘আমরা শ্রবণ করলাম ও মান্য করলাম।’ (সূরা আন নূর, ২৪:৫১)
নিঃসন্দেহে এটাই একজন মুসলিমকে সে যা তা হিসাবে চিহ্নিত করে: এমন কেউ যে তার নিজেকে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ইচ্ছার কাছে সমর্পণ করে। অবশ্যই সরকার গুলির অদক্ষতা, দুর্নীতি ও বর্বরতা, তাদের আদর্শের অবধারিত ব্যর্থতা, এবং তাদের পুনঃ পুনঃ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লাঞ্ছনা মৌলবাদীদের কাজকে সহজ করে দিয়েছে। তবুও এই ধারণা নিতান্তই সাধারণ যে এসবই মৌলবাদের উত্থানকে শক্তি যুগিয়েছে। নিশ্চিতভাবেই, মুসলিম জনগণের দারিদ্র ও অসহায় অবস্থা তাদেরকে অত্যন্ত আগ্রহের সাথেই “আধুনিকীকরণ”, “পশ্চিমাকরণ” এবং “গণতন্ত্রের” পথে ঠেলে দেওয়ারই কথা ছিল, তাদের দেশগুলো যেগুলির উজ্জ্বল উদাহরণ কদাচিত ছিল বলা চলে! নিঃসন্দেহে, সবচেয়ে সাধারণ কৃষকও প্রতিদিন টেলিভিশনের (সবচেয়ে দীনহীন ঘরেও যা একটি বিছানার মতই প্রয়োজনীয় জিনিসে পরিণত হয়েছে) পর্দায় পশ্চিমা বিশ্বের বস্তুতান্ত্রিক সাফল্যের চিত্রের প্রতিচ্ছবিই প্রতিদিন দেখতে পায়!
ইসলামী সচেতনতার এই ক্রমাগত বৃদ্ধির পেছনে সত্যিকার যে কারণ রয়েছে, তা সেগুলি নয় যা পশ্চিমা বিশ্লেষকরা সবসময় উল্লেখ করে থাকে। এই ব্যাপারটি বুঝতে তাদের অক্ষমতার আংশিক কারণ হচ্ছে নির্ভেজাল বস্তুবাদে তাদের নিমজ্জিত হওয়া। তারা বিশ্বাস করে যে বিজ্ঞান ও “বিবর্তনবাদ” প্রমাণ করেছে যে মানুষ অন্ততঃপক্ষে অগ্রসর জন্য ছাড়া আর কিছু নয়, কোন প্রগতিশীল বানর বলা যায়, এবং মানুষের মৌলিক চাহিদাসমূহ যেমন: খাদ্য, পানীয়, অজানা প্রাণী থেকে নিরাপত্তা, যৌনকামনা আমাদের ধরে নেওয়া পূর্বপুরুষদের থেকে সামান্যই ভিন্ন। এসবের পরিতৃপ্তি ঘটলেই মানুষের চরিতার্থতা। মুসলিম বিশ্ব কমবেশী মানবীয় অবস্থার বাস্তবতার সাথে সংস্পর্শ রেখেছে যে, সুখ একটি পার্থিব বস্তু নয়, বরং আরো গভীর কোনকিছু, এবং এর জ্ঞান থাকাটা প্রয়োজন, শুধুমাত্র বস্তুর চাহিদা মিটানোর চেয়ে মানবীয় অবস্থার ভালর জন্য হয়তো বেশীই প্রয়োজন। বস্তুবাদী মনোভাবের অশুভ ফলাফল আজ পশ্চিমা সমাজের পচন ধরা সামাজিক অবস্থায় অত্যন্ত প্রকট। মুসলিম দেশসমূহেও এর ফলাফল আজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
দ্বিতীয় যে কারণটির জন্য ইসলামী পুনর্জাগরণ এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তা হলো, আজ বহু মুসলিম বিশেষ করে অধিক স্বাক্ষর ও শিক্ষিতদের কাছে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে পশ্চিম নিজেই সত্যি সত্যি “গণতন্ত্র” বা এ ধরনের অন্য কোন আদর্শে, যেমন “বাক স্বাধীনতা”, “মানবাধিকার” ইত্যাদিতে বিশ্বাসী নয়, যা সে এত যত্নে লালন করেছে বলে দাবী করে-যতক্ষণ না সেগুলি তাদের স্বার্থরক্ষা করে। এই দুই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি কেবল মৌলবাদীদের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। কার্যতঃ বর্ধনশীল হারে পশ্চিমারা অনুরূপ মনোভাব প্রকাশ করতে শুরু করেছে। প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমাদের কাছে অতীত পরাজয়, নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করা, অদক্ষ ও দুর্নীতিবাজ সরকার-এর কোনটাই ইসলামের বিস্ময়কর উত্থানের গ্রহণযোগ্য কারণ নয়। সামপ্রতিক হিসাবে শুধুমাত্র ইংল্যান্ডেই গড়ে প্রতিদিন তিনজন ইসলাম গ্রহণ করছে। আমেরিকায় এই সংখ্যা আরো বেশি এবং এসবই ঘটছে, ইসলামের বিরুদ্ধে রাজনীতিবিদ ও প্রচারমাধ্যমগুলির অবিরত বিকৃতি ও জালিয়াতি সত্ত্বেও। কার্যত যে সমস্ত দেশে দর্শনীয়ভাবে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ছে (মিশর ও আলজিরিয়া), সেখানে সরকার, বেতার, টিভি এবং সংবাদ সংস্থা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে। এতদসত্ত্বেও লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছে (আক্ষরিক অর্থে) চৌদ্দশত বছর পুরনো এক বইয়ের প্রতি ফিরে যাওয়ার জন্য। কিভাবে এটা সম্ভব? নিশ্চয়ই “বিজ্ঞান” এবং “যুক্তি” কুরআন এবং ইসলামকে মারণাঘাত করেছিল যেভাবে তা বাইবেল ও খৃষ্টানত্বকে করেছিল? মনে হচ্ছে ব্যাপারটি তা ঘটেনি, এবং কেন নিশ্চয়ই তার কোন উপযুক্ত কারণ আছে!
সেটিই হচ্ছে তৃতীয় কারণ এবং আসলে এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কেন মৌলবাদের এবং ইসলামের এই বিরাট উত্থান সম্ভব হলো? ইকোনমিস্টের প্রবন্ধে বলেছে:
“…বিংশ শতকের শেষভাগে এসে কেন অনেকের কাছে মুসলিম বিশ্বের সংস্কৃতিকে পশ্চিমের একমাত্র বাস্তব আদর্শিক প্রতিযোগী মনে হচ্ছে তার একটি উপযুক্ত কারণ রয়েছে। কনফুসিয়ানদের বিপরীতে, এবং আরো বেশী করে ল্যাটিন আমেরিকান, স্লাভ ও জাপানীদের বিপরীতে-ইসলাম দাবী করে যে তা অতিপ্রাকৃত নিশ্চয়তার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এই নিশ্চয়তা হচ্ছে আল্লাহর বাণী, যা প্রতিটি শব্দাংশে মুহাম্মাদের কাছে অবতীর্ণ হয়েছে। অধিকন্তু, এবং যা অন্য কোথাও ঘটছে না-নতুনেরা এই নিশ্চয়তার দাবীতে যোগ দিতে ভীড় জমাচ্ছে।” (পৃ. ৪, অ ২)
তাহলে এই জরিপ, মুসলিমদের বাস্তবে তাদের দ্বীন ত্যাগ করে ক্ষমার অযোগ্য পাপ “শিরক” করতে বলার আগে-আল্লাহর আইনকে মানব-রচিত আইন দিয়ে প্রতিস্থাপন করে-কুরআনকে “আল্লাহর বাণী” নয়, অন্ততঃ এর কিছু অংশ নয়, একথা ঘোষণা করল না কেন, যাতে এখানে সেখানে কিছু জোড়াতালি দিয়ে আগে যা ঘটেছিল তার সাথে সমতা রক্ষা করা যায়? অন্ততঃ বাইবেলের ব্যাপারে এ কাজটি তো দক্ষতার সাথে সম্পাদন করা গেছে। সমপ্রতি বিশ্বের প্রথম সারির বাইবেল বিশেষজ্ঞদের একটি প্রতিনিধি দল বলেছেন যে যীশুর কথা বলে দাবী করা শব্দের প্রায় ৭০% ভাগই তার কথা নয়, এবং ধর্মযাজকগণ কোন ঝুঁকি ছাড়াই বলছেন যে বাইবেলের কোন কোন অধ্যায়, যেমন সোডোম ও গোমোরা শহরে সমকামীদের আল্লাহ কর্তৃক ধ্বংস হওয়া, আল্লাহর বাণী নয়। কার্যতঃ বিজ্ঞান ও আধুনিক বাইবেল বিশেষজ্ঞগণ বাইবেলের বাণীর সত্যতা সম্পর্কে মোটের উপর এতই সংশয় বিস্তার করেছে যে যারা বাইবেল “আল্লাহর বাণী” এই অসমর্থনীয় মতকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়, তাদের সম্পর্কে একটা ক্ষতিকর শব্দ বানানো হয়েছে: মৌলবাদী! আসলে খৃষ্টান মৌলবাদীরা বাইবেল সম্পর্কে সেই দাবীই করে যা মুসলিমরা কুরআন সম্পর্কে করে থাকে। তাহলে খৃষ্টানদের দাবী কেন সমানভাবে শক্তিশালী শক্তি এবং অনুরূপ আদর্শিক প্রতিযোগী হিসাবে গণ্য হয় না? কারণ হচেছ যে দাবী করলেই কোন কিছুর ভিত্তি তৈরী হয় না। দাবী প্রমাণ করতে হয়, এবং সাক্ষ্যপ্রমাণের গ্রহণযোগ্যতা দাবীর শক্তিস্বরূপ। খৃষ্টানদের পক্ষে বাইবেল “আল্লাহর বাণী” এই দাবীতে অটল থাকা কঠিন, কারণ সাক্ষ্যপ্রমাণ এর বিরুদ্ধে যায়।
“ইনজিলের” সত্যতার মোহ মধ্যযুগে বজায় রাখা সম্ভব ছিল, কারণ খুব কম সংখ্যক লোকের কাছেই তা সহজলভ্য ছিল, এবং তারা ছিল পাদ্রীরা! পোপের হুকুমে অন্যদের তা পড়া নিষেধ ছিল, এমনকি কখনও তা পড়ার জন্য মৃত্যুযন্ত্রণা পেতে হয়েছে। শিক্ষা বিস্তারের সাথে সাথে এবং “আলোকিত যুগের” শুরুর সময় বাইবেল সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছায়। এর আভ্যন্তরীণ বৈপরীত্য এবং বৈজ্ঞানিক অসামঞ্জস্য প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে তা সম্মান হারিয়ে ফেলে।
“বিজ্ঞানই” হচ্ছে আধুনিক বিশ্বের নিশ্চয়তার দাবী, যা, এই দাবী করে যে তা হচ্ছে চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং কারিগরি বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণ। এর ফলাফল হচ্ছে এর প্রয়োজনীয়তার প্রমাণ, এবং “গণতন্ত্রের” ডানার আশ্রয়ে এই ফলাফল অর্জিত হয়েছে। এভাবে এই দুটো পরস্পর জড়িত। “গণতন্ত্রের” সপক্ষে যুক্তিসমূহের একটি হচ্ছে বিগত পঞ্চাশ বছরে গণতান্ত্রিক জাতিগুলির মধ্যে বড় কোন দ্বন্দ্বের অনুপস্থিতি, এবং অপরটি হচ্ছে এর দ্বারা অর্জিত বস্তুগত সমৃদ্ধি। আসলে, আমার মনে পড়ছে যে আমি ইকোনমিস্টে পড়েছি: “অন্যান্য সভ্যতার তুলনায় পশ্চিমা জাতিগুলি অধিক হারে মানুষের বস্তুগত চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়েছে।” সব যুক্তিই অত্যন্ত শক্তিশালী। এভাবে দাবী তৈরী হলো এবং একে সমর্থনের প্রমাণও যোগাড় করা হলো। (আমরা ইনশাল্লাহ, পরবর্তীতে এই দাবীর যৌক্তিকতা বিচার করবো।) যাহোক, এখানেই শেষ হলো না। দাবী এবং আনুষঙ্গিক সাহায্যকারী প্রমাণ থেকে আদর্শকে রূপদান করা হলো, তা না হলে জরিপের লেখক কাউকে এই পরামর্শ (মুসলিম বিশ্ব ছাড়াও) দেওয়ার ধৃষ্টতা দেখাতেন না যে তাঁর ধারণাগুলি গ্রহণ করা উচিত, তিনি বলেছেন বলেই! তিনি বিশ্বাস করেন যে “আধুনিক জীবনযাত্রার” সপক্ষে তাঁর প্রদত্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের যথার্থতা তাঁর পরামর্শগুলিকে জোরদার করতে যথেষ্ট। অংশত যা “গণতন্ত্র”কে গণতন্ত্র হিসাবে তৈরী করেছে তা হচ্ছে আপোষকামিতার নীতি এবং বাস্তবধর্মীতা যা মানবীয় অজ্ঞতা এবং দোষের আলোকে সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত। সমস্যা এই যে ইকোনমিস্টের জরিপ আশা করে যে ইসলাম অনুরূপ কাঠামোতে কাজ করবে। ইসলাম, অপরপক্ষে, এই নিশ্চয়তার উপর ভিত্তি করে তৈরী যে তা সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছ থেকে অবতীর্ণ। এর অনুসিদ্ধান্ত সমূহের মধ্যে সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে আল্লাহ মানুষের মত অজ্ঞ এবং দোষত্রুটিপূর্ণ নন, বরং তিনি সর্বজ্ঞানী ও সম্পূর্ণভাবে ত্রুটিহীন, এবং সেজন্যই আল্লাহর বাণীর ব্যাপারে আপোষের কোন প্রশ্ন নেই, নেই প্রয়োগবাদের দর্শন – বিশেষভাবে অনুমোদিত ক্ষেত্র ছাড়া।
সবকিছুই ব্যাখ্যা করা সম্ভব, এই যুক্তিতে জরিপে এইসমস্ত বাধাবিঘ্ন এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, কিন্তু আসলে আল্লাহ ইতোমধ্যেই এই সম্ভাব্য ছিদ্রপথ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বন্ধ করে দিয়েছেন যখন তিনি চৌদ্দশত বছর পূর্বে একজনের মাধ্যমে ইসলাম অবতীর্ণ করেছিলেন যাতে তিনি তাঁর আয়াতসমূহ ব্যাখ্যা করেন:
“আমরা তোমার প্রতি গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি, এবং তোমাকে নিযুক্ত করেছি মানুষকে তা বোঝাবার জন্য।” (সূরা আন্তনাহল, ১৬:৪৪)
অতএব কুরআনের পাঠ্যাংশের ব্যাখ্যার জ্ঞান বিশেষভাবে মুহাম্মাদ (সঃ) কেই দেওয়া হয়েছিল, এবং এখানেই শেষ করা হয়নি। কুরআন আরো বলছে:
“যে কেউ রাসূলের বিরোধিতা করে এবং বিশ্বাসীদের পরিবর্তে অন্য পথ বেছে নেয়, তাহলে আল্লাহ তাদেরকে তাদের নির্বাচিত পথে চলার জন্য ছেড়ে দেবেন এবং তাদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন, কতই না মন্দ আশ্রয় সেটা!”
বিশ্বাসীদের পথ কি? নবী (সঃ) ব্যাখ্যা করেছেন: “যার উপর আমি ও আমার সাহাবারা আছে”। নবী (সঃ) আরো বলেছেন মুসলিমরা যেন তাঁর ও হিদায়াত প্রাপ্ত অনুসারীদের পথ আঁকড়ে ধরে থাকে। এই সাহাবারা বংশ পরম্পরায় জ্ঞান এবং পথ বর্ণনা করে গেছেন বর্তমান সময় পর্যন্ত; ঠিক যেভাবে নবী (সঃ) বলেছিলেন তাঁরা করবেন:
“এই উম্মাতের ভিতর থেকে সবসময় একটি দল থাকবে যারা সত্যের উপর দৃঢ় হবে, তাদের বিশ্বাসে অক্ষত থাকবে তাদের বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও।”
এটা হচ্ছে ঠিক সেই ধরনের উপলব্ধির ক্ষমতা যা ইসলামকে সমালোচকদের কাছে হতাশাব্যঞ্জক ও অনুগামীদের কাছে প্রত্যয়ী করে তোলে। এবং এই উপলব্ধির ক্ষমতা ইসলামের বিভিন্ন দিক ও বিভাগে বিস্তার লাভ করে। ইসলামের এই দাবী যে এটা এই নিশ্চয়তার উপর ভিত্তিশীল যে এটা সর্বজ্ঞানী সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে, এটা কেবল দাবীই নয়, বরং এই দাবীর পেছনে রয়েছে শক্তিশালী প্রমাণ। এর অনুগামীদের জন্য এই প্রমাণ যথেষ্ট শক্তিশালী যা আধুনিক বিশ্ব কর্তৃক প্রদত্ত প্রমাণের উপর অগ্রগণ্য।
  
পর্ব ৪ : এ সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই!


তাহলে কি সেই প্রমাণ যা ইসলাম দৃঢ় প্রত্যয় উৎপাদনকারী হিসাবে উপস্থাপন করে? প্রথম বিচার্য বিষয় হচ্ছে বিশুদ্ধতা। পাঠ্যাংশের বিশুদ্ধতা সমগ্র “ভাণ্ডারের” মমার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ একবার যদি কোন পাঠ্যাংশ কোন তাত্ত্বিক বা রাজনৈতিক যুক্তিযুক্ততা সিদ্ধ করার জন্য বিকৃত বা পরিবর্তিত করা হয়, এবং যদি বিকৃতি থেকে বিশুদ্ধকে পৃথক করার কোন নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি না থাকে, তাহলে পাঠ্যাংশে এমন কোন অনুচ্ছেদ পাওয়া যাবে না যা প্রশ্নাতীত। বিশুদ্ধ ও সংরক্ষিত বিষয়বস’র ক্ষেত্রে এটা ততটা সহজ নয়। খৃষ্টান মৌলবাদীরা এটা ভালই জানে। যদি এটা “আল্লাহর বাণী” না হয়, তবে পথ নির্দেশনা হিসাবে এর কোন মূল্য আছে জ্ঞানের সংকলন হওয়া ব্যতীত? খুব কমসংখ্যক সত্যিকার পণ্ডিত লোকই, এমনকি ইসলামের প্রতিপক্ষের মধ্যে থেকেও, কুরআনের ঐতিহাসিক বিশুদ্ধতা নিয়ে বিতর্ক করার প্রয়াস পেয়েছেন। আসলে এটা একটা অর্থহীন পণ্ডশ্রম ছাড়া আর কিছুই হবে না, কারণ যে কেউ প্রাক্তন সোভিয়েট ইউনিয়নের তাশখন্দে ভ্রমণ করতে প্রস্তুত থাকবে, সেখানে নবী (সঃ) এঁর সাহাবী কুরআনের লেখক জায়েদ ইবনে সাবিত এর স্বহস্তে লিখিত কুরআনের সম্পূর্ণ কপি দেখতে পাবে, যা নবী (সঃ) এঁর মৃত্যুর দুবছরের মধ্যে প্রথম খলিফা আবু বকরের আদেশে লেখা হয়েছিল। তাশখন্দের পাণ্ডুলিপিটি জায়েদের লেখা প্রথম পাণ্ডুলিপির নকল, যা জায়েদেরই নিজের হাতে করা, কিন্তু সেটি তৃতীয় খলিফা ওসমান বিন আফফান এর আদেশে বার বছর পরে করা হয়। যার উপর পঞ্চাশের অধিক সাহাবার ঐকমত্য হয়েছিল, যাঁরা নিজেরা কুরআনের অংশবিশেষের লেখক ছিলেন এবং আরও অনেকের, যাঁরা স্মৃতিতে কুরআন ধরে রেখেছিলেন। এই “উসমানীয় কুরআন”, এই নামেই যা পরবর্তীতে পরিচিতি লাভ করেছিল, তখন জীবিত নবী (সঃ) এর সব সাহাবার দ্বারা গৃহীত হয়েছিল কোন ব্যতিক্রম ছাড়া, সেই এক ও অভিন্ন কুরআন হিসাবে যা আল্লাহর চূড়ান্ত রাসূল মুহাম্মাদ (সঃ) এঁর উপর আল্লাহ অবতীর্ণ করেছিলেন। যে কেউ কুরআনের যে কোন কপি পৃথিবীর যে কোনখানের কোন মসজিদ থেকে নিতে পারেন এবং জায়েদের মুসহাফের সাথে মিলিয়ে দেখতে পারেন, তিনি দুটিকে অভিন্ন দেখতে পাবেন অক্ষরে অক্ষরে। যে উচ্চারণে নবী (সঃ) কুরআন তিলাওয়াত করতেন, আজ পর্যন্তও সেই একই উচ্চারণে কুরআন তিলাওয়াত হয়। অধিকন্তু কুরআনের ভাষা, আরবী হচ্ছে একটি জীবন্ত ভাষা, এবং এই কিতাব সবসময়েই জনসাধারণের হাতের নাগালেই ছিল-শুধুমাত্র কতিপয় ধর্মযাজকের অন্দরমহলে নয়।
সুতরাং যে কেউ কুরআন পাঠ করবে সে যুক্তিগ্রাহ্য সন্দেহের সীমার বাইরে নিশ্চিত বোধ করতে পারে যে তারা সেই একই শব্দাবলী পাঠ করছে যা মুহাম্মাদ (সঃ) এঁর কাছে চৌদ্দশত বছর আগে অবতীর্ণ হয়েছিল।
“নিশ্চয়ই আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষণ করব।” (সূরা আল হিজর, ১৫:৯)
এই বক্তব্যের ফলাফল লাভের বাস্তবতা মানবজাতির প্রতি একটি স্পষ্ট প্রমাণ, এবং কুরআনের স্পষ্ট প্রকাশিত অলৌকিক ঘটনাবলীর অন্যতম। এ ছাড়াও এই সংরক্ষণ শুধু কুরআনের জন্য সীমাবদ্ধ নয়, তা এর ব্যাখ্যার জন্যও যাকে সুন্নাহ বলা হয় অর্থাৎ নবী (সঃ) এঁর কথা, কাজনীরব সম্মতি। এ সবই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে খুঁটিনাটিসহ তাঁর স্ত্রীগণ ও সাহাবাগণ মুখস্থ করে ও লিখে রেখেছেন এবং শিক্ষা দিয়েছেন যা হিজরী দুই থেকে তিনশত সনে হাদীসের বিখ্যাত পুস্তকসমূহে সংগৃহীত হয়েছে। হাদীস সাহিত্যের সম্ভার বলা যায় বেশ অন্যায্যভাবেই কুরআনের বিশুদ্ধতার সাধারণ গ্রহণযোগ্যতার মত অনুরূপ গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এটা শুধুমাত্র এজন্য যে, যে উপায়ে হাদীস সংরক্ষিত হয়েছে তা ছিল কুরআনের চেয়ে দীর্ঘতর ও জটিলতর, এবং সেজন্যই তা ইসলামের শত্রুদের সহজ লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। কিছু প্রাচ্যবিদ এ দাবীও করেছেন যে হাদীসের বিশুদ্ধতার হার বাইবেলের পাঠ্যাংশের মতই। আপাতঃ সাদৃশ্য থাকলেও এটা খুবই ভাসাভাসা তুলনা। উদাহরণ স্বরূপ হাদীসের প্রধান পুস্তকসমূহ যেমন সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম এবং সুনানে আবু দাউদ হিজরী দুইশত সাল পার হওয়ার ঠিক আগে পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। যারা এগুলিকে সংকলন করেছিলেন তারা নিজেরা কেউ চাক্ষুষ সাক্ষী ছিলেন না। হাদীস সাহিত্যের সমগ্র ভাণ্ডারে বহু হাদীস পরিষ্কারভাবে জাল করা হয়েছে এবং সন্দেহযুক্ত, এবং সামগ্রিকভাবে এতে পরস্পর-বিরোধিতা রয়েছে।
সাধারণভাবে এই বক্তব্যগুলি সত্য, কিন্তু হাদীস সংরক্ষণের বিস্তারিত ইতিহাস অধ্যয়ন করলে তৎক্ষণাত চোখে পড়ে যে বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন।
  • প্রথমতঃ যেমন আমরা কুরআন সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছি, নবী (সঃ) এঁর ভাষা সংরক্ষিত হয়েছে।
  • দ্বিতীয়তঃ যে সমস্ত প্রধান হাদীস বইয়ের কথা আমরা উল্লেখ করেছি, সেগুলি পূর্বের ও ক্ষুদ্রতর সংকলনসমূহের চেয়ে তেমন নতুন কিছু নয়। এছাড়াও বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মৌখিক বর্ণনা ছিল, কিন্তু নবী (সঃ) এর বাণীর সংগ্রাহকগণ যে কোন বর্ণনাকে নবীর (সঃ) বর্ণনা বলে উপযুক্ত প্রমাণ ব্যতীত নিশ্চিত হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। যে পদ্ধতিতে এই ব্যাপারটি সম্পাদিত হতো তা হচ্ছে ‘ইসনাদ’বা বর্ণনাকারীদের ধারাক্রম। নবী (সঃ) মৃত্যুর পর ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই বিভিন্ন দলের উদ্ভব ঘটেছিল যারা সাহাবাগণ কর্তৃক প্রাপ্ত ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হয়েছিল। এসব উপদলগুলি নবী (সঃ) এঁর নামে বিভিন্ন হাদীস তৈরী করে প্রচার করত। ফলে নবী (সঃ) এঁর সাহাবারা কেউ হাদীস বিবৃত করলেই তার কাছে থেকে বর্ণনাকারী সাহাবার নাম জানতে চাইতেন, এভাবে বিবৃতকারীর বক্তব্যের সত্যতা সুনিশ্চিত হতো। সাহাবাদের শিষ্যরা এই পদ্ধতি অনুসরণ করতে থাকেন, এবং সুরক্ষার জন্য আরও পদক্ষেপ নেওয়া হয় এভাবে যে শুধু বর্ণনাকারী সাহাবার নাম নয়, তার পরবর্তী বর্ণনাকারীর নামও চাওয়া হয়। এসব বর্ণনাকারীর গ্রহণযোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য শর্ত আরোপ করা হয়। বিভিন্ন শর্তের উপর বিভিন্ন বিজ্ঞ ব্যক্তিগণ দ্বিমত পোষণ করেন, কেউ অন্যদের চেয়ে বেশী কড়াকড়ি আরোপ করেন, কিন্তু তিনটি মৌলিক চাহিদার ব্যাপারে সকলেই একমত হন।
  • প্রথমতঃ বর্ণনাকারীকে একজন সৎ মুসলিম হতে হবে।
  • দ্বিতীয়তঃ তারা কোন কিছু ভুলে যান না এমন স্মৃতিশক্তি থাকতে হবে এবং
  • তৃতীয়তঃ তারা কখনো মিথ্যাবাদী হবেন না।
পরবর্তী প্রজন্মের হাদীস প্রচারকরা তাঁদের হাদীসের শিক্ষাদানের সময় উপস্থিত লোকেদের নাম লিখে রাখতেন। কোন হাদীস বর্ণনা ও ব্যাখ্যাদানের সময় উপস্থিত না থাকলে কাউকে সেই হাদীস শিক্ষকের উদ্ধৃতি দিয়ে ঐ হাদীস বর্ণনা করতে অনুমতি দেওয়া হতো না। এভাবেই “রিজাল” শাস্ত্রের উদ্ভব হয় যেখানে হাদীসের সমস্ত বর্ণনাকারীর চরিত্র, স্মৃতিশক্তির বিবরণ, বাসস্থান, সফরসমূহ, শিক্ষক, ছাত্র তাদের সম্পর্কে অন্যান্য পণ্ডিতদের মতামত লিখিত থাকত। এভাবে যত উপায়ে সম্ভব এটা সুনিশ্চিত করার ব্যবস্থা নেওয়া হয় যাতে হাদীস শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞগণ কোন হাদীসকে নবী (সঃ) এর সহীহ হাদীস বলে ঘোষণা করলে সেটা তাই হবে, কোন যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ ছাড়া যা তিনি উল্লেখ করেছেন। এই পদ্ধতি যে শুধুমাত্র নবী (সঃ) এঁর বক্তব্য সম্পর্কে ব্যবহার করা হয়েছে তা না, বরং সাহাবাদের এবং আদি যুগের বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য সম্পর্কেও ব্যবহৃত হয়েছে। বস্তুত, যেকোন সত্যাশ্রয়ী জ্ঞানী ব্যক্তি এভাবে নবী (সঃ) পর্যন্ত তাঁর শিক্ষকদের ইসনাদ উপস্থাপন করতে পারবেন! বিষয়বস্তুর বর্ণনা ও প্রাসঙ্গিক বিশুদ্ধতা ছাড়াও কুরআন নিজেই এই দাবীর সত্যতার প্রমাণ উপস্থাপন করেছে যে এটা আল্লাহর বাণী । অবশ্যই “প্রমাণ” একটি বড় ব্যাপার বিশেষতঃ যখন এটা আল্লাহর অথবা ধর্মের বেলায় প্রযোজ্য হবে। বিশেষ করে “পশ্চিমা মানসের” পক্ষে, যারা গত দুই হাজার বছর যাবত খৃষ্টবাদের এই ধারণা কবলিত, যে ধর্মকে হতে হবে “রহস্যময়”“উপলব্ধির বাইরে”। আল্লাহ এবং ওহীর ধারণা যে শুধু যুক্তিগ্রাহ্য তাই নয়, প্রমাণেরও যোগ্য, এটা অবিশ্বাসের সাথেই দেখা হয়। আসলে, ব্যাপারটা কি? যদি এটা প্রমাণ করা যায়, তাহলে বিশ্বাসের স্থান কোথায়? এটা এ কারণে যে খৃষ্টান বিশ্বকে শেখানো হয়েছে যে “বিশ্বাস” অর্থ হচ্ছে অবিশ্বাস্যকে প্রমাণ ছাড়া মেনে নেওয়া“ত্রিত্ববাদ” নামক অর্থহীন তত্ত্ব এবং একে ঘিরে ধর্মতাত্ত্বিক প্যাঁচাল এটাই প্রকাশ করছে। খৃষ্টানদের কাছে আশা করা হয় যে তারা বিশ্বাস করবে কালোকে সাদা বলে কিন্তু সেটা কালোই থাকবে, অথবা তাদের ভাষায় যে অদৃশ্য, স্বয়ংসম্পূর্ণ, অপরিবর্তনীয়, সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ সৃষ্টিকর্তা একজন দৃশ্যমান, অভাবগ্রস্ত ও মরণশীল, ত্রুটিপূর্ণ জীবে পরিণত হলেন এবং ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন এবং তারপরও এই মানুষটি অদৃশ্য, স্বয়ংসম্পূর্ণ, অপরিবর্তনীয়, সর্বশক্তিমান এবং সর্বজ্ঞ সৃষ্টিকর্তা-সম্পূর্ণ খোদা এবং সম্পূর্ণ মানুষ। অবশ্যই যার মন আছে সে বুঝবে যে অনিবার্যভাবেই একটি অপরটিকে নিবারণ করে। যা সম্পূর্ণরূপে উপাস্য, তা কখনও একজন মানুষ হতে পারে না বা মানবীয় গুণাবলী ধারণ করতে পারে না, কারণ তা এমন সত্তাকে সত্যিকার উপাস্য হওয়া থেকে খারিজ করে দেবে। আরো বলা যায় যে, যে মানুষের ভিতরে আল্লাহর গুণাবলী থাকে, সে মানুষ থাকবে না। “ব্যাখ্যার অযোগ্য”-কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ত্রিত্ববাদের উদ্ভব ঘটেছে: একজন খোদা তিনটি সত্তা দিয়ে তৈরী, তিনটিই সম্পূর্ণ খোদা, (এবং সেজন্য অভিন্ন, তবুও কোন না কোনভাবে ভিন্ন) কিন্তু তিনটি মিলে খোদা একটিই। অধিকন্তু খৃষ্টানদের বিশ্বাস করতে বলা হয় যে মানুষের মুক্তি এই বিশ্বাসে নিহিত যে খোদা নিজেকে হত্যা করেছেন (বা তাঁর পুত্র, বা একজন নির্দোষ মানুষ, বা একসাথে তিনটিই) পাপের বোঝার মুক্তিপণ হিসাবে-যে পাপ তিনি সমস্ত মানুষের উপর আরোপ করেছেন-আদম ও হাওয়ার নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খাওয়ার পাপের জন্য! এই তালগোল ব্যাপার নিয়ে যখন কোন খৃষ্টান একঝাঁক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়, তখন তার একমাত্র আশ্রয় হচ্ছে একথা যে এগুলি সবই “রহস্যময়”, এবং যদি তুমি জাহান্নাম থেকে বাঁচতে চাও তবে প্রশ্ন করা বন্ধ কর এবং একে একটি বিশ্বাসের বিষয় হিসাবে গ্রহণ কর। তারপরও এটা অবাস্তব মনে হয় যে ন্যায়পরায়ণ সৃষ্টিকর্তা যুক্তি ও বুদ্ধির সর্বক্ষেত্রে অগ্রহণযোগ্য এবং উপলব্ধির অযোগ্য ব্যাপার প্রত্যাখ্যান করার জন্য কাউকে শাস্তি দেবেন যেখানে তিনি মানুষকে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দিয়েছেন, কোন শক্তিশালী প্রমাণ দেখানো ছাড়াই যে তাদের সেটাই করা উচিত।
অপরপক্ষে কুরআন মানবজাতিকে তাদের সচেতনতা ও যুক্তি ব্যবহার না করার জন্য তিরস্কার করেছে, এবং বলেছে যে এটা করার ব্যর্থতা নিজেই তাদের ধ্বংসের একটি কারণ:
“যারা তাদের প্রতিপালককে অস্বীকার করে তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের শাস্তি ; তা কত মন্দ প্রত্যাবর্তন স্থল। যখন তারা নিক্ষিপ্ত হবে, তারা লেলিহান জাহান্নাম থেকে উদ্ভূত একটি বিকট শব্দ শুনবে, রোষে জাহান্নাম যেন ফেটে পড়বে। যখনই তাতে কোন দলকে নিক্ষেপ করা হবে, জাহান্নামের রক্ষীরা তাদের জিজ্ঞাসা করবে, ‘তোমাদের নিকট কি কোন সতর্ককারী আসেনি?’ তারা বলবে, ‘অবশ্যই আমাদের নিকটে সতর্ককারী এসেছিল, আমরা তাদের মিথ্যাবাদী গণ্য করেছিলাম এবং বলেছিলাম, আল্লাহ কিছুই অবতীর্ণ করেন নি, তোমরা তো মহা-বিভ্রান্তিতে রয়েছো।’ এবং তারা আরো বলবে, ‘যদি আমরা তাদের কথা শুনতাম অথবা বিবেকবুদ্ধি প্রয়োগ করতাম, তাহলে আমরা জাহান্নামবাসী হতাম না।’ ” (সূরা আল-মুলক, ৬৭:৬-৯)
কার্যত ইসলামী ধর্মতত্ত্বে এমন কিছুই নেই যা সুস্থ যুক্তিগ্রাহ্য নয়। সত্যি বলতে কি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহি আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বা কুরআন সম্পর্কে কখনও কিছু না শুনে যে কারো পক্ষে যে কোনখানে ইসলামের মমার্থ বোঝা সম্ভব। এটা এজন্য যে, যে কেউ আমাদের চারিপাশের পৃথিবী ও মহাবিশ্বের গঠন ও এর মাঝে জড়িত কর্মকৌশল খেয়াল করবে সেই তাৎক্ষণিকভাবে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব উপলব্ধি করবে এবং একথাও যে সমস্ত শক্তি ও নিয়ন্ত্রণ এই সত্তার অধিকারে, এবং সে কারণে সত্যিকারভাবে একমাত্র তিনিই ইবাদতের যোগ্য, এবং সৃষ্টিকর্তার ইবাদতের জন্য একজনকে তাঁর কাছ থেকে প্রাপ্ত নির্দেশনার উপর নির্ভর করতে হবে। এটা করার চেষ্টাই হচ্ছে “ইসলাম”, যার অর্থ হচ্ছে “আল্লাহর প্রতি বিশ্বস্ততা ও আনুগত্য”। এই বিশ্বজনীনতা ও সারল্য ইসলামের ঐশী উৎপত্তির পক্ষে একটি শক্তিশালী যুক্তি। মুসলিমের জন্য বিশ্বাস কখনো প্রমাণ ও যুক্তির অন্ধকারে অন্ধভাবে ঝাঁপ দিয়ে পড়া নয়, বরং চিন্তা, অভিজ্ঞতা, সহজাত প্রবৃত্তি এবং সাক্ষ্যপ্রমাণের ফলাফল হিসাবে নেওয়া পদক্ষেপ। চূড়ান্ত পর্যায়ে এটা একটিমাত্র সত্যকে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করা, কিন্তু এটা কোন বিশেষ তত্ত্বে বিজ্ঞানীর বিশ্বাসের চেয়ে বা কোন ডাক্তারের চিকিৎসার কোন কার্যকরী ও প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতির উপর বিশ্বাসের চেয়ে বেশী অন্ধ নয়। আদালতে জুরীর বিচারের সাথে এর তুলনা করা যেতে পারে। আদর্শভাবে যা চাওয়া হয় তা হলো যে, মামলা সম্পর্কে জুরীর সামনে সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থিত করা হয়। যখন সাক্ষ্যপ্রমাণের গুরুত্ব উপসংহারমূলক হয় তখন জুরী তার সিদ্ধান্ত প্রদান করে। এটা বলা তার জন্য যথেষ্ট নয় যে: “বেশ, আমরা সাক্ষ্যপ্রমাণ সত্যিই প্রত্যয় উৎপাদনকারী হিসাবে পাচ্ছি!” শেষ পর্যন্ত তাকে অবশ্যই সিদ্ধান্তে আসতে হবে, “দোষী!” অথবা “নির্দোষী!”, সত্যের উপর ভিত্তি করে। তেমনি ইসলামে সৃষ্টিকর্তা মানুষের সামনে উপসংহারমূলক প্রমাণসমূহ উপস্থাপন করেছেন, যার ভিত্তিতে মানুষকে তাদের বিশ্বাসের ঘোষণা দিতে হবে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে।

পর্ব ৫ : সাক্ষ্যপ্রমাণের গুরুত্ব 
 
আল্লাহ কুরআনে সাধারণভাবে সমগ্র মানবজাতির প্রতি এবং বিশেষভাবে আরবদের প্রতি প্রতিদ্বন্দ্বিতার আহ্বান জানিয়েছেন:
“আমি আমার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকলে তোমরা তার অনুরূপ কোন সূরা আনয়ন কর, এবং যদি তোমরা সত্যবাদী হও তবে আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের সকল সাক্ষীকে আহ্বান কর।” (সূরা আল-বাকারা, ২:২৩)
মুহাম্মাদ (সঃ) এঁর সময় আরব সভ্যতা উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না-কোন বিশাল রাস্তা অথবা সরকারী ভবন, বা বৈজ্ঞানিক অথবা চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান, কিছুই নয়। বাস্তবে তারা খুবই আদিম ও বর্বর জীবন যাপন করত। একটি বিষয়েই তারা উৎকর্ষ অর্জন করেছিল-তা তাদের ভাষা। তারা কবিতার অত্যন্ত ভক্ত ছিল, এবং নিজেদের কাব্যদক্ষতা নিয়ে গর্ব করত। তারা পরস্পরের প্রশংসা করত, সতর্ক করত, উপদেশ দিত-এবং তর্কবিতর্কও করত-কবিতার মাধ্যমে। শুধু কবিতার জন্যই সেখানে উহাজ নামক জায়গায় বাৎসরিক মেলা বসত-সবচেয়ে সুন্দর কবিতাগুলি কা’বার দরজায় ঝুলিয়ে দেওয়া হত। মুহাম্মাদের যুগে আরবরা তাদের ভাষাগত দক্ষতার শিখরে ছিল। বাস্তবে আরবীতে সবচেয়ে সুন্দর কবিতাগুলির একটি ছিল লাবিদ ইবনে রাবিআর, যার কবিতা, যখন উহাজে আবৃত্তি করা হয়েছিল, প্রশংসায় আরবরা তার সামনে মাথা নত করেছিল। এই লাবিদই যখন কুরআনের আয়াত শুনতে শুরু করল, সে ইসলাম গ্রহণ করল এবং কবিতা লেখা ছেড়ে দিল। যখন একবার তাকে কিছু কবিতা শোনাতে বলা হল, সে উত্তর দিল: “কি! কুরআনের পরেও?” আসলে বহু আরব শুধুমাত্র কুরআন শুনেই ইসলামে প্রবেশ করেছিল, কারণ তাদের জন্য সেটা কুরআনের ঐশী উৎপত্তির সিদ্ধান্তমূলক প্রমাণ ছিল। তারা জানত কোন মানুষের পক্ষে এমন আলঙ্কারিক কাব্য রচনা সম্ভব নয়। মানুষের কাছে কুরআনের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার আহ্বান অনুরূপ একটি কুরআন রচনা করা, এর অর্থ অনেকে যা ধারণা করে তা নয়, অর্থাৎ শেক্সপিয়ার, হোমার, শেলী বা কীটস যে অর্থে অদ্বিতীয় তা নয়। কুরআন তার গঠন শৈলীর দিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আরবী কবিতা “বিহার” (ছন্দ গঠন পদ্ধতি) এর দিক দিয়ে ষোলটি ভাগে বিভক্ত, এবং এছাড়াও তাদের আছে গণকদের ভাষণ, গদ্য কবিতা এবং সাধারণ ভাষণ। কুরআনের গঠন এর কোন ভাগেই পড়ে না এবং এটাই কুরআনকে অননুকরণীয় করেছে, এবং মুশরিক/প্রতিমা পূজারী আরবদের একে প্রতিরোধের ব্যাপারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় ফেলেছে। আলকামা বিন আবদুল মানাফ তা সুনিশ্চিতভাবে জানিয়েছেন যখন তিনি তাদের নেতাদের সম্বোধন করে বলেন: “ওহে কুরাইশ, তোমাদের উপর একটি নতুন দুর্যোগ আপতিত হয়েছে। যখন মুহাম্মাদ যুবক ছিলেন, তিনি ছিলেন তোমাদের মাঝে সবচেয়ে প্রিয়, ভাষণে সবচেয়ে সত্যবাদী এবং সর্বাধিক বিশ্বস্ত, তখন পর্যন্ত, যখন তোমরা তার চুলে রূপালী রেখা দেখতে পাও, তিনি তোমাদের কাছে তাঁর বাণী নিয়ে আসেন। তোমরা বলেছ তিনি একজন যাদুকর, কিন্তু তিনি তা নন, কারণ আমরা এমন বহু যাদুকর দেখেছি এবং তাদের মন্ত্র পড়া ও গিঁট দেওয়া দেখেছি। তোমরা বলেছ তিনি একজন গণক, কিন্তু আমরা এদের সাথে এবং এদের আচরণের সাথে পরিচিত, এবং আমরা তাদের ছন্দোবদ্ধ পদ্যও শুনেছি। তোমরা তাঁকে ভবিষ্যদ্বক্তা বলেছ, কিন্তু তিনি ভবিষ্যদ্বক্তাও নন, কারণ আমরা তাদের ছন্দোবদ্ধ কবিতাও জানি; এবং তোমরা তাঁকে কবি বলেছ, কিন্তু তিনি কবি নন, কারণ আমরা সব ধরনের কবিতা সম্পর্কেই জানি। তোমরা তাঁকে পাগল বলেছ, কিন্তু তিনি যাদুগ্রস্ত বা পাগল নন, কারণ আমরা যাদুগ্রস্তদের দেখেছি, এবং তাঁর মাঝে তাদের মত হাঁপানো ও ফিসফিস করা ও ঘোরের কোন লক্ষণ নেই। হে কুরাইশদের লোকসকল, তোমাদের নিজেদের কার্যাবলী নিয়ে চিনি-ত হও, কারণ আল্লাহর কসম, তোমাদের উপর গুরুতর বিপদ আপতিত হয়েছে।”
কুরাইশরা সিদ্ধান্ত নিল যে নবী (সঃ) এর বিরুদ্ধে একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য যে প্রচার তারা করতে পারে তা হলো যে তাঁর ভাষণ একজনকে তার বাবা, স্ত্রী, ভাই ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। অতএব হজ্জ্বের সময় আবু লাহাব মক্কার পথে পথে দাঁড়িয়ে থাকত এবং মানুষকে মুহাম্মাদের কথা শোনার ব্যাপারে সতর্ক করত। তুফাইল ইবনে আমর, দাওস গোত্র প্রধান এবং একজন বিশিষ্ট কবি, নিজে বলেছেন যে তাঁকে মক্কাবাসীরা সম্বোধন করে বলেছিল:
“ ‘হে তুফাইল, তুমি আমাদের শহরে এসেছ, এই লোকটি যে নবী বলে দাবী করছে, সে আমাদের কর্তৃত্বকে ধ্বংস করেছে এবং আমাদের সমপ্রদায়কে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করেছে। আমরা ভয় পাচ্ছি সে তোমার লোকদের মাঝে তোমাকে ও তোমার কর্তৃত্বকে খর্ব করতে সফল হবে, যেভাবে আমাদের মাঝে করেছে। এ লোকের সাথে কথা বলো না। কোন ভাবেই তার কি বলার আছে তা শুনবে না। তার বক্তব্য যাদুকরের মত, পিতা ও পুত্রে, ভাইয়ে ভাইয়ে এবং স্বামী-স্ত্রীতে বিভেদ সৃষ্টি করে।’ তারা আমাকে খুব অদ্ভুত নানা কাহিনী শোনাতে লাগল এবং তাঁর অবিশ্বাস্য কায়কারবারের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে আমাকে আতঙ্কিত করে তুললো। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে এই লোকের কাছে যাব না, বা তার সাথে কথা বলবো না বা তার কোন কথাও শুনবো না। পরদিন আমি কাবার চারিদিকে তাওয়াফের জন্য ইবাদাতের স্থানে গেলাম, যা আমরা হজ্জের সময় আমাদের মূর্তির সম্মানার্থে ইবাদাত হিসাবে করে থাকি। আমি আমার কানে তুলা গুঁজে রাখলাম এই ভয়ে যে মুহাম্মাদের কথার কিছু অংশ যদি আমি শুনে ফেলি! আমি ইবাদাতের স্থানে ঢুকতেই তাঁকে কাবার কাছে দাঁড়ানো দেখতে পেলাম। তিনি আমাদের চেয়ে ভিন্ন ধরনের প্রার্থনা করছিলেন। তার সম্পূর্ণ ইবাদাতই ছিল অন্যরকমের। দৃশ্যটি আমাকে মোহিত করল। তাঁর ইবাদাত আমার ভিতরে কম্পন সৃষ্টি করল। এবং আমি তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হলাম, আমার অনিচ্ছাসত্ত্বেও এগিয়ে গেলাম যতক্ষণ না আমি তাঁর নিকটবর্তী হলাম। আমার সতর্কতা সত্ত্বেও তাঁর কিছু কথা আমার কানে গেল আল্লাহর ইচ্ছায়, এবং আমি নিজেকে শুনিয়ে বললাম: ‘তুমি কি করছ তুফাইল? তুমি একজন সহজে উপলব্ধি করতে সক্ষম কবি। তুমি কবিতার ভাল মন্দ নির্ণয় করতে পার। লোকটি কি বলছে তা শুনতে কিসে তোমাকে বাধা দিচ্ছে? তার কাছ থেকে যদি ভাল কিছু শোন, তবে তা গ্রহণ কর, এবং যদি তা মন্দ কিছু হয়, বর্জন কর।’ যতক্ষণ পর্যন্ত না ঘরে যাবার জন্য নবী তৈরী হলেন, আমি সেখানে রইলাম। তিনি যখন ঘরে প্রবেশ করলেন, আমি তাঁকে অনুসরণ করে প্রবেশ করলাম এবং বললাম: ‘হে মুহাম্মাদ, আপনার লোকেরা আপনার সম্পর্কে আমাকে কিছু কথা বলেছে। আল্লাহর কসম, তারা আমাকে আপনার বাণী থেকে ভয় দেখিয়ে দূরে সরিয়ে রেখেছে যেজন্য আমি এমনকি আমার কান তুলা গুঁজে বন্ধ রেখেছি আপনার কথা না শোনার জন্য। এত কিছুর পরও আল্লাহ আমাকে এর কিছু অংশ শুনিয়েছেন এবং আমি একে উত্তম পেয়েছি। সুতরাং আমাকে আপনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আরো কিছু বলুন।’ নবী (সঃ) বললেন এবং আমাকে সূরা ফালাক আবৃত্তি করে শুনালেন। আল্লাহর শপথ, এর আগে আমি কখনো এত সুন্দর ভাষা শুনিনি। না আমার কাছে এর চেয়ে মহৎ অথবা ন্যায় কোন উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে। তক্ষুণি, আমি তাঁর দিকে আমার হাত বাড়িয়ে দিয়ে আনুগত্যের শপথ নিলাম এবং সাক্ষ্য দিলাম যে আল্লাহ ছাড়া কেউ উপাসনার যোগ্য নেই এবং মুহাম্মাদ (সঃ) আল্লাহর রাসূল। এভাবে আমি ইসলামে প্রবেশ করি। এমনকি কুরাইশ নেতারাও কুরআন শুনায় বাধা দিতে সক্ষম ছিল না।”
ইবনে ইসহাকের সীরাতে (নবীর জীবনী) একটি ঘটনার উল্লেখ আছে যে আবু সুফিয়ান, আবু জেহেল এবং আল-আখনাস রাত্রিবেলা চুপিসারে তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে নবী (সঃ) এঁর কুরআন পাঠ শুনত-ভোর পর্যন্ত যার যার স’ানে লুকিয়ে থেকে। ফেরার পথে তারা একে অপরকে দেখতে পেল এবং পরস্পরকে ভর্ৎসনা করল, একথা বলে: “পুনরায় এমন করো না, কারণ যদি কোন দুর্বলমনা নির্বোধ তোমাদের দেখে, তোমরা তাদের মনে সন্দেহের উদ্রেক করবে।” একাধারে তিন রাত্রি এ ঘটনা ঘটলো, যতক্ষণ না তারা একে অপরের কাছে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করলো আর এমন না করার জন্য। কুরাইশদের এক পরামর্শ সভায়, যেখানে মুহাম্মাদের প্রচার বন্ধ করার সম্ভাব্য উপায় নিয়ে আলাপ আলোচনা হচ্ছিল, উতবা ইবনে রাবিআ নামক কুরাইশ নেতা পরামর্শ দিল যে মুহাম্মাদের কাছে কিছু প্রস্তাব রাখা হোক এবং “সে যা চায় তাকে দেয়া হোক, যাতে সে আমাদের শান্তিতে থাকতে দেয়।” নেতারা রাজি হলো, উতবা গেল এবং মুহাম্মাদের (সঃ) কাছে বসলো, বলল: “হে ভাতিজা, তুমি আমাদের গোত্রসমূহের সবচেয়ে সম্মানিত গোত্রের একজন এবং পূর্বপুরুষের দিক থেকে সম্ভ্রান্ত স্থানের অধিকারী, তুমি তোমার লোকেদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে এসেছ, এভাবে তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছো এবং তাদের রীতিনীতিকে হেয় করছো, এবং তুমি তাদের দেবদেবীদের ও তাদের ধর্মকে অপমান করছো, তাদের পূর্বপুরুষদের অবিশ্বাসী ঘোষণা করেছ, সুতরাং আমার কথা শোন, আমি কিছু প্রস্তাব রাখব এবং হয়তো তুমি সেগুলির কোনটিকে গ্রহণ করবে।” নবী (সঃ) শুনতে রাজী হলেন এবং সে বলল: “যদি তুমি যা চাও তা টাকা-পয়সা হয়, তাহলে আমরা তোমাকে আমাদের প্রধান বানিয়ে দেব যাতে কেউ তোমার বাইরে কোন সিদ্ধান্ত নিতে না পারে, যদি তুমি সার্বভৌম ক্ষমতা চাও, আমরা তোমাকে রাজা বানিয়ে দেব এবং এই দুষ্ট জ্বিন, যেটা তোমার কাছে আসে, তুমি যাকে দেখ, সেটা থেকে যদি তুমি মুক্তি না পাও, আমরা তোমার জন্য একজন চিকিৎসক খুঁজে বের করব এবং আমাদের সর্বস্ব ব্যয় করেও তোমাকে সুস্থ করে তুলব, কারণ প্রায়ই কোন পরিচিত আত্মা কোন মানুষের উপর ভর করে থাকে যতক্ষণ না তাকে সারিয়ে তোলা হয়।” নবী (সঃ) ধৈর্য্য ধরে শুনলেন এবং তারপর বললেন: “এখন আমার কথা শুনুন।” নবী (সঃ) তখন সূরা ফুসসিলাত (৪১ নং সূরা) এর শুরু থেকে সেজদার আয়াত পর্যন্ত তিলাওয়াত করলেন, তারপর সিজদা করলেন, সারাক্ষণ উতবা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল, তার হাতের উপর ভর দিয়ে বসে। নবী (সঃ) তারপর বললেন: “যা শোনার আপনি শুনেছেন, আবুল ওয়ালিদ, এখন বাকী আপনার উপর।” যখন উতবা তার সাথীদের কাছে ফিরে গেল তারা খেয়াল করলো যে তার মুখের ভাব সম্পূর্ণ বদলে গেছে এবং তারা জানতে চাইল কি হয়েছে। সে বললো যে সে এমন কিছু বাক্য শুনেছে যা সে কখনো শোনেনি, যা কবিতাও নয়, যাদুও নয়। “আমার উপদেশ নাও এবং আমি যা বলি তা কর। এই লোককে তার মত চলতে দাও; কারণ আল্লাহর শপথ, আমি যে বাণী শুনেছি তার উজ্জ্বলতা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে। যদি অন্য আরবরা তাকে হত্যা করে, তোমরা মুক্তি পেয়ে যাবে, যদি সে আরবদের উপর বিজয়ী হয়, তার ক্ষমতা হবে তোমাদের ক্ষমতা, তার শক্তি তোমাদের শক্তি, এবং তোমরা তার মাধ্যমে সমৃদ্ধি অর্জন করবে।” তারা বলল: “সে তোমাকে তার কথা দিয়ে জাদু করেছে।” যার উত্তরে সে বললো: “তোমরা আমার মতামত শুনেছ, এখন তোমাদের যা মনে হয় তাই কর।”
কুরআনের শক্তি এমনই যে উমর ইবনুল খাত্তাব, যিনি নবী (সঃ) কে হত্যার জন্য বের হয়েছিলেন, পথেই শুনলেন তাঁর বোন এবং বোনের স্বামী কুরআন তিলাওয়াত করছে। বিশটি আয়াত পাঠ করার পর তিনি মুহাম্মদ (সঃ) কাছে গিয়ে হত্যার পরিবর্তে ইসলাম গ্রহণ করলেন। অতএব একজন নিরক্ষর এবং অশিক্ষিত লোকের পক্ষে-যাঁর কাব্যজ্ঞান ছিল না, কিভাবে অতুলনীয় অলঙ্কার এবং বিশুদ্ধ বাগ্মিতা সম্পন্ন একটি বই লেখা সম্ভব যার ক্ষুদ্রতম অধ্যায়ের সমতুল্যও কবিতার বিভিন্ন প্রকরণ ও আরবী ভাষার সমস্ত বিশেষজ্ঞ ও পণ্ডিতরা মিলে তৈরী করতে সক্ষম হয়নি? কার্যত তারা নবী (সঃ) এর সাথে যুদ্ধই বেছে নিয়েছিলো। এভাবে তাদের অভিজাত সমপ্রদায় নিহত হলো, এবং তাদের ব্যবসা বাণিজ্য ও সম্মান ধূলায় লুণ্ঠিত হলো। কিভাবে তারা কুরআনের আয়াতের চেয়ে এটাই বেছে নিতে পারলো? এর কারণ তাই যেমন আত তাবারী তাঁর তাফসীরের ভূমিকায় লিখেছেন:
“এতে কোন সন্দেহ নেই যে সর্বোচ্চ এবং সবচেয়ে উজ্জ্বল মানের প্রাঞ্জলতা সেটাই যা নিজেকে সর্বাপেক্ষা বেশী স্বচ্ছতার সাথে প্রকাশ করে, বক্তার ইচ্ছা স্পষ্ট করে তোলে এবং শ্রোতার উপলব্ধি সহজতর করে। কিন্তু যখন তা এই মানের প্রাঞ্জলতার উর্ধ্বে উঠে যায় এবং মানুষের ক্ষমতার সীমাতিক্রম করে, যাতে আল্লাহর কোন বান্দাই এর সমতুল্য তৈরী করতে পারে না, তখন সেটা সর্বশক্তিমান, এক আল্লাহর রাসূলদের জন্য প্রমাণ ও নিদর্শন হয়ে দাঁড়ায়। তখন তা মৃতকে জীবিত করা এবং কুষ্ঠরোগীকে সুস’ করা ও অন্ধকে দৃষ্টিদান করার পরিপূরক, যেগুলি নিজেরা রাসূলদের জন্য নিদর্শন ছিল, কারণ সেগুলি চিকিৎসা ও ভেষজ বিজ্ঞানে সর্বোচ্চ অর্জনকে উৎকর্ষতায় ছাপিয়ে গিয়েছিল…” তাবারী আরো বলছেন: “…এটা স্পষ্ট যে কোন উপদেশই প্রাঞ্জল নয়, কোন জ্ঞান গভীর নয়, কোন ভাষণ বেশী ভাবগম্ভীর নয়, কোন প্রকাশভঙ্গি মহত্তর নয়, এই পরিষ্কার বক্তব্য এবং ভাষণের চেয়ে-যার সাহায্যে একজন মাত্র মানুষ একত্রে এক জাতির কাছে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আহ্বান জানিয়েছিলেন যারা ছিল বাগ্মিতা ও অলঙ্কারপূর্ণ উক্তিতে, কবিতা ও গদ্যে, গদ্য কবিতা ও ভবিষ্যদ্বাণীতে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ। তিনি তাদের খেয়ালখুশিকে মূর্খতায় নামিয়ে আনলেন এবং তাদের যুক্তির অসারতা প্রদর্শন করলেন। তিনি তাদের ধর্ম থেকে বিযুক্ত হলেন এবং অন্যান্যকে তাঁর অনুসরণ করতে বললেন, তাঁর উদ্দেশ্য গ্রহণ করতে, এর সত্যের সাক্ষ্য দিতে, এবং একথা দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত করতে যে তিনি তাদের কাছে তাদের রবের প্রেরিত বাণীবাহক। তিনি তাদেরকে জানতে দিলেন যে, তিনি যা বলেছেন তার সত্যতার দৃশ্যমানতা, তাঁর নবুওয়াতের সত্যতার প্রমাণ হলো বয়ান (স্পষ্ট বর্ণনা), হিকমাহ (জ্ঞান), ফুরকান (সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারী), যা তিনি তাদের কাছে তাদের নিজেদের ভাষায় বর্ণনা করেছেন, এমন বর্ণনাভঙ্গির মাধ্যমে যা তাদের নিজেদের বর্ণনাভঙ্গির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তারপর তিনি তাদের বলেছেন যে তারা তিনি যা এনেছেন তার কোন অংশের সমতুল্যও কিছু আনতে সক্ষম হবে না, এবং তাদের সেটা করার শক্তির অভাব রয়েছে। তারা সকলেই তাদের অক্ষমতা স্বীকার করেছে, স্বেচ্ছায় সত্যকে স্বীকৃতি দিয়েছে যা তিনি এনেছেন, এবং নিজেদের ত্রুটির সাক্ষ্য দিয়েছে…।”
আমরা যদি বিশ্লেষণাত্মকভাবে যে কারো নবুওয়াতের দাবী পরীক্ষা করে দেখি, তাহলে তিনটি সম্ভাবনা পাওয়া যাবে দাবী সম্পর্কিত। প্রথম সম্ভাবনা হচ্ছে যে দাবীদার একজন মিথ্যুক। দ্বিতীয় সম্ভাবনা হল যে সে সত্যিকারভাবে বিশ্বাস করে যে সে ওহী গ্রহণ করছে, কিন্তু আসলে সে কোন ধরনের ভ্রান্তিতে তে ভুগছে, এবং তৃতীয়টি হলো যে ব্যক্তিটি সত্যিই ওহী পেয়ে থাকেন এবং তিনি সত্য বলছেন। এ প্রসঙ্গে মুহাম্মাদ (সঃ) এর বিরুদ্ধে খৃষ্টান ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী প্রাচ্যবিদদের উত্থাপিত কিছু যুক্তি উল্লেখ করা কৌতূহল উদ্দীপক হবে, কারণ সামগ্রিকভাবে তারা তাঁর সপক্ষেই সিদ্ধান্তমূলক প্রমাণ উপস্থাপন করছে। কোন এক মতাবলম্বী দল যা বলছে তার সারাংশ এই যে মুহাম্মাদ একজন মিথ্যাবাদী এবং প্রতারক; তিনি বিভিন্ন ইহুদী রাবাই ও খৃষ্টান পাদরীদের কাছ থেকে শিক্ষালাভ করেছেন, এবং বিভিন্ন সময়ে হেরা গুহায় অবস্থানকালে কুরআন সংকলন করেছেন। কেউ এই সব অভিযোগকে একটু কম কঠোর করতে গিয়ে বলেছেন যে তিনি তাঁর জাতির সংস্কার সাধনের বিশ্বস্ত আকাঙ্খা দ্বারা চালিত হয়েছিলেন এবং এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইসলাম উদ্ভাবন করেছিলেন। অন্যেরা তাঁকে অধিকতর জাগতিক লোভের জন্য অভিযুক্ত করে এবং এর প্রমাণ হিসাবে তাঁর বহু সংখ্যক স্ত্রীর উল্লেখ করে। দ্বিতীয় মতাবলম্বী দলটি এই মনোভাবকে একেবারেই প্রত্যাখ্যান করে, তারা সাক্ষ্যপ্রমাণ পর্যালোচনা করে দেখতে পায় যে মুহাম্মাদের চরিত্র তাঁকে মিথ্যা ও প্রতারণার বহু ঊর্ধ্বে স্থাপন করে, এবং তাঁর জীবনযাত্রার বাস্তবতা ছিল আড়ম্বরহীনতা ও দারিদ্র্যের শীর্ষে। কোন রাবাই বা পাদ্রী তাঁর শিক্ষক ছিল এমন কোন জোরালো প্রমাণ না পাওয়াতে এবং তাঁর নিজ পরিবারে ও স্ত্রীদের কাছে তাঁর পূর্ণ গ্রহণযোগ্যতার কারণে-যাদের কাছে কোন দ্বৈত চরিত্র অবধারিতভাবে ধরা পড়ত, তারা দাবী করে যে তিনি তাঁর নবুওয়াতের দাবীর ব্যাপারে বিশ্বস্ত, এবং তিনি সত্যিই বিশ্বাস করেন যে তিনি একজন নবী যাঁর কাছে ওহী আসে। আবার, তারা মুহাম্মাদের সত্য নবী হওয়ার সম্ভাবনা গ্রহণ করতে না পেরে নানা ধরনের মনো-বিশ্লেষণমূলক ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করে, যেমন কুরআন অবচেতন মনের কণ্ঠস্বর, বা মৃগী রোগীর মত মূর্চ্ছাধীন অবস্থায় থাকাকালীন ওহী আসে ইত্যাদি। মূল দাবী হচ্ছে যে মুহাম্মাদ বিভ্রান্ত। এ সমস্ত অভিযোগ আমরা এখানে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করব না। বিপরীত অবস্থানগুলির ভাসাভাসা পরীক্ষা করাই যথেষ্ট হবে। এটা এজন্যই মুহাম্মাদের পক্ষে সিদ্ধান্তমূলক প্রমাণ হবে যে একই সাথে তিনি হিসাবী মিথ্যাবাদী এবং বিভ্রান্ত হতে পারেন না। যে লোক আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে যে সে নবী, সে কখনো বসে চিন্তা ও পরিকল্পনা করে না যে সে পরদিন কি বলবে, কারণ সে বিশ্বাস করে যে আল্লাহ তা তাকে ওহীর মাধ্যমে জানাবেন। তবুও ইসলামের প্রতিপক্ষরা মুহাম্মাদের ঘটনার পেছনে উভয়টিকেই ব্যাখ্যা হিসাবে দাঁড় করায়। কুরআনের তথ্য ও ভাষাগত অননুকরণীয়তা ব্যাখ্যার জন্য তাঁকে একজন ধূর্ত ও হিসাবী প্রতারক হতে হয়, তথাপি তাঁকে তাঁর স্পষ্ট প্রতীয়মান বিশ্বস্ততা ব্যাখ্যার জন্য ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হতে হয়। এই দুই ধরনের তথ্যকে একত্রে সঙ্গতিপূর্ণ করতে গেলে তৃতীয় আর একটি সম্ভাবনাই একমাত্র পথ, তা হচ্ছে যে তিনি আসলেই তা, যা তিনি দাবী করেন্তআল্লাহর রাসূল।
কার্যত কুরাইশদের মুহাম্মাদ (সঃ) এর বিরুদ্ধে কোন বিশ্বাসযোগ্য যুক্তি খুঁজে পেতে অত্যন্ত বেগ পেতে হয়েছিল। তারা জানত যে মুহাম্মদ (সঃ) কুরআনের সদৃশ কিছু তৈরী করতে সক্ষম ছিলেন না, তা প্রাঞ্জলতার দিক থেকেই হোক বা এতে বিধৃত জ্ঞানের দিক থেকেই হোক। তারা তাঁর চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের সাথে সুপরিচিত ছিল এবং তাঁকে তাদের মধ্যে সর্বোত্তম, সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও জনপ্রিয় হিসাবে স্বীকার করে নিয়েছিল। এমনকি আবু লাহাব, নবীর চরম শত্রু, বলেছিল: “আমরা তোমাকে মিথ্যাবাদী বলি না মুহাম্মাদ, আমরা শুধু তুমি যা এনেছ তাতে বিশ্বাস করি না।” বাস্তবে মুহাম্মাদকে গ্রহণ করতে আবু লাহাবের প্রত্যাখ্যানের পেছনে রয়েছে গোত্রীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা। যখন নবী (সঃ) তাঁর জাতিকে প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার জন্য নির্দেশ পেলেন, তিনি সাফা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে মক্কার সকল গোত্রকে আহ্বান করলেন, যতক্ষণ না তারা সবাই জড়ো হল বা কোন প্রতিনিধি পাঠাল। তিনি তাদের বললেন:
“হে আমার জাতি, আমি যদি বলি যে একদল ঘোড়সওয়ার তোমাদের আক্রমণ করার জন্য এই পাহাড়ের পিছনে রয়েছে, তোমরা কি আমাকে বিশ্বাস করবে?” তারা সকলে বলল: “নিশ্চয়ই, আমরা কেন তোমাকে বিশ্বাস করব না, আমরা তোমার কাছ থেকে কখনো সত্য ছাড়া আর কিছু শুনিনি।” তখন নবী (সঃ) বললেন: “আমি তোমাদেরকে তোমাদের রবের কাছ থেকে এক ভয়ঙ্কর লাঞ্ছনার জন্য সতর্ক করতে এসেছি।” সুতরাং মুহাম্মাদের জাতি তাঁর সততার সাক্ষ্য দিয়েছে, এবং এটা যে তারা তাঁর কাছ থেকে কখনো মিথ্যা শোনেনি। এবং যেমন বাইজান্টাইন রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াস আবু সুফিয়ানকে নবী (সঃ) সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর বলেছিলেন: “যদি তিনি মানুষ সম্পর্কে মিথ্যা না বলে থাকেন, তবে তিনি আল্লাহর সম্পর্কে মিথ্যা বলবেন না!”
পর্ব ৬ : একটি সুচিন্তিত অনুসন্ধান 
 
অধিকিন্তু বাইজানটাইন রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াস নবী (সঃ) এর অসংখ্য গুণাবলী চিনতে পেরেছিলেন যা তাঁকে নিঃসন্দেহে আল্লাহর নবী হিসাবে নির্দেশ করে, খৃষ্টানরা যার আগমনের প্রত্যাশা করেছিল-নীচের বর্ণনা থেকে যা বোঝা যায়:
“আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন যে আবু সুফিয়ান ইবনে হারব আমাকে জানালেন যে, তিনি যখন কুরাইশদের এক কাফেলা নিয়ে গিয়েছিলেন, হিরাক্লিয়াস তার কাছে এক সংবাদবাহক পাঠালেন। তারা শাম দেশে (সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, লেবানন, জর্ডান) ব্যবসা করছিলেন, এবং সেই সময়ে আল্লাহর রাসূলের সাথে আবু সুফিয়ান ও কুরাইশদের সন্ধি চুক্তি ছিল। অতএব আবু সুফিয়ান ও তার সঙ্গীরা ইলিয়াতে (জেরুসালেমে) গেলেন হিরাক্লিয়াসের সাথে দেখা করতে। হিরাক্লিয়াস তাকে দরবারে ডেকে পাঠালেন যেখানে সব উচ্চ পদমর্যাদার রাজপুরুষেরা ছিল। তিনি তার দোভাষীকে ডেকে পাঠালেন, যে হিরাক্লিয়াসের প্রশ্ন শুনে তাদেরকে শোনাল: “তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তির সবচেয়ে নিকটাত্মীয় কে যে নবী বলে দাবী করেছে?” আবু সুফিয়ান উত্তর দিলেন: “আমি তাঁর নিকটাত্মীয়।” হিরাক্লিয়াস আদেশ দিলেন: “একে আমার কাছে আন এবং তার সঙ্গীদের তার পিছনে দাঁড় করিয়ে দাও।” হিরাক্লিয়াস তার দোভাষীকে বললেন আবু সুফিয়ানের সঙ্গীদের বুঝিয়ে দিতে যে, তিনি ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে আমাকে কিছু প্রশ্ন করবেন, যদি আমি মিথ্যা বলি তাহলে সঙ্গীরা যেন তার প্রতিবাদ করে। আবু সুফিয়ান আরো যোগ করলেন: “আল্লাহর কসম, যদি আমি আমার সঙ্গীরা আমাকে মিথ্যাবাদী বলবে এই ভয় না করতাম, নবী সম্পর্কে আমি মিথ্যা বলতাম।” প্রথম যে প্রশ্ন তিনি তাঁর সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন তা ছিল: “তোমাদের মাঝে তাঁর বংশ মর্যাদা কিরূপ?” আমি উত্তর দিলাম, “তিনি আমাদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান।” হিরাক্লিয়াস আরো জিজ্ঞাসা করলেন: “তোমাদের মধ্যে থেকে তাঁর পূর্বে আর কেউ কি নবুওয়াতের দাবী করেছে?” আমি উত্তর দিলাম: “না।” তিনি বললেন: “তার পূর্বপুরুষের কেউ কি রাজা ছিল?” আমি বললাম: “না।” হিরাক্লিয়াস জিজ্ঞাসা করলেন: “তাঁর অনুসরণকারীরা কি ধনী না দরিদ্র?” আমি উত্তর দিলাম: “দরিদ্ররাই তাঁর অনুসরণ করে।” তিনি বললেন: “তার অনুসারীদের সংখ্যা বাড়ছে না কমছে?” আমি উত্তর দিলাম: “তারা বাড়ছে।” তিনি তখন জিজ্ঞাসা করলেন: “তার ধর্ম গ্রহণকারীদের কেউ কি এই ধর্মে অখুশী এবং পরে পরিত্যাগ করেছে?” আমি উত্তরে বললাম: “না।” হিরাক্লিয়াস বললেন: “তোমরা কি তাঁর দাবীর পূর্বে তাঁকে কখনও মিথ্যার দায়ে অভিযুক্ত করেছো?” আমি বললাম: “না।” হিরাক্লিয়াস বললেন: “তিনি কি তাঁর প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেন?” আমি উত্তর দিলাম: “না। আমরা তাঁর সাথে চুক্তিবদ্ধ, তবে আমরা জানি না এ ব্যাপারে তিনি কি করবেন।” আমি তাঁর বিরুদ্ধে বলার কোন সুযোগ পাইনি তখন ছাড়া যখন হিরাক্লিয়াস জিজ্ঞাসা করলেন: “তোমরা কি তাঁর সাথে যুদ্ধ করেছ কখনো?” আমি উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ।” তখন তিনি বললেন, “এই যুদ্ধের ফলাফল কি ছিল?” আমি বললাম, “কখনো তিনি জিতেছেন, কখনো আমরা।” হিরাক্লিয়াস বললেন, “তিনি তোমাদের কি করতে বলে থাকেন?” আমি বললাম, “তিনি আমাদের শুধুমাত্র এক আল্লাহর ইবাদাত করতে বলেন, তাঁর সাথে আর কাউকে ইবাদাতে শরীক করতে নিষেধ করেন, এবং আমাদের পূর্বপুরুষেরা যা বলেছেন তা সবই পরিত্যাগ করতে বলেন। তিনি আমাদের সালাত আদায় করতে বলেন, সত্য কথা বলতে, পবিত্র থাকতে ও আত্মীয়স্বজনের সাথে ভাল ব্যবহার করতে বলেন।” হিরাক্লিয়াস দোভাষীকে বললেন পরবর্তী বক্তব্য আমাকে জানিয়ে দিতে: “আমি তোমাকে তাঁর বংশমর্যাদা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছি, তুমি বলেছ যে তিনি অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান। আসলে প্রত্যেক নবীই নিজ জাতির সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকেই হয়ে থাকেন। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি তোমাদের মধ্যে আর কেউ এ দাবী করেছে কিনা, তোমার উত্তর ছিল না বোধক। যদি উত্তর হ্যাঁ বোধক হতো, আমি সন্দেহ করতাম যে এই লোকটি তার পূর্বের লোকের দাবীর অনুসরণ করছে। তারপর আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি যে তার পূর্বপুরুষেরা রাজা ছিল কিনা। তোমার উত্তর না বোধক ছিল ; এবং যদি তা হ্যাঁ বোধক হতো, আমি মনে করতাম সে তার রাজত্ব ফিরে পেতে চাইছে। আমি আরো জিজ্ঞাসা করেছি তার দাবীর পূর্বে কখনো সে মিথ্যাবাদী হিসাবে অভিযুক্ত হয়েছে কিনা। এবং তোমার উত্তর ছিল না বোধক। সুতরাং আমি অবাক হচ্ছি কিভাবে একটি লোক আল্লাহর সম্পর্কে মিথ্যা বলতে পারে যে কখনো মানুষের সম্পর্কে কোন মিথ্যা বলেনি। আমি তারপর তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি তাকে ধনীরা বা দরিদ্ররা, কারা অনুসরণ করে। তুমি বলেছে দরিদ্ররাই তাঁর অনুসারী, এবং আসলে নবীদের অনুসরণকারীরা দরিদ্র শ্রেণী থেকেই হয়ে থাকে। তারপর আমি জিজ্ঞাসা করেছি তাঁর অনুসারীরা সংখ্যায় বাড়ছে না কমছে, তুমি উত্তর দিয়েছ বাড়ছে, এবং সত্য হচ্ছে যে এটাই সত্য বিশ্বাসের লক্ষণ, যতক্ষণ না তা সবদিকে পরিপূর্ণ হবে। আমি আরো জিজ্ঞাসা করেছি এমন কেউ আছে কি না, যে তাঁর ধর্ম গ্রহণ করে অখুশী হয়ে তা পরিত্যাগ করেছে। তোমার উত্তর ছিল না বোধক, এবং আসলে এটাই সত্য বিশ্বাসেরই লক্ষণ, যখন তার আনন্দ অন্তরে প্রবেশ করে এবং তা সম্পূর্ণভাবে সত্তায় মিশে যায়। আমি জিজ্ঞাসা করেছি তিনি কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন কিনা, তুমি না বোধক উত্তর দিয়েছ এবং সত্যিই নবীরা কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করেন না। তারপর আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি তিনি তোমাদের কি করতে বলেন। তুমি উত্তরে বলেছ যে তিনি তোমাদেরকে শুধুমাত্র এক আল্লাহর ইবাদাত করতে বলেন এবং তাঁর সাথে কোন কিছু শরীক করতে এবং মূর্তিপূজা করতে নিষেধ করেন এবং সালাত আদায় করতে, সত্য বলতে, অবৈধ উপায়ে ব্যভিচার না করতে বলেন। যদি তুমি যা বলেছ তা সত্যি হয়, তিনি খুব শীগগিরই আমার পায়ের নীচের এই ভূমি দখল করবেন এবং আমি কিতাব থেকে জানি যে তাঁর আসার সময় হয়েছে, তবে আমি জানি না যে তিনি তোমাদের মধ্য থেকে আসবেন, এবং আমি যদি নিশ্চিত হতে পারতাম যে আমি তাঁর কাছেই যাচ্ছি, তাহলে আমি এখনি তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য যেতাম এবং যদি আমি তাঁর সাথে থাকতাম, আমি নিশ্চয়ই তাঁর পা ধুয়ে দিতাম।”
হিরাক্লিয়াস তারপর দাহিয়া কর্তৃক আনীত বুরার গভর্নরের কাছে প্রদত্ত আল্লাহর রাসূলের চিঠিটি আনতে বললেন। চিঠির বিষয়বস্তু ছিল নিম্নরূপ:
“পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে। এই চিঠিটি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে বাইজানটাইনের শাসনকর্তা হিরাক্লিয়াসের প্রতি। তার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক যে সঠিক পথ অনুসরণ করে। তারপর আমি আপনাকে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানাই, যদি আপনি মুসলিম হন আপনি নিরাপদ, এবং আল্লাহ আপনাকে দ্বিগুণ প্রতিদান দেবেন, এবং যদি আপনি দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেন আপনি আপনার অধীনস্তদের পথভ্রষ্টতার পাপের ভাগী হবেন: “হে আহলে কিতাব! সে কথার উপরে আস, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই; আমরা আল্লাহ ছাড়া কারো উপাসনা করি না, কোন কিছুকেই তাঁর অংশী করি না এবং আমাদের কেউ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাকেও প্রতিপালক রূপে গ্রহণ করে না। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে বল, ‘আমরা আত্মসমর্পণকারী, তোমরা সাক্ষী থাক।”
আবু সুফিয়ান তারপর যোগ করল, “যখন হিরাক্লিয়াস তার বক্তব্য শেষ করলেন এবং চিঠিটি পড়লেন, দরবারে বিরাট শোরগোল শুরু হলো। তাই আমাদেরকে দরবার থেকে বের করে নেওয়া হলো। আমি আমার সঙ্গীদেরকে বললাম যে আবি-কাবশার (নবীকে হেয় করার জন্য ব্যবহৃত ডাক নাম) ঘটনাটি এত লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে যে বাইজানটাইনের বাদশাও তার ভয়ে ভীত, তখন থেকে আমি নিশ্চিত হতে শুরু করলাম যে অদূর ভবিষ্যতে তিনি বিজয়ী হবেন যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম।” পরবর্তী বর্ণনাকারী যোগ করেছেন:
“ইবনে আন-নাতুর জেরুজালেমের গভর্নর ছিলেন এবং হিরাক্লিয়াস জেরুজালেম সফর করছিলেন, তিনি সকালে বিষণ্ন মনে জেগে উঠলেন। তাঁর কিছু পাদ্রী জিজ্ঞাসা করল তাঁর মন খারাপের কারণ কি? হিরাক্লিয়াস একজন ভবিষ্যদ্বক্তা ও জ্যোতিষী ছিলেন। তিনি বললেন, “এক রাত্রে আমি যখন তারাদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, আমি দেখলাম খাতনাকারীদের নেতা আবির্ভূত হয়েছেন। তারা কারা, যারা খাতনা করেন?” লোকেরা উত্তর দিল, “ইহুদীরা ছাড়া আর কেউ খাতনা করে না, সুতরাং আপনার ভয়ের কোন কারণ নেই। শুধু এই হুকুম দিয়ে দিন যে এই দেশে যত ইহুদী আছে সবাইকে হত্যা করা হোক।” এই আলোচনার সময় গাসসানের রাজার কাছ থেকে আল্লাহর রাসূলের খবর নিয়ে দূত এলো। সংবাদ শুনে তিনি লোকজনকে বললেন সংবাদবাহক খাতনা করা কিনা সন্ধান করতে। লোকজন অনুসন্ধান করে হিরাক্লিয়াসকে খবর দিল যে সে খাতনাকারী। হিরাক্লিয়াস তখন তাকে আরবদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। সংবাদবাহক বলল, “আরবরাও খাতনা করে থাকে।” এই কথা শুনে হিরাক্লিয়াস মন্তব্য করলেন যে আরবদের সার্বভৌমত্বের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। হিরাক্লিয়াস তারপর হোমস গেলেন এবং সেখানে থাকাকালীন তাঁর চিঠির উত্তরে তাঁর বন্ধুর কাছ থেকে তাঁর ধারণা সমর্থন করে এই মর্মে এক চিঠি পেলেন যে আরবে একজন আবির্ভূত হয়েছেন এবং তিনি সত্যিই নবী। তখন হিরাক্লিয়াস হোমসে অবস্থিত তাঁর প্রাসাদে বাইজানটাইনের সব প্রধানদের একত্রিত হওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। যখন তারা সমবেত হলো, তিনি প্রাসাদের সব দরজা বন্ধ করার হুকুম দিলেন। তারপর তিনি এসে বললেন: “হে বাইজানটাইনগণ, যদি সাফল্য তোমাদের আকাঙ্খা হয়ে থাকে এবং তোমরা সঠিক নির্দেশনা চাও এবং তোমাদের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে চাও তাহলে এই নবীর প্রতি আনুগত্যের শপথ নাও!” একথা শুনে লোকজন প্রাসাদের দরজার দিকে বন্য গাধার মত ছুটতে লাগলো, কিন্তু সব বন্ধ দেখতে পেলো। হিরাক্লিয়াস ইসলামের প্রতি তাদের ঘৃণা অনুভব করলেন এবং যখন তাদের ইসলাম গ্রহণের আর আশা রইল না, তিনি তাদেরকে পুনরায় একত্র করতে আদেশ দিলেন। বললেন: “আমি এই মাত্র যা বলেছি তা তোমাদের বিশ্বাসের দৃঢ়তা পরীক্ষা করার জন্য এবং আমি তা দেখেছি।” লোকেরা তার সামনে সিজদা করল এবং তাঁর উপর সন্তুষ্ট হলো, এবং এখানেই হিরাক্লিয়াসের কাহিনীর শেষ (তার বিশ্বাস সম্পর্কিত)।

আরেকটি অনুসন্ধানী মন

হিরাক্লিয়াসই একমাত্র শাসক নন যিনি মুহাম্মাদের নবুওয়াত চিনতে পেরেছিলেন। আবিসিনিয়ার শাসক, নেগাসও অনুরূপভাবে ইসলামের বাণী এবং কুরআনের ভাষার ঐশী উৎপত্তি বুঝতে পেরেছিলেন যখন তিনি মুশরিক কুরাইশদের অত্যাচার ও উৎপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা মুহাজির মুসলিমদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন। অসংখ্য খৃষ্টান ও ইহুদী বিদ্বান ব্যক্তি, যারা মুহাম্মাদকে তাদের কিতাবে উল্লেখিত শেষ নবী হিসাবে চিনতে পেরেছিলেন মুহাম্মাদের সময়ে এবং তার পরে, তাঁদের দ্বারা নবী (সঃ) এঁর দাবী আরো গুরুত্ব লাভ করেছিল। হিরাক্লিয়াসের কথা আগেই বলা হয়েছে। সাধু বহিরা, যাকে কিছু প্রাচ্যবিদ মুহাম্মাদের শিক্ষক হিসাবে চালানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা করেছেন, মুহাম্মাদের বালক অবস্থাতেই তাঁর মধ্যে নবুওয়াতের চিহ্ন দেখতে পেয়েছিলেন, যখন মুহাম্মাদ তাঁর চাচা আবু তালিবের কাফিলার সাথে সিরিয়া গিয়েছিলেন, যেমন ওয়ারাকা বুঝেছিলেন, যিনি মক্কার কতিপয় খৃষ্টানের একজন ছিলেন, যিনি খৃষ্টানদের কিতাবের কিছু অংশ আরবীতে অনুবাদ করেছিলেন। যিনি মুহাম্মাদের স্ত্রী খাদিজার চাচাত ভাই ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে প্রথম ওহী নাযিলের পর নবী এই একই ওয়ারাকার কাছে গিয়েছিলেন, যিনি বলেছিলেন, “নিশ্চয়ই, যাঁর হাতে ওয়ারাকার প্রাণ তাঁর শপথ, আপনি এই জাতির নবী। আপনার কাছে সেই মহান ফেরেশতাই এসেছেন, যিনি এসেছিলেন মূসার কাছে। আপনাকে মিথ্যাবাদী বলা হবে, তারা আপনার সাথে বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ করবে, আপনাকে বিতাড়িত করবে ও আপনার সাথে যুদ্ধ করবে।” আল জুরাদ ইবনে আকালা, এক খৃষ্টান জ্ঞানী ব্যক্তি ও শাসক নবী (সঃ) এর সাথে সাক্ষাতের জন্য এসেছিলেন ও বলেছিলেন: “আল্লাহর কসম, আপনি সত্য সহকারে এসেছেন, এবং সত্য কথাই বলেছেন, নবী হিসাবে ইনজিলে আমি আপনার বর্ণনা পেয়েছি, এবং কুমারী মাতার পুত্র আপনার আগমন ঘোষণা করেছেন।” আল জুরাদ তারপর তাঁর লোকজন সহ ইসলাম গ্রহণ করেন। এছাড়াও মুকাওকিস, কিবতীদের বাদশাহ, নবী (সঃ) এঁর তাঁকে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে লেখা পত্রের উত্তরে লিখেছিলেন: “আমি আপনার বাণী পড়েছি এবং তাতে আপনি যা উল্লেখ করেছেন এবং যার প্রতি আহ্বান করেছেন তা বুঝতে পেরেছি। আমি জানতাম একজন নবী আসবেন এবং ভেবেছিলাম তিনি শাম দেশে আবির্ভূত হবেন, এবং আমি আপনার দূতের সাথে উত্তম আচরণ করেছি।”
নবী (সঃ) এঁর একজন সাহাবা, সালমান ফারসীর গল্প বিষয়টিকে আরো বিশদভাবে বর্ণনা করেছে এভাবে:
“আমি পারস্যের লোক, আমি এসেছি ইস্পাহানের জাঈ শহর থেকে। আমার পিতা নগরপ্রধান ছিলেন। তাঁর কাছে আমি আল্লাহর সৃষ্টির সবচেয়ে প্রিয় ছিলাম। আমার জন্য তাঁর ভালবাসা এতদূর ছিল যে আমাকে তিনি যে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করতেন, তার তদারকির ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত বোধ করতেন, যা কখনো নিভতে দেওয়া হতো না। আমার পিতা ভূমি মালিক ছিলেন, এবং একদিন যখন তিনি ব্যস্ত ছিলেন, আমাকে তাঁর জমি দেখতে যেতে বললেন এবং সেখান থেকে তাঁর জন্য কিছু জিনিস আনতে বললেন। পথে আমি খৃষ্টানদের একটি গির্জা দেখতে পেলাম। আমি ভেতরের লোকজনের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম যারা তখন প্রার্থনা করছিল। আমার পিতা আমাকে গৃহে আবদ্ধ করে রাখতেন বলে অন্য মানুষের জীবনে কোথায় কি ঘটছে আমি তার কিছুই জানতাম না। সুতরাং যখন আমি এই লোকদের কাছে এলাম এবং তাদের আওয়াজ শুনলাম আমি ভিতরে ঢুকলাম তারা কি করছে জানতে। যখন আমি তাদের দেখলাম, তাদের প্রার্থনার পদ্ধতি আমার ভাল লাগল এবং আমি তাদের ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হলাম। আমি নিজেকে বললাম, “আল্লাহর শপথ, এই ধর্ম আমাদের ধর্মের চেয়ে ভাল।” আল্লাহর শপথ, সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি তাদের ছেড়ে গেলাম না, এবং আমার পিতার জমি তদারকি করতে গেলাম না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “এই ধর্মের উৎপত্তি কোথায়?” তারা বলল, “শাম দেশে (অর্থাৎ বৃহত্তর সিরিয়ায়)।” আমি পিতার কাছে ফিরে গেলাম যিনি আমার জন্য অসি’র হয়ে পড়েছিলেন এবং আমাকে খুঁজতে লোক পাঠিয়েছিলেন। আমি পৌঁছার পর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “বাবা, তুমি কোথায় ছিলে? আমি কি তোমার উপর একটা কাজের দায়িত্ব দিইনি?” আমি বললাম, “আমি কয়েকজন লোককে গির্জায় প্রার্থনা করতে দেখে তাদের কাছে গিয়েছিলাম এবং তারা তাদের ধর্মের যা কিছু করছিল আমার তা ভাল লেগেছে।” আমার পিতা বললেন, “বাবা! ঐ ধর্মে কোন ভাল কিছু নেই। তোমার পূর্বপুরুষের ধর্ম বেশী ভাল।” আমি বললাম, “না, আল্লাহর শপথ, ঐ ধর্ম আমাদের চেয়ে ভাল।” তিনি আমাকে ভয় দেখালেন এবং পায়ে শিকল দিয়ে ঘরে বেঁধে রাখলেন। আমি খৃষ্টানদের কাছে অনুরোধ করে সংবাদ পাঠালাম যে তারা যেন শাম থেকে কোন খৃষ্টান কাফেলা এলে আমাকে খবর দেয়। একটি বাণিজ্য কাফেলা আসতেই তারা আমাকে খবর দিল। আমি তাদের বললাম যে তারা যেন আমাকে কাফেলার লোকজন সম্পর্কে অবহিত করে এবং কখন তারা তাদের কাজকর্ম শেষ করে দেশে ফিরে যাবে তা জানায়। আমি আমার পায়ের শিকল খুলে কাফেলাতে যোগ দিলাম শাম পৌঁছা পর্যন্ত। পৌঁছে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “তোমাদের ধর্মের সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তি কে?” তারা বলল, “গির্জার পাদ্রী।” আমি তাঁর কাছে গেলাম এবং বললাম, “আমি এই ধর্ম পছন্দ করি এবং আমি আপনার সাথে গির্জায় থেকে আপনার সেবা করতে চাই, আপনার কাছ থেকে শিখতে চাই ও আপনার সাথে প্রার্থনা করতে চাই।” পাদ্রী রাজী হলেন। কিছুদিন পরে আমি জানতে পারলাম যে এই পাদ্রী তার লোকজনকে দান করতে আদেশ করত এবং উৎসাহিত করত শুধু নিজে তা ভোগ করার জন্য। সে দরিদ্রকে তা দিত না। সে সাতটি পাত্র ভর্তি সোনা ও রূপা জমা করে রেখেছিল! আমি তাকে যা করতে দেখেছিলাম সেজন্য তাকে খুবই ঘৃণা করতাম। পাদ্রী মারা গেল। খৃষ্টানরা তাকে সমাহিত করার জন্য সমবেত হল। আমি তাদেরকে বললাম যে সে খারাপ লোক ছিল, সে তোমাদেরকে দান করতে বলত যাতে সে তা নিজে রাখতে পারে এবং দরিদ্রকে কিছুই দিত না। তারা বলল, “তুমি কিভাবে জানলে?” আমি বললাম, “আমি তোমাদেরকে তার ধনভাণ্ডার দেখাতে পারি।” তারা বলল, “দেখাও।” আমি তাদের জায়গাটি দেখালাম এবং যখন তারা সেটা দেখল তারা বলল: “আল্লাহর শপথ, আমরা তাকে কখনও সমাহিত করব না!” তারা তার মৃতদেহ নিয়ে সেটাকে ক্রুশবিদ্ধ করল এবং পাথর ছুঁড়ে মারল। তারা নতুন পাদ্রী নিয়োগ করল। যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে না, তাদের মধ্যে এর চেয়ে ভাল লোক আমি দেখিনি। না এমন লোক দেখেছি যে এর চেয়ে বেশী দুনিয়াত্যাগী ও পরজীবনের প্রতি আসক্ত; না এমন দায়িত্বশীল লোক যে দিন রাত কাজ করছে। আমি তাকে ভালবাসতাম সবকিছুর চেয়ে বেশী। তার মৃত্যুর কিছু সময় পূর্বপর্যন্ত আমি তার সাথে অবস্থান করলাম। যখন তার মৃত্যু নিকটবর্তী হল, আমি তাকে বললাম: “হে গুরু! আমি আপনার সাথে থেকেছি এবং আপনাকে আমি আগে যা কিছু ভালবাসতাম তার চেয়েও বেশী ভালবেসেছি। এখন আল্লাহর হুকুমে আপনার সময় শেষ হয়ে এসেছে, এখন আপনি আমাকে কার কাছে যেতে বলেন এবং আমাকে কি করতে বলেন?” পাদ্রী বললেন, “আল্লাহ কসম, মানুষ সম্পূর্ণ ক্ষতির মধ্যে রয়েছে, তারা যার উপর ছিল তাকে পরিবর্তন ও বদল করেছে। আমি যা এখনও ধরে রেখেছি, আল মুসিলের একজন লোক ছাড়া আর কেউ তা ধরে রেখেছে বলে আমি জানি না। সুতরাং তুমি তার কাছে যাও।” যখন মানুষটি মারা গেলেন, আমি আল-মুসিলে গেলাম ও সুপারিশকৃত মানুষটির সাথে দেখা করলাম। আমি তাকে বললাম যে আমার পূর্বতন গুরু তার কথা আমাকে বলেছেন যাতে আমি তার সাথে থাকি; এবং আরো বলেছেন যে তারা একই পথের অনুসারী। আল-মুসিলের লোকটি আমাকে তার সাথে থাকতে বললেন, আমি থাকলাম এবং দেখলাম যে তার বন্ধুর ধারণ করা বিশ্বাসের লোকদের মধ্যে তিনি উত্তম। শীগগিরই তিনি মারা গেলেন। মৃত্যুকালীন সময়ে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম তিনি আমাকে এই ধর্মের অনুসারী কার কাছে যেতে সুপারিশ করেন। লোকটি বললেন, “আল্লাহর কসম! আমি আর কাউকে জানি না যে আমাদের এই ধর্মের উপর রয়েছে নাসীইবিন এর একজন লোক ছাড়া, তুমি তার কাছে যাও।” তার মৃত্যুর পর আমি নাসীইবিন এর সেই লোকের কাছে গেলাম ও তার কাছে কিছুদিন বাস করলাম। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো। মৃত্যু ঘনিয়ে এলো এবং মৃত্যুর পূর্বে আমি তার উপদেশ চাইলাম কার কাছে এবং কোথায় আমি যেতে পারি। লোকটি বললেন যে আমি আম্মুরিয়াতে একই ধর্মের একজন লোকের কাছে যেতে পারি, যা আমি করলাম, এবং কিছু গরু এবং ভেড়ার মালিক হলাম। আম্মুরিয়ার লোকটির মৃত্যু নিকটবর্তী হলে আমি আমার অনুরোধের পুনরাবৃত্তি করলাম। উত্তরটি ভিন্ন হলো। লোকটি বললেন: “হে বৎস! আমি আমাদের ধর্মের উপর রয়েছে এমন আর কাউকে জানি না। যাই হোক, একজন নবীর আবির্ভাব কাল তুমি দেখতে পাবে। এই নবী ইব্রাহিম এর ধর্মেই হবেন। তিনি আরব দেশ থেকে আসবেন এবং দুটি কালো পাথরের মধ্যবর্তী ভূখণ্ডে হিজরত করবেন। এই উপত্যকার মধ্যখানে খেজুর বৃক্ষ ছড়িয়ে থাকবে। তাঁর বিশেষ কয়েকটি চিহ্ন থাকবে। তিনি উপহার হিসাবে প্রদত্ত খাবার খাবেন, কিন্তু দান গ্রহণ করবেন না। তাঁর দুই কাঁধের মাঝখানে নবুওয়াতের মোহর অঙ্কিত থাকবে। যদি তোমার পক্ষে সেখানে যাওয়া সম্ভব হয়, তবে তাই কর।” তার মৃত্যুর পর আমি কিছুদিন আম্মুরিয়াতে অবস্থান করলাম, ততদিন পর্যন্ত যখন কালব গোত্রের একদল ব্যবসায়ী আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। আমি তাদের বললাম, “আমাকে আরবে নিয়ে চল এবং আমার গরু ও ভেড়াটি নিয়ে নাও।” তারা রাজী হলো। যখন আমরা ওয়াদিউল কুরা (মদীনার কাছে) পৌঁছলাম, তারা আমাকে একজন ইহুদীর কাছে দাস হিসাবে বিক্রি করে দিল এবং খেজুর গাছগুলি দেখে আমার আশা হল হয়তো এটাই আমার বন্ধুর বর্ণিত জায়গা হতে পারে। একদিন আমার মনিবের চাচাত ভাই তার সাথে দেখা করতে এলো এবং আমাকে কিনে নিল। সে আমাকে মদীনায় নিয়ে গেল। আল্লাহর শপথ! দেখা মাত্রই আমি চিনলাম যে এটাই আমার বন্ধুর বলা সেই জায়গা। তারপর আল্লাহ তাঁর রাসূল পাঠালেন। তিনি মক্কায় যতদিন থাকার থাকলেন। আমি তাঁর সম্পর্কে কিছুই শুনিনি কারণ আমি সারাক্ষণ গোলামীর কাজে ব্যস্ত থাকতাম। তিনি মদীনায় হিজরত করলেন। আমি খেজুর গাছের উপরে আমার মনিবের কাজে ব্যস্ত ছিলাম। তার একজন চাচাত ভাই এসে সামনে দাঁড়াল এবং বললো: “বনী কাইলার ধ্বংস হোক, তারা কুবাতে একজন লোকের চারিদিকে সমবেত হয়েছে যে আজ মক্কা থেকে পৌঁছেছে এই দাবী করে যে সে নবী।” শোনামাত্র আমি এমন কাঁপতে লাগলাম যে প্রায় আমার মনিবের ঘাড়ের উপর পড়ে যাচ্ছিলাম। আমি নেমে এসে জিজ্ঞাসা করলাম: “কি বললে, কি বললে?” আমার মনিব রেগে গিয়ে আমাকে প্রচণ্ড জোরে ঘুঁষি মারলো এবং বললো: “এতে তোমার কি হলো? তোমার কাজ কর গিয়ে।” আমি বললাম, “কিছু না, আমি শুধু সে কি বলছে তা জানতে চাইছিলাম।” সেই সন্ধ্যায় আমি কুবায় রাসূলুল্লাহকে দেখতে গেলাম। আমি সাথে করে আমার জমিয়ে রাখা কিছু খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম। আমি গিয়ে বললাম, “আমি শুনেছি আপনি সৎলোক এবং আপনার সঙ্গীরা অভাবগ্রস্ত, এবং আমি আপনাকে দান হিসাবে কিছু দিতে চাই। আমি দেখলাম যে অন্য কারো চেয়ে এটা আপনারই বেশী প্রয়োজন।” আমি তাঁকে তা দিলাম, তিনি তাঁর সাথীদের বললেন, “খাও!” এবং তিনি তাঁর হাত সরিয়ে রাখলেন তা থেকে। আমি মনে মনে বললাম, “একটা চিহ্ন মিলেছে।” পরবর্তীতে আমি যখন আবার মদীনাতে নবীর কাছে গেলাম আমি বললাম: “আমি দেখেছি আপনি দান গ্রহণ করেন না, এখানে আমি আপনার জন্য উপহার হিসাবে কিছু এনেছি।” নবী সেখান থেকে নিজে খেলেন ও সাহাবাদেরও খেতে বললেন, তাঁরাও খেলেন। আমি মনে মনে বললাম, “দুটি চিহ্ন মিলল।” তৃতীয় সাক্ষাতে আমি নবীর কোন সাহাবার জানাযায় গেলাম। আমি তাঁকে সালাম দিলাম, তারপর পেছনের দিকে চলে গেলাম যাতে নবুওয়াতের মোহর দেখতে পাই আমার বন্ধুর বর্ণনামত। যখন তিনি আমাকে দেখলেন তিনি বুঝতে পারলেন আমি কি দেখতে চাইছি। তিনি তাঁর চাদরটি পিঠ থেকে সরিয়ে দিলেন এবং আমি মোহরটি দেখলাম। আমি সেটি চিনতে পারলাম। আমি নীচু হয়ে সেখানে চুমা দিলাম ও কাঁদতে শুরু করলাম। রাসূল (সঃ) আমাকে ঘুরে সামনে এসে কথা বলতে বললেন, এবং আমি তাঁকে আমার কাহিনী বললাম।”
পর্ব ৭ : আহলে কিতাব: ভবিষ্যদ্বাণী, পূর্বাভাস ও অতীত ঘটনাবলী 
 নবীর মৃত্যুর পরে ইসলামী বিজয় অভিযানসমূহের সময় এবং পরপরই বিপুল সংখ্যক খৃষ্টান ইসলাম গ্রহণ করে। তারা এতে বাধ্য হয়নি, বরং তারা যা ইতোমধ্যেই আশা করছিল, এটা তারই স্বীকৃতি। আনসেলম টরমিদা, যিনি একজন যাজক ও খৃষ্টান পণ্ডিত, তিনি এধরনের একজন ছিলেন যার ইতিহাস উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক। তিনি একটি বিখ্যাত বই লিখেছেন ‘খৃষ্টানদের যুক্তি প্রত্যাখ্যান করার জন্য বুদ্ধিমানদের জন্য উপহার।’ বইয়ের ভূমিকায় তিনি তাঁর ইতিহাস বর্ণনা করেছেন।
“আপনাদের জানার জন্য বলছি যে আমি এসেছি মাজোরকা শহর থেকে, যা সমুদ্র তীরে অবস্থিত একটি বড় শহর, দুটি পর্বতের মাঝখানে এবং একটি উপত্যকা দিয়ে দ্বিধাবিভক্ত। দুটি চমৎকার পোতাশ্রয় সহ এটি একটি বাণিজ্যিক শহর। বড় বড় বাণিজ্য তরী বিভিন্ন মালপত্র নিয়ে পোতাশ্রয়ে নোঙ্গর করে। শহরটি যে দ্বীপে অবস্থিত, তার নামও একই-মাজোরকা, এবং এর অধিকাংশ ভূমিই ডুমুর ও জয়তুন গাছে ভরা। আমার পিতা শহরের একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। আমি তাঁর একমাত্র পুত্র। যখন আমি ছয় বছরের বালক, তিনি আমাকে একজন যাজকের কাছে পাঠালেন যিনি আমাকে ইনজিল পড়ালেন ও যুক্তিবিদ্যা শেখালেন, যা আমি ছয় বছরেই শেষ করি। তারপর আমি মাজোরকা ছেড়ে কাস্টিলিয়ন এলাকার লার্ডা নগরে গেলাম, যা সেই এলাকার খৃষ্টানদের শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। এক হাজার থেকে দেড় হাজার খৃষ্টান ছাত্র সেখানে সমবেত হত। সবাই যাজকদের শাসনে থাকত, যারা তাদের শিক্ষা দিতেন। আমি আরো চার বছর ইনজিল ও ভাষা শিক্ষা করলাম। তারপর আমি আনবাদিয়া এলাকার বোলোন-এ গেলাম। বোলোন বিরাট বড় শহর; সেই এলাকার সব মানুষের শিক্ষাকেন্দ্র। প্রতি বছর দু হাজারেরও বেশী ছাত্র সেখানে নানা জায়গা থেকে আসত। তারা মোটা খসখসে কাপড়ে দেহ ঢেকে রাখত যা তারা বলত “আল্লাহর রঙ”। তাদের সকলে, শ্রমিকের সন্তান বা শাসকের সন্তান যে হোক, ঐ চাদর পরত; যাতে অন্যদের থেকে ছাত্রদের আলাদা করা যায়। শুধু যাজকরাই তাদের শেখাতেন, নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং নির্দেশনা দিতেন। আমি গির্জায় একজন বৃদ্ধ যাজকের সাথে থাকতাম। তিনি তাঁর জ্ঞান, ধার্মিকতা ও কৃচ্ছতার জন্য মানুষের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ছিলেন, যা তাঁকে অন্যান্য খৃষ্টান যাজক থেকে বিশিষ্টতা দিয়েছিল। সব জায়গা থেকে প্রশ্ন ও উপদেশ দানের অনুরোধ আসত, বাদশাহ ও শাসকদের কাছ থেকেও; উপহার, উপঢৌকনসহ। তারা আশা করত যে তিনি তাদের উপহার গ্রহণ করবেন ও তাদের আর্শীবাদ করবেন। তিনি আমাকে খৃষ্টবাদের মূলনীতিসমূহ এবং এর প্রায়োগিক বিধিসমূহ শিক্ষা দিলেন। আমি তাঁর সেবাযত্ন করে ও সব দায়িত্ব পালনে সাহায্য করে তাঁর খুব কাছের লোক হয়ে গেলাম এবং তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহকারীতে পরিণত হলাম। ফলে তিনি আমাকে তাঁর গির্জার ভিতরে তাঁর বাসগৃহের এবং খাদ্য ও পানীয়ের ভাণ্ডারের চাবির দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তিনি নিজের কাছে শুধু একটা চাবি রেখেছিলেন যে ঘরে তিনি ঘুমাতেন সে ঘরের। আমার ধারণা, আল্লাহই ভাল জানেন, যে তিনি তার কোষাগার সেখানে রাখতেন। আমি দশ বছর যাবত ছাত্র ও খাদেম ছিলাম, তারপর তিনি অসুস্থ হলেন এবং তাঁর সহকর্মী যাজকদের সভায় উপস্থিত হতে পারলেন না। তাঁর অনুপস্থিতিতে যাজকরা কিছু ধর্মীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছিল, যতক্ষণ না তারা সেই জায়গায় আসে যেখানে ইনজিলে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাঁর নবী যীশুর মাধ্যমে বলছেন: “তারপর পারাক্লীট নামে এক নবী আসবেন।” এই নবীকে নিয়ে এবং নবীদের মধ্যে ইনি কোনজন তা নিয়ে তারা বহু তর্কবিতর্ক করলো। প্রত্যেকেই নিজ নিজ জ্ঞানবুদ্ধি অনুসারে মতামত দিল; এবং তারা এই বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই আলোচনা শেষ করলো। আমি আমার যাজকের কাছে গেলাম এবং তিনি যথারীতি সেদিনের ঘটনার বিবরণ জানতে চাইলেন। আমি তাঁর কাছে পারাক্লীট সম্পর্কে যাজকদের বিভিন্ন মতামত উল্লেখ করলাম, এবং কিভাবে তারা এর অর্থ পরিষ্কারভাবে না বুঝেই সভা শেষ করেছে তা বললাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার উত্তর কি?” আমি বাইবেলের সুপরিচিত ব্যাখ্যার আলোকে আমার মতামত দিলাম। তিনি বললেন যে আমার বক্তব্য কোন কোন যাজকের মত প্রায় সঠিক, এবং অন্যান্যরা ভুল। “কিন্তু সত্য এসবকিছুর চেয়ে ভিন্ন। এটা এজন্য যে এই মহান নামের ব্যাখ্যা খুব অল্প সংখ্যক সুশিক্ষিত পণ্ডিতের জানা আছে। এবং আমরা খুব কমই জানি।” আমি নীচু হয়ে তাঁর পায়ে চুমু খেলাম, বললাম: “জনাব, আপনি জানেন যে আমি বহু দূরের দেশ থেকে সফর করে আপনার কাছে এসেছি, দশ বছরেরও বেশী সময় ধরে আপনার সেবা করছি, এবং অনুমানের বাইরে জ্ঞান অর্জন করেছি, সুতরাং দয়া করে আমাকে অনুগ্রহ করুন এবং এই নামের ব্যাপারে আমাকে সত্য কি তা বলুন।” যাজক তখন কাঁদলেন এবং বললেন, “হে বৎস! আল্লাহর শপথ, তোমার সেবাযত্ন ও আমার প্রতি তোমার আন্তরিকতার জন্য তুমি আমার খুবই প্রিয়। এই নামের সত্য জানার ভিতরে বিরাট উপকার রয়েছে, কিন্তু বিরাট বিপদও আছে। এবং আমি ভয় করি যে যখন তুমি সত্য জানবে এবং খৃষ্টানরা সেটা বুঝতে পারবে, তুমি সাথে সাথে নিহত হবে।” আমি বললাম, “আল্লাহর শপথ, ইনজিলের শপথ এবং তাঁর যিনি এটা সহ প্রেরিত হয়েছিলেন, আপনি যা বলবেন তার একটি কথাও আমি কাউকে বলব না, আমি তা আমার অন্তরের মাঝে গোপন রাখব।” তিনি বললেন, “হে বৎস! যখন তুমি তোমার দেশ থেকে এখানে এসেছিলে, আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম দেশটি মুসলিমদের এলাকার কাছে কিনা, এবং তারা তোমাদের উপর হামলা করে কিনা বা তোমরা তাদের উপর হামলা করো কিনা। এটা ইসলামের প্রতি তোমার বিদ্বেষ কতটুকু তা পরীক্ষার করার জন্য। জেনে রাখ, হে বৎস, পারাক্লিট নবী মুহাম্মাদের নাম, যাঁর প্রতি দানিয়েল নবীর কথামত চতুর্থ কিতাব নাযিল হয়েছে। তাঁর পথই হচ্ছে ইনজিলে বর্ণিত সরল পথ।” আমি বললাম: “তাহলে জনাব, এই খৃষ্টানদের ধর্ম সম্পর্কে আপনি কি বলবেন?” তিনি বললেন: “হে বৎস, যদি এই খৃষ্টানরা যীশুর আদি ধর্মের উপর থাকত, তাহলে তারা আল্লাহর ধর্মের উপর থাকত, কারণ যীশুর ধর্ম ও অন্য সব নবীদের ধর্ম আল্লাহর একই সত্য ধর্ম। কিন্তু তারা তা পরিবর্তন করেছে এবং অবিশ্বাসী হয়ে গেছে।” আমি তাঁকে বললাম: “তাহলে জনাব এ থেকে বাঁচার উপায় কি?” তিনি বললেন, “হে আমার পুত্র, ইসলাম গ্রহণ করা।” আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম: “যে ইসলাম গ্রহণ করেছে সে কি মুক্তি পাবে?” তিনি উত্তর দিলেন: “হ্যাঁ, এই দুনিয়ায় এবং পরজীবনে।” আমি বললাম: “বিচক্ষণ ব্যক্তি নিজের জন্য উত্তমকেই বেছে নেয়; যদি আপনি ইসলামের মূল্য বুঝে থাকেন, জনাব, তাহলে কিসে আপনাকে এ থেকে বিরত রেখেছে?” তিনি উত্তর দিলেন: “হে বৎস, সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাকে ইসলামের সত্য জানার ও ইসলামের নবীকে বোঝার সুযোগ দেননি যতক্ষণ না আমি বৃদ্ধ হয়েছি এবং আমার হাড় দুর্বল হয়েছে। হ্যাঁ, আমাদের জন্য এতে কোন ওজর নেই, অপরপক্ষে আল্লাহর প্রমাণ আমাদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যদি আল্লাহ আমাকে তোমার মত বয়সে এই নির্দেশনা দান করতেন, আমি সবকিছু ত্যাগ করে সত্য ধর্ম গ্রহণ করতাম। এই দুনিয়ার প্রতি ভালবাসাই সকল পাপের উৎস, এবং দেখ, আমি খৃষ্টানদের দ্বারা কত শ্রদ্ধেয়, প্রশংসাপ্রাপ্ত ও সম্মানিত, এবং আমি কত সচ্ছলতা ও আরামের মধ্যে বাস করছি! আমার ক্ষেত্রে, আমি যদি ইসলামের প্রতি সামান্য আকর্ষণ প্রদর্শন করি, তারা অনতিবিলম্বে আমাকে হত্যা করবে। মনে কর আমি তাদের হাত থেকে বেঁচে গেলাম এবং মুসলিমদের কাছে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলাম, তারা বলবে, তোমার ইসলাম গ্রহণ করাতে আমাদের অনুগ্রহ করা হয়েছে বলে মনে করো না, এতে তুমিই নিজের প্রতি অনুগ্রহ করেছ সত্য ধর্মে প্রবেশ করে, সেই ধর্ম যা তোমাকে আল্লাহর শাস্তি থেকে বাঁচাবে! অতএব আমি তাদের মাঝে একজন নব্বই বছরের দরিদ্র বৃদ্ধ হিসাবে বাস করব, তাদের ভাষা না জেনে, এবং তাদের মাঝে উপবাসে মৃত্যুবরণ করবো। আল্লাহর জন্যই সমস্ত প্রশংসা, আমি যীশুর ধর্মের উপর আছি, যা সহকারে তিনি এসেছিলেন, এবং আল্লাহ আমার সম্পর্কে এটা জানেন।” তাই আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি কি আমাকে মুসলিমদের দেশে যাওয়ার ও তাদের ধর্ম গ্রহণ করার উপদেশ দেন?” তিনি আমাকে বললেন, “যদি তুমি বিজ্ঞ হও এবং নিজেকে বাঁচাতে চাও, তাহলে তার দিকে দৌড়ে যাও যাতে দুনিয়া ও আখিরাত দুটোই অর্জিত হয়। কিন্তু হে পুত্র, এ বিষয় সম্পর্কে কেউ আমাদের সাথে উপস্থিত না থাকায় জানে না, এটা শুধু তোমার ও আমার মধ্যে। চেষ্টা কর এবং এটাকে গোপন রাখ। যদি এটা প্রকাশিত হয় এবং লোকে এ সম্পর্কে জানতে পারে, তারা অনতিবিলম্বে তোমাকে হত্যা করবে। তাদের বিরুদ্ধে আমি তোমার কোন কাজেই লাগতে পারব না। না তোমার একথা বলা কোন কাজে আসবে যে তুমি আমার কাছে ইসলাম সম্পর্কে শুনেছ বা আমি তোমাকে মুসলিম হতে উপদেশ দিয়েছি, কারণ আমি তা অস্বীকার করব। তারা তোমার বিরুদ্ধে আমার সাক্ষ্য বিশ্বাস করবে। সুতরাং যা কিছুই ঘটুক, একটি শব্দও বলো না।” আমি প্রতিজ্ঞা করলাম তা না করার জন্য। তিনি আমার প্রতিজ্ঞায় সন্তুষ্ট ও তৃপ্ত হলেন। আমি আমার ভ্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকলাম এবং তাঁকে বিদায় জানালাম। তিনি আমার জন্য প্রার্থনা করলেন এবং পঞ্চাশ দীনার দিলেন। তারপর আমি জাহাজে করে মাজোরকায় গেলাম ও বাবা-মার সাথে ছয় মাস অবস্থান করলাম। তারপর আমি সিসিলি গেলাম ও মুসলিম দেশে যাওয়ার জন্য জাহাজের অপেক্ষায় পাঁচ মাস থাকলাম। অবশেষে তিউনিসগামী একটি জাহাজ এলো। আমরা সূর্যাসে-র পূর্বেই যাত্রা করলাম এবং দ্বিতীয় দিন দুপুরে তিউনিস পৌঁছলাম। যখন আমি জাহাজ থেকে নামলাম, যে সব খৃষ্টান পণ্ডিতরা আমার আসার খবর পেয়েছিলেন, আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে এলেন এবং আমি তাদের সাথে সহজভাবে ও আরামে চার মাস কাটালাম। তারপর আমি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম কোন দোভাষী আছে কিনা। তখন সুলতান ছিলেন আবুল আব্বাস আহমেদ। তারা বললেন যে সুলতানের যিনি চিকিৎসক, তিনি একজন মহৎ লোক, এবং তিনি সুলতানের নিকট উপদেষ্টাদের একজন। তাঁর নাম ইউসুফ আল তাবিব। আমি শুনে অত্যন্ত খুশী হলাম এবং তিনি কোথায় থাকেন জানতে চাইলাম। তারা আমাকে সেখানে আলাদাভাবে সাক্ষাতের জন্য নিয়ে গেলেন। আমি তাঁকে আমার কাহিনী শোনালাম এবং আমার এখানে আসার কারণ জানালাম; যা হলো ইসলাম গ্রহণ। তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হলেন যে ব্যাপারটি তাঁর সাহায্যে সম্পূর্ণ হবে। সুলতান রাজী হলেন এবং আমি তাঁর সামনে উপস্থিত হলাম। সুলতান আমাকে প্রথম প্রশ্ন করলেন আমার বয়স সম্পর্কে। আমি বললাম যে আমার বয়স পঁয়ত্রিশ বছর। তিনি তখন আমার শিক্ষা ও যে সব বিষয়ে আমি জ্ঞান অর্জন করেছি তা জানতে চাইলেন। আমি উত্তর দেবার পর তিনি বললেন, “আপনার আগমন ভালত্বের আগমন। আল্লাহর রহমতে মুসলিম হয়ে যান।” আমি তখন ডাক্তারকে বললাম, “সম্মানিত সুলতানকে বলুন যে যখন কেউ তার ধর্ম পরিবর্তন করে, তার লোকজন তার অমর্যাদা করে এবং তার সম্পর্কে মন্দ কথা বলে। তাই, আমি চাই সুলতান যেন দয়া করে এই নগরীর খৃষ্টান যাজকদের ও ব্যবসায়ীদের আনতে পাঠান এবং আমার সম্পর্কে তাদের কাছ থেকে জেনে নেন তাদের কি বলার আছে। তারপর আল্লাহর ইচ্ছায়, আমি ইসলাম গ্রহণ করবো।” তিনি দোভাষীর মাধ্যমে আমাকে বললেন, “আপনি তাই বলেছেন যা আবদুল্লাহ বিন সালাম নবী (সঃ) এঁর কাছে এসে ইসলাম গ্রহণের সময় বলেছিলেন।” তিনি তখন যাজকদের ও কয়েকজন খৃষ্টান ব্যবসায়ীকে আনতে পাঠালেন ও আমাকে একটি সংলগ্ন কক্ষে বসিয়ে রাখলেন তাদের চোখের আড়ালে। “আপনারা এই নতুন যাজক সম্পর্কে কি মনে করেন যিনি জাহাজে করে এসেছেন?” তারা বললেন: “তিনি আমাদের ধর্মের একজন বড় পণ্ডিত। আমাদের পাদ্রীরা বলেন যে তিনি সবচেয়ে জ্ঞানী এবং ধর্মীয় জ্ঞানে কেউ তাঁর চেয়ে অগ্রগামী নয়।” খৃষ্টানদের একথা শোনার পর সুলতান আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং আমি তাদের সম্মুখে এলাম। আমি দুটি সাক্ষ্য উচ্চারণ করলাম যে আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল, এবং যখন খৃষ্টানরা একথা শুনল তারা পরস্পরকে ক্রসচিহ্ন এঁকে দেখাল এবং বলল: “বিয়ে করার আকাঙ্খা ছাড়া আর কিছুই তাকে এ কাজে প্রেরণা দেয়নি, কারণ আমাদের ধর্মে যাজকরা বিয়ে করতে পারে না।” তারপর তারা হতাশা ও দুঃখের সাথে স্থানত্যাগ করলো। সুলতান আমার জন্য দৈনিক এক চতুর্থাংশ দীনার বরাদ্দ করলেন এবং আল হাজ্জ মুহাম্মাদ আল সফর এর কন্যার সাথে আমার বিয়ে দিলেন। যখন আমি স্ত্রীকে ঘরে আনতে মনস্থ করলাম, তিনি আমাকে একশত সোনার দীনার ও একপ্রস্থ চমৎকার পোশাক উপহার দিলেন। আমি সংসার শুরু করলাম এবং আল্লাহ আমাকে এক পুত্র দিয়ে অনুগ্রহ করলেন যার নাম আমি রেখেছি মুহাম্মাদ, নবীর নাম অনুসারে, বরকতের জন্য।”
মদীনায় ইহুদীদের এক সমপ্রদায় বাস করত যারা সেখানে হিজরত করেছিল প্রত্যাশিত নবীর আগমনের অপেক্ষায় থাকার জন্য। তারা মদীনার মূর্তিপূজারী আরবদের তাঁর আগমনের কথা বলে হুমকি দিত এভাবে যে তিনি এসে তাদের ধ্বংস করবেন যেভাবে আল্লাহ আদ ও সামুদ জাতিকে ধ্বংস করেছিলেন। এ কারণেই কিছু সংখ্যক আরব নবীর কথা জানার সাথে সাথে তাঁর সাথে যোগ দেবার জন্য তাড়াহুড়া করেছিল। একজন জ্ঞানী ইহুদী, ইবনুল হাইয়াবান, নবীর আগমনের সাত বছর পূর্বেই সিরিয়া ত্যাগ করে এসেছিল এবং তার মৃত্যুর সময়ে তার সমপ্রদায়কে বলেছিল:
“ওহে ইহুদীগণ, তোমরা কি মনে কর এ সম্পর্কে যে আমি কেন খাদ্য ও পানীয়ে পূর্ণ দেশত্যাগ করে কষ্ট ও ক্ষুধার এই দেশে এসেছি?”
যখন তারা উত্তর দিল যে তারা বুঝতে পারছে না কেন, তখন সে বললো যে সে এদেশে এসেছে একজন নবীর আবির্ভাবের আশায়, যাঁর আসার সময় সন্নিকট। এই সেই শহর যেখানে তিনি হিজরত করবেন এবং সে এখানে এই আশায় এসেছিল যে তিনি এলে সে তাঁর অনুসারী হবে। বেশ কিছুসংখ্যক ধর্মযাজক ইসলাম গ্রহণ করেছিল, যাদের মাঝে আবদুল্লাহ ইবনে সালাম ছিলেন যিনি, যখন নবীর কাছে তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দিতে গিয়েছিলেন, বলেছিলেন: “ও আল্লাহর রাসূল! আমার লোকেরা অত্যন্ত কূটবুদ্ধি সম্পন্ন, সুতরাং তাদের ডেকে জিজ্ঞাসা করুন আমার সম্পর্কে তারা কি ভাবে।” অতএব নবী (সঃ) তাই করলেন, তাদের জিজ্ঞাসা করলেন: “তোমরা আবদুল্লাহ ইবনে সালাম সম্পর্কে কি বল?” তারা তখন বলল,“আল্লাহর কসম, সে আমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি, সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত ও জ্ঞানী।” নবী (সঃ) বললেন, “যদি সে ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে তোমরা কি বলবে?” তারা বলল, “আমরা আল্লাহর আশ্রয় চাই, সে কখনো তা করবে না!” তখন আবদুল্লাহ আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল।” শোনামাত্র তার লোকেরা তাকে গালাগালি করতে লাগল একথা বলে, “সে আমাদের মধ্যে নিকৃষ্ট, নীচ বংশজাত এবং সবচেয়ে অজ্ঞ।” একবার আবদুল্লাহ ইবনে সালাম এই আয়াতটির উপর মন্তব্য করছিলেন-
“এবং তারা (আহলে কিতাব) একথা জানে (যে মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল) যে ভাবে তারা তাদের নিজ সন্তানদের জানে।”
“আল্লাহর শপথ, আল্লাহ সত্য বলেন, কারণ আমরা আমাদের সন্তানদের পরিচয়ের ব্যাপারে শুধু আমাদের স্ত্রীদের উপর নির্ভর করি, অথচ আল্লাহ আপনার সম্পর্কে তাঁর কিতাবে উল্লেখ করেছেন (অর্থাৎ তাওরাতে)।” তিনি এটাও সাক্ষ্য দেন যে যখন তিনি নবীর সম্পর্কে শুনেছিলেন, ইতোমধ্যেই তিনি তাঁর নাম, আগমনের সময় এবং স্থান সম্পর্কে জানতেন।
অসংখ্য ঘটনা আছে যেখানে ইহুদীরা নবীকে পরীক্ষা ও প্রশ্ন করেছিল, কেউ তাঁর কথা গ্রহণ করেছিল অন্যেরা করেনি। নবী (সঃ) এঁর স্ত্রী, সাফিয়া বিনতে হুয়াই, তাঁর পিতা ও চাচা (যাঁরা ইহুদী ছিলেন) সম্পর্কে বলেন:
“যখন রাসূলুল্লাহ কুবায় আসেন, আমার পিতা হুয়াই ইবনে আখতাব এবং আমার চাচা আবু ইয়াসের ফজরের নামাজের পর অন্ধকার থাকতেই তাঁর সাথে দেখা করতে যান এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত ফিরে আসেননি। তারা ক্লান্ত, ভগ্নোৎসাহ হয়ে ফিরলেন, এবং ধীরে ধীরে হাঁটছিলেন। আমি তাদের কাছে গেলাম কিন্তু তাঁরা এতই বিষণ্ন ছিলেন যে আমাকে খেয়ালই করলেন না। তখন আমি শুনলাম আমার চাচা আমার বাবাকে জিজ্ঞাসা করছেন, “ইনি কি সেই জন?” তিনি উত্তর দিলেন: “হ্যাঁ, আল্লাহর কসম।” আমার চাচা বললেন: “তুমি কি তাকে চিনতে পেরেছ এবং নিশ্চিত?” তিনি বললেন: “হ্যাঁ।” আমার চাচা বললেন: “এখন তুমি তাহলে তার সম্পর্কে কি করবে?” তিনি বললেন: “আল্লাহর শপথ! যতদিন বেঁচে থাকব ঘৃণা ও শত্রুতা পোষণ করব।”

ভবিষ্যদ্বাণী, পূর্বাভাস ও অতীত ঘটনাবলী

মুহাম্মাদের নবুওয়াত গ্রহণ করার ব্যাপারে বাইবেল কি বলে সে সম্পর্কে আমার জ্ঞানে আমি নিজেই প্রভাবিত ছিলাম। এবং দুজন ইহুদী রাবাই ‘বক্তাদের আসরে’ আমার কাছে স্বীকার করেছিলেন যে তাঁদের কিতাবে উল্লেখিত নবী হচ্ছেন মুহাম্মাদ। এটা বহু আগে থেকেই স্বীকৃত যে নবুওয়াতের দাবীর সত্যতার সুনিশ্চিত লক্ষণ হচ্ছে একজনের সঠিকভাবে এবং ক্রমাগতভাবে ভবিষ্যৎ ঘটনা সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষমতা থাকা। এটা বিশেষভাবে খৃষ্টানদের জন্য সত্যি যারা প্রায়ই দাবী করে, “মুহাম্মাদ কি কি ভবিষ্যৎদ্বাণী করেছেন?” এটা এজন্য যে বাইবেল একে সত্য নবী থেকে মিথ্যা নবী পার্থক্য করার একটা উপায় হিসাবে বর্ণনা করেছে। সবাই কখনো না কখনো ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছু বলতে পারে, কেউ সেগুলিকে অনেকবারই সঠিক হিসাবে পেতে পারে, কিন্তু শুধুমাত্র সেই সবসময় সঠিক পূর্বাভাস দিতে পারে যে এমন একজনের কাছ থেকে তথ্য গ্রহণ করে যাঁর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞান আছে। কুরআনে ও সহীহ হাদীসে অনেক ভবিষ্যদ্বাণী আছে যা সত্যি হয়েছে।
  • ১। কুরআন বলছে:
    “আল্লাহর ইচ্ছায় তোমরা অবশ্যই ‘মসজিদুল হারামে’ নিরাপদে প্রবেশ করবে, কেউ মুণ্ডিত মস্তকে, কেউ কেশ কর্তন করবে। তোমাদের কোন ভয় থাকবে না।” (সূরা আল ফাতহ, ৪৮ : ২৮)
    এই আয়াতটি হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় নাযিল হয়। প্রায় দুই বছরের মধ্যেই আয়াতের ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হয়, মক্কা বিজয় হয় এবং মুসলিমরা হজ্জ করে যেভাবে আয়াতে বলা হয়েছে সেভাবে।
  • ২। কুরআন বলছে:
    “তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস করে ও সৎকাজ করে আল্লাহ তাদের এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তিনি তাদের জমীনের উত্তরাধিকারী করবেন, যেমন তিনি করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদের এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য তাদের ধর্মকে সুদৃঢ় করবেন-যা তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং ভয়-ভীতির পরিবর্তে তাদেরকে নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমার ইবাদাত করবে, আমার কোন অংশী করবে না।” (সূরা আন-নূর, ২৪, ৫৫)
    এবং আরো বলছে:
    “যারা অবিশ্বাস করে তাদের বল, তোমরা শীঘ্রই পরাজিত হবে।” (সূরা আলে ইমরান, ৩:১২)
    এবং
    “যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে, তুমি দেখবে লোকে দলে দলে প্রবেশ করছে আল্লাহর দ্বীনে…” (সূরা আন-নাসর, ১১০:১-২)
    প্রথম আয়াতটি নাযিল হয়েছিল যখন মুসলিমরা দুর্বল ছিল, তাদেরকে ন্যায্য বিজয়ের ওয়াদা দিয়ে। দ্বিতীয়টি সফল হয়েছিল মক্কা বিজয়ের পর এবং প্রথম চার খলীফার খিলাফতকালে যখন মুসলিমরা আল্লাহর সাহায্যে ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্য বিজয়ের পর এবং মাত্র বিশ বছরের মধ্যেই স্পেন থেকে চীনের অংশবিশেষ পর্যন্ত মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। এই বিজয় কুরআনের আরেকটি আয়াতকেও পূর্ণ করছে:
    “তিনিই রাসূল পাঠিয়েছেন হিদায়াত ও সত্য দ্বীন সহকারে, যাতে তা অন্য সমস্ত ধর্মের উপর বিজয়ী হয়।” (সূরা আত-তাওবাহ, ৯:৩২)
    ইসলাম আসার পর খৃষ্টান, ইহুদী ও মূর্তিপূজারী ধর্মসমূহ আর কখনই পূর্ব প্রাধান্য ফিরে পায়নি-বাহ্যিকভাবে ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে। কুরআনের (সূরা আল ফাতহ, ৪৮:১৮-২১) এবং (১:১৩) আয়াতও বিজয়ের ওয়াদা ও গণীমত লাভের ওয়াদা করছে-যেগুলি পূর্ণ হয়েছে। ইসলামের বর্তমান বৃদ্ধির হার অব্যাহত থাকলে ২০২৫ সালে সংখ্যায় তারা খৃষ্টানদের ছাড়িয়ে যাবে।
  • ৩। কুরআন বলছে:
    “রোমকরা পরাজিত হয়েছে-নিকটবর্তী অঞ্চলে; কিন্তু তারা তাদের এ পরাজয়ের পর শীঘ্রই বিজয়ী হবে, কয়েক বছরের মধ্যেই, অগ্র ও পশ্চাতের সিদ্ধান্ত আল্লাহরই। সেদিন বিশ্বাসীরা হর্ষোৎফুল্ল হবে; আল্লাহর সাহায্যে। তিনি যাকে ইচ্ছা সাহায্য করেন এবং তিনি পরাক্রমশালী, পরম দয়ালু। এ আল্লাহরই প্রতিশ্রুতি; আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না, কিন্তু অধিকাংশ লোক বোঝে না। তারা জীবনের বাহ্য দিক সম্বন্ধে অবগত, পারলৌকিক জীবন সম্বন্ধে তারা অনবধান।” (সূরা আর-রূম, ৩০:১-৭)
    পূর্ব রোমান বা বাইজানটাইন সাম্রাজ্য পারস্যের হাতে বিরাট পরাজয় বরণ করেছিল যারা ৬১৪ খৃষ্টাব্দে জেরুজালেম দখল করে নিয়েছিল, এবং এরপর মিশর ও সিরিয়ার পতন ঘটে, এবং কনস্টান্টিনোপল অবরুদ্ধ হয়-(নিকটবর্তী অঞ্চলে)। মুশরিক আরবরা এতে উল্লসিত হয়, কারণ এটি ছিল আহলে কিতাবদের উপর মূর্তিপূজারীদের বিজয়। যখন এই আয়াত নাযিল হয়, তখন এটা ধারণাতীত ছিল যে রোমানরা আবার উঠে দাঁড়াতে পারবে। “কয়েক বছর” শব্দটি “বিদ’আ” শব্দের অনুবাদ, যার আসল অর্থ তিন থেকে নয় বছর। একজন মুশরিক উবাই, আবু বকরের সাথে একশত উটের বাজী ধরেছিল যে এটা কখনো ঘটবে না। ৬২৩ খৃষ্টাব্দে বাইজানটাইন রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াস বিভিন্ন যুদ্ধ ক্ষেত্রে পারস্যবাসীদের ধ্বংস করেছিলেন। উবাই নিহত হয়েছিল যুদ্ধে ও তার আত্মীয়রা বাজীর শর্ত পূরণ করেছিল। একই সময়ে মুসলিমরাও মুশরিকদের উপর বিজয়ী হয়ে আনন্দ করেছিল যেমন কুরআনে বলা হয়েছে।
  • ৪। দুটি সহীহ হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত একটি দীর্ঘ বর্ণনা পাওয়া যায়, যেখানে নবী (সঃ) একটি বাগানে বসেছিলেন। উসমান ইবনে আফফান সেখনে এলেন এবং নবী (সঃ) আবু মূসা আশ’আরী (বর্ণনাকারী) কে বললেন উসমানকে জান্নাতের সুসংবাদ দিতে, এবং এটা জানাতে যে লোকে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। এই ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়েছিল, উসমান মুসলিমদের নেতা হয়েছিলেন, এবং কিছুসংখ্যক বিদ্রোহী তাঁকে হত্যা করেছিল।
  • ৫। আলী ইবনে আবি তালিব, চতুর্থ খলীফা নবী (সঃ) কর্তৃক তাঁর হত্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য জানতে পেরেছিলেন, এমনকি যে তাঁকে হত্যা করার কথা, তাকেও তিনি চিনতেন, লোকদের তিনি সনাক্ত করেও দেখিয়েছিলেন। সবাই যখন জানতে চাইল কেন তিনি লোকটিকে হত্যা করছেন না, তখন তিনি উত্তর দিয়েছিলেন: “তাহলে কে আমাকে হত্যা করবে?” হত্যার পূর্ব রাত্রে, আলী বেরিয়ে এসে আকাশের দিকে তাকালেন এবং বললেন: “আল্লাহর শপথ, তিনি কখনো মিথ্যা বলেননি বা তাঁর সম্পর্কে কোন মিথ্যা বলা হয়নি।” পরদিন সেই লোকই আলীকে হত্যা করে, এবং তাঁর রক্ত ছিটকে গিয়ে তাঁর দাড়িতে লাগে, যেমনটি নবী বলেছিলেন।
  • ৬। যখন মুসলিমরা খায়বারে ইহুদীদের সাথে যুদ্ধ করছিলেন, কয়েকদিনের দুর্গ অবরোধের পর নবী (সঃ) বললেন যে পরদিন তিনি এমন একজনকে নেতৃত্বের পতাকা দেবেন যাঁকে আল্লাহ বিজয় দান করবেন। তিনি আলীকে পতাকা দেন এবং আলীর নেতৃত্বে সেদিনই দুর্গের পতন ঘটে।
  • ৭। একদিন নবী (সঃ) আলী ও যুবাইরকে একসাথে হাসতে দেখে জানতে চাইলেন আলী কি যুবাইরকে ভালবাসেন? আলী উত্তর দিলেন: “আমি কিভাবে তাকে ভালবাসব না যখন সে আমার ভাতিজা/ভাগ্নে ও একই ধর্মের?” নবী (সঃ) যুবাইরকে একই প্রশ্ন করলেন ও অনুরূপ উত্তর পেলেন। নবী (সঃ) তখন যুবাইরকে বললেন, সে আলীর সাথে অন্যায়ভাবে যুদ্ধ করবে। জামালের যুদ্ধে, যুদ্ধক্ষেত্রে যখন আলী ও যুবাইর মুখোমুখি হলেন, আলী যুবাইরকে এই ঘটনাটি স্মরণ করিয়ে দিলেন। যুবাইরের মনে পড়ল, তিনি বললেন যে তিনি ভুলে গিয়েছিলেন এবং তিনি যুদ্ধ ক্ষেত্র ত্যাগ করলেন, কারণ আলী ন্যায়তঃ খলীফা, তাঁকে যুদ্ধের মাধ্যমে বিরোধিতা করা অন্যায়।
  • ৮। নবী (সঃ) বলেছেন: “খিলাফত তিরিশ বছর স্থায়ী হবে, তারপর আসবে রক্তক্ষয়ী রাজতন্ত্র।” তাই ঘটেছিল। আবু বকর দুই, উমর দশ, উসমান বার, আলী আড়াই এবং হাসান সাড়ে তিন-মোট ত্রিশ বছর। এরপর মন্দ বিস্তৃত হয় ও রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • ৯। নবী (সঃ) মিশর দখলের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এবং তাদের সাথে সাহাবাদের ভাল ব্যবহার করতে বলেছিলেন। এবং বলেছিলেন তারা পারস্য সম্রাট খসরুর ধনভাণ্ডার লাভ করবে, এবং সুরাকা ইবনে মালিক সিজারের ব্রেসলেট হাতে পরবে। তাই হলো এবং উমরের কাছে যখন সিজারের ব্রেসলেট এলো, তিনি সুরাকাকে ডেকে রাসূলের প্রতিশ্রুতি ভবিষ্যদ্বাণী স্মরণ করিয়ে দিয়ে সেই ব্রেসলেট পরিয়ে দিলেন।
  • ১০। সহীহ বুখারীর একটি হাদীসে আউফ বিন মালিককে বলা হয়েছে কিয়ামতের পূর্বে ছয়টি লক্ষণের কথা: “প্রথম, আমার মৃত্যু; দ্বিতীয়, জেরুজালেম বিজয়; তৃতীয়, তাদের মধ্যে একটি মহামারী; চতুর্থ, ধনসম্পদের প্রাচুর্য যখন কাউকে একশ দীনার দিলেও সে তাতে খুশী হবে না; পঞ্চম, একটি বিপদ যা সমস্ত আরব পরিবারকে ব্যতিক্রম ছাড়াই গ্রাস করবে; ষষ্ঠ, খৃষ্টানদের সাথে চুক্তি, যা খৃষ্টানরা ভঙ্গ করবে ইত্যাদি… (এই শেষটি এখনও পূর্ণ হয়নি)। জেরুজালেম জয় করা হয়েছে, ১৬ হিজরীতে আমওয়াসে মড়ক শুরু হয় এবং সত্তর হাজার মারা যায়, সম্পদের প্রাচুর্য দেখা দেয়, বিশেষতঃ উসমানের খিলাফতের সময় এবং পরে খলীফা ওমর বিন আবদুল আযীয় এর সময়, যখন যাকাত নেবার লোক পাওয়া যেত না। তারপর উসমানের সময়কার বিদ্রোহ ও হত্যা পরবর্তী পরিসিস্থিতিতে যাতে সব আরব পরিবারই কোন না কোনভাবে জড়িত ছিল।
  • ১১। নবী (সঃ) উল্লেখ করেছেন যে মুসলিমরা রোম ও কনস্টান্টিনোপল জয় করবে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আগে হিরাক্লিয়াসের শহর জয় করবে অর্থাৎ কনস্টান্টিনোপল। পঞ্চদশ শতকে তা হয়েছে। রোম বিজয় পূর্ণ হওয়া বাকী আছে। নবী (সঃ) এই বক্তব্যগুলির ব্যাপারে যা লক্ষণীয় তা হচ্ছে এগুলি এমন এক সময় করা হয়েছিল যখন এটা কল্পনারও বাইরে ছিল যে মদীনার মত একটি ক্ষুদ্র নগর-রাষ্ট্র, যা সবদিকে মুশরিক আরবদের দ্বারা পরিবেষ্টিত, তারা শক্তি ও ক্ষমতার এমন চূড়ান্ত পর্যায়ে কখনো পৌঁছাবে। তাছাড়াও এই ভবিষ্যদ্বাণীগুলিতে পরিষ্কার ভাষায়, সুনির্দিষ্ট নাম ও তারিখ ও সঠিকভাবে নির্দেশ করা হয়েছে, বাইবেল বা নষ্ট্রাডামুসের মত অস্বচ্ছ, অনির্দ্দেশ্যভাবে নয়।
  • ১২। নবী (সঃ) মুসলিমদের ভিতরে বিভক্তির কথা ও বিভিন্ন দলের বৈশিষ্ট্যের কথাও উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন কিছু লোক আলীর প্রতি তাই করবে যা খৃষ্টানরা যীশুর প্রতি করেছে। এটা পরিষ্কারভাবে শিয়াদের নির্দেশ করছে যারা আলীকে প্রশংসা ও ভালবাসার বাড়াবাড়ি করে এবং তাদের মধ্যে নুসারিয়া উপদল আলীকে আল্লাহর প্রকাশ হিসাবে ইবাদত করে। তিনি একদলের কথা বলেছেন যারা “কদর” বা ভাগ্যকে অস্বীকার করবে, তিনি তাদেরকে উম্মাহর অগ্নি উপাসক বলেছেন এবং তাই হয়েছে। তিনি আরও বলেছেন যে কেউ কেউ কুরআনকে সৃষ্ট বস্তু বলবে, কেউ কুরআনের বাইরে অন্য কিছুকে অর্থাৎ সুন্নাহকে অস্বীকার করবে-এসবই সত্য হয়েছে। তিনি আরো বলেছেন যে একদল কুরআনের আয়াত ব্যবহার করে বিশ্বাসীদের অবিশ্বাসী হিসাবে ঘোষণা করবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে এবং তাদেরকে হত্যা করতে হবে। খারেজীরা ছিল এ ধরনের দল যারা আলী ও মুয়াবিয়াকে অবিশ্বাসী ঘোষণা করেছিল এবং যারা তা বিশ্বাস করবে না, তারাও অবিশ্বাসী হবে বলে ঘোষণা করেছিল, এবং তারা মুসলিমদের হত্যা করতো, এবং তারা ছিল তামীম গোত্রের, যেমন নবী বলেছিলেন।
  • ১৩। নবী (সঃ) বলেছিলেন যে কিয়ামতের পূর্বসতর্কীকরণ হিসাবে কিছু লক্ষণ দেখা যাবে। সেগুলির মধ্যে যা সত্য হয়েছে তা হচ্ছে:
    • ক) নগ্নপদ বেদুইনরা উচ্চ প্রাসাদ তৈরীর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে। বর্তমানে আরব উপদ্বীপের এককালের দরিদ্র মেষপালকের বংশধররা ভবন নির্মাণে আধুনিক বিশ্বের সাথে পাল্লা দিচ্ছে।
    • খ) মসজিদগুলি প্রাসাদের মত হবে। বর্তমানে বিভিন্ন মসজিদে কারুকার্য, মার্বেল মোড়া মেঝে, দামী কার্পেট, ঝাড়বাতি ইত্যাদি দেখা যায়, অথচ নবী (সঃ) আল্লাহর ঘর সাজসজ্জাহীন রাখতে বলেছেন।
    • গ) বিশ্বস্ততা উঠে যাবে মানুষের অন্তর থেকে এমনভাবে যে একজন বলবে, “আমি অমুক শহরের একজন বিশ্বস্ত লোককে জানি।”
    • ঙ) হত্যা বেড়ে যাবে এমনভাবে যে, যে হত্যাকারী সে জানবে না যে সে কেন হত্যা করেছে আর যে নিহত সেও জানবে না যে সে কেন নিহত হয়েছে।
    • চ) সুদের ব্যবহার এমনভাবে বৃদ্ধি পাবে যে কেউই এর হাত থেকে বাঁচতে পারবে না।
    • ছ) মুসলিমদের শত্রুরা তাদের ভূমি ও সম্পদ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেবে, মুসলিমরা জিহাদ ছেড়ে দেবে, এবং কেবল দুনিয়াবী ব্যাপার নিয়ে মত্ত থাকবে।
    • জ) শিক্ষার হার বাড়বে।
    • ঝ) আলেমদের তিরোধানের সাথে সাথে ধর্মীয় জ্ঞানও লোপ পাবে।
    • ঞ) বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার বাড়বে, এবং মুসলিমরা তা হালাল করবে যদিও নবী (সঃ) তা হারাম করেছেন।
    • ট) যৌন স্বেচ্ছাচারিতা বাড়বে, এবং এর পরিণতিতে এমন সব নতুন রোগ দেখা দেবে যা আগে শোনা যায়নি। যেমন, এইডস ইত্যাদি।
    • ঠ) দাজ্জালের আবির্ভাব, প্রত্যেকেই নবুওয়াতের দাবী করা, অথচ মুহাম্মাদ (সঃ)-ই শেষ রাসূল। মুসাইলামা থেকে শুরু করে এলিজা মোহাম্মদ (নেশন অফ ইসলাম এর প্রতিষ্ঠাতা) এবং ভারতের গোলাম আহমদ কাদিয়ানী পর্যন্ত সবাই এর অন্তর্ভুক্ত।
    • ড) কাপড় পরেও মহিলারা উলঙ্গ থাকবে।
    • ঢ) মদ্যপান সাধারণ হয়ে যাবে এবং মুসলিমরা অন্য নামে একে হালাল করবে।
    • ণ) মসজিদে শোরগোল হবে।
    • ত) নিকৃষ্ট ও মূর্খ লোকেরা নেতা হবে ও জুলুম করবে।
    • থ) একজন তার স্ত্রীর আনুগত্য করবে ও মাতার অবাধ্য হবে, এবং তার বন্ধুদের সাথে উত্তম আচরণ করবে এবং পিতাকে ঘৃণা করবে।
    • দ) পুরুষেরা রেশম ও স্বর্ণ পরিধান করবে, এবং তা বৈধ করবে যদিও নবী (সঃ) তা তাঁর উম্মার পুরুষদের জন্য তা অবৈধ করেছেন।
    • ধ) মানুষ দুনিয়ার স্বার্থে দ্বীনকে ত্যাগ করবে, এবং দ্বীনের উপর দৃঢ় থাকা দুই হাতে জ্বলন্ত কয়লা ধরে রাখার সমান হবে।
    এগুলো মুহাম্মাদ (সঃ) এর অসংখ্য ভবিষ্যদ্বাণীর কয়েকটি, যেগুলি স্পষ্টভাবে সত্য হয়েছে এবং কিছু সংখ্যক বর্তমানে আমাদের যুগে সত্য হিসাবে দেখা দিয়েছে যা তাঁর দাবীকে শক্তিশালী করেছে।
কুরআন অতীতের সম্পর্কেও সঠিক জ্ঞান দান করে। এগুলি এমন তথ্য যা মুহাম্মাদ (সঃ) আল্লাহর কাছ থেকে ছাড়া পেতে পারতেন না। কিছু উদাহরণ নীচে দেওয়া হলো:
  • ১। কুরআনে নূহের নৌকার উল্লেখ আছে:
    “নৌকাটি যুদী পর্বতের উপর স্থির হল” (সূরা হুদ, ১১:৪৪)
    সামপ্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় যুদী পর্বতের উপর নূহের নৌকার একই আয়তনের একটি নৌকা আকৃতির বস্তু আবিষ্কৃত হয়েছে। বাইবেল দাবী করছে যে নৌকাটি আরারাত পর্বতমালা থেকে বিশ মাইল দূরে এসে স্থির হয়েছিল। এটা সম্ভব নয়, কারণ এই পাহাড়গুলির ভূতাত্ত্বিক গঠন সমপ্রতি সম্পূর্ণ হয়েছে এবং নূহের সময় তার অস্তিত্বই ছিল না। কুরআনেও এই বন্যাকে একটি স্থানীয় ঘটনা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা শুধু নূহের জাতিকে ধ্বংস করেছিল। বাইবেল বন্যার যে সময় ও তারিখ দিয়েছে এবং এটি একটি বিশ্বব্যাপী দুর্যোগ বলে যে দাবী করেছে, তা সমস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
  • ২। কুরআন ইউসুফের কালে মিশরের শাসককে “রাজা” হিসাবে উল্লেখ করেছে, আর মূসা শাসককে “ফারাও” হিসাবে উল্লেখ করেছেন। এটা সামান্য হলেও সঠিকত্বের দিক দিয়ে জোরালো, কারণ ইউসুফের সময় শাসকরা হাইকোস বংশের এবং সেমেটিক ছিল। তারা নিজেদের ফারাও বলত না। মূসার সময়ে হাইকোসদের জায়গায় যে স্থানীয় মিশরীয় রাজবংশ রাজত্ব করত, তারা এই শব্দ ব্যবহার করত। বাইবেল উভয় ক্ষেত্রেই ফারাও সম্বোধন করে অশুদ্ধ প্রমাণিত হয়েছে। কুরআনে প্রাচীন মিশরীয় ধর্মের নানা দিকও সঠিকভাবে বর্ণিত হয়েছে, বিশেষতঃ ফারাও কে খোদা হিসাবে এবাদত করা।
  • ৩। কুরআন যীশুর আদি অনুসারীদের “নাজারেন” বলে উল্লেখ করেছে যা ঐতিহাসিকভাবে সঠিক। যীশুর পরে রোমানরা তাদেরকে “খৃষ্টান” ডাকনামে ডাকত-এ্যাক্টস ১১:২৬ “এন্টিয়োকে প্রথম শিষ্যদের খৃষ্টান ডাকা হয়।”
  • ৪। কুরআনে ইরাম নামে এক শহরের উল্লেখ আছে যা আল্লাহ তার অধিবাসীদের পাপের জন্য ধ্বংস করেছিলেন। সামপ্রতিক কাল পর্যন্ত এই শহরের কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি এবং এটাকে উপকথা হিসাবেই ধরে নেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে উত্তর-পশ্চিম সিরিয়াতে, ৪৩০০ বছর পুরানো এবলা শহরটি খনন করা হয়। মাটির ফলকে উৎকীর্ণ কিউনিফর্ম লিপিতে যেসব নগরের সাথে এবলার ব্যবসা বাণিজ্য ছিল, তাদের নাম পাওয়া যায়। এদের মাঝে ইরামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এসব তথ্য মুহাম্মাদ কোথায় ও কিভাবে পেলেন? বাইবেলে পেয়ে থাকলে তিনি তার ভুলগুলি কিভাবে শুদ্ধ করলেন?

কুরআন হচ্ছে শেষ ওহী এবং একটি প্রমাণ, যা শুধু চৌদ্দশত বৎসর আগের আরবদের জন্য নয়, আজকের বিজ্ঞানীদের জন্যও। যারা বিংশ শতাব্দীতে বাস করছে-যা খুব শীগগিরই একবিংশ শতাব্দী হয়ে যাবে, তাদের জন্য কুরআনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হয়তোবা এটা যে, আধুনিক বিজ্ঞানের অধিকাংশ আবিষ্কার ও কুরআন পরস্পর সঙ্গতিপূর্ণ, এবং কোন কোন ক্ষেত্রে আগের ধারণাকৃত বহু বিষয় গত বিশ বৎসরে আবিষ্কৃত হয়েছে। এ বিষয়ে অগ্রণী পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন মরিস বুকাইলী, যিনি গভীর অধ্যয়নের ফলস্বরূপ ‘বাইবেল, কুরআন ও বিজ্ঞান’ নামক একটি বই লিখেছেন। এ বইয়ে তিনি প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিক বিষয়ে প্রাপ্ত বাইবেল ও কুরআনের বক্তব্য তুলনা করেছেন। বিচার-বিশ্লেষণের পরে তাঁর সিদ্ধান্ত হচ্ছে:
“পূর্ববর্তী দুটি ঐশীবাণী অর্থাৎ তাওরাত ও ইঞ্জিলের পর কুরআন অবতীর্ণ হয়। কুরআনের বাণীসমূহ যে শুধুমাত্র স্ববিরোধিতা থেকেই মুক্ত তা নয়, বাইবেলের মত এতে মানুষের কোন হস্তক্ষেপের প্রমাণ নেই। কেউ যদি নিরপেক্ষভাবে এবং বৈজ্ঞানিক বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে এর বক্তব্যসমূহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে চায়, তাহলে দেখতে পাবে যে তা আধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তদুপরি বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট বক্তব্য ও বাণী সেখানে রয়েছে। তারপরও এটা অচিন্তনীয় যে মুহাম্মাদের সময়ের একজন মানুষ এর রচয়িতা হতে পারে।
এতকাল যাবত যে সব আয়াতের বক্তব্য ব্যাখ্যা করা সম্ভব হচ্ছিল না, আধুনিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞান আমাদেরকে সে সবের অর্থ বোঝার ব্যাপারে সাহায্য করেছে। একই বিষয়ে বাইবেল ও কুরআনের বক্তব্যের তুলনা করলে কিছু মৌলিক পার্থক্য ধরা পড়ে। বাইবেলের বর্ণনা যেখানে বৈজ্ঞানিকভাবে অগ্রহণযোগ্য, সেখানে কুরআনের বর্ণনা আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে প্রাপ্ত জ্ঞান ও তথ্যের আলোকে সঙ্গতিপূর্ণ। উদাহরণ হিসাবে সৃষ্টিতত্ত্ব মহাপ্লাবনের বিষয নেওয়া যেতে পারে। ইহুদীদের মিসর-ত্যাগের ঘটনার বর্ণনায় কুরআন বাইবেলের সম্পূরক। যেমন প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারে দেখা গেছে, মূসার আমলকে চিহ্নিত করা যায় এমন সব নিদর্শন কুরআন ও বাইবেলের বর্ণনার মিল প্রমাণ করছে। এছাড়া অন্য সব বিষয়ে এই দুই গ্রন্থের পার্থক্য বিরাট। যা আসলে এতদিন যাবত মুহাম্মাদ সম্পর্কে চলে আসা এই অভিযোগকেই খণ্ডন করছে যে তিনি কুরআন রচনা করেছেন বাইবেল থেকে নকল করে, কোন প্রমাণ দেওয়া ছাড়াই এসব অভিযোগ করা হতো।

মুহাম্মাদের আমলের জ্ঞানের উৎকর্ষতার আলোকে এটা ধারণাতীত যে কুরআনের বিজ্ঞান সম্পর্কিত বক্তব্য কোন মানুষের করা। সুতরাং এটা স্বীকার করে নেওয়া অত্যন্ত যথাযথ যে কুরআন শুধু অবতীর্ণ কিতাব নয়, বরং এর সঠিকত্বের নিশ্চয়তার জন্য এবং এতে বর্ণিত বৈজ্ঞানিক তথ্যের জন্য একে বিশেষ মর্যাদার স্থান দেওয়া উচিত, কারণ কুরআনের অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা একথাই প্রমাণ করে যে এর কোন মানবিক ব্যাখ্যা অসম্ভব।”
আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা সমর্থিত কিছু বক্তব্য
  • ১। ভ্রূণসৃষ্টি ও এর বিকাশ সম্পর্কিত যথাযথ বর্ণনা:নবী মুহাম্মাদের সময়ে এ সম্পর্কে বিরাজমান তত্ত্বের ভিতরে এরিস্টটলের এই ধারণা অন্তর্ভুক্ত ছিলো যে একটি শিশু রক্তের জমাট বাঁধা অবস্থা থেকে সৃষ্ট, যেভাবে পনীর তৈরী হয়। আঠারশ শতাব্দীতে হার্টসিকার দাবী করেন যে তিনি আদি মাইক্রোস্কোপ-এর সাহায্যে স্পার্ম এর মধ্যে প্রাথমিকভাবে গঠিত মানুষ দেখতে পেয়েছেন। কুরআন এসব কিছুই বলছে না, বরং মানবের ভ্রূণাবস্থার বিকাশের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বর্ণনা দিচ্ছে:
    “আমি তো মানুষকে মাটির উপাদান থেকে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর আমি তাকে শুক্রবিন্দুরূপে এক নিরাপদ আধারে স্থাপন করি, পরে আমি শুক্রবিন্দুকে পরিণত করি জমাট রক্তে, অতঃপর জমাট রক্তকে পরিণত করি পিণ্ডে এবং পিণ্ডকে পরিণত করি অস্থিপিঞ্জরে, অতঃপর অস্থিপিঞ্জরকে মাংস দ্বারা ঢেকে দিই, অবশেষে তাকে রূপ দান করি। সুনিপুণ স্রষ্টা আল্লাহ কত মহান! এরপর তোমরা অবশ্যই মৃত্যুবরণ করবে। অতঃপর কিয়ামতের দিন তোমাদের পুনরুত্থিত করা হবে।” (সূরা আল মু’মিনুন, ২৩, ১২-১৬)
    নবী (সঃ) আরো ব্যাখ্যা করেন যে “নুতফা” পুরুষের শুক্রাণু ও নারীর ডিম্বাণু উভয়টিকেই বোঝায়। “আলাকা” শব্দটির তিনটি অর্থ আছে আরবীতে: (১) আঁকড়ে থাকা বস্তু, (২) জমাট রক্তবিন্দু, (৩) জোঁকের মত বস্তু। তিনটি অর্থই বিকাশমান ভ্রূণের প্রথম ধাপকে সঠিকভাবে বর্ণনা করে। নিষিক্ত ডিম্বাণু এমন হয় যে তা জরায়ূর দেওয়াল আঁকড়ে ধরে রাখে। তারপর আকার ও আচরণের দিক থেকে সেটা জোঁকের সাদৃশ্য অবলম্বন করে। জোঁক এবং ভ্রূণ উভয়েই রক্ত শোষণ করে। এটা জমাট রক্তবিন্দুর মতও হয়ে থাকে। পরবর্তী স্তরে এটা চিবানো-বস্তুর মত হয় দেখতে, এটাও সঠিক। এটাও সত্যি যে পেশী ও মাংসের পূর্বে অস্থি তৈরী হয়। রাসূলের হাদীসে এসেছে:
    “যখন বিয়াল্লিশ দিন পার হয়, আল্লাহ একজন ফেরেশতা পাঠান যখন সে ভ্রূণকে আকার দান করে, এর কান, চোখ, চামড়া, মাংস এবং হাড় তৈরী করে। তারপর সে জানতে চায়, “হে রব, এটা কি পুরুষ অথবা নারী? এবং তোমাদের প্রভু স্থির করেন যা তিনি চান এবং তখন ফেরেশতারা তা লিখে নেয়।”
    এই যথাযথ তথ্য বর্ণিত দিকগুলির বিকাশের সঠিক সময় জানাচ্ছে এবং ভ্রূণের লিঙ্গ ঠিক বিয়াল্লিশ দিনের পূর্বে সুনিশ্চিত ভাবে জানা সম্ভব নয়। মাত্র কয়েক দশক পূর্বেও শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কারের আগে এটা জানা সম্ভব ছিল না। শীর্ষস্থানীয় ভ্রূণতত্ত্ববিদগণের অন্যতম কিথ মুর, কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনাটমি বিভাগের প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, কুরআনের এই সমস্ত বক্তব্য ও সহীহ হাদীসের বক্তব্য সম্পর্কে বলেন,
    “উনিশ শতক পর্যন্ত, মানবীয় বিকাশের ধাপগুলি সম্পর্কে কিছুই জানা ছিল না। উনিশ শতকের শেষ দিকে বর্ণমালার প্রতীকের উপর ভিত্তি করে মানব ভ্রূণের বিকাশের বিভিন্ন ধাপ চিহ্নিত করা হয়। বিশ শতকে সংখ্যার সাহায্যে এর ২৩টি ধাপ বর্ণনা করা হয়। এই সংখ্যার সাহায্যে চিহ্নিতকরণ পদ্ধতি অনুসরণ করা সহজ নয় এবং একটি ভালো পদ্ধতি হবে অঙ্গসংস্থান বিদ্যার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা পদ্ধতি। সামপ্রতিককালে কুরআনের অধ্যয়নের ফলে ভ্রূণবিকাশের বিভিন্ন ধাপ চিহ্নিতকরণের আর একটি পদ্ধতি প্রকাশিত হয়েছে যা এর সহজবোধ্য আকৃতির পরিবর্তন ও নড়াচড়ার উপর ভিত্তি করে তৈরী। এখানে যেসব শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, তা আল্লাহ জিবরাইলের মাধ্যমে রাসূল (সঃ) কে জানিয়েছেন এবং তা কুরআনে লিপিবদ্ধ হয়েছে…. এটা আমার কাছে পরিষ্কার যে এসব বক্তব্য নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছ থেকে মুহাম্মাদ (সঃ) এঁর কাছে এসেছে কারণ এই জ্ঞানের প্রায় সবটুকুই অবিষ্কৃত হয়েছে এর বহু শতক পরে। এটা আমার কাছে প্রমাণ করছে যে মুহাম্মাদ নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল।”
    ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এনাটমি বিভাগের প্রফেসর ও চেয়ারম্যান এবং ফিলাডেলফিয়ার টমাস জেফারসন বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্যানিয়েল বাও ইনস্টিটিউটের পরিচালক মার্শাল জনসন বলেন,
    “বিজ্ঞানী হিসাবে আমি সেসব বস্তু নিয়ে কাজ করি যা আমি নির্দিষ্টভাবে দেখতে পারি। আমি ভ্রূণতত্ত্ব এবং ডেভেলপমেন্টাল বায়োলজি বুঝতে পারি। আমি কুরআনে যে শব্দগুলি আমার কাছে অনুবাদ করে দেওয়া হয়েছে তা বুঝতে পারি। আমাকে যদি আমার আজকের জ্ঞান ও বর্ণনার যোগ্যতা সহকারে সেই যুগে স্থানান্তর করা হয়, আমি ব্যাপারগুলি যেভাবে বর্ণনা করা আছে সেভাবে বর্ণনা করতে পারব না। আমি এটা প্রত্যাখ্যানের কোন কারণ দেখি না যে মুহাম্মাদ এই তথ্য অন্য কোথাও থেকে পেয়েছেন, সুতরাং আমি এই ধারণার সাথেও সাংঘর্ষিক কিছু দেখতে পাই না যে তিনি যা বলেছেন তাতে ঐশী হস্তক্ষেপ রয়েছে।”
  • ২। মহাকাশবিজ্ঞান:
    “অবিশ্বাসীরা কি ভেবে দেখে না যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল; অতঃপর আমি উভয়কে পৃথক করে দিলাম; এবং জীবন্ত সব কিছু পানি থেকে সৃষ্টি করলাম; তবুও কি তারা বিশ্বাস করবে না?” (সূরা আল আম্বিয়া, ২১:৩০)
    এই আয়াতটি বিশ্বের উৎপত্তির সাধারণ তত্ত্ব বর্ণনা করছে, যে সত্য আজ থেকে চল্লিশ বছর আগেও নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যার সূচনার আগে আবিষ্কৃত হয়নি। এখানে যে পৃথক করার বলা হয়েছে তা বিজ্ঞানীদের কথিত “বিগ-ব্যাং” তত্ত্বের অনুরূপ। তাছাড়া, সমস্ত জীবিত প্রাণী প্রটোপ্লাজম দিয়ে তৈরী যার ৮০-৮৫% ভাগই পানি।
    “অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন, যা ছিল ধূম্রপুঞ্জ বিশেষ। অনন্তর তিনি আকাশ ও পৃথিবীকে বললেন, ‘তোমরা উভয়ে আমার আদেশ পালনের জন্য ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় প্রস্তুত হও।’ তারা বলল, ‘আমরা তো অনুগত থাকতে পস্তুত আছি।” (সূরা আল ফুসসিলাত, ৪১:১১)
    এখানে ধূম্রপুঞ্জ শব্দটি বিশ্বের আদিম অবস্থার সঠিক বর্ণনা দিচ্ছে, যা ছিল গরম গ্যাসের পিণ্ড যাতে বস্তুকণা দ্রুত ছোটাছুটি করছে, ধোঁয়ার মত। এ থেকে গ্রহ, নক্ষত্র ও পৃথিবী তৈরী হয়।
    “আমি আমার ক্ষমতাবলে আকাশ নির্মাণ করেছি এবং আমিই একে সমপ্রসারিত করছি।” (সূরা আয যারিয়াত, ৫১:৪৭)
    এটা একটা স্বীকৃত সত্য যে আমরা যে বিশ্বে বাস করছি তা সমপ্রসারণশীল। “আল্লাহই দিন এবং রাত তৈরী করেছেন, এবং চাঁদ ও সূর্য। প্রত্যেকেই নিজ নিজ গতিতে কক্ষপথে সাঁতার কাটছে/ঘুরছে।”
    নিজ গতিতে চলার জন্য যে আরবী শব্দ ব্যবহৃত হয় তা হচ্ছে সাবাহাহ্‌ (এই আয়াতে ইয়াসবিহুনা)। এটা এমন গতি নির্দেশ করছে যা বস্তুর নিজের। যদি এটা পানিতে ঘটত, তাহলে এটা হত সাঁতার কাটা; এটা সেই নড়াচড়া যা একজনের পায়ের মাধ্যমে হয়। মহাশূন্যে নড়াচড়ার সময় এটা হবে নিজের অক্ষের উপর ঘুরে যাওয়া। সূর্য নিজের কক্ষপথে পৃথিবীর চারপাশে নয়, বরং ছায়াপথের কেন্দ্রের চারপাশে ঘোরে, সুতরাং এখানে কোন বৈপরীত্য নেই, কারণ কুরআন সূর্যের কক্ষপথ নির্দিষ্ট করেনি।
    “তুমি কি দেখ না আল্লাহ রাতকে দিনে এবং দিনকে রাতে পরিবর্তন করেন?” (সূরা আল লুকমান, ৩১:২৯) “তিনি রাত্রি দ্বারা দিনকে আচ্ছাদিত করেন এবং রাত্রিকে আচ্ছাদিত করেন দিন দ্বারা।” (সূরা আয যুমার, ৩৯:৫)
    পেঁচানো বা জড়ানো আরবী শব্দ কাওওয়াররার অনুবাদ। এর মূল অর্থ হচ্ছে মাথার চারপাশে পাগড়ী পেঁচিয়ে বাঁধা। অবিরত পেঁচানোর পদ্ধতি-যাতে এক অংশ আরেক অংশের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে, কুরআনে এমনভাবে বলা হয়েছে যে মনে হয় সে সময়ে পৃথিবীর গোলাকৃতি হওয়ার ধারণার সাথে মানুষ পরিচিত ছিল, যা স্পষ্টতঃই সত্য নয়।
    “তিনিই সূর্যকে তেজষ্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং তার তিথি নির্দিষ্ট করেছেন…” (সূরা ইউনুস, ১০:৫)
    কুরআনে সূর্যকে “সিরাজ” হিসাবে বলা হয়েছে যার অর্থ হচ্ছে “মশাল” যা নিজের তাপ ও আলো উৎপন্ন করে যেখানে চন্দ্রকে “নূর” বা আলো হিসাবে বলা হয়েছে যার অর্থ অন্য উৎস থেকে নেয়া আলোর আভা।
  • ৩। ভূতত্ত্ব:
    “আমি কি ভূমিকে বিছানা ও পর্বতকে কীলক সদৃশ করিনি?” (সূরা আন নাবা’, ৭৮:৬-৭)“আল্লাহই পৃথিবীতে পর্বতমালা স্থাপন করেছেন যাতে এ তোমাদের নিয়ে ঢলে না পড়ে।” (সূরা আল লুকমান, ৩১:১০)
    সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে যে পর্বতমালার মূল ভূত্বকের ভিতরে চলে গেছে যা সাতটি টেকটোনিক প্লেট দিয়ে গঠিত। এই প্লেটগুলির নড়াচড়াই ভূমিকম্পের কারণ। এটা ধারণা করা হচ্ছে যে এই মূল ও পর্বতের ওজন ভূত্বকের স্থিতিশীলতার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
  • ৪। প্রাণী ও উদ্ভিদ জগত: কুরআনের ষষ্ঠতম পারায় বলা আছে যে মধু সংগ্রহকারী মৌমাছি হচ্ছে স্ত্রী মৌমাছি; যদিও এটা সাধারণ ধারণা যে মৌমাছিরা সৈনিক এবং তারা রাজার অধীন। কুরআনে আরো বলা আছে যে উদ্ভিদের মাঝেও স্ত্রীপুরুষ রয়েছে এবং বায়ুর সাহায্যেও উদ্ভিদের প্রজনন ঘটে থাকে।
    “আমি বৃষ্টিগর্ভ বায়ু প্রেরণ করি।” (সূরা আল হিজর, ১৫:২২)
    এগুলি সবই সামপ্রতিককালে আবিষ্কৃত হয়েছে।
  • ৫। পরমাণু বিজ্ঞান: গ্রীক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস (৪৬০-৩৬১ খৃ.পূ.) এই তত্ত্বের উদ্‌গাতা যে বস্তু ছোট অবিভাজ্য কণা দিয়ে তৈরী, যার নাম এটম। আধুনিক বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে যে এটম আছে, তবে তা বিভাজ্য। কুরআন বলছে:
    “তিনি অদৃশ্য সম্বন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে অণু-পরিমাণ কিছু কিংবা তদপেক্ষা ক্ষুদ্র অথবা বৃহৎ কিছু যাঁর অগোচর নয়।” (সূরা সাবা, ৩৪:৩)
  • ৬। ত্বক বিজ্ঞান:
    “মানুষ কি মনে করে যে আমি তার অস্থিসমূহ একত্রিত করতে পারব না? বস্তুত আমি তার অঙ্গুলির অগ্রভাগ পর্যন্ত পুনর্বিন্যস্ত করতে সক্ষম।” (সূরা আল ক্বিয়ামাহ, ৭৫:৩-৪)
    কোন দুটি আঙ্গুলের ছাপ একরকম নয়। [সংকলক - দুইটি মানুষের আঙ্গুলের ছাপ এক রকম না হওয়ায়, এই বৈশিষ্ট্যকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ভেরিফিকাশন নামে অন্যতম সিকিউরিটি অথেন্টিক্যাশেন মেথড হিসেবে বর্তমানে ব্যবহত হচ্ছে।] এই আয়াতে আমাদের পুনর্জীবিত করার আল্লাহর জ্ঞান ও ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে যা সবচেয়ে একক ও স্বতন্ত্র অঙ্গ পর্যন্ত করা হবে।
    “যারা আমার আয়াতকে অবিশ্বাস করে তাদের আগুনে দগ্ধ করবই। যখনই তাদের চর্ম দগ্ধ হবে তখনই তার স্থলে নতুন চর্ম সৃষ্টি করব, যাতে তারা শাস্তি ভোগ করে। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” (সূরা আন নিসা, ৪:৫৬)
    যেসব স্নায়ুপ্রান্ত বেদনা বোধ করে তা চামড়ায় রয়েছে। যখন চামড়া মারাত্মকভাবে পুড়ে যায়, তখন স্নায়ুপ্রান্ত ধ্বংস হয়ে যায় ও বেদনা আর টের পাওয়া যায় না। জাহান্নামে আল্লাহ পুনরায় চামড়া সৃষ্টি করবেন যাতে তার অধিবাসীরা স্থায়ীভাবে তীব্র ব্যথা অনুভব করে।
    “নিশ্চয়ই যাক্কুম বৃক্ষ হবে পাপীর খাদ্য; গলিত তাম্রের মত তা উদরে ফুটতে থাকবে, ফুটন্ত পানির মত।’ ‘আস্বাদ গ্রহণ কর, তুমি তো ছিলে সম্মানিত, অভিজাত। তোমরা তো এ শাস্তি সম্পর্কে সন্দিহান ছিলে।’ (সূরা আদ দুখান, ৪৪:৪৩-৫০)
    “…এবং যাদের পান করতে দেওয়া হবে ফুটন্ত পানি যা তাদের নাড়িভুড়ি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে।” (সূরা মুহাম্মাদ, ৪৭:১৫)
    অন্ত্রে তাপ বহনকারী ধারক থাকে না। এটা জানা আছে যে, যদি নাড়িভুঁড়ি কেটে যায় তাহলে এর ভিতরের উপাদানসমূহ উচ্চ সংবেদনশীল পেরিটোনিয়া ক্যাভিটিতে চলে যায়, যেখানে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হয়। এটা বর্তমানের প্রচলিত জ্ঞান নয়, মুহাম্মাদের সময়ের তো নয়ই। সে যাই হোক, কুরআনের রচয়িতা এসব সত্যের সাথে সুপরিচিত!
  • ৭। পানি চক্র: কুরআনে সঠিকভাবে পানি চক্রের বর্ণনা দেওয়া আছে এবং ভূগর্ভের ঝরণার পানির উৎস হিসাবে বৃষ্টির পানিকে উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের কাছে এটা খুবই স্বাভাবিক প্রতীয়মান হলেও গ্রীক দার্শনিকগণ এটা মনে করতেন না, তাঁরা ভাবতেন মাটির তলার ঝর্ণাধারা তৈরী হত সমুদ্রের পানির ধারা গুহায় জমে গিয়ে, যা বিরাট পাতালের সমুদ্রে গহ্বরের মাধ্যমে সরবরাহ হতো। আসলে অষ্টাদশ শতকের পূর্বে পানি চক্র সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। অথচ কুরআন এদিকে বলছে,
    “তুমি কি দেখনা, আল্লাহ আকাশ থেকে বারিবর্ষণ করেন, অতঃপর ভূমিতে স্রোতরূপে প্রবাহিত করেন?” (সূরা আয যুমার, ৩৯:২১)
    সংক্ষিপ্ত রাখতে গিয়ে আমি শুধু কয়েকটি বক্তব্যের উল্লেখ করেছি এবং বিজ্ঞান বিষয়ক কুরআনের বক্তব্যের ও হাদীসের বর্ণনার সীমাবদ্ধ ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছি। কানাডার ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অব মেডিসিন ও ডেন্টিস্ট্রির এনাটমি বিভাগের প্রফেসর ও চেয়ারম্যান টি.ভি.এন পারসাদ বলেছেন,
    “মুহাম্মাদ একজন সাধারণ লোক ছিলেন, তিনি পড়তে জানতেন না, লিখতে পারতেন না, আসলে তিনি নিরক্ষর ছিলেন…আমরা যে বিষয়ে আলোচনা করছি তা হল যে চৌদ্দশত বছর পূর্বে কিছু নিরক্ষর লোক গভীর কিছু উচ্চারণ করেছিল ও বক্তব্য দিয়েছিল যা বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক। আমি ব্যক্তিগতভাবে বুঝতে পারি না এটা হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা কিভাবে হতে পারে, এতে অসংখ্য অত্যন্ত সঠিক ব্যাপার রয়েছে… আমার মনে কোন সংশয় নেই এই সত্য স্বীকার করতে যে কোন ঐশী প্রেরণা বা ওহী তাঁকে এই বক্তব্যগুলি দিতে নির্দেশ দিয়েছে। আমরা যেন ড. মরিস বুকাইলির কথাগুলি ভুলে না যাই যে এই সত্যগুলো “মানবীয়ভাবে ব্যাখ্যার ব্যাপারে একটি চ্যালেঞ্জ।”
    এবং প্রফেসর পারসাদ এর বিবৃতি যে এটা হঠাৎ ঘটে যেতে পারে না, এখানে অসংখ্য সঠিক তথ্য রয়েছে! মুহাম্মাদের জন্য অনুমান করা এবং প্রতিটি সঠিক হওয়ার সম্ভাব্যতা আসলেই বিস্ময়কর। এ সমস্ত বিজ্ঞানীরা, যাঁরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে সুপরিচিত, সেই আরবদের মত যারা তাদের ভাষা পাণ্ডিত্য সহকারে আয়ত্ব করেছিল মুহাম্মাদের সময়ে, স্পষ্ট প্রমাণ চিনতে পারেন এবং কুরআনের প্রকৃতির অলৌকিকত্ব অনুধাবন করতে পারেন। “আমরা তাদেরকে আমাদের নিদর্শন দেখাবো দূর দিগন্তে এবং তাদের মধ্যে যতক্ষণ না তারা জানতে পারে যে এটাই সত্য।”
কুরআন বাহ্যিক বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এবং আভ্যন্তরীণের সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ। অসঙ্গতি ও বৈপরীত্য রয়েছে আসলে মানুষের কাজের প্রকৃতিতে, তা তারা বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সাধু অথবা সূফী যাই হোক না কেন। এটা ঐশী ওহীর জন্য সত্য হতে পারে না, যেমন কুরআন বলছে, “তারা কি সতর্কতার সাথে কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করে না, যদি এটা আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছ থেকে হতো, তারা এতে বহু অসামঞ্জস্য খুঁজে পেতো।